নিয়নের আলোয়

পদার্থবিদ্যার একটা জটিল সমস্যা অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই তার কোনো আগাগোড়া খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সমস্যাটা যে খুব কঠিন, তা-ও নয়; তবে আমাদের সিলেবাস-বহির্ভূত। রশীদুল হাসান স্যারের সেই কথাটাই ভাবছিলাম যে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের মূলকথা মাত্র তিন জন লোক বুঝেছিল। আর আমার সমস্যাটাই আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর।




শেলফের কোনায় একটা মাকড়শা ওঁত পেতে বসে আছে পোকামাকড় ধরার আশায়। দু-তিনটা টিকটিকি বাল্বের আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছে সেই একই আশায়। আমিও সেই ঘোরাঘুরিই করছি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের আশপাশ দিয়ে।




মুঠোফোনের একটানা ক্রিং ক্রিং শব্দে আমার ভাবনার জালটা একঝটকায় ছিঁড়ে গেল।
: হ্যালো! চিকু নাকি?
প্রশ্ন শুনেই টের পেলাম বন্ধু প্রিন্স।
: হ্যাঁ, তোদের তথাকথিত সেই চিকুই বলছি।
ছোট্ট জবাব দিলাম আমি।
: শোন, গতকাল যে-মেয়েদুটোকে আমরা দেখেছিলাম না, ওরা কিন্তু ইডেনে পড়ে। আমি ওদের বাসা পর্যন্ত চিনে এসেছি।
উল্লসিত প্রিন্স চেঁচিয়ে উঠল।
: তা বেশ! আমাদের তাতে লাভ-লোকসান কী?
আমি বোকার মতোই হঠাৎ বলে ফেলি।
: বাব্বারে, তুই দেখছি ভাজামাছ উলটে খেতে জানিস না! তুই আর…শোন, আমি দু-জনের পেছনে লাইন লাগাচ্ছি।
প্রিন্স একটু উষ্ণ গলায়ই বলল।
: আমি খুব বেশি ইন্টারেস্টেড না। তোর যা খুশি করতে পারিস। আমাকে আর এর মধ্যে টানিস না।
আমি ওকে বাধা দিলাম।
: আমার প্রক্সিগুলো তবে দিয়ে দিস। আর কলেজ ছুটির পর তোর গাড়িটা নিয়ে ‘চিত্রা’র সামনে একটু…এই ধর, আধঘণ্টার মতো অপেক্ষা করিস। আচ্ছা, বাই বাই…
ঝটাং করে ও ফোনটা কেটে দিল।




বলতে ভুলে গেছি, আমার কলেজের বন্ধুদের চাপে আমার চিকু নামটাই বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে। আমিও খুব একটা আপত্তি করি না, আর ওরাও ডেকে মজা পায়। আর আমার শারীরিক অবস্থাই তার প্রধান কারণ। ছ-ফুটের, ৮৮ পাউন্ডের একটা মানুষ। রাত্রে যদি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, তবে মানুষ তো অবশ্যই, রাস্তার কুকুরগুলোর পর্যন্ত পিলে চমকে যাবে ভূত ভেবে। সেই আমার নাম চিকু না হয়েই-বা আর কী হবে!




তবে তার জন্য আমি চেষ্টাও কম করিনি। ডাক্তার, কবরেজ, হেকিম, ফকির, দরবেশ কিছুই বাদ দিইনি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তাই শেষমেশ ভাবলাম, শরীরের স্বাস্থ্য যা হবার তা এমনিতেই হবে। অগত্যা, মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য বাড়ানোর জন্য লেগে গেলাম।




কিছু কিছু গল্প লিখি বলে বন্ধুমহলে একটু দুর্নামও আছে। প্রেমঘটিত কোনো সমস্যায় পড়লেই বন্ধুরা দৌড়ে আসে। আবার প্রক্সির জন্যও চিকু। তাই চিকুর এত জনপ্রিয়তা।




প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস শেষ করে বেরুতে বেরুতে প্রায় তিনটা বেজে গেল। বেরিয়ে দেখি, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। বললাম ‘চিত্রা’র সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। আমি চোখ বুজে ভাবছিলাম একটু আগে শেষ-করা পরীক্ষাগুলোর কথা।




: এখানেই রাখব, ভাইয়া?




ড্রাইভারের কথায় সচকিত হয়ে উঠলাম। গাড়ি ততক্ষণে ‘চিত্রা’র পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথার ওপর তপ্ত সূর্য। গাড়ির ছাদ ভেদ করে যেন সূর্য এসে মাথায় লাগছে। তা ছাড়া থ্রি-ডোরের এই পুরোনো জিপগুলো এমনিতেই খুব একটা আরামদায়ক নয়। গাড়িতে বসে বসে ঘামছি। আধঘণ্টার জায়গায় এক ঘণ্টা কেটে গেল, প্রিন্সের দেখা নেই। এমন সময় ও পেছন দিয়ে এসে হাজির। দরজা খুলে দিলাম। আর ড্রাইভারকে বললাম বাসার দিকে যেতে।




: আর বলিস না! সহজে চিড়ে ভিজবে বলে মনে হচ্ছে না। একেবারে জ্বালিয়ে মারল।




একনিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে ও থামল।




: তোকে ঘোল খাইয়েই ছাড়বে।




আমি জবাব দিই।




: এত সহজে না। আমি কম কীসে? সামনের ওই মোড়টায় আমাকে নামিয়ে দে। একটু পরে ওরা এখান দিয়েই যাবে।




প্রিন্স চড়া গলায় বলে উঠল। ওকে নামিয়ে দিলাম।




প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের মতো হল প্রিন্সের কোনো খোঁজখবর নেই। ওর প্রক্সিগুলো নিয়মিত দিয়েই চলেছি। ভাবছি, ফোন করব। ক্লাস শেষ করে বেরিয়েই দেখি, প্রিন্স দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই ও চেঁচিয়ে উঠল, “কেল্লাফতে!” তারপর 'জাওয়ান'-এর দুটো টিকিট পকেট থেকে বের করে আমার নাকের দু-আঙুল ওপর দিয়ে নেড়ে চলে গেল। আমার আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না।




গাড়ি নিয়ে বেইলি রোডের প্রায় শেষমাথায় এসেছি। হঠাৎ দেখি, রাস্তার উপর ভীষণ জটলা। ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি থামাতে। নেমে ভিড় ঠেলে দেখি, একটা রিকশা উলটে পড়ে আছে। পাশেই একটা (স্কুল কি কলেজের, তা বুঝতে পারিনি) মেয়ে বেশ আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। রিকশাওয়ালাও বেশ আহত। লোকমুখে শুনলাম, একটা সিএনজি নাকি ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে।




ভিড়ের মধ্যে অনেকেই নানারকম প্রিয়-অপ্রিয় মন্তব্য করছে, কিন্তু কেউই ওদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। রিকশাওয়ালার ভার কয়েক জন লোকের উপর ছেড়ে দিলাম। তারপর ড্রাইভারের সাহায্যে ধরাধরি করে ওকে গাড়িতে তুললাম। গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে আবার রওনা দিলাম। পিজি হাসপাতালে পৌঁছে তাড়াতাড়ি ওকে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার নার্সকে বললেন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে। নার্স ওকে নিয়ে গেল। ওর ব্যাগগুলো তখনও আমার হাতে। নাম, ঠিকানা, ফোননম্বর সবই পেলাম। স্কুলের শেষতম ক্লাসের ছাত্রী ওদের বাসায় ফোন করলাম হাসপাতালে বসেই।




একটু পরেই ক্রন্দনরত অবস্থায় ওর আব্বা-আম্মা এসে উপস্থিত হলেন। ওর আব্বা বার বার বলতে লাগলেন, “বাবা, তুমি না থাকলে আজ ওর যে কী হতো, তা এক আল্লাহ‌ই জানেন!” ওর আব্বা চলে গেছেন ওর জন্য কেবিন ঠিক করতে। ওর আম্মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কী করি, কোথায় থাকি, ইত্যাদি। অপারেশন রুমের বাইরে আমরা বসে আছি। প্রায় আধঘণ্টার মতো লাগল অপারেশন শেষ হতে। নার্স ট্রলিতে করে ওকে নিয়ে বেরিয়ে এল। ডাক্তার বললেন, আঘাত বেশি গুরুতর হয়নি, কেবল কয়েকটা স্টিচ দিতে হয়েছে।




ওর জ্ঞান এখনও ফেরেনি। ওর তুষারশুভ্র মুখমণ্ডলের ওপর জমে-থাকা ঘামের ছোটো ছোটো বিন্দু নিয়নের উজ্জ্বল আলোতে পড়ে আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। ওর আম্মাকে আমার ফোননম্বর দিয়ে বললাম, “কেমন থাকে রাতে, একটু জানাবেন। আমি এখন যাচ্ছি। বেশি রাত হলে মা টেনশন করবেন।”




হাসপাতাল থেকে যখন বেরুলাম, তখন রাত খুব একটা হয়নি। রাস্তার নিয়নবাতিগুলোর চারদিক ঝলমল করছিল। বিজ্ঞাপনগুলো জ্বলছে আর নিভছে… এলজি এসি, টিভি, ফ্রিজ…আমার চোখদুটো যেন তখনও ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালের অপারেশন রুমের সামনে ওর তুষারশুভ্র মুখমণ্ডলের ওপর পড়া নিয়নের আলোয়।




আইনস্টাইনের সূত্রানুসারে, ই ইজ ইক্যুয়াল টু এমসি স্কয়ার। তাহলে অবশ্যই (আমার মতে) ভালোলাগা দিনশেষে ভালোবাসাই। সাঁ সাঁ শব্দে গাড়ি ছুটে চলেছে বাসার দিকে। আমি প্লেয়ারটা চালিয়ে দিলাম। মান্না দে গেয়ে উঠলেন, ও কেন এত সুন্দরী হলো/অমনি করে ফিরে তাকাল.../দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই,/আমি তো মানুষ…
Content Protection by DMCA.com