‘না’ বলতে শেখা

 যে দায়িত্বটি পালন করতে পারবেন না, সে দায়িত্ব কখনও কাঁধে নেবেন না।
 যে কথাটি রাখতে পারবেন না, সে কথা কখনও কাউকে দেবেন না।
 যে হাতটি ধরে রাখতে পারবেন না, সে হাত কখনও প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ধরবেন না।
 যাকে ভালোবাসতে পারেননি, তাকে কখনও ‘ভালোবাসি’ শব্দটি বলবেন না।
 যে টাকাটা ফেরত দিতে পারবেন না, সে টাকা কখনও ধার নেবেন না।
  
 কমিটমেন্ট অনেক বড়ো ব্যাপার। যার মধ্যে ন্যূনতমও আত্মসম্মানবোধ আছে, সে কখনও কমিটমেন্ট ভাঙে না। যা আপনার কাছে একটি শব্দ কিংবা বাক্য কেবলই, হয়তো তা-ই কারও কাছে তার পুরোটা জীবন! বাটপারি, জোচ্চুরি, ছোটোলোকি সবাই করতে পারে না, তাই সবাই তা ধরতেও পারে না। সবার চরিত্রে আপনার মতো ওসব দিক না-ও থাকতে পারে। যাদের মনমানসিকতায় ওসব নেই, তারা ওসবে অভ্যস্ত নয়। অভ্যস্ত নয় বলেই আপনার ওই পর্যায়ের বেহায়াপনা তাদের জীবনে দুঃখ ডেকে আনে।
  
 কেন, জানেন? যে লোকটা আপনার উপর আস্থা রেখে আজ কোনও একটা সিদ্ধান্তে আসছে, সে সত্যিই আজ বুঝতে পারে না, এমনকী অনুমান পর্যন্ত করতে পারে না যে আপনি এতটা ফালতু একটা লোক। ফালতু যদি হন, তবে অনুগ্রহ করে শুধুই ফালতুদের সাথে চলুন। ফালতু হয়ে বাঁচুন, ফালতু হয়েই মরুন। এর চাইতে বেশি কিছু আপনি ডিজার্ভ করেন না। হয়তো আপনার বাড়ি-গাড়ি, প্রতিপত্তি, মেধা সবই আছে, তবু আপনি সে লোকটার চোখে ঘৃণ্য, জঘন্য, নর্দমার কীটসম, যে আপনার জন্য বিনা দোষে কষ্ট পাচ্ছে। আপনি পুরো পৃথিবীর সামনে মাথা উঁচু করে বাঁচলেও সে লোকটার সামনে থেকে আপনাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়। এরকম করে কারা বাঁচে, জানেন তো? কারা আবার! চোরের দল বাঁচে! এরকম চোরছ্যাঁচড় হয়ে বেঁচে থেকে লাভ আছে? আপনার বিবেচনায় লাভ আছে হয়তো! থাকে যদি, তবে কেবল চোরদের সাথেই ওরকম করে বাঁচুন।
  
 যে ওয়াদা ভেঙে ফেলে, তার সাথে একজন খুনির মনোগত পার্থক্য সামান্যই। প্রচলিত আইনে শরীর খুন করার শাস্তি হয়, মন খুন করার কোনও শাস্তি হয় না। এইটুকুই পার্থক্য। গোটা পৃথিবীকে জয় করে ফেললেও কী লাভ হবে যদি কারও কাছে সারাজীবনের জন্য হেরে বসে থাকেন? সে বাঁচার কী মানে যেভাবে বাঁচলে কারও সামনে চোরের মতন করে বাঁচতে হয়? আপনি কতটা ভালো মানুষ, তা নির্ভর করে আপনি কতটা প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেন, তার উপর। যতক্ষণ নিজের শেষ সম্বলটি সঙ্গে আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত একজন ভালো মানুষ কিছুতেই ওয়াদা ভাঙে না। সফল হওয়ার চাইতে অনেক বেশি জরুরি ভালো হওয়া।
  
 প্রকৃতির বিচার বোঝেন তো? বোঝেন না? অপেক্ষা করুন, নিজের জীবন থেকেই বুঝতে পারবেন। না কি বোঝেন ঠিকই, কিন্তু মানেন না? ভালো! নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অপেক্ষায় থাকুন, প্রকৃতি প্রতিটি মানুষকেই তার কৃতকর্মের ফল পেতে বাধ্য করে। হ্যাঁ, করেই করে! আরেকজন মানুষের জীবন অন্যায়ভাবে বিপন্ন করে দেওয়ার শাস্তি আপনি জীবিতাবস্থাতেই পেয়ে যাবেন। প্রকৃতির হিসেবে কখনও কোনও ভুল হয় না। ওয়েট অ্যান্ড সি!
  
 চরিত্র জিনিসটাকে আমরা অনেকে হাস্যকরভাবে শুধুই প্রজননযন্ত্রের একমুখিতা দিয়ে বিচার করলেও এখানে আরও অনেক কিছুই জড়িত থাকে। কথায় ও কাজে মিল নেই যার, তার সমস্ত ধার্মিকতা, সাফল্য, অর্জন, দক্ষতা, জ্ঞান, প্রতিষ্ঠা, একগামিতা ইত্যাদি মিলেও তাকে ভালো চরিত্রের সার্টিফিকেট দিতে পারে না। ওয়াদা ভেঙে ফেলে যে, তার চাইতে চরিত্রহীন লোক আর হয় না। চরিত্র নিয়ে অনেক চরিত্রহীন লোককে বিভিন্ন জায়গায় বড়ো বড়ো কথা বলে বেড়াতে দেখি। সত্যিই করুণা হয় ওদের জন্য। ওদের দেখি আর বিস্ময়ে ভাবি, এতটা নির্লজ্জ হয়েও বাঁচা যায়!
  
 মুখের উপর ‘না’ বলতে শিখুন। যেখানে-সেখানে বুঝে না বুঝে ‘হ্যাঁ’ বলে দেবেন না। ভালো না বেসেও ‘ভালোবাসি’ বলাটাকে ভালোবাসা বলে না, লাম্পট্য বলে। মন না ছুঁয়েও মনছোঁয়ার মিথ্যে দোহাইয়ে শরীরছোঁয়াকে ভিক্ষাবৃত্তি বলে। কী বাজে একটা জীবন ওসব ফালতু লোকের! অট্টালিকায় বাস করে, অথচ সারাজীবনই ভিক্ষা করে চলে! পুরো দুনিয়ার চোখে রাজা হয়ে বাঁচে, অথচ একটা মানুষের চোখের সামনে থেকে ছিঁচকে-চোরের মতো পালায়! থুঃ!
  
 যে মানুষ---মুখের উপর সরাসরি ‘না’ বলতে পারে; যে ওয়াদা রাখতে পারবে না, যত সমস্যাই হোক না কেন, সে ওয়াদা কখনও দেয় না; যাকে ভালোবাসে না, সে কষ্ট পাবে জেনেও তাকে সরাসরি কোনও ভণিতা না করে ‘ভালোবাসি না’ বলতে পারে; যে সময়ের মধ্যে টাকাটা ফেরত দিতে পারবে না, সে সময়ে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা ধার নেয় না---সে মানুষই প্রকৃত মানুষ। বাকিরা মানুষের মুখোশে এক-একটি সাক্ষাৎ শয়তান, জ্যান্ত অমানুষ।
  
 বিএমডব্লিউ-হাঁকানো ওরকম এক-শো ফালতু লোক মিলেও মানমর্যাদায় সেই বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা চাচার একটি ছেঁড়া-স্যান্ডেলের ফিতের সমানও হতে পারবে না, যে চাচাটির কথায় ও কাজে পুরোপুরি মিল আছে। কেউ মানুষের অবয়ব ধারণ করে বাঁচলেই মানুষ হয়ে যায় না। মানুষ তার কর্মের কারণেই কারও কারও চোখে অমানুষ হয়ে বাঁচে। ওরকম অমানুষদের বড়ো বড়ো কথা বলতে দেখলে ওদের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে! ওরা রাস্তার কুকুরের লাথিরও যোগ্য না!
  
 যত কষ্টই হোক, স্পষ্ট উচ্চারণে ‘না’ বলতে শিখুন। ‘না’ সবাই বলতে পারে না, এটা বলতে পারার জন্য মনের শক্তি ও সততা দুই-ই লাগে। দুর্বল ও দুশ্চরিত্র যারা, ওরাই সবখানে মন জুগিয়ে চলতে ‘হ্যাঁ’ বলে যায়। সবাইকে খুশি করে চলে যে, সে লোকের কাছ থেকে খুব সাবধান থাকতে হয়। ‘না’ বলতে জানলে সাময়িক তিরস্কারের শিকার হলেও শেষ স্যালুটটা আপনিই পাবেন, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। না পারলে ‘পারব না’ বলুন, না বুঝলে 'বুঝি না' বলুন, না জানলে ‘জানি না’ বলুন, না করলে ‘করব না’ বলুন। সোজা হিসেব তো! এটি রকেট সায়েন্স নয় যে বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা!
  
 ‘না’ নিছকই কোনও শব্দ নয়; ‘না’ হচ্ছে সৎচরিত্রের প্রকাশ, ওয়াদারক্ষার শক্তি, আত্মসম্মানবোধের মাপকাঠি, মানুষের বিশ্বাস ও ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন, অসীম নির্ভরতার প্রতীক, মাথা উঁচু করে বাঁচবার একটি প্রধান শর্ত। মাত্র এক-অক্ষরের এই শব্দটি দায়িত্ব নিয়ে উচ্চারণ করতে এক-পৃথিবীসমান শক্তির প্রয়োজন হয়, যা সবার থাকে না। কাউকে খুশি করবার চাইতে অনেক বেশি জরুরি হলো তার চোখে আমৃত্যুই সম্মানিত হয়ে বাঁচা। 
Content Protection by DMCA.com