নির্জন গহনে: ১৫



৭১.

‘আমি’ খাদ্যদেহের বিভ্রম, তুমি তা নও—তুমি চিরস্বরূপ। এই মুহূর্তে তুমি যা জানো, তা হলো—“আমি আছি।” কিন্তু এই ‘আমি’-বোধ কোথা থেকে এসেছে? এটি এসেছে—পাঁচটি উপাদান (ক্ষিতি, অপ, তেজ, বায়ু, আকাশ) থেকে, আর তিনটি গুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) থেকে গঠিত খাদ্যদেহ থেকে। এই দেহ গঠিত হয়েছে খাদ্য থেকে, চলে প্রাণশক্তির মাধ্যমে, আর এই দেহের মধ্যেই জন্মেছে এই বোধ—“আমি আছি।”

উপনিষদ বলেন: “অন্নময়ঃ কোষঃ”—দেহ হলো খাদ্যবস্তু দ্বারা গঠিত একটি স্তর, এর ভেতরে আত্মা নেই—শুধু আবরণমাত্র। এই খাদ্যদেহ, উপাদান ও গুণ—সবই অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল, বিনাশযোগ্য। সুতরাং এদের ভেতর থেকে জন্মানো ‘আমি’-বোধও মিথ্যা—কারণ যা পরিবর্তনশীল, তা কখনোই সত্য হতে পারে না। কিন্তু এই ‘আমি’ এমন দক্ষ প্রতারক, যে তোমাকে বিশ্বাস করিয়েছে—“এই দেহই আমি”, “এই ইতিহাসই আমি”, “এই ভয়, ব্যথা, আশা, ভালোবাসা—সবই আমি।”

এখন যদি তুমি জানতে চাও সত্য, তবে তোমার একমাত্র পথ—এই ‘আমি’-বোধে ধ্যানস্থ হও, এবং ধীরে ধীরে তাকে চিহ্নিত করো, চিনে ফেলো তার মিথ্যা স্বরূপ। উপনিষদ বলেন: “নেতি নেতি”—এই নয়, ওটাও নয়—দেহ নয়, গুণ নয়, প্রাণ নয়, চিন্তা নয়, ‘আমি’ও নয়। তুমি কখনোই ছিলে না এই দেহ, এই মন, এই গুণ, এই খাদ্যবস্তু। তুমি কখনোই ছিলে না এই ‘আমি’—সেটি ছিল কেবল এক ছায়া, এক স্বয়ং-প্রতিষ্ঠ মায়া, যা এসেছিল, থাকবে কিছুদিন, এবং চলে যাবে। কিন্তু তুমি রয়ে যাবে, কারণ তুমি ছিলে তার আগেও, আর থাকবে তার পরেও—রূপহীন, নিরাকার, চিরস্বরূপ, পরব্রহ্ম।

৭২.

‘আমি’কে অতিক্রমই মোক্ষ—সেই ‘অজ’ সত্তার কোনো জন্ম, মৃত্যু, কর্ম নেই। অনেকেই বলে—“আমি বুঝি ‘আমি আছি’”—কিন্তু এই বোঝা ও উপলব্ধি এক জিনিস নয়। শব্দগত অনুধাবন হলো মনের খেলা, আর প্রকৃত উপলব্ধি হলো ‘আমি’-কে ছেড়ে ফেলে ফেলা।

উপনিষদ বলেন: “জ্ঞানম্ ভিন্নম্, জ্ঞাতৃত্বম্ ভিন্নম্”—জ্ঞান এক জিনিস, আর সেই জ্ঞানকে অতিক্রম করা অন্য জিনিস। তাই গুরু বলেন—যিনি সত্যিই ‘আমি’ কে উপলব্ধি করেছেন, তিনি আর ‘আমি’ নন, তিনি আর ব্যক্তি নন, তিনি সেই—যিনি জন্মহীন। আর যিনি জন্মহীন, তাঁর কাছে জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, কর্মফল নেই, পুনর্জন্ম নেই। কারণ কর্ম তখনই কার্যকর, যখন কর্তা আছে, আর কেবল তখনই পুনর্জন্ম ঘটে, যখন আমি ‘ব্যক্তি’-রূপে জড়িয়ে পড়ে ফলভোগে।

উপনিষদ বলেন: “যঃ পশ্যতি ন কিঞ্চন, তস্মিন্ ন কর্ম লিপ্যতে”—যিনি কিছুতেই নিজেকে জড়ান না, তাঁর উপর কোনো কর্ম কার্যকর হয় না। তাই যিনি ‘আমি’-কে অতিক্রম করেছেন, তাঁর জন্য সেই খেলা শেষ। ধর্ম, পুনর্জন্ম, কর্ম, ফল—সব তার জন্য অস্পৃষ্ট, কারণ তিনি জানেন—“আমি জন্মাইনি, আমি ছিলাম না, তবু আছি”—আমি সেই নিরাকার চেতনা—পরব্রহ্ম।

এখন বোঝো—শুধুমাত্র ‘আমি’ বোধ জানলেই হবে না, সেই বোধকে অতিক্রম করতে হবে। তখনই তুমি সত্য বুঝবে—তুমি জন্মহীন, মৃত্যুহীন, কর্মশূন্য, নিঃসংশয়। সেই মুহূর্তেই সব শেষ, আর শুরু হয় প্রকৃত স্থিতি—যা কখনো আসেনি, যাবে না, কেবল রয়েছে—রূপহীন মৌন পরব্রহ্মরূপে।

৭৩.

‘আমি’ হলো মূল বিভ্রম, মুক্তি তারই অতিক্রমে—জ্ঞানের অপসরণেই চিরজ্ঞান। তোমার ভেতরে এই যে ‘আমি আছি’—এটাই প্রথম বিভ্রম, কারণ তার আগেও তুমি ছিলে, কিন্তু তখন কোনো ধারণা ছিল না, অভিজ্ঞতাও ছিল না। সেই “আমি জানি, আমি আছি”—এই জ্ঞানই জন্ম দিয়েছে ব্যক্তিত্ব, দেহবোধ, আত্মপরিচয়, ভয় ও মৃত্যু।

উপনিষদ বলেন: “যদ্ ভিজ্ঞানং তদসত্যম্”—যা জানা যায়, তার মধ্যে সত্য নেই। এই ‘আমি’ হলো সর্বপ্রথম মায়া—এক প্রতিচ্ছায়া, যা বলে: “তুমি আছ”—কিন্তু আসলে তুমি তখনই দূরে সরে গেছ নিজ থেকে। তাই মুক্তি মানে ‘আমি’-র জয় নয়, বরং তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। সে আর ফিরে আসে না, এবং তুমি ফেরো অজানা এক মৌনভাবে—যেখানে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, কোনো চেতনার বোধও নেই। এ অবস্থায় নেই—না ‘জানা’, না ‘অজানা’, না ‘আমি আছি’, না ‘আমি নেই’—কেবল এক নিঃশব্দ নিরস্তিত্ব, যেখানে অভিজ্ঞতা পর্যন্ত বিলীন, তবুও তুমি আছ—অভিজ্ঞতাতীত চৈতন্যরূপে।

উপনিষদ বলেন: “অজ্ঞাতং বিজ্ঞাতারম্”—সেই চৈতন্য অজ্ঞেয়, কারণ সে নিজেই সব জ্ঞানের উৎস, কিন্তু নিজে কোনো অভিজ্ঞতার বিষয় নয়। তাই জানো—প্রথম বিভ্রম ‘আমি’, আর মুক্তি মানে সেই ‘আমি’ বোধের অনুপস্থিতি। যখন তা চিরতরে হারায়, তখন তোমার ভেতরে যা রয়ে যায়, তা না জ্ঞান, না অজ্ঞান, বরং অজ্ঞানময় চেতনার অতীত পরব্রহ্ম—যার কোনো গল্প নেই, কোনো দৃষ্টান্ত নেই, কেবল নিঃস্বর সর্বস্থিতি।

৭৪.

‘আমি’ বলার আগেই তুমি—সেই জন্মহীন স্বরূপে স্থিত হও। তুমি বলো—“আমি আছি”, কিন্তু কী করে তুমি এটা বলতে পারো? কারণ তুমি তারও আগে আছ—তুমি সে ভূমি, যার উপরে ‘আমি’ বোধ উদিত হয়েছে—যেমন আকাশের উপর মেঘ আসে, আবার সরে যায়। উপনিষদ বলেন: “আত্মা পশ্যতিঃ, ন পশ্য্যতে”—আত্মা দেখে, কিন্তু তাকে দেখা যায় না, সে নিজেই সাক্ষ্যদাতা, অভিজ্ঞতার অতীত। এই ‘আমি’ বোধ—তা তো পরবর্তী প্রকাশ। তার আগে ছিলে তুমি নিজে, কিন্তু তখন তুমি কিছুই জানো না, কিছু বলো না, কিছু চাও না—তবু তুমি ছিলে।

সেই “তুমি”-ই সত্য—কারণ সে কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছাড়াই রয়েছে, সে কোনো কিছুর উপর নির্ভর করে না, এমনকি ‘আমি’-র উপরও নয়। এখন তুমি ‘আমি’কে দেখো—অর্থাৎ, তুমি ‘আমি’-রও সাক্ষী। আর যে ‘আমি’-কে দেখছে, সে-ই তোমার প্রকৃত স্বরূপ। উপনিষদ বলেন: “যঃ পশ্যতি, ন চ পশ্যতে—সঃ পশ্যতি”—যে দেখছে, কিন্তু যাকে দেখা যায় না, সে-ই সত্যদ্রষ্টা। তুমি জন্মাওনি, তুমি কোনো চিন্তা, অনুভূতি, বা ‘আমি’ নও। তুমি সেই সর্বপ্রথম, নিরাকার, মৌন অস্তিত্ব—যার উপরে আসে ‘আমি’, আর সেই ‘আমি’-র মাধ্যমেই অভিজ্ঞতা সম্ভব হয়। কিন্তু যখন তুমি বুঝে ফেলো—“আমি সেই, যার আগেও ছিলাম”—তখনই তুমি স্থিত হও পরব্রহ্মে, যেখানে নেই ‘আমি’, নেই ভাষা, নেই অভিজ্ঞতা—কেবল অভিজ্ঞতাতীত চেতনামাত্র।

৭৫.

দেহ যায়, 'আমি' মুছে যায়—যা থাকে, তা-ই তুমি। চিরস্থিত পরব্রহ্ম এই ‘আমি’ বোধ—এসেছে পাঁচভূত আর ত্রিগুণের গঠিত দেহ-মনের ভিতর থেকে, আর তার মূলেই লুকিয়ে আছে—এক মহামায়া, যা বলে “আমি আছি”, “আমি এই।” কিন্তু যে-মুহূর্তে দেহ পড়ে যায়, এই 'আমি'ও নিঃশব্দে অন্তর্হিত হয়—ঠিক যেমন জাগরণ শেষে স্বপ্ন মিলিয়ে যায়।

উপনিষদ বলেন: “দেহ নশ্যে ‘অহং’ লয়ং গচ্ছতি”—দেহ বিনষ্ট হলে, ‘আমি’ও বিনষ্ট হয়। কিন্তু তুমি কি মুছে যাও? না! কারণ তুমি কখনোই ছিলে না এই দেহ, কখনোই ছিলে না এই ‘আমি’। তুমি সেই, যার বুকে দেহ এসেছে, যার উপর ‘আমি’ উদিত হয়েছে, আর যার মাঝে সব মিলিয়ে যায়। এখন গুরু বলেন—“যদি তুমি এখনই এই 'আমি'-তে স্থিত হও, তবে একসময়—এই ‘আমি’ নিজেই গলে যাবে, আর যা থাকবে—তুমি নিজেই, পরব্রহ্মরূপে।” তা না হলে, দেহ একদিন যেভাবেই হোক পড়ে যাবেই, ‘আমি’ নিজেই নিঃশব্দে চলে যাবে, তুমি কিছু জানার আগেই—আর তখন তোমার অস্তিত্ব-মূল্যে কোনো গুরুত্ব থাকবে না, কারণ তুমি তখনো বুঝতেই পারোনি, তুমি কে।

উপনিষদ বলেন: “অহং ন ম্রিয়তে, ন জায়তে”—‘আমি’ জন্মায়, মরে, কিন্তু আমি—এই আমি নয়, আমি হলাম অজ, অ-মৃত, অচল। তাই এখনই সময়—‘আমি’-তে স্থির হও, কিন্তু তাতে আটকে থেকো না, বরং একাগ্র সাধনায় তাকে অতিক্রম করো, যাতে তার নিজেরই অন্তর্ধান ঘটে, তখন তুমি রয়ে যাও সেই অদ্বিতীয়, অভিজ্ঞতাতীত, চিরস্বরূপ চেতনায়। মৃত্যুর আগেই নিজেকে চিনে ফেলো—যাতে মৃত্যুর পরে আর কিছু মরবার না থাকে, কারণ তখন থাকবে কেবল তুমি—যিনি কখনও জন্মেননি, তাই কখনও মরেন না।
Content Protection by DMCA.com