৪৬.
‘আমি’-র বিভ্রমেই ভয়, আর ‘আমি’ নেই তো ভয়েরও অস্তিত্ব নেই। তুমি ভাবো—“আমি এই ব্যক্তি, এই দেহ, এই মন”, “আমি অমুকের ছেলে”, “আমি তমুকের বন্ধু”, “আমার সম্পদ, আমার খ্যাতি, আমার জীবন”। এই ব্যক্তিসত্তা, এই “আমি অমুক”—এই বিশ্বাসই সমস্ত ভয়ের মূল।
উপনিষদ বলেন: “দ্বিতীয়াৎ বৈ ভয়ং ভবতি”—যেখানে দ্বিতীয় আছে, সেখানে ভয় অপরিহার্য। ভয়ের রূপ অনেক—মৃত্যুভয়, দারিদ্র্যভয়, একাকিত্ব, অসম্মান, রোগ, অবজ্ঞা, পরিত্যাগ। প্রতিটি মুহূর্তে নতুন নতুন ভয়ের জন্ম হয়—কারণ ‘আমি ব্যক্তি’...এই ধারণা সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে।
কিন্তু যদি তুমি জানতে পারো—এই ‘আমি’ই মিথ্যা, এই ব্যক্তিসত্তা একটি কল্পনা মাত্র, এই দেহ-মনের ‘আমি’ কেবল ভ্রম—তবে কাকে ঘিরে এই ভয়? ভয় কেবল সেখানে, যেখানে ‘আমি’ মনে করে—“আমার কিছু আছে”, “আমার কিছু হারাবে”, “আমার কিছু ক্ষয়ে যাবে”।
আর যখন তুমি বুঝে ফেলো—তুমি এই ‘আমি’ নও, বরং তুমি সেই, যার উপরে এই ‘আমি’-র ছায়া পড়েছে, তখন ভয় মুছে যায় চিরতরে। উপনিষদ বলেন: “ন চন্যোঅস্তি দ্রষ্টা, ন চ শ্ৰোতা”—নেই দ্বিতীয়, নেই আলাদা দর্শক বা শ্রোতা—আর যেখানে একইমাত্র সত্য, সেখানে কার ভয় কীসের?—যখন ‘আমি’ নেই, তখন হারাবার কেউ নেই, মরার কেউ নেই, ভীত হবার মতো ব্যক্তি নেই। তুমি সেই—যে নিজে মরে না, বদলায় না, হারায় না, যে মৌন চৈতন্যে সমস্ত অভিজ্ঞতা ভেসে ওঠে, আবার মিলিয়ে যায়।
আর সেই চৈতন্যে স্থিত হওয়াই প্রকৃত ভয়মুক্তি—কারণ তখন ভয় পাবার কেউ আর থাকে না।
৪৭.
‘আমি’-তে স্থিতি, ‘আমি’-কে অতিক্রম করে চূড়ান্ত মুক্তি। তুমি দুঃখে আছ, দ্বিধায় আছ, আতঙ্কে আছ—চারপাশের গোলযোগ, ভেতরের অস্থিরতা, অনির্ভরতার ছায়া—সব কিছু থেকে মুক্তি চাও। আর ঠিক তখনই গুরু-র আবির্ভাব ঘটে—হয় মানুষের রূপে, নয়তো বইয়ের শব্দে, ধ্যানের অভ্যন্তরে। তিনি বলেন—“তোমার সমস্ত সমস্যা এই একটি মূলভিত্তির উপর দাঁড়ানো—‘আমি ব্যক্তি’—এই বিশ্বাস।”
উপনিষদ বলেন: “গুরুম্ উপসৃপ্য, শ্রদ্ধয়া, বিদ্যাং অভিগচ্ছেত্”—গুরুর কাছে গিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে, জ্ঞানের পথ গ্রহণ করো। গুরু বলেন—“স্থির হও সেই মূল ধারণায়: ‘আমি আছি’—শব্দহীন, নির্লিপ্ত, নিরাকার এই অস্তিত্ব-চেতনা। সমস্ত নাম, পরিচয়, ইতিহাস ছুড়ে ফেলে কেবল এই এক বোধে স্থিত হও।” আর এই ‘আমি’ বোধে স্থিত হতে হতে এক সময় তুমি নিজেই দেখতে পাবে—এই ‘আমি’ও সত্য নয়। সে-ও এক ধারণা, সময়ের সাথে উদিত ও অপসৃত এক মায়াময় অনুভব।
আর ঠিক সেই অনুধ্যানেই জন্ম নেয় মুক্তি—যখন তুমি বুঝে ফেলো: ‘আমি’ও মিথ্যা, আর যা মিথ্যা, তার কোনো ক্ষমতা নেই তোমাকে বেঁধে রাখার। উপনিষদ বলেন: “অসঙ্গো হ্যায়ং পুরুষঃ”—এই আত্মা আসলে কিছুতেই সংশ্লিষ্ট নয়—সে চিরকাল মুক্ত, নির্লিপ্ত, চিরস্থিত। গুরু তোমাকে দিশা দেখান, কিন্তু পথে হাঁটা তোমার দায়িত্ব। তিনি যা বলেন—তা কোনো পুঁথিগত তথ্য নয়, বরং তাঁর নিজের দেখা, জাগা, আত্মানুভবের শব্দ। আর সেই পথে তুমি যখন ধীরে ধীরে ‘আমি’ ধারণাকেও ফেলে দিতে শেখো, তখন যা থাকে, তা আর কোনো চিন্তা নয়, কোনো নাম নয়—তা হলো তুমি নিজে—পরিবর্তনহীন, পরম, মৌন চৈতন্য।
৪৮.
নিঃশব্দে বসো, ‘আমি’ হয়ে থেকো—শেষে ‘আমি’-ও চলে যাবে। তুমি বহু দূরে চলে এসেছ—সেই আদি ‘আমি’ বোধ থেকে, যা একদিন জন্মেছিল শব্দহীন উপস্থিতির মতো। এখন তুমি আটকে আছ—নাম, পরিচয়, ইতিহাস, চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ, ভয়—এক ধারণার জঙ্গল, যেখানে প্রতিটি গাছেই ঝুলছে ‘আমি’-র কোনো উপাধি।
উপনিষদ বলেন: “আত্মানং বিদ্ধি”—নিজেকে চিনো—নামে নয়, রূপে নয়, অভিজ্ঞতার মূল উৎস হিসেবে। এই উপলব্ধি সাধারণভাবে আসে না, এটি আসে—যাদের হৃদয় সংবেদনশীল, অথবা যারা জীবনের আঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রশ্ন করতে শিখেছে—"আমি কে?", "সব কিছুর অর্থ কী?"—তখনই ঘটে সাধনার সূচনা, তখনই গুরু আসেন—মুখে অথবা মৌনে, বইয়ে অথবা বাস্তবে। আর তিনি বলেন—“সব কিছুর মূল হলো এই ‘আমি’ ধারণা—এটিকে জানো, এটিতেই স্থিত হও, কারণ এই ‘আমি’-র মধ্যেই লুকিয়ে আছে তোমার সমস্ত দুর্ভোগের বীজ।”
এখন তোমার কাজ—চুপচাপ বসে পড়া, মনকে সরিয়ে, দেহকে সরিয়ে, ইতিহাসকে সরিয়ে—শুধু ‘আমি আছি’ এই অনুভবে স্থিত হও। তখন ধীরে ধীরে সমস্ত দুনিয়ার ব্যস্ততা, চাহিদা, উদ্বেগ—বিপ্রতীপ হয়ে যাবে। তুমি কেবল থাকো—‘আমি’ হয়ে, কিন্তু ব্যক্তি না হয়ে। আর যখন তুমি স্থির থাকবে যথেষ্ট সময় ধরে, সততা ও ধৈর্য নিয়ে, তখন নিজে থেকেই এই ‘আমি’ বোধ মুছে যাবে—যেমন শিশির ঝরে পড়ে প্রভাতের রোদে।
উপনিষদ বলেন: “নিশ্চল তৎ ব্ৰহ্ম”—যা সম্পূর্ণ স্থির, চুপ, নিঃশব্দ—সেটাই ব্রহ্ম। যখন ‘আমি’-ও চলে যাবে, তখন আর কিছু থাকবে না—থাকবে না দেহ, মন, পরিচয়, আকাঙ্ক্ষা—কেবল তুমি, সেই নামহীন, অভিজ্ঞতাতীত, অদ্বিতীয় স্বরূপ, যাকে বলে—পরব্রহ্ম। আর সেই অবস্থায় পৌঁছানোর পথ বড়ো কঠিন নয়—গুরু বলেন, কেবল চুপ করে বসো, ‘আমি’ হয়ে থাকো, এবং নিজেই দেখো—কে থাকে শেষ পর্যন্ত।
৪৯.
‘আমি’-তে স্থিত হও, তারপর তাকে অতিক্রম করো। সব কিছু ফেলে দাও—যা ‘আমি’-র সঙ্গে যায় না, যা ‘আমি’-র বাইরে তৈরি হয়েছে—ভাষা, চিন্তা, পরিচয়, ইতিহাস দিয়ে—সব ফেলে শুধু এই অনুভবে স্থির হও—“আমি আছি”।
উপনিষদ বলেন: “তদ্ একং, তস্মাৎ অন্যম্ ত্যজ”—যা একমাত্র সত্য, তাতে স্থিত হও, আর বাকি সব ত্যাগ করো। ‘আমি’ বোধে বার বার ফিরে আসো, ক্লান্ত না হয়ে, বিরতিহীনভাবে, চিন্তা এলেও ফিরিয়ে দাও, স্মৃতি এলেও সরিয়ে দাও, অভ্যাস করো—‘আমি’-তে স্থিতি, নিঃশব্দে, নির্ধারণে, নামহীনভাবে। এই ‘আমি’ যেন এক দেবতা—যিনি প্রথমে আবদ্ধ করেন, কিন্তু যিনি তুষ্ট হলে নিজেই বন্ধন খুলে দেন। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে—যখন তুমি চাও না কিছু, জানো না কিছু, পরিচয়হীন হয়ে থাকো, তখন এই ‘আমি’-ই নিজেই বিলীন হয়ে যায়। আর যা থাকে, তা কেবল তুমি নিজে—পরম, অদ্বিতীয়, অভিজ্ঞতাতীত।
উপনিষদ বলেন: “ন তত্র দর্শীর, ন শ্রোতা, ন জ্ঞাতা”—সেখানে কেউ দর্শক নয়, কেউ শ্রোতা নয়, কেউ জ্ঞাতা নয়—কেবল সত্তা আছে। সাধনা কেবল এই—‘আমি’ বোধে স্থিত হও, ধীরে ধীরে তার গভীরে প্রবেশ করো, আর একদিন, যখন সময় আসে—সে নিজেই হারিয়ে যায়, ঠিক যেমন প্রভাতে মুছে যায় রাত্রির চিহ্ন। আর তখন, তুমি থাকো সেই নিঃশব্দ, নিরুপাধি পরব্রহ্মরূপে, যে কখনও ‘আমি’ ছিল না, তবু যার বুকে সেই ‘আমি’ এসেছিল, এবং মিলিয়েও গেছে।
৫০.
‘আমি’ বোধের কেন্দ্রে স্থিতি, তারও ঊর্ধ্বে উত্তরণ। এই চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একমাত্র একটি অনুভব—“আমি আছি”। এই বোধই চৈতন্যের মূল রস, যেখানে ব্যক্তিত্ব নেই, ইতিহাস নেই, পরিচয়ের কোনো ছায়াও নেই।
উপনিষদ বলেন: “নামরূপাত্মকং জগৎ, তৎ ত্যজ”—নাম ও রূপের জগৎকে ত্যাগ করো, আর স্থিত হও—যা শুধু অস্তিত্বমাত্র, তাতে। এই ‘আমি’—শব্দহীন, নির্জন, শুদ্ধ—সবার ভেতরে একইরকম, যেমন আকাশে বাতাস থাকে, কিন্তু তা আলাদাভাবে ধর্তব্য নয়। এই বোধে কোনো “আমি অমুক”, “আমি এমন” নেই—এখানে কেবল থাকে নিরূপাধি ‘আমি’—যেমন শিশুর প্রথম চেতনা, ভাষার আগেই শুধু জানা—“আমি আছি”।
তাই তোমার সমস্ত সাধনা হোক এই এক স্থানে ফেরার প্রচেষ্টা—‘আমি’-র শুদ্ধ কেন্দ্রে। আর যখন তুমি গভীর আন্তরিকতা ও নিঃস্বার্থভাবে সেখানে স্থিত হতে পারো, তখন সেই ‘আমি’-ও নিজেই হারিয়ে যাবে। তুমি তখন যা খুঁজছিলে, তা পেয়ে যাবে—কিন্তু তা হবে না কোনো অভিজ্ঞতা, না কোনো চিন্তা—তুমি নিজেই হয়ে যাবে সেই অভিজ্ঞতাতীত চৈতন্য।
উপনিষদ বলেন: “স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা?”—যিনি স্থিত চৈতন্যে প্রতিষ্ঠিত, তাঁর বর্ণনা কি আদৌ সম্ভব? গভীর আন্তরিকতা নিয়ে শুধু থেকো, কিছু বোলো না, কিছু ভেবো না, কিছু চেয়ো না—কেবল ‘আমি আছি’, এই মৌন শুদ্ধ বোধে স্থিত হও। আর যখন সময় আসবে, সেই বোধ নিজেই গলে যাবে, আর তুমি রয়ে যাবে—পরিচয়হীন, নিঃশব্দ, নির্বিচার পরব্রহ্মরূপে।