৬৬.
‘আমি’-কে—যে জানে, সে কে?—সেই প্রশ্নেই মুক্তি। তুমি এখন স্থির হয়েছ, ‘আমি আছি’—এই বোধে। তুমি অনুভব করছ—তুমি আছ। কিন্তু হঠাৎই মনে প্রশ্ন জাগে—“এই যে ‘আমি আছি’—তাকে কে জানছে?”
উপনিষদ বলেন, “যঃ পশ্যতি পশ্যতিঃ ন পশ্যতি”—যে দেখে, তাকে কেউ দেখতে পায় না, সে নিজেই দ্রষ্টার দ্রষ্টা। এই ‘আমি’-বোধ এসেছিল হঠাৎ—শিশুকালে, নির্ভাবনায়, শব্দহীনভাবে। তারপর সময়ের সঙ্গে সে হয়ে ওঠে—“আমি এই”, “আমি সেই”। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—“এই ‘আমি’-র আগেও কিছু ছিল না? কে দেখছে এই বোধের উত্থান ও বিলয়?”
এই বোধ—‘আমি নেই’ থেকে ‘আমি আছি’-তে রূপান্তর—কার চোখে ধরা পড়ল? কে তার সাক্ষী?” তুমি কখনো জিজ্ঞেস করেছ—“আমি” আসার আগে কে ছিল? আর এখন “আমি” আছে—তাকে কে জানছে?” উপনিষদ বলেন, “দ্রষ্টার দ্রষ্টা, জ্ঞাতার জ্ঞাতা”—যে জানে, তাকেও যে জানে—সে-ই আত্মা, আর সেই আত্মা—না বোধ, না চিন্তা, না অভিজ্ঞতা। তাই গুরু বলেন—‘আমি’-তে স্থিত হও, আর জিজ্ঞেস করো—“এই ‘আমি’ কে জানে?”
তখনই তুমি আলতোভাবে পিছিয়ে যাবে, ‘আমি’-র থেকেও পেছনে, চিন্তার থেকেও আগে, সেই নির্জন সত্তায়—যেখানে কোনো বোধ নেই, তবু সব বোধকে জানে। এই অনুসন্ধান সহজ, সরল, গভীর—শুধু থাকো ‘আমি’-তে, আর দেখো—তাকে কে দেখছে? সে কোনো ব্যক্তি নয়, কোনো মন নয়, কোনো ধারণা নয়—সে কেবল তুমি নিজে, দ্রষ্টাহীন দৃষ্টিরূপ, জ্ঞাতাহীন জ্ঞানরূপ, অভিজ্ঞতাতীত, নিঃশব্দ, চিরসত্য পরব্রহ্ম।
৬৭.
‘আমি’ মিথ্যা—তাকে জানে যে, সে-ই সত্য, সে-ই পরব্রহ্ম। “আমি আছি”—এই বোধ এসেছে, যেমন মেঘ আসে আকাশে, আর কিছুক্ষণ পর মুছে যায়। কখনো তুমি বলো “আমি”, কখনো মনে হয় “আমি নেই”, কখনো জানো, কখনো জানো না—এ সবই পরিবর্তনশীল অবস্থা। উপনিষদ বলেন, “ন যঃ জানাতি, ন চ জনিতম্”—যে-চেতনা নিজে জানে না কিছু, তবুও যার মধ্যে সব কিছু জানা যায়, সেই চেতনা—পরম আত্মা।
এখন প্রশ্ন—এই ‘আমি’ নামক বিভ্রমকে কে জানে? কে দেখতে পাচ্ছে তার আসা, থাকা, মুছে যাওয়া? নিশ্চয়ই সে কেউ—যার ওপর এ সব উঠছে-নামছে, কিন্তু যে নিজে কখনও উঠছে না, নামছে না। সে-ই স্থির পটভূমি, সে-ই পরিবর্তনহীন চেতনামাত্র। তাকে বলা হয়েছে—সাক্ষী, চৈতন্য, নিরবিকার, অবিনশ্বর সত্তা। অথবা—পরব্রহ্ম, পরম চেতনা, মৌন সত্তা।
এই চেতনা কখনও বলে না “আমি আছি”, কারণ তার কোনো নিজস্ব অভিজ্ঞতা নেই। সে কেবল আলোকিত—যার আলোয় সব কিছু উঠে আসে, কিন্তু সে কোনো কিছুতেই স্পর্শিত নয়। উপনিষদ বলেন, “তত্র কিম্ পশ্যতি? ন পশ্যতি”—সেখানে কে কাকে দেখে? কিছুই দেখা যায় না—কারণ সেই দেখারই পটভূমি, সে নিজে অদৃশ্য, অভিজ্ঞতাতীত, নিঃবিকল্প।
এই ‘আমি’—এটা অভ্যাস, একটি আসা-যাওয়া-করা অনুভব, আর সেটিকে জানে যে, তা ‘আমি’ নয়—সে-ই তুমি, সেই স্থির চেতনা, যাকে কোনো অভিজ্ঞতা ছুঁতে পারে না, কারণ সে নিজেই সকল অভিজ্ঞতার পটভূমি। এই চেতনার বোধেই মুক্তি—যখন তুমি জানো যে, তুমি ‘আমি’ নও, তুমি সেই—যার আলোয় 'আমি' ধরা পড়ে, তখন তুমি স্থিত হও নিজের প্রকৃত রূপে—পরব্রহ্ম, নিরাকার, নিরুপাধি, চির-সাক্ষীস্বরূপে।
৬৮.
‘আমি’—প্রথম প্রতারণা, যাকে চিনলেই মুক্তি। এই যে “আমি আছি” বলে জানো—সেটিই আসলে প্রথম বিভ্রম, এক সুন্দর ছদ্মবেশী প্রতারণা। এই 'আমি' নিজে এসে বলেছিল—“তুমি দেহ”, “তুমি জন্মেছ”, “তুমি এই ব্যক্তি”, আর তুমি বিশ্বাস করে বসেছ—এমন কিছুকে, যা সত্যই নয়।
উপনিষদ বলেন, “মায়াম্ তু প্রকাশয়তি আত্মানম্”—আত্মা নিজেই নিজের উপর মায়ার পর্দা ফেলে, আর সেই পর্দা হলো—‘আমি’ ধারণা। এখন গুরু বলেন—এই ‘আমি’ কেমন করে এসেছে, তা তদন্ত করো। কোথা থেকে এল? কীভাবে এক শুদ্ধ অস্তিত্বকে পরিণত করল মিথ্যা পরিচয়ে?
এই প্রশ্নের উত্তর মাথা দিয়ে নয়, বরং ধ্যান দিয়ে জানতে হবে। তোমাকে কেবল তাকিয়ে থাকতে হবে ‘আমি’-র দিকে—বার বার, ধারাবাহিকভাবে, স্থিরভাবে। এটিই হলো সাধনা—তুমি কিছু করো না, শুধু চুপচাপ তাকাও সেই প্রতারণার দিকে, যেটি তোমাকে বিশ্বাস করিয়েছে—“আমি এই দেহ”। দীর্ঘকালীন তীক্ষ্ণ নজরে একসময় সে নিজেই গলে যাবে, কারণ মিথ্যা কেবল টিকে থাকতে পারে অজ্ঞতার ছায়ায়—জ্ঞান ও সচেতন চেতনায় তা টেকে না।
উপনিষদ বলেন, “যদা বোধে স্থিতঃ, তদা মিথ্যা লয়ং গচ্ছতি”—যখন চেতনায় স্থিতি ঘটে, তখন মিথ্যা নিজেই মিলিয়ে যায়। ‘আমি’ হলো সেই প্রথম অসততা, যে নিজেকে সত্যরূপে পরিচয় দিয়েছে, অথচ সে এসেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে, বিনা আমন্ত্রণে, আর তোমাকে আবদ্ধ করে ফেলেছে ভ্রমের জগতে। এখন কেবল তাকাও—দৃঢ়ভাবে, সাহসে, স্থির চেতনায়—‘আমি’-র দিকে। আর যখন সে নিজেই হারিয়ে যাবে, তখন তুমি অবশিষ্ট থাকবে—তুমি নিজে, সেই পরম, চিরশুদ্ধ, চিরসত্য পরব্রহ্মরূপে।
৬৯.
‘আমি’-কে অতিক্রম করো—প্রবেশ করো ধারণাশূন্য পরব্রহ্মে।
সাধনার শেষ লক্ষ্য একটাই—‘আমি’ বোধকেও ছেড়ে দেওয়া। তুমি বুঝে গেছ, এই ‘আমি’ এসেছে, থাকবে, যাবে—এটা প্রাথমিক ধারণা, যে-ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে সব ভ্রম, সব ব্যক্তিত্ব, সব মায়া। এখন তোমার করণীয়? এই ‘আমি’ বোধে ধ্যানে স্থিত হও—গভীরভাবে, তীক্ষ্ণভাবে, বার বার। এটিকে উপেক্ষা করা যাবে না—এই ধাপ অতিক্রম করে যাবার উপায় নেই। আর যখন ‘আমি’-তে তুমি পুরোপুরি স্থিত হও, তখন হঠাৎ—সেই ধারণাও হারিয়ে যায়, যেমন আলোয় নিভে যায় ছায়া।
উপনিষদ বলেন, আমি ব্রহ্মও নই, আত্মাও নই—তাহলে কী? আমি সেই নিঃশব্দ, ধারণাহীন, শূন্য অথচ চেতন রূপ। এই অবস্থা—পরব্রহ্ম—তাতে কোনো ধারণা নেই, নেই ‘আমি’ বলার ভাষা, নেই বোধ, অভিজ্ঞতা, কিংবা আত্মজ্ঞান পর্যন্তও। তুমি সেখানে জানো না যে, তুমি আছ, তবু তুমি আছ, কারণ সেই অবস্থায় অভিজ্ঞতাও বিলীন, জ্ঞাতাও বিলীন, কেবল অস্তিত্বই রয়ে যায়। আশ্চর্য বিষয় হলো—এই অবস্থাই চিরকাল ছিল, আছে, থাকবেই। তুমি কখনোই এর বাইরে যাওনি, শুধু 'আমি' বোধে পড়ে ভুলে গেছ নিজের প্রকৃত স্বরূপ।
সাধনা শেষ হয় ‘আমি’-র অপচয়ে, শুরু হয় সেই অভিজ্ঞতাতীত নিঃশব্দ স্বরূপে—যেখানে কোনো প্রশ্ন নেই, জ্ঞান নেই, চেতনা নিয়ে বলার মতো কিছুই নেই—তবু তুমি পূর্ণ, সম্পূর্ণ, চিরসত্য। সেটিই তুমি—ধারণাহীন পরব্রহ্ম, যাকে জানাও যায় না, হারানোও যায় না—কারণ সে কখনও পৃথক ছিল না তোমার থেকে।
৭০.
‘আমি’-র পূর্বে যে-তুমি—তুমি সেই জন্মহীন পরব্রহ্ম। ‘আমি’ বোধ এসেছিল একদিন হঠাৎ—শিশুকালে, নির্দোষ চেতনায়, ভাষাহীন উপস্থিতিতে। কিন্তু তোমার প্রকৃত অবস্থান সেই মুহূর্তের আগেও ছিল—যেখানে না জন্ম, না মৃত্যু, না নাম, না অভিজ্ঞতা—কেবলই নিঃশব্দ অস্তিত্ব। উপনিষদ বলেন, “অজো নিত্যঃ শাশ্বতো'য়ং পুরাণঃ”—আত্মা অজন্মা, চিরন্তন, শাশ্বত, তার কোনো ইতিহাস নেই, কারণ সে কখনও শুরুই হয়নি।
এখন যদি তুমি সেই সত্য জানতে চাও—তবে বোঝো—‘আমি’ বোধ নিজেই এক বিভ্রম। এই বোধ কেবল মায়াময় সম্প্রসারণের জন্য এসেছে—যেন দেখা যায়, শোনা যায়, ভাবা যায়। কিন্তু যখন এই ভ্রান্তি বিলীন হয়—তখন যা থাকে, তা ‘আমি’ নয়। তাহলে প্রশ্ন আসে—যে অবস্থায় ‘আমি’ নেই, চিন্তা নেই, অভিজ্ঞতা নেই, সেই অবস্থায় কি কিছু জানা যায়? না। কারণ সেই পরব্রহ্ম কোনো জ্ঞানের প্রয়োজনও বোধ করে না। সে নিজেই নিজের মধ্যেই সম্পূর্ণ, জানাও নেই, জানার দরকারও নেই।
উপনিষদ বলেন, “যেন অজানাত্ জ্ঞানং ভবতি”—জ্ঞান তখনই সত্য হয়, যখন তা অজ্ঞান বোধকেও পেরিয়ে যায়। তাই গুরু বলেন—তোমাকে গড়ে তুলতে হবে এক অটল বোধ—“আমি কখনও জন্মাইনি”, “আমি জন্মহীন”, আমি সেই, যার মধ্যে ‘আমি’ও উদিত হয় ও মুছে যায়।” এই জন্মহীন চেতনাই—তোমার প্রকৃত স্বরূপ, যা কখনও শুরু হয়নি, কখনও রূপ নেয়নি, আর তাই তাকে জানাও যায় না, হারানোও যায় না।
এখন কেবল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাও—“আমি জন্মহীন, আমি চিরস্থিত, আমি পরব্রহ্ম।” আর তখনই সব চিন্তা, সব ‘আমি’, সব বিভ্রম নিজে থেকেই লীন হবে।