নির্জন গহনে: ১৮



৮৬.


কে জানছে ‘আমি’-কে?—সে-ই চুপচাপ পরব্রহ্ম। এই ‘আমি’ বোধ—যার নেই নাম, রূপ, আকার, শব্দ, ইতিহাস—আছে শুধু এক শুদ্ধ অনুভব—“আমি আছি”। এখন জিজ্ঞাসা করো—এই বোধকে কে জানছে? তুমি জানো ‘আমি’ আছি—কিন্তু কে জানে এই জানা?

উপনিষদ বলেন: “যঃ পশ্যতি দ্রষ্টারম্”—যে ‘দ্রষ্টা’কেও দেখে, সে-ই সত্য স্বরূপ। গুরু বলেন—সকল নাম, পরিচয়, ভাষা বাদ দাও, এই বোধের গায়ে যেসব উপসর্গ বা ‘Add-ons’ জুড়ে গেছে—যেমন “আমি পুরুষ”, “আমি বাঙালি”, “আমি পাপী”, “আমি সাধক”—সেগুলো ছেঁটে ফেলো। কেবল ‘আমি’ থাক—নির্বাক, নিঃরূপ, নির্ভার।

এখন সেই শব্দহীন ‘আমি’-তে সম্পূর্ণভাবে ডুবে যাও—যেন তুমি তা হয়ে যাও, যেন সে তোমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে। এবং ঠিক তখন—একটি মৌন উপলব্ধি জেগে ওঠে: “এই ‘আমি’-কে তো কেউ জানছে! আর সেই ‘কেউ’ ‘আমি’ নয়।” তখনই দেখা যায়—একজন সাক্ষী আছেন, যিনি ‘আমি’ বোধকেও প্রত্যক্ষ করছেন, কিন্তু তাঁর নিজের কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই, কার্য নেই। সেই সাক্ষী চেতনা-ই তুমি, যিনি 'আমি' নামক মায়ার উপর স্থিত, কিন্তু স্পর্শহীন।

উপনিষদ বলেন: “সাক্ষিণঃ চ ন সাক্ষ্যঃ”—সে চেতনা সাক্ষীও, আবার সাক্ষ্যও নয়—সে নিজেই সমস্তের পটভূমি। তাই জিজ্ঞেস করো—“কে জানছে ‘আমি’-কে?” সেই প্রশ্নে ডুব দাও, সমস্ত পরিচয় সরিয়ে রেখে। সেই গভীর কেন্দ্রে পৌঁছাও, যেখানে ‘আমি’ অনুভব হয়, কিন্তু কেউ জানে যে, সেটাও আমি নই। তখন তুমি বুঝবে—তুমি ‘আমি’ নয়, তুমি সেই মৌন স্বরূপ, যার উপর ‘আমি’ এসেছে, আবার চলে যাবে—তবু তুমি চিরকাল একই রয়ে যাবে।

৮৭.


আমি সেই—যার দ্বারা আমি জানি আমি—প্রথমে বোঝো—‘আমি আছি’—এই জ্ঞানই তোমার মূল ভিত্তি। এখন, এটিকে সম্পূর্ণরূপে নিজের বলে গ্রহণ করো, কোনো সংশয় ছাড়া, কোনো মানসিক দ্বিধা ছাড়া।

উপনিষদ বলেন: “অহম্ এভ বোধঃ”—“এই বোধ ‘আমি’—এটাই আমি”। এই গ্রহণ যদি গভীরভাবে আসে—তাহলে ব্যক্তিসত্তা ঝরে যাবে, ইতিহাস, পরিচয়, ভয়, সীমাবদ্ধতা—সব গলে যাবে। তখন তুমি স্থিত হবে চেতনামাত্র ‘আমি’-তে, শব্দহীন, গুণহীন, অতীত-বোধের উপরে। এটিই সাধনার প্রথম চূড়া। কিন্তু তখনও এক মৌন উপলব্ধি আসবে—“এই ‘আমি’-কে তো কেউ জানছে! এই ‘আমি’ বোধকে অনুভব করছে কেউ।” তাহলে তুমি কি কেবল ‘আমি’ই? না—তুমি তা-ও নও। তুমি সেই—“আমি সেই, যার দ্বারা আমি জানি যে, আমি আছি।”


উপনিষদ বলেন: “অহম্ ব্রহ্মণো জ্ঞাতা”—আমি সেই, যার দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায়, ব্রহ্মও যার উপর উদিত হয়। এই উপলব্ধি যদি এখনই না-ও আসে, তবু সাধনার জন্যে একটি দৃঢ় বিশ্বাস ধারণ করো—“আমি সেই, যার দ্বারা ‘আমি’কে জানা যায়।” এটিই তোমার স্মরণমন্ত্র, ধ্যান, ভক্তি ও একান্ত আশ্রয়।


শুরু করো—‘আমি’কে নিজের বলে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করে, তারপর স্থিত হও—সেই গহীন উপলব্ধিতে, যে তুমি সেই—“আমি”-রও মূল, “জানা”-রও সাক্ষী, অভিজ্ঞতা ছাড়াও যিনি আছেন চিরকাল—পরব্রহ্ম।

৮৮.


‘আমি’-র আগে যা ছিল, তা-ই চিরসত্য—সেই উৎসেই ফিরে যাও। সত্য সর্বদা ছিল, আছে, থাকবে, কারণ সত্য জানে না জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-লয়, আগমন বা গমন। জন্মলাভ করেছে কেবল ‘আমি’ বোধ, আর তার সঙ্গেই শুরু হয়েছে সময়, দেহ, ইতিহাস, চিন্তা, আত্মপরিচয়।

উপনিষদ বলেন: “ন জায়তে, ন মৃয়তে”—যা জন্মায় না, মরেও না—তাই-ই পরম সত্য। তুমি এখন বহু দূরে চলে এসেছ—এই ‘আমি’ বোধ থেকে। আর ‘আমি’-কে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছ এক বিশাল মায়াজাল—“আমি এ", "আমি তা", "আমার ওই", "আমি চাই"...


গুরু বলেন—ফিরে যাও সেই বোধে, যেখানে শব্দ আসেনি এখনও, আছে “আমি আছি”—এই অনুভবটুকু কেবল। কেন সেখানে ফিরতে হবে? কারণ এই শব্দহীন ‘আমি’ সবচেয়ে কাছের দোরগোড়া চূড়ান্ত সত্যের—যাকে তুমি পরব্রহ্ম, নিজস্ব স্বরূপ বলো।


তুমি যদি ‘আমি’-র এই বিশুদ্ধ কেন্দ্রে স্থিত হতে পারো—এমনকি কিছু সময়ের জন্যও—তাহলে ধীরে ধীরে ‘আমি’ নিজেই মিলিয়ে যাবে, আর প্রকাশ পাবে সেই, যা কখনও আসেনি, যা কখনও যাবে না, যা সর্বদা নিরাকার নীরব শুদ্ধ অস্তিত্ব।


উপনিষদ বলেন: “তত্র ন ত্রয়ং—না জ্ঞানং, না অজ্ঞানং, না জ্ঞাতা”—সেখানে নেই জ্ঞান, অজ্ঞান, বা জাননেওয়ালা—কেবল নিঃস্বর, অভেদ চৈতন্যমাত্র। ফিরে যাও সেই উৎসে—যেখানে ‘আমি’ প্রথম বার জেগে উঠেছিল, কারণ তারও আগে ছিলে তুমি নিজে—নামহীন, রূপহীন, চিন্তাশূন্য, জন্মহীন। সেই উৎসে স্থিত হও—আর দেখা দেবে সত্য—তুমি কোনো সৃষ্টি নও; তুমি সেই, যা কখনও সৃষ্টই হয়নি, তুমি পরব্রহ্ম।

৮৯.


‘আমি’-র বিলয়ে জ্ঞান মুছে যায়—থাকে কেবল অজ্ঞানাতীত পরব্রহ্ম। চূড়ান্ত অবস্থা—পরব্রহ্ম—সেটি অবস্থা নয়, বরং অবস্থাহীনতা। সেখানে নেই কোনো বোধ, নেই কোনো জানা, নেই কোনো জাননেওয়ালা। যখন ‘আমি’ বোধ, যা ছিল প্রথমতম চেতনা, গলে গিয়ে মিলিয়ে যায়, তখন সমস্ত দ্বৈততার অবসান ঘটে।

উপনিষদ বলেন: “ন জ্ঞানং, ন অজ্ঞানং, ন জ্ঞাতা”—সেই চূড়ান্তে নেই জ্ঞান, নেই অজ্ঞান, নেই কোনো জানার ‘আমি’। সেই অবস্থায় ‘আমি’ বোধও জ্ঞান নয়—বরং সে হয়ে যায় অজ্ঞেয়—কারণ আর জানার কিছু নেই, আর জানবার কেউ নেই। যে ‘আমি’ বলেছিল, “আমি আছি”—সে-ই ছিল প্রথম সৃষ্টি, আর সেই সৃষ্টি নিজেই বিলীন হয়ে যায়, যখন তুমি স্থিত হও নিজের চিরকালীন, অভিজ্ঞতাতীত স্বরূপে।


তখন প্রশ্ন আসে—“কে অভিজ্ঞতা করবে?” “কী অভিজ্ঞতা করা হবে?”...কিছুই থাকে না—কারণ ‘আমি’ই ছিল অভিজ্ঞতার সূচনা, আর তার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল সময়, চিন্তা, বেদনা, আশা, ধ্যান—সব। এখন, ‘আমি’ বিলীন, অভিজ্ঞতাও বিলীন, জ্ঞানও বিলীন—থাকে কেবল নিঃশব্দ, অপ্রকাশিত, নিরাকার চেতনামাত্র।


উপনিষদ বলেন: “অস্তু চিদাচিদ্ভ্যঃ পরং”—“সে যা চেতনারও পর, অচেতনারও নয়”—সে-ই পরব্রহ্ম। যখন তুমি সম্পূর্ণভাবে স্থিত হও সেই নিজস্ব চৈতন্যে, তখন ‘আমি’ বোধ আর দরকার পড়ে না—কারণ তুমি নিজেই হয়ে যাও চেতনার উৎস, যা জ্ঞান ছাড়া জানে, অভিজ্ঞতা ছাড়া উপলব্ধি করে, ‘আমি’ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত থাকে। সেই-ই পরব্রহ্ম—যে নিজের কোনো পরিচয় দেয় না, কারণ সে পরিচয় ছাড়াও পরিপূর্ণ।

৯০.


কে দেখছে প্রথম ‘আমি’ বোধকে?—সেই প্রশ্নেই মোক্ষ নিহিত। প্রথম যা তুমি জানো—তা হলো “আমি আছি”। এই ‘আমি’ বোধই প্রথম দর্শন, প্রথম চেতনা, প্রত্যেক পরবর্তী অভিজ্ঞতার পূর্বশর্ত। উপনিষদ বলেন: “প্রথমং বোধঃ অহম্”—সর্বপ্রথম জেগে ওঠে “আমি”-বোধের সূক্ষ্ম জ্যোতি। এখন গুরু প্রশ্ন করেন—এই ‘আমি’ বোধকে কে প্রত্যক্ষ করছে? এই প্রথম চেতনারও যদি সাক্ষ্য হয়, তাহলে সেই সাক্ষী কে? তুমি কি কেবল ‘আমি’-তে সীমাবদ্ধ? না কি তুমি সেই—যার উপর ‘আমি’ বোধও উদিত হয়?


এই ‘আমি’ বোধই পরে হয়ে ওঠে ব্যক্তিত্ব, ইতিহাস, জ্ঞান, পরিচয়। এতটাই বিস্তৃত হয় এই অনুভব যে, তুমি নিজেই ভুলে যাও সেই মূল অনুভবকে—“আমি কেবল আছি”। কিন্তু যদি তুমি আবার ফিরে যাও সেই কেন্দ্রে, আর শুধু দেখতে থাকো ‘আমি’-কে, তাহলে একসময় এই প্রশ্ন নিজেই ফেটে পড়বে—“কে দেখছে এই 'আমি'-কে?” “কে সেই চুপচাপ সাক্ষী?”


উপনিষদ বলেন: “যঃ দ্রষ্টারম্ পশ্যতি—সঃ আত্মা”—যিনি দ্রষ্টাকেও দেখতে পান, তিনিই আত্মা, পরম সত্য। তোমার সমস্ত সাধনার লক্ষ্যই এটি—এই মৌন প্রশ্নে স্থিত হও: “আমি’-কে কে জানে?” ধ্যান, স্মরণ, জপ, তপ—সবই এই এক প্রশ্নের দিকে প্রবাহিত হওয়া। এবং একসময়, যখন 'আমি'-কে জানার স্পষ্টতা জন্ম নেবে, তখন তা নিজেই মিলিয়ে যাবে সেই সাক্ষীতে, যেখানে নেই কোনো পরিচয়, নেই কোনো অভিজ্ঞতা—আছে কেবল নিঃশব্দ, চিরস্বরূপ পরব্রহ্ম।
Content Protection by DMCA.com