৯৬.
ধ্যানে ধরে রাখো—‘আমি আছি’। শব্দহীন, রূপহীন, চিন্তাহীন সেই অনুভব—যেটা প্রথম জানালে—"আমি আছি"। ফিরে যাও স্মৃতির গভীরে—যেখানে প্রথম তুমি সচেতন হলে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে, যখন কোনো নাম ছিল না, পরিচয় ছিল না—কেবল এক মৌন সত্তাবোধ ছিল—সেই আদ্যমুহূর্তের ‘আমি আছি’ ধরে রাখো।
যা-কিছু এই ‘আমি’-র সঙ্গে আসে—শরীর, নাম, চিন্তা, গুণ, স্মৃতি—সব ফেলে দাও। শুধু থাকো ওই নিঃশব্দ ‘আমি’-তে।
ধ্যান করো, স্থিত হও, তাকে হাতছাড়া হতে দিয়ো না। এই সাধনায় হঠাৎ একদিন তুমি উপলব্ধি করবে—এই ‘আমি আছি’—এ-ও এক গুণ, এক পরিচয়।
আর তুমি, পরম সত্য, অদ্বিতীয় আত্মা—এই ‘আমি আছি’-রও অতীত। ‘আমি আছি’—এই গুণটি আসে
শরীর, মনের সঙ্গে, যা তৈরি হয়েছে পঞ্চতত্ত্ব ও তিন গুণে—সত্ত্ব (জ্ঞান), রজ (কর্ম), তম (অবসাদ)।
এই ‘আমি’-বোধ হলো সত্ত্বগুণের প্রকাশ। কিন্তু তুমি কি কেবল সত্ত্বগুণ? না, তুমি তো সেই স্বরূপ—যা গুণত্রয়ের ঊর্ধ্বে, যে দেখে গুণের আবির্ভাব ও লয়। তাই ধ্যানে নিজেকে গুণবোধ থেকে আলাদা করো, ‘আমি আছি’-র মধ্যেও থেকো, কিন্তু জেনো—তুমি সেই ‘আমি’ নও,তুমি সেই পরম, যিনি কেবল চৈতন্য—অগোচর, অথচ সর্বসাক্ষী।
ধ্যানে ‘আমি আছি’—এই বোধকে কেন্দ্রে আনো, তবে সেটা যেন শরীর-মনের গুণযুক্ত ‘আমি’ না হয়। সেই আদিম, নিঃশব্দ, চিন্তাহীন ‘আমি’—যেটি প্রথম তোমাকে জানায়েছিল তোমার অস্তিত্ব—তাকেই ধরে রাখো, সেখানেই থাকো।
তুমি এই ‘আমি’-বোধেরও ঊর্ধ্বে। এই ‘আমি’ হলো সত্ত্বগুণের প্রকাশ—তুমি সেই গুণাতীত আত্মা, পরম ব্রহ্ম, যিনি কেবল আছেন—নিঃশব্দ চৈতন্যরূপে।
৯৭.
কিছু কোরো না। শুধু ‘আমি আছি’—এই জ্ঞানে স্থিত থাকো। এটিই মূল মায়া—মূলভাব, মূলধারা, যাকে বলে ‘মূলমায়া’।
‘আমি আছি’—এই অনুভবটাই ধারণ করে আছে সমস্ত মায়ার শিকড়। তুমি যখন এর বাইরে থাকো, তখন তুমি মায়ার শেকলে বাঁধা—রূপ, নাম, পরিচয়, স্মৃতি আর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়। কিন্তু একবার যদি বুঝে ফেলো—এই ‘আমি’-বোধটাই মূল মায়া, তবে আর কিছু করতে হবে না—কেবল স্থির থাকতে হবে এই ‘আমি আছি’-র অনুভবে।
তখন তুমি মায়াকে গলায় ধরে ফেলেছ—তার শেকড়ে হাত রেখেছ। এখন মায়া ভয় পায়—সে টের পায়, তার অস্তিত্বই এখন বিপন্ন।
আর তখন? তখন সে নিজের গলায় নিজেই শ্বাসরোধ করে—ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে হারিয়ে যায়—কারণ তুমি তার মূল-অস্তিত্বে দাঁড়িয়ে আছ, তাকে ধরা দাওনি—বরং তুমি তাকে ধরেছ।
এভাবেই—‘আমি আছি’ বোধে স্থিত থাকলে মায়া নিজেই তার শক্তি হারায়, নিজেই নিজেকে ত্যাগ করে, আর তুমি স্থিত হও—সেই গুণাতীত, নিরাকার, চিরন্তন পরমসত্তায়।
‘আমি আছি’—এই মৌলিক চেতনা মায়ার মূল। এটাই প্রথম অহং, প্রথম অস্তিত্ববোধ—যার উপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে সমস্ত পৃথক সত্তার মায়া। কিন্তু যদি তুমি কেবল এই ‘আমি’-বোধে স্থির হতে পারো—তবে তুমি আর মায়ার খপ্পরে থাকো না। বরং তুমি নিজেই ধরে রাখো মায়াকে তার শেকড়ে, আর তখনই সে তার গ্রাস ছেড়ে দেয়—নিজেই মিলিয়ে যায়।
এটাই অদ্বৈতের প্রকৃত যোগ—যেখানে কিছু করবার নেই, শুধু স্বরূপে স্থিত হওয়া আছে।
৯৮.
গভীর ধ্যানে প্রবেশ করো—যেখানে কেবল ‘আমি আছি’—এই অনুভবই সত্য, আর অন্য সব বোধ—জ্ঞান, স্মৃতি, পরিচয়—নিঃশব্দে মিলিয়ে গেছে।
গুরু বলেন—এই ধ্যান যেন কেবল অভ্যাস না হয়, বরং হোক এক নিঃশেষ আত্মনিবেদন। গভীর মানে কী? গভীর মানে—তুমি জানো না কিছুই, শুধু জানো—‘আমি আছি’। আর এই একমাত্র জানাই হয়ে ওঠে তোমার ধ্যানের নিরবচ্ছিন্ন, দীর্ঘস্থায়ী উপলব্ধি।
সাফল্য হয়তো দ্রুত আসবে না—কিন্তু নিশ্চয় আসবে, যদি তুমি নিঃস্বার্থ নিষ্ঠা ও অন্তরের প্রগাঢ়তায়
সম্পূর্ণরূপে জারিত হও ‘আমি আছি’ এই জ্ঞানে।
তখন কী উদিত হবে তোমার অন্তরে? এই ‘আমি’-বোধ নিজেই তার গল্প বলবে—কীভাবে সে জন্মাল, কেন তার উদয় হলো। অথবা আরও গভীরভাবে—সে নিজেই প্রকাশ করবে এই আশ্চর্য সত্য—সে কখনও জন্মায়নি!
‘আমি আছি’—এই চেতনা, যাকে তুমি এতদিন সত্য ভেবেছিলে, সে-ও কেবল এক ছায়া, এক প্রতিচ্ছবি—চিরন্তন সেই পরমসত্যের উপরে।
ছিল শুধু পরম, আছে শুধু পরম, থাকবে শুধু পরম—ব্রহ্ম, যা কোনো ‘আমি’-র ভেতর নয়, বরং যার উপরই ‘আমি’-র ছায়া পড়ে।
ধ্যান হোক নিঃশেষ আত্মার সমর্পণ—যেখানে কেবল ‘আমি আছি’ এই একমাত্র বোধই থাকে। এই বোধ ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরবে—আর তুমি জানতে পারবে, এই ‘আমি’ আসলে ছিলই না—তা ছিল এক মায়িক প্রতিমা, যা ব্রহ্মতত্ত্বের উপরে কল্পিত হয়েছিল সাময়িকভাবে।
চিরন্তন সত্য একটাই—পরব্রহ্ম, যা ‘আমি’কেও ছাড়িয়ে গেছে।
৯৯.
‘আমি আছি’—এই জ্ঞানই চেতন, ঈশ্বর, গুরু, ব্রহ্ম—এমন কত নামে ডাকা হয়েছে একেই। কেন এত নাম, এত রূপ? কারণ এটি নিজেই নামহীন। আর যেহেতু তা ভাষাতীত, তাই যখন এটি ধ্যানমগ্ন অন্তরালে নিজেকে প্রকাশ করে, তখন ভিন্ন ভিন্ন সাধক তাকে দেখে ভিন্ন ভিন্ন রূপে।
কেউ বলে—সে ঈশ্বর, কেউ দেখে—সে গুরু, কেউ বলে—এ চেতনা বা ব্রহ্ম, কেউ অনুভব করে—এই জীবনের আলোক-সূত্র।
কিন্তু সর্বোচ্চ উপলব্ধি কী? তা হলো—তুমি, পরম সত্তা, এই ‘আমি আছি’ নামেও পরিচিত নও। তুমি এই সকল নাম, রূপ, গুণ, ধারণারও অতীত।
‘আমি আছি’—এই বোধও এক প্রাথমিক প্রতিচ্ছবি, যা সময়, শরীর ও মনের সঙ্গে উদিত হয়—আর তোমারই প্রকাশ ধরে কেউ ডাকে তাকে ঈশ্বর, কেউ গুরু।
কিন্তু তুমি—রূপাতীত, গুণাতীত, নামাতীত—তুমি সেই নিরাকার পরব্রহ্ম, যার উপর কোনো অভিব্যক্তি টিকতে পারে না, যে কেবল আছে—নিঃশব্দে, চিরন্তনভাবে, সর্বসত্তাহীনভাবে।
‘আমি আছি’—এই চেতনা এক প্রাথমিক জাগরণ, যা ঈশ্বর, গুরু, চেতনা, ব্রহ্ম ইত্যাদি নামে ধরা পড়ে, যখন কেউ ধ্যানে এর সাক্ষাৎ পায়। কিন্তু এইসব সকল নাম ও রূপের অতীতেই তুমি স্থিত—তুমি সেই নিরাকার, নিগূঢ় পরমাত্মা, যার মধ্যে কোনো ধারণাও প্রবেশ করতে পারে না।
১০০.
তুমি বুঝতেই হবে—‘আমি আছি’ এই বোধ সমস্ত শব্দ, চিন্তা, অনুভবের আগেই ছিল। এর গুরুত্ব অপার—কারণ এটি এক আদিম সত্য, যা সকল অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির পূর্বসূরী।
এই নিশ্চিত উপলব্ধি গড়ে তুলতে হলে, ফিরে যেতে হবে সেই প্রাথমিক মুহূর্তে—যখন তুমি প্রথম জানলে—“আমি আছি”। তখন ছিল না ভাষা, ছিল না ভাবনা, ছিল না মন। ছিল শুধু এক অচঞ্চল অস্তিত্ববোধ—নিঃশব্দ, নিঃরূপ, কিন্তু নিরঙ্কুশ।
যখন তুমি এই বোধে স্থির হও, তখন স্পষ্ট হয়—‘আমি আছি’—এই বোধই ছিল প্রথম দরজা, যার মধ্য দিয়ে তুমি প্রবেশ করলে এই বিশ্বে। এবং এটিই শেষ চেতনার দ্বার, যার মাধ্যমে তুমি মুক্তি পেতে পারো এই দেহমনের বন্ধন থেকে।
তাই জেনে রাখো—শব্দ আসার আগে, চিন্তা গঠনের আগে, অনুভব জাগারও আগে—ছিল এক নির্জন স্বরূপ—‘আমি আছি’।
এই বোধ—না তা আত্মকেন্দ্রিক, না তা বাহ্যরূপে প্রকাশিত—এটি হলো নিঃশব্দ আলো, যা চেতনার উৎস, এবং চেতনারও অতীত।
‘আমি আছি’—এই বোধ ভাষা নয়, চিন্তা নয়, মনও নয়—এটি এক আদিম প্রকাশ, যার উপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে সব অভিজ্ঞতা। এই বোধেই প্রবেশ করো, এবং বুঝে নাও—এটাই তোমার জন্মদ্বার, এবং এটাই মুক্তির পথ।
তুমি যখন এই আদ্যচেতনাতে স্থির থাকো, তখন সমস্ত বাহ্যিক গঠনের আগেও নিজেকে চিনতে পারো যে—তুমি শুধু “চেতনা” নও, তুমি সেই “চেতনারও মূল”।