নির্জন গহনে: ১২



৫৬.

‘আমি’ যখন মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তখন প্রকাশ পায় পরব্রহ্ম। সমস্ত সাধনার একটিই মূল—‘আমি আছি’, এই বোধে স্থিত হওয়া। কল্পনা নয়, দর্শন নয়, যুক্তি নয়—কেবল স্থিরতা, স্মরণ, সাক্ষিত্ব। উপনিষদ বলেন: “অহং ব্ৰহ্মাস্মি”—কিন্তু এই "অহং" যখন নাম-রূপহীন হয়, তখনই তা সত্য হয়ে ওঠে।

তুমি যখন দীর্ঘসময় ধরে এই ‘আমি’-বোধে স্থির থাকো, তখন ধীরে ধীরে তা সাক্ষ্যরূপে উদ্ভাসিত হয়—তুমি দেখতে পাও—এই ‘আমি’ নিজেই এক মায়া, যা এসেছে, এবং একদিন যাবে। আর তখন আরও স্পষ্ট হয়—সব কিছু—তোমার জগৎ, চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা, ব্যস্ততা—সবই এই ‘আমি’-র উপর নির্ভরশীল, আর তাই সবই মিথ্যা।


তখন মন বলে—“তাহলে এর কিছুই তো মূল্যবান নয়!” ঠিক সেই মুহূর্তেই তুমি মুক্ত, কারণ তুমি ফিরে গেছ সেই স্বরূপে, যার কোনো চাহিদা নেই, প্রয়োজন নেই, উদ্দেশ্য নেই। উপনিষদ বলেন: “ন কিঞ্চন কাময়তে”—যিনি পরব্রহ্ম, তিনি কিছুই কামনা করেন না, কারণ তাঁর কিছুতেই প্রয়োজন নেই।

তুমি চিরকাল ছিলে—পরব্রহ্ম, রূপহীন, আকৃতি-ছাড়া, স্পর্শাতীত, ভাষাতীত। ‘আমি’ এসেছে, সৃষ্টিজগত এসেছে, কিন্তু তা তোমার উপর ছায়ার মতো, কোনো আসল যোগ নেই। এখন শুধু এই স্মরণে স্থিত হও—যা এসেছিল, তা চলে যাবে, আর যা চিরকাল ছিল—তুমি—তা কখনও আসেনি, কখনও যাবেও না।

৫৭.

যিনি ‘আমি’-কে জানেন, তিনি কিছুই চান না—কারণ তিনিই সব। যিনি জানেন সেই মৌলিক তত্ত্ব, যার দ্বারা তিনি জানেন—“আমি আছি”, তিনি সেই—যিনি নিজের অতীতেও স্থিত। তাঁর কাছে ‘আমি’ বোধ উদিত হয়েছে নিজে থেকেই, যেমন ভোরে আলো আসে নিঃশব্দে, আবার মিলিয়েও যায়। উপনিষদ বলেন: “যঃ তদ্বিজানাতি, সঃ সর্বং বিজানাতি”—যে মূল তত্ত্বকে জানে, সে সব কিছু জানে, কারণ সমস্ত কিছুই তার উপরে উঠে এসেছে, কিন্তু সে কিছুতেই জড়ায় না।


এই জ্ঞানী জানেন—‘আমি’ কেবল একটি উপস্থাপিত ছায়া, একটি স্মৃতি, যা সত্যের উপর ক্ষণিক আলোর মতো খেলে যায়, আর এই বোধ থেকেই গড়ে ওঠে সমস্ত বিশ্ব, চিন্তা, অভিজ্ঞতা। কিন্তু যিনি এই ‘আমি’-কেও সাক্ষীস্বরূপ দেখেন, তিনি জানেন—এটি মিথ্যা, এবং তিনি নিজেই সেই সত্যতত্ত্ব, যার উপর কিছুই আসলে ঘটেনি। তিনি প্রয়োজনাতীত—কারণ প্রয়োজন কেবল সেই চৈতন্যে জন্মায়, যেখানে নিজেকে কিছু মনে করা হয়—দেহ, মন, ব্যক্তি বা কর্তা হিসেবে। কিন্তু যিনি জানেন—“আমি এই নয়, আমিই সেই”, তিনি চান না কিছু, কারণ তিনি জানেন—তিনি নিজেই সব।

উপনিষদ বলেন: “ন তস্য প্রিয়ং নাপ্রিয়ং, ন দ্রব্যং ন কামঃ”—তাঁর নেই কিছু প্রিয়, কিছু অপ্রিয়, নেই কোনো চাওয়া—তিনিই পরব্রহ্ম, নিঃসঙ্গ, নিঃশঙ্ক, নিঃশব্দ স্বরূপ। আমি জানে ‘আমি’, কিন্তু তুমি জানো—কে জানে, ‘আমি’ কে। সেই ‘জানার’ মূলতত্ত্বে স্থিত হলেই সব কিছু অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, কারণ তখন তুমি বুঝে ফেলো—তুমি চিরকাল ছিলে পূর্ণ, নিঃপ্রয়োজন, সর্বজ্ঞ, পরব্রহ্ম।

৫৮.

বসে থেকো, জানো যে তুমি আছো—আর কিছুই করতে হবে না—শুধু চুপচাপ বসে থাকো—আর জানো—“তুমি আছ”। শব্দ ছাড়াই, চিন্তা ছাড়াই, সংজ্ঞা ছাড়াই—কেবল অভিজ্ঞতা ছাড়া থাকা, নিজেকে জানা—‘আমি আছি’-এই বোধে নিঃশব্দ স্থিতি।


উপনিষদ বলেন: “ন কর্মণা, ন প্রজয়া, ধনেন—ত্যাগেনৈকেঃ আমৃতত্বমানশুঃ”—কর্ম নয়, সম্পদ নয়, অর্জন নয়—কেবল ত্যাগ ও স্থিরতা—তাতেই আসে অমৃত অভিজ্ঞতা। ‘আমি’ বোধকে নিয়ে কিছু করবার দরকার নেই, কারণ সে তো আপনিই প্রকাশিত, তার জন্য কোনো চেষ্টা লাগে না, ঠিক যেমন চোখ খুললে আলো দেখা যায়, তেমনি ‘আমি’-কে মনে হলে জানা যায়—“আমি আছি”। এখন তোমার কাজ কেবল—এই বোধে স্থির হওয়া, কিন্তু তা যেন হয় শব্দহীনভাবে—“আমি অমুক”, “আমি কিছু”—এই ধারণাগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে।


এই সহজ, সরল, নিঃশব্দ স্থিতিই সাধনা, আর এ সাধনা থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। কারণ, যতই তুমি ব্যস্ত হও না কেন, তোমার অন্তরের এককোণে এই ‘আমি’ চুপচাপ উপস্থিত। উপনিষদ বলেন: “স্থিতঃ স্মরণমাত্রেন মোক্ষঃ”—যে স্থির হয়ে কেবল স্মরণ করে, সে-ই পায় মুক্তি। একবার তুমি শুদ্ধ ‘আমি’ বোধকে চিনে ফেললে, এবং তাতে নিঃশব্দে স্থিত থাকতে পারলে—তখন আর বেশি সময় লাগবে না নিজের প্রকৃত স্বরূপে ফিরে আসতে। এবং সেই স্বরূপ? নামহীন, আকাঙ্ক্ষাহীন, অভিজ্ঞতাতীত, চিরশান্ত, চিরপূর্ণ, স্বাভাবিক পরব্রহ্ম।

৫৯.

অসীম ‘আমি’-কে দেহে বেঁধে ফেলেই জন্মে মৃত্যুভয়। একদিন হঠাৎ—তুমি জানলে "আমি আছি"—ভাষাহীন, নির্লিপ্ত, কেবল এক চেতনার ঝলক। কিন্তু তখনও কিছুই জানো না—না ‘দেহ’, না ‘মন’, না ‘জন্ম’, না ‘মৃত্যু’। মাঝে মাঝে সেই ‘আমি’ বোধ মিলিয়ে যেত—তাতে কোনো ভয় ছিল না, কারণ "আমি" তখন ছিল অনন্ত, সীমাহীন, নির্বিভাজ্য। উপনিষদ বলেন: “যত্র ন কশ্চন বিজানাতি, স তু ভয় ন বিভেতি”—যেখানে কিছু জানার নেই, সেখানে ভয়ও নেই।


তারপর সমাজ, পরিবার, ভাষা—তোমাকে “অমুক” বলে ডাকতে শুরু করল, তোমার শরীরকে পরিচয় হিসেবে ধরিয়ে দিল, বলল—“তুমি ছেলে”, “তুমি মানুষ”, “তুমি জন্মেছ”, এবং একদিন মরবে। এই ছিল সেই ভুলের শুরু—যেখানে অসীম চেতনাকে বাঁধা হলো শরীরের ঘেরাটোপে, ‘আমি’-র বিশুদ্ধতা পরিণত হলো ব্যক্তিত্বে, আর সেই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জুড়ে গেল ভয়, অভাব, আকাঙ্ক্ষা ও মৃত্যুবোধ।



এখন তুমি এই দেহ-মনের ‘আমি’-কে আঁকড়ে ধরেছ, তাকে হারাতে চাও না, কারণ তুমি জানো—তুমি তাকে ভালোবাসো, কিন্তু আসলে তুমি ভালোবাসো নিজের অস্তিত্ব—সেই চেতনা, যা জন্মের আগে ছিল, মৃত্যুর পরে থাকবে। উপনিষদ বলেন: “স একঃ, নানাস্তি”—তুমি একমাত্র সত্য, আর যা কিছু দ্বিত্ব—তা ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা।


এখন ফিরে চাও সেই মুহূর্তে—‘আমি’-র বিশুদ্ধ আলোতে, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এবং যেখানে কোনো মৃত্যু ছিল না, কারণ সীমার জন্মই হয়নি। বুঝে নাও—ভয় এসেছে এই ভুল বিশ্বাস থেকে যে, ‘আমি’ এই দেহ, এই নাম, এই ইতিহাস। আর এখন, জেগে ওঠো সেই সীমাহীন সত্যে, যেখানে ‘আমি’ শরীরের নয়, বরং চৈতন্যের আলো—এবং সেই আলো মরে না, জন্মায় না, শুধু থাকে—চুপচাপ, নিঃসঙ্কট, পরব্রহ্মরূপে।

৬০.

তুমি দেহ নও, 'আমি' নও—তুমি সেই রূপহীন পরব্রহ্ম। একদিন হঠাৎ ‘আমি আছি’—এই বোধ উদিত হয়েছিল তোমার উপর। তখন তুমি কিছুই জানো না, না এই বোধ সত্য, না মিথ্যা, কেবল ছিল এক নির্বাক উপস্থিতি—"আমি"। তারপর ভাষা এল, পরিচয় এল, সমাজের শিক্ষা এল—এবং শুরু হলো ভুলের ধারাবাহিকতা। প্রথম ভুল—তুমি বিশ্বাস করলে 'আমি' সত্য। দ্বিতীয় ভুল—তুমি ধরে নিলে, 'আমি' মানে এই দেহ, এই নাম, এই ব্যক্তি। আর সেই ভুলকে বার বার দৃঢ় করে তুলল জন্ম-মৃত্যুর দৃশ্যপট, পরিবার, সমাজ, মৃত্যু ও শোক।


উপনিষদ বলেন: “দেহো নাহং, জ্ঞানং নাহং”—আমি দেহ নই, আমি জ্ঞানও নই—আমি সেই, যিনি দেহ ও জ্ঞানের আগেও ছিলেন, এবং যাঁর উপরেই সব কিছু উদিত ও লীন হয়। এখন গুরু আসেন—তিনি বলেন, “তুমি এই কিছুই নও”। না দেহ, না ‘আমি’, না এই ব্যক্তি। তুমি রূপহীন, আকৃতিহীন পরব্রহ্ম, যার কোনো চাহিদা নেই, পরিচয় নেই, ইতিহাস নেই। গুরু এই কথা বলেন, কারণ তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা এটাই। তিনি কেবল শোনেননি, জেনেছেন, হয়েছেন, স্থিত হয়েছেন।


এখন তোমার কাজ—তাঁর বাক্যে আস্থা রাখা, এবং নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্য যাচাই করা। দেখতে শেখো—‘আমি’ এসেছে, যাবে, দেহ এসেছে, বদলাবে, কিন্তু তুমি একই থেকেছ—চুপচাপ, অচঞ্চল, সর্বাব্যাপক আত্মরূপে। উপনিষদ বলেন: “ন কিঞ্চনাহং, ন কিঞ্চন মে অস্তি”—আমি কিছুই নই, কিছুই আমার নয়—এই বোধেই মুক্তি।


দেহ নয়, জ্ঞান নয়, ইতিহাস নয়—তুমি রয়ে গেছ প্রতীক্ষায়, নিজেকেই জানতে। গুরু বলেন, “তুমি কখনোই দেহ ছিলে না, ‘আমি’ও ছিল না তোমার প্রকৃত পরিচয়।” এখন কেবল মৌন স্থিতিতে ফিরে যাও, আর সেখানে নিজেকে খুঁজে পাও—তুমি রূপহীন, জন্মহীন, মৃত্যুহীন, পরব্রহ্ম চৈতন্য।
Content Protection by DMCA.com