৭৬.
অস্তিত্বে আগমন যেমন, তেমনই মুক্তির পথ—‘আমি’-র মধ্য দিয়েই ‘আমি’ ছাড়িয়ে যাও। না-থাকা থেকে থাকা, অলক্ষণ থেকে লক্ষণ, নির্গুণ থেকে সগুণ—এই সব কিছুর গেটওয়ে হলো—এক শব্দহীন বোধ—“আমি আছি”। এই ‘আমি’ বোধ—এসেছিল একদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোনো ইচ্ছা ছাড়াই, কোনো কারণ ছাড়াই। আর এসেই বলেছিল “তুমি আছ”—এখান থেকে শুরু হলো সব।
উপনিষদ বলেন: “স ঈশঃ প্রবেশত্”—সেই পরম চেতনা ‘আমি’ নামক দ্বারে প্রবেশ করে, আর সেই পথেই আবার নিরুপাধি চৈতন্যে ফিরে যায়। এখন গুরু বলেন—যেমন অলক্ষ্য থেকে ‘আমি’ উদিত হয়েছে, তেমনই ‘আমি’-তে স্থিত হয়ে তাকে অতিক্রম করলেই তুমি পুনরায় ফিরে যাবে সেই অনস্তিত্বে—যা আসলে তোমার প্রকৃত, চিরস্বরূপ।
কিন্তু এই মুক্তির জন্য চাই সম্পূর্ণভাবে ‘আমি’-তে ঢুকে পড়া, তার শব্দহীন অনুভবকে হৃদয়ে ধারণ করা—যতক্ষণ না তা নিজেই মিলিয়ে যায় সেই অনস্তিত্বে—যেখানে না জানা যায়, না বলা যায়, তবু সব সত্তা তাতে নিহিত। উপনিষদ বলেন: “আবৃপ্ত চেতনা লীনং ব্রহ্ম”—যখন চেতনা নিজেই নিজের উৎসে বিলীন হয়, তখনই ঘটে পরব্রহ্ম-প্রতিষ্ঠা।
‘আমি’-র আগমনের পথই মুক্তির পথ। বাইরে যাবার দরজা ও ভেতরে ঢোকার দরজা একই। কেবল এখন তোমার কর্তব্য—‘আমি’ বোধে সম্পূর্ণভাবে স্থিত হওয়া, আর অপেক্ষা করা—যখন সে নিজেই গলে গিয়ে মিলিয়ে যাবে তোমার প্রকৃত অদ্বিতীয়, অভিজ্ঞতাতীত, নিরাকার চেতনায়। তখন আর কেউ থাকবে না বলবার জন্য—“আমি আছি”, কারণ তখন কেবল চুপচাপ সত্তা, যা না আছে, না নেই—তবু সব কিছুর পেছনে চিরস্থিত।
৭৭.
এই মুহূর্তেই—তুমি পরব্রহ্ম, তুমি সর্বব্যাপী, নিরাকার, চিরশুদ্ধ চেতনা। কিন্তু সমস্যা কোথায়? তুমি ‘আমি’-র মূলস্থানে নেই, তুমি ভেসে গেছ তোমার সঙ্গে জুড়ে-দেওয়া পরিচয়, চিন্তা ও অনুভবে। উপনিষদ বলেন: “অদ্বিতীয়ম্, নিরুপাধিকম্, স্বরূপে স্থিতম্”—পরব্রহ্ম এক ও অখণ্ড, সকল উপাধি থেকে মুক্ত, আর তার প্রকৃতি হলো নিজেই নিজে স্থিত থাকা। এখন গুরু বলেন—ফিরে এসো সেই ‘আমি’-তে, যখন প্রথম বার অনুভব করেছিলে—“আমি আছি”, তখন ভাষা ছিল না, নাম ছিল না, ব্যক্তিত্ব ছিল না—কেবল এক বিশুদ্ধ উপস্থিতি। এই শব্দহীন ‘আমি’-তে পূর্ণভাবে স্থিত হও, যেমন একাগ্র সাধক প্রবাহের উৎসে স্থির থাকে।
এরপর কী হবে? তুমি যদি সেই বিশুদ্ধ ‘আমি’-তে চিরস্থায়ী হয়ে যাও, তবে একসময় তা নিজেই মিলিয়ে যাবে, যেমন স্বপ্ন মিলায় জাগরণে, অথবা ঘরের বাতি নিভে যায় সূর্য উঠলে। তখন যা থাকবে—তুমি নিজে, যে-কোনো সময়েই ছিলে, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলে নিজেকে। উপনিষদ বলেন: “যঃ স্থিতঃ তস্য লয় ন ভবতি”—যিনি নিজস্ব স্বরূপে স্থিত, তাঁর আর মিলন-বিচ্ছেদ ঘটে না। তুমি এখনই পরব্রহ্ম—শুধু ভুলে গেছ।
তাই এই সাধনা—সব পরিচয় ছেঁটে ফিরে যাও শব্দহীন 'আমি'-তে এবং তাতে স্থিত হও যতক্ষণ না সে নিজেই বিলীন হয় তোমার স্বরূপ-আলোতে। তখন থাকবে শুধু তুমি—অভিজ্ঞতাতীত, অপরিবর্তনীয়, নিঃশব্দ, সর্বব্যাপী। যে-তুমি কোনো দিন জন্মাওনি, মরবে না, পরিবর্তনেও জড়াবে না—কারণ তুমি চিরকাল নিজের মধ্যেই স্থিত।
৭৮.
'আমি কে' নয়, 'আমি আছি'—এই অনুভবেই আছে প্রত্যাবর্তনের দ্বার। তুমি জন্মাওনি, তুমি কখনও তৈরি হওনি, তুমি ছিলে—এক নিঃশব্দ, অদৃশ্য, অভিজ্ঞতাতীত চেতনায়। আর সেই চেতনাতেই একদিন হঠাৎ উদিত হলো—একটি স্বপ্নের মতো অনুভব—“আমি আছি”।
উপনিষদ বলেন: “অজঃ সন্ ন ভবতি”—যে কখনও জন্মায়নি, সে কেবল ভ্রান্তি-রূপে অস্তিত্বময়তা অনুভব করে। এই ‘আমি’-বোধ—তা কোনো ব্যক্তির নয়, তা আসেনি কারোর ইচ্ছায় বা সিদ্ধান্তে, যেমন ঘুমের মধ্যে হঠাৎ স্বপ্ন আসে—তেমনি এই ‘আমি’ এসেছে—একটি জন্মহীন, নিরুপাধি চেতনার উপর। তাই গুরু বলেন—“কে এল, কে অনুভব করল—তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কে তুমি, কী পরিচয়—তা-ও নয় মূল কথা। শুধু স্থিত হও সেই ‘আমি’ বোধে—যা কোনো শব্দ ছাড়াই অনুভবযোগ্য।”
ওই অবস্থায় না ব্যক্তি আছে, না ইতিহাস, না ভবিষ্যৎ। কেবল এক বিশুদ্ধ, জন্মহীন সত্তা, যার বুকে স্বপ্নের মতো এই ‘আমি’ এসেছে, আর এখন সেই স্বপ্নে ফিরে যাওয়া দরকার নয়—বরং স্থির হও, দেখে যাও—যেভাবে এসেছে, সেভাবেই মিলিয়ে যাবে।
উপনিষদ বলেন: “স্মরণ মাত্রই নিজস্বরূপে প্রতিষ্ঠা”—শুধু স্মরণই যথেষ্ট—এই ‘আমি’ বোধে স্থিত হওয়া, আর কিছু করার নেই। ব্যক্তি কে, তা বোঝার চেষ্টা নয়, বরং ‘আমি’ বোধকে দেখা—যেমনটি সে প্রথম এসেছিল—নির্বাক, অবাক, স্বতঃস্ফূর্ত। তুমি সেই জন্মহীন শূন্যতায় স্থিত ছিলে, এখন শুধু ফিরে যাও—‘আমি’-তে স্থির থেকে, যেন সে নিজেই গলে যায়, আর তুমি পুনরায় স্থিত হও তোমার চিরস্বরূপে—পরব্রহ্মে।
৭৯.
‘অহম’-এ ফিরে যাও—সেখানে উদিত হবে জ্ঞান ‘অহম্ ব্রহ্মাস্মি’। প্রথমে এসেছিল এক নিঃশব্দ অনুভব—“অহম্”—আমি আছি। তারপর সেই ‘অহম্’ আকৃতি ধরল, বলল—“আমি এই দেহ”, “আমি এই নাম”, “আমি অমুক”। তখনই তা পরিণত হলো—“অহম্ + আকার” = অহংকার।
উপনিষদ বলেন: “অহম্ এতম্ মনুষ্যরূপম্ আশ্রিতঃ”—আত্মা ‘অহম’ বোধে এসে মানবরূপকে ধারণ করেছে। কিন্তু আসল ‘অহম’—কোনো দেহ নয়, নাম নয়, পরিচয় নয়। সেটি ছিল কেবল এক নির্বাক উপস্থিতি—যেটা বলছিল না কিছুই, শুধুই ছিল। এখন গুরু বলেন—“এই আকার ছেড়ে দাও। দেহ, পরিচয়, চরিত্র, ইতিহাস—সব ‘অহংকার’। তুমি এখন ফেরো সেই মূলবিন্দুতে—শুদ্ধ ‘অহম্’ বোধে স্থিত হও।” এবং যখন তুমি স্থিত হও এই নিঃশব্দ ‘অহম’-এ, তখন ধীরে ধীরে উদিত হয় সেই চিরসত্য জ্ঞান—“অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—আমি ব্রহ্ম।
উপনিষদ বলেন: আমি এই দেহ-মন নই, আমি সেই পরম চৈতন্য, যে সব কিছুতে প্রকাশিত, তবুও নিজে অপ্রকাশ্য, অপ্রভেদ্য, অজ। মুক্তির পথ শুরু হয় ‘অহম’-এ ফিরে আসা দিয়ে, আর শেষ হয় ‘অহম্’ বোধেরই মহাজ্ঞানরূপে বিকাশে। যখন তুমি ‘অহম্’-এ স্থিত, দেহ ও আকার ভুলে যাও, তখনই তুমি উপলব্ধি করো—এই ‘আমি’ কোনো ব্যক্তিসত্তা নয়, বরং আমি নিজেই সেই ব্রহ্ম—চিরসত্য, চিরচেতন, চিরনির্বিকার।
৮০.
তুমি 'আমি' নও, কর্মও নও—তুমি সেই, যার উপর 'আমি' এসেছে। এই যে তুমি বলো—“আমি আছি”, আর সেই ‘আমি’ দিয়ে গড়ে তোলো পরিচয়, ইতিহাস, সম্পর্ক, তার সাথে জন্ম নেয় হাজারো কর্ম ও কার্যকলাপ—সব কিছুতেই ‘আমি’ হলো মূলকেন্দ্র। কিন্তু একবার জিজ্ঞাসা করো—এই ‘আমি’-র আগেও কি কিছু করেছিলে? কোনো অভিজ্ঞতা ছিল? কোনো কর্ম ছিল?—না। কিছুই ছিল না। কেবল এক নিঃক্রিয়া, নিঃচঞ্চল অস্তিত্ব—যা কোনো কিছু করে না, তবু সব কিছুর পটভূমি।
উপনিষদ বলেন: “ন কর্তা, ন ভোক্তা”—আত্মা কোনো কর্ম করে না, কোনো ফল ভোগ করে না—সে কেবল সাক্ষীমাত্র। তাই বুঝতে হবে—এই ‘আমি’ বোধ নিজেই এক মরীচিকা। আর এই মরীচিকাই নিজের সঙ্গে জুড়ে নেয়—“আমি করলাম”, “আমি অনুভব করলাম”, “আমি ভোগ করছি”। অথচ প্রকৃত সত্য হলো—তুমি এই সব কিছুর সাক্ষী, তুমি 'আমি'-রও আগে, এবং ‘আমি’-র মাধ্যমে গড়ে ওঠা সব কর্ম, ইতিহাস, ভয় ও আশা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
এই যে ‘আমি’ এসেছে, সেটি এসেছে তোমার উপর, তুমি তাকে আহ্বান করোনি, তার কোনো কর্মেও তোমার যোগ নেই। উপনিষদ বলেন: এই আত্মা চিরকাল অসঙ্গ—সে কোনো কিছুতেই লিপ্ত নয়। এখনই উপলব্ধি করো—তুমি ‘আমি’ নও, তুমি কোনো কার্যকলাপ বা অনুভূতির অংশীদার নও। তুমি সেই নিঃস্পর্শ, নিরাকার চেতনা, যার উপর সব কিছু আসে, যায়, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তুমি সব কিছুর আগে, সব কিছুর পেছনে, এবং সব কিছুর অতীত—তুমি পরব্রহ্ম, চিরসাক্ষী, অভিজ্ঞতাতীত, চিরমুক্ত।