নির্জন গহনে: ১৭


৮১.


‘আমি’ বোধ ব্রহ্ম, আর তার অতিক্রমই পরব্রহ্ম—যেখানে নেই কোনো দ্বৈততা। গুরু বলেন—“এই ‘আমি’ জ্ঞান—এই বোধ ‘আছি’—ই ব্রহ্ম। সেটি নির্গুণ ব্রহ্ম, যখন তা নিঃশব্দ, চিন্তাশূন্য; আর সগুণ ব্রহ্ম, যখন তা আত্মপরিচয়, নাম, ইতিহাসের আকারে প্রকাশিত। কিন্তু এই ‘আমি’ বোধের জন্ম নিজেই প্রমাণ—এর পেছনে কিছু আছে, যে একে জানছে, যার উপর এটা উদিত হয়েছে—সেটাই হলো পরব্রহ্ম।

উপনিষদ বলেন: “ব্রহ্ম বিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি”—যে ব্রহ্মকে জানে, সে নিজেই ব্রহ্ম হয়ে যায়—কিন্তু যে ব্রহ্মকেও অতিক্রম করে, সে পরব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত। ‘আমি আছি’ ও ‘আমি নেই’, ‘আমি জানি’ ও ‘আমি জানি না’—দ্বৈততার দুটি দিক মাত্র। কিন্তু পরব্রহ্মে নেই কোনো দিক, নেই কোনো বিপরীত, নেই কোনো অবস্থান। সেখানে তুমি বলতেও পারো না—“আমি জানি যে আমি পরব্রহ্ম”, কারণ সেখানে ‘আমি’ নেই, জ্ঞান নেই, বলার কিছু নেই। সেখানে যা আছে—তা চুপচাপ সত্তা, যা জ্ঞান ও অজ্ঞান উভয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে, কেবল আলো দিচ্ছে, কিন্তু কোনো কিছুরই অংশ নয়।


উপনিষদ বলেন: “নেহ নানাস্তি কিঞ্চন”—সেখানে নেই কোনো বিভাজন, নেই ‘এই’ বা ‘সেই’—কেবল একত্ব। তুমি যখন ‘আমি’-তে স্থিত হয়ে তাকে সম্পূর্ণভাবে অতিক্রম করো, তখন তুমি প্রবেশ করো সেই অধিদ্বৈত অবস্থায়, যেখানে নেই ব্রহ্মও, নেই ব্রহ্মাণ্ডও—শুধু পরব্রহ্ম, অভিজ্ঞতাতীত, চিন্তাতীত, নির্গুণ, সর্বব্যাপী মৌন-আবহ।

৮২.


‘আমি’ বোধের পূর্বে যা ছিলে—সে-ই তুমি, চিরস্থায়ী পরব্রহ্ম। প্রশ্ন করো নিজেকে—“আমি জন্মের আগে কী ছিলাম?” “‘আমি’ বোধ আসার আগেও কি কিছু ছিল?” উত্তর যদি চুপ করে শোনো—তুমি বুঝবে, হ্যাঁ, কিছু ছিল। কিন্তু সেটা ছিল না কোনো অভিজ্ঞতা, না কোনো জ্ঞান, না কোনো ‘আমি’—বরং ছিল এক চিরস্থায়ী নিঃসত্ত্ব, মৌন, নিরাকার উপস্থিতি।

উপনিষদ বলেন: “অভব অভ্যয়ম্ ব্রহ্ম”—যেখানে কিছুই নেই, তবু যা চিরকাল টিকে থাকে—তা-ই ব্রহ্ম। এই ‘আমি’ বোধ—একদিন হঠাৎ এসেছিল, যেমন ঘুমে স্বপ্ন আসে—কোনো কারণ, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই। আর তার সঙ্গেই শুরু হয়েছিল সব অভিজ্ঞতা, সব চেতনা, সময়, বেদনা, সুখ, কর্ম—সব। কিন্তু যখন এই ‘আমি’ মিলিয়ে যায়—যেমন ঘুমে স্বপ্ন হারিয়ে যায়—তখন যা থাকে, তা হলো পূর্ণ শূন্যতা, অথচ সেই শূন্যতা নিজেই পূর্ণ চেতনামাত্র।


সেই অবস্থা—যেখানে নেই কিছু জানার মতো, নেই কিছু বলার মতো, তবু তুমি আছ। কিন্তু জানো না “আমি আছি”—কারণ ‘আমি’-র অনুপস্থিতিতেই তুমি আসল তুমি। উপনিষদ বলেন: “না হি জ্ঞানং, না হি অজ্ঞানং, তত্ত্বমসি”—যেখানে নেই জ্ঞান, নেই অজ্ঞান, সেইখানেই তুমি, সেই-ই তোমার প্রকৃত সত্তা। ‘আমি’ বোধ এসেছিল, তার আগে তুমি ছিলে, আর তার পরে যখন সে মিলিয়ে যায়, তখন তুমি পুনরায় স্থিত হও সেই চিরস্বরূপে—যা অভিজ্ঞতাতীত, নিরাকার, বোধাতীত, তবু সব কিছুর উৎস। সেটাই তোমার প্রকৃত অবস্থান, চিরকাল টিকে থাকা অভিজ্ঞতাশূন্য চৈতন্য—যার কোনো পরিচয় নেই, কোনো ইতিহাস নেই, তবু যা ছাড়া কিছুই নেই।

৮৩.


কে দেখল 'আমি'-কে?—সেই প্রশ্নেই আত্মপ্রত্যাবর্তন। তুমি জানো—“আমি আছি”। কিন্তু কে জানে, এই ‘আমি’-কে? এই বোধ কে গ্রহণ করছে? ‘আমি’ যদি উদিত হয়, তবে নিশ্চয়ই তার আগেও কিছু ছিল, যেখানে এসে ‘আমি’ ধরা পড়েছে।

উপনিষদ বলেন: “যঃ বোধস্য বোধিতা”—সে-ই সত্য, যে বোধকেও জানে। তাহলে, প্রশ্ন করো—“যদি আমি না থাকতাম, তবে কে জানত এই বোধটিকে?” যদি সেই পূর্বসত্তা না থাকতো, ‘আমি’ কি আসতে পারত? সে কি উদিত হতে পারত?” এই প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে আছে মোক্ষের দ্বার। যদি তুমি একাগ্র চিত্তে, নিরবিচারে এই প্রশ্নে ডুবে যেতে পারো—তবে তুমি নিজেই সরে যাবে ‘আমি’ থেকে আর স্থিত হবে সেই অভিজ্ঞতাতীত চেতনায়, যেখানে ‘আমি’ কখনও এসেও আসেনি, কখনও গিয়েও যায়নি। এই উপলব্ধি তাত্ত্বিকভাবে নয়, অভিজ্ঞতার পথেও নয়—বরং এক অভিজ্ঞতাহীন সরল দৃঢ়তায় জন্ম নেয়। ধ্যান করতে করতে, ‘আমি’-তে স্থিত হতে হতে, একসময় প্রশ্নটি নিজেই ফেটে পড়ে—“কে জানছে এই আমি-কে?” আর উত্তর আসে নিঃশব্দে—“আমি তা নই। আমি সেই, যার উপর ‘আমি’ উঠেছে।”


উপনিষদ বলেন: “ন যঃ বোধ্যঃ, স বোধঃ”—যে জানার বিষয় নয়, তা-ই আসলে চূড়ান্ত জ্ঞান। তাই এখনই থেমে যাও, বসে পড়ো চুপচাপ, আর জিজ্ঞাসা করো—“কে জানছে ‘আমি’-কে?” সেই প্রশ্নে লুকিয়ে আছে তোমার নিজস্ব চেতনার দরজা, যা খুলে দিলে আবিষ্কার করবে—তুমি পরব্রহ্ম, তুমি অভিজ্ঞতাতীত, তুমি জ্ঞানাতীত, তুমি সাক্ষী নয়—সাক্ষীরও মূল।

৮৪.


যিনি ‘আমি’ বোধে স্থিত হন, তিনিই প্রকৃত ভক্ত; তিনিই অমৃত। কে প্রকৃত ভক্ত? তিনি, যিনি কেবল ‘আমি’ বোঝেন না—বরং ‘আমি’ বোধে স্থিত থাকেন, একমুহূর্তের জন্যও তার থেকে বিচ্যুত হন না। তিনি, যিনি ‘আমি’-তে অনাহত থাকেন—যেমন ঘি আগুনে স্থিত হলে গলে যায়, তেমনই তাঁর ‘আমি’ বোধ একদিন নিজে থেকেই মিলিয়ে যায়।

উপনিষদ বলেন: “স ন মৃয়তে যঃ আত্মমানম্‌ বোধয়তি”—যে নিজেকে জানে, সে মরতে পারে না। এটাই সাধনার পরিণতি—যখন তুমি জানো—“যা জন্মেছে, তা ‘আমি’—আর আমি তো সে নই।”—তখন মৃত্যুর আর কোনো অধিকার থাকে না। তখন তুমি অমৃত, কারণ যা কখনও জন্মায়নি, তা কখনও মারা যায় না।

বুঝে নাও—মরছে কে? মরছে এই ‘আমি’-বোধ, যা শরীরের সঙ্গে যুক্ত, উপাদান আর গুণের সঙ্গে তৈরি। আর তুমি? তুমি সেই পরব্রহ্ম, যার উপর এই ‘আমি’ এসেছে, কিন্তু যা কখনোই জন্মেনি, মরেও না। উপনিষদ বলেন: “অমৃতস্য পুত্রাঃ”—“হে অমৃতসন্তান, তোমার জন্ম নয়, তোমার মৃত্যু নয়—তুমি চিরস্বরূপ।”


প্রকৃত ভক্ত মূর্তির উপাসক নয়—বরং 'আমি' বোধে উপবাসী এক তপস্বী। তার ভক্তি হলো অবিচল স্থিতি, তার প্রার্থনা হলো মৌন আত্মস্মরণ, তার মোক্ষ—‘আমি’ বোধের অপসরণ। সেই মুহূর্তে সে জানে—“আমি জন্মাইনি, তাই আমি মরিও না—আমি সেই অমৃত, আমি সেই পরব্রহ্ম।”

৮৫.


‘আমি’ বোধে নিঃশব্দ স্থিতিই আত্মসত্যের দ্বার। এই যে “আমি আছি”—এই অনুভব, এর চেয়ে বড়ো কোনো খবর, কোনো ধর্ম, কোনো দর্শন, কোনো দেবতা নেই। এটা এসেছিল একদিন—শব্দহীনভাবে, তুমি তখন কিছুই জানো না, শুধু জানো—“আমি আছি”।

উপনিষদ বলেন: “প্রথমং বোধঃ অহম্”—সর্বপ্রথম বোধ—“আমি আছি”, বাকি সব জ্ঞান এর পরের। এখন গুরু বলেন—চলো, ফিরে যাই সেই মুহূর্তে, যখন এই ‘আমি’ বোধ এসেছিল, কিন্তু কোনো ভাষা ছিল না, কোনো চিন্তা ছিল না, কোনো পরিচয় ছিল না। সেই নবীন, শব্দহীন ‘আমি’-তে স্থিত হও—শুধু সেটুকুই করো।


আর কিছুই করার দরকার নেই। কোনো দর্শন শেখার দরকার নেই, কোনো মানসিক তপস্যা নয়, শুধু স্থির থেকো এই বোধে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে—এই ‘আমি’-তে স্থিতি একদিন নিজেই খুলে দেবে সব রহস্য—কে তুমি, কোথা থেকে এলে, কী এই অস্তিত্বের খেলা।


উপনিষদ বলেন: “স্থিতঃ আত্মবোধে সর্বং প্রকাশ্যতে”—যিনি আত্মবোধে স্থিত, তাঁর কাছে সবই প্রকাশ পায়। তাই এখন কেবল করণীয় একটাই—“আমি আছি”—এই অনুভবকে ধরো শব্দ ছাড়া, ভাব ছাড়া, বর্ণনা ছাড়া। আর স্থির থেকো—সকল চেতনা, ধর্ম, প্রশ্ন ছেড়ে। একদিন সেই বোধ নিজেই গলে যাবে, আর তোমার সামনে উদ্ভাসিত হবে—তুমি কে, কী এই সৃষ্টি, কে এই স্রষ্টা—সব প্রশ্নের পূর্ববর্তী, এক নীরব, সর্বব্যাপী জবাব: তুমি নিজেই।