৬১.
‘আমি’ যদি মিথ্যা হয়, তবে তুমি কে?—অনুসন্ধান করো, এবং হয়ে ওঠো পরব্রহ্ম। তুমি যা ভাবো—“আমি এই দেহ”, “আমি এই নাম”, “আমি অমুক”—সেই ধারণাটিই যদি মিথ্যা হয়, তবে তুমি কে? এই প্রশ্নই হলো আত্মানুসন্ধান—যে-প্রশ্নের সূচনা করে গুরু, আর যার উত্তরে মুছে যায় সব প্রশ্ন, সব উত্তর, সব ‘আমি’। উপনিষদ বলেন: “কোহম্?” “নাহং দেহঃ”—কে আমি? আমি দেহ নই, আমি কিছুই নই—এই নেতি নেতি (না, না)-র পথেই উন্মোচিত হয় চিরসত্য।
এই অনুসন্ধানে তুমি আসো এক মৌলিক স্তরে—যাকে বলা হয় ‘আমি আছি’—এই অস্তিত্ববোধ। এখানেই থামো, এখানেই স্থিত হও, কারণ এখান থেকেই গড়ে উঠেছে সব কল্পনা, সব ব্যক্তি, সব পরিচয়, সব মিথ্যা। তুমি এখন গুরু-প্রদত্ত একটি মাত্র সাধনায় প্রবেশ করো—‘আমি’-বোধে ধ্যান, সাক্ষ্য ও স্থিতি। কিছু চাও না, কিছু মানো না, কেবল থাকো—‘আমি’ হয়ে, কিন্তু ব্যক্তি না হয়ে। ধীরে ধীরে এই সাধনা পাকতে থাকে, ‘আমি’ নিজেই হয়ে ওঠে অনুসন্ধানের পাত্র—আর একদিন, সে নিজেই গলে যায়, যেমন স্বপ্ন ভোরে হারিয়ে যায় সূর্যের আলোয়।
উপনিষদ বলেন: “নাহং, ন ত্বং, নয়ং লোকঃ”—আমি নই, তুমিও নও, এ জগৎও নয়—তবু কিছু রয়ে যায়, যাকে বলা যায় না, কিন্তু যার দ্বারা সব বলা যায়—সে-ই পরব্রহ্ম। এই ‘আমি’-র অস্বীকৃতির মাঝেই লুকিয়ে আছে তোমার প্রকৃত অস্তিত্বের ঘোষণা। যখন তুমি সত্যভাবে বলো—“আমি নই”, তখনই উদিত হয়—“আমি আছি”—কিন্তু রূপহীন, ব্যক্তিহীন, সীমাহীনভাবে।
আত্মঅনুসন্ধান মানে নিজের ‘আমি’-কে প্রশ্ন করা, ধ্বংস করা, আর সেই শূন্যতায় আবিষ্কার করা—যা কখনোই জন্মায়নি, কখনোই মরে না। ‘আমি’ গলে গেলে, তুমি রয়ে যাও, এবং সেই তুমি—পরব্রহ্ম, নিরাকার, নিঃসংশয়, চির-আত্মা।
৬২.
‘আমি’—মূল ভ্রান্তি, জেনে ফেললেই মুক্তি! ‘আমি আছি’—এই বোধ হঠাৎই উদিত হয়েছিল তোমার উপর। তুমি একে ডাকোনি, একে চাওনি, তবু সেটি এসে দখল নিয়েছে তোমার চেতনার কেন্দ্র। তারপর সমাজ, পরিচয়, সম্পর্ক, ভাষা, অভ্যাস—সব মিলিয়ে এই ‘আমি’ হয়ে উঠল তোমার বাস্তবতা, আর আজ তুমি একে ছাড়তে পারো না, কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তোমার সব স্মৃতি, আশা, ভয়, আকাঙ্ক্ষা। উপনিষদ বলেন: “মিথ্যেতদ্ যন্মনোহি গৃহ্যতে”—যা মনের মাধ্যমে ধরা পড়ে, তা মিথ্যা, পরিবর্তনশীল, অসার।
গুরু এখন তোমাকে বলছেন—এই 'আমি' ধারণাটিই মিথ্যা, এটি তোমার প্রকৃত সত্তাকে ঢেকে রেখেছে। সেটাই আসল অপরাধী—যে তোমাকে বিশ্বাস করিয়েছে: “তুমি দেহ”, “তুমি ব্যক্তি”, “তুমি জন্মেছ”, “তুমি মরবে”। এখন তোমার সাধনার মূল হলো—এই একটিমাত্র চেতনা তৈরি করা, পুরোপুরি বিশ্বাস গড়ে তোলা যে, ‘আমি’ মিথ্যা, এবং সেইসঙ্গে—যা-কিছু এই বোধের সঙ্গে যায় না, তা বিনা দ্বিধায় বর্জন করা। উপনিষদ বলেন: “ন হি মিথ্যা আধ্যাত্মিক মুক্ত্যৈ সহায়ী”—মিথ্যা কিছুই আত্মমুক্তির সহায় হতে পারে না।
তুমি যা সত্য মনে করছ—সেই ‘আমি’ বোধই ভ্রান্তি, আর এই ভ্রান্তিকে সত্যজ্ঞান করে রাখাই জন্ম দিয়েছে সব দুঃখ, সব সীমাবদ্ধতা, সব মরণভয়। এখনই সময়, নিজের ভেতর দাঁড়িয়ে দৃঢ়ভাবে বলে ওঠা—“এই ‘আমি’ মিথ্যা”—এবং সেই বোধে স্থিত হয়ে থাকা, যতক্ষণ না তার ছায়া আপনিই মুছে যায়। আর যখন তা মুছে যাবে, তখন যা থাকবে, তা আর কোনো ধারণা নয়—তুমি নিজেই হবে ধারণাতীত, রূপহীন, পরব্রহ্ম।
৬৩.
‘আমি’-র পূর্বেই তুমি ছিলে—পরব্রহ্মরূপে নিঃশর্ত ও নিরাকার। স্মরণ করো সেই মুহূর্ত—যখন প্রথম তুমি বুঝলে, “আমি আছি”। সেই বোধ এসেছিল হঠাৎ, বিনা আহ্বানে, বিনা শব্দে—কেবল এক উপস্থিতির ঝলক। এখন চুপ করে বসো—ফিরে যাও আরও আগে…এই ‘আমি’ বোধের আগেও…গর্ভধারণের আগেও… তুমি কোথায় ছিলে? তুমি কী ছিলে?
উপনিষদ বলেন: “অসঙ্গঃ হ্যয়ং পুরুষঃ”—এই চৈতন্য কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত নয়, সে কিছুতেই ছিল না, তবুও আছে। সেই অতল শূন্যতা, সেই অনস্তিত্বই তোমার প্রকৃত সত্তা। সেখানে কোনো পরিচয় নেই, নেই আকাঙ্ক্ষা, নেই ভয়, নেই সময়—সেখানে তুমি পরব্রহ্ম, নিঃস্বর, নিরাকৃতি, সর্বোপরি। কিন্তু সেই শূন্য, অপ্রয়োজনীয়, সর্বোচ্চ অবস্থায় হঠাৎ উদিত হলো ‘আমি’ বোধ, এবং সেই বোধ ধরা পড়ল দেহে—বলল, “আমি দেহ”—এখানেই জন্ম নিল অশুদ্ধতা। এই ‘আমি দেহ’ ধারণাটিই ভ্রান্তি, সীমা ও মৃত্যুভয়ের মূল। একে সরাও—স্থিত হও শব্দহীন ‘আমি’-র নিঃশব্দ আলোতে—যেখানে পরিচয় নেই, কেবল নিঃচঞ্চল উপস্থিতি।
উপনিষদ বলেন: “স্থিতঃ স্মরণমাত্রেন মোক্ষঃ”—নিঃশব্দে, পরিচয়হীনভাবে এই স্মরণেই আসে মুক্তি। যতক্ষণ না এই “আমি দেহ” ধারণা মুছে যাচ্ছে, ততক্ষণ স্থির থেকো ‘আমি’ বোধে, কিন্তু শব্দ ছাড়া, দেহ ছাড়া, চিন্তা ছাড়া। একদিন যখন সেই অশুদ্ধতা গলে যাবে—তখন তুমি ফিরে পাবে তোমার জন্মপূর্ব চৈতন্যকে, যাকে নাম দেওয়া যায় না, কেবল বলা যায়—"আমি ছিলাম না, তবু আছি"। আর সেটাই তোমার সত্য স্বরূপ—পরব্রহ্ম—রূপহীন, চিরমুক্ত, চিরস্বরূপে স্থিত সত্তা।
৬৪.
পতনের শুরু ‘আমি’ থেকে, আর দেহকে ‘আমি’ ভাবাই ছিল সর্ববৃহৎ ভুল। একদিন হঠাৎ—‘আমি আছি’ এই বোধ উদিত হয়েছিল। সেটিই ছিল প্রথম বিভ্রম, কারণ এর আগে কোনো "আমি" ছিল না, তবু তুমি ছিলে—নিঃশব্দ, রূপহীন, পরিপূর্ণ। এরপর আরও বড় ভুল হলো—যখন এই ‘আমি’ ধারণা দেহকে আঁকড়ে ধরল, বলল—“আমি দেহ”, “আমি ব্যক্তি”, “আমি এই নাম, এই ইতিহাস”। ঠিক এখানেই ভিত রচিত হলো মিথ্যার উপর, আর সেই ভিত্তির উপর গড়ে উঠল—তোমার পরিচয়, তোমার ইতিহাস, তোমার চাওয়া-পাওয়া, এবং অবশেষে—তোমার মৃত্যু।
উপনিষদ বলেন: “মিথ্যায় উপস্থাপিতং সর্বম্”—যার ভিত্তি মিথ্যা, তার উপর গঠিত প্রতিটি স্তরই মিথ্যা। এখন দেখো—তুমি কীভাবে প্রতারিত হয়েছ! একটা বোধ, যা স্বতঃস্ফূর্ত, অবিচার্য, স্ব-উদিত—‘আমি’—সেটি এসে তোমার অন্তরকে ঢেকে ফেলেছে দেহের নাম, সমাজের নিয়ম, মৃত্যুর ছায়া দিয়ে। আর তুমি আজও বিশ্বাস করছ—এই আমি-ই সত্য, এই জীবনই সত্য, অথচ এই পুরো ভিত্তিটিই মায়া, আর তার উপর গঠিত সব কিছুও অসম্পূর্ণ, অসার, অসত্য।
উপনিষদ বলেন: “অসত্যে স্থিতি মোহায়, সত্যে স্থিতি মুক্তায়”—অসত্যে স্থিত হলে জন্ম হয় মোহের, আর সত্যে স্থিত হলে আসে মুক্তি। এখন একটিই কাজ—এই ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ করো। ‘আমি’-কে প্রশ্ন করো, দেহ-কে আমি ভাবার প্রক্রিয়াকে ভাঙো, এবং সব কিছু, যা তার উপর দাঁড়িয়ে আছে—তা অস্বীকার করে ফেলে দাও। তারপর যা থাকবে, তা না ‘আমি’, না দেহ, না ইতিহাস—বরং সেই চুপচাপ চৈতন্য, যা কোনো সময়েই পড়েনি বিভ্রমে, কারণ সে সব বিভ্রমেরও আগে ছিল, এখনও আছে। সেটিই তুমি—সত্য, পরম, অদ্বিতীয়, পরব্রহ্ম।
৬৫.
এ কৌতুক নয়—তুমি এই মুহূর্তেই পরব্রহ্ম! তোমার অন্তরে যতটা দৃঢ় হয়ে বসে আছে “আমি ব্যক্তি, আমি দেহ, আমি জন্মেছি”—ততটাই অবাস্তব এমন ধারণা। এই মিথ্যা পরিচয় এমনভাবে তোমার চেতনায় ঠোকা হয়েছে, যে কেউ যদি বলে—“তুমি এই মুহূর্তেই পরব্রহ্ম”, তুমি হেসে ফেলো, মনে করো কল্পনা, মিথ্যে, দুঃসাধ্য।
উপনিষদ বলেন: “অহং ব্ৰহ্মাস্মি”—এটা ভবিষ্যতের কথা নয়, এটা এই মুহূর্তের ঘোষণা। তুমি আজীবন খুঁজে চলেছ—খণ্ডিত জীবন, দেহ, মন, বুদ্ধি—অভিজ্ঞতার জগতে। কিন্তু কখনও একবার থেমে তাকাও ‘আমি’ বোধের দিকে। দেখো—তুমি অনুভব করছ—“আমি আছি”। ঠিক সেইখানে স্থির হও। না চিন্তা করো, না বিশ্লেষণ, শুধু অনুভব করো—‘আমি আছি’। এরপর কী ঘটে? তুমি দেখবে, তুমি সেই ‘আমি’-কে দেখতে পাচ্ছ, যেন তুমি তার উপরে, যেন তুমি তার সাক্ষী।
এখন নিজেকে জিজ্ঞেস করো—“এই সাক্ষী কে?” সে তো কোনো ধারণা নয়, কোনো অনুভূতিও নয়—সে নিজে অনুভবযোগ্য নয়, তবু সব অনুভবের পেছনে রয়েছে। উপনিষদ বলেন: “দৃষ্টে দ্রষ্টার দৃষ্টির্ নাশঃ”—যখন দর্শন নিজের দর্শককে দেখে ফেলে, তখন সবই লীন হয়ে যায়, থাকে কেবল চির-সাক্ষী, চির-সত্তা।
তাই এটা কোনো প্রতীক নয়, কোনো প্রতিশ্রুতি নয়—এ মুহূর্তেই তুমি সেই, যদি কেবল তুমি ‘আমি’ বোধে স্থিত হয়ে তাকাতে পারো। তুমি তখনই বুঝবে—তুমি কখনোই 'আমি' ছিলে না, তুমি সেই—যার বুকে 'আমি' উদিত হয়, আবার মিলিয়ে যায়। সেই তুমি—চুপচাপ, রূপহীন, নিরাকার, অভিজ্ঞতাতীত, পরব্রহ্ম।