আমাদের বাড়িটা নব্বইয়ের দশকের; বর্তমানের আধুনিক বাড়িগুলোর সাথে তুলনা করলে একটু মান্ধাতা আমলের তো বটেই। তবু এই বাড়ির প্রতিটা কোনায় আমি ব্যথাজাতীয় একধরনের সুখ খুঁজে পাই।
আমার বারান্দাসংলগ্ন ছোট্ট একটা ছাদ আছে, ওখানে আগে আমাদের বড়ো একটা বাগান ছিল। আমাদের বাড়িটা লোকজনেরা চিনত বাগানবাড়ি নামে। তখন এলাকাটাতেও এত লোকারণ্য ছিল না। পরবর্তীতে জমিসংক্রান্ত ঝামেলা এড়ানোর জন্যে বাগানটা নষ্ট করে ছোটো আরেকটা বাড়ি তোলা হয়, যার ছাদের কিছু অংশ আমার বারান্দা ঘেঁষে রয়েছে।
ছাদে আম্মু অনেক ধরনের গাছ লাগিয়েছে। আমাদের সকলেরই বৃক্ষরোপণ-প্রেম আছে। বাগানটা ছিল দখিনদিকে। আমার বারান্দা দিয়ে একটা লোহার সিঁড়ি আছে। বাগানে যাবার জন্যই সিঁড়িটা লাগানো হয়েছিল। যখন বাগান ছিল, তখন আব্বু প্রতিশীতে আমার আর আপুনির জন্যে ফুলের চারা লাগানোর বেড তৈরি করে দিত। স্কুলে থাকা অবস্থায়ই আমি প্রতিমাসে প্রচুর গাছ কিনতাম। এখনও কিনি, তবে প্রতিমাসে নয়, কারণ গাছ লাগানোর জায়গাই যে নেই!
ফুলের বেড তৈরি হয়ে যাবার পর সেখানে কত রঙের ফুল গাছ যে লাগাতাম! আর শীতকাল তো এমনিতেও ফুলেল ঋতু। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, ক্যালেন্ডুলা, জিনিয়া, ফ্লকস, অনেক রঙের কসমস, কেয়া, গাঁদা, ইনকা এরকম আরও কত কী যে বুনতাম...! আব্বু-আম্মু সবজি আর ফলের গাছ লাগাত। আমাদের বাগানের চারপাশ ঘিরে লেবু আর পেয়ারা গাছ ছিল। শুধু লেবু গাছই ছিল ৩৫টা আর পেয়ারা গাছ ছিল ২৬টা। বিকেল হলেই দখিনের সিঁড়ি বেয়ে সবাই নেমে যেতাম, যার যার বৃক্ষে সে সে পানিসেচ দিতাম; তারপর আব্বু, আমি আর আপুনি মিলে ব্যাডমিন্টন খেলতাম।
কখনও আম্মু হয়তো একটা লাউচারা লাগিয়েছে, আব্বু সেটা অতি যত্ন করতে গিয়ে গাছের গোড়ায় কাঁচা গোবর দিয়ে মেরে ফেলত, আর আম্মু শুরু করে দিত চিল্লাপাল্লা। ওসব দেখে আমরা হেসে খুন হতাম, আর আব্বু মিটিমিটি হাসত, তবু ভুল স্বীকার করত না, আম্মু আরও ক্ষেপে যেত! শুধু ভুল স্বীকার করলেই মেয়েরা অনেক শান্ত হয়ে যায়, ছেলেরা এই সহজ জিনিসটা বুঝতেই চায় না।
সকালে প্রাতঃভ্রমণের সময় আমরা যেন দ্রুত হাঁটি, তাই আব্বু বলত, দেখি তো, ওই-ই পর্যন্ত কে আগে যেতে পারে! বাসায় ফিরে এসে নাশতা করে স্কুলে যেতে হত এবং নাশতায় অবশ্যই দুর্গন্ধযুক্ত ফল কলা থাকত। আপুনি মজায় মজায় খেয়ে ফেলত, কারণ ও কলা পছন্দ করত। আর আমাকে বলা হতো, কলা না খেলে স্কুলে যেতে দেওয়া হবে না। আমি তখন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতাম আর কলা খেতাম, কারণ জীবন চলে গেলেও স্কুল মিস দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না। রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস দুধ খেতে হতো, নইলে আব্বু চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখত। ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে খেয়ে ফেলতাম।
আপুনির বিয়ে হয়ে যাবার পর মানসিকভাবে একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল ও। অবচেতন মনে হয়তো ওগুলো নিয়েই ভাবতাম, ওকে মিস করতাম, কিন্তু চেতনমনে সেটা বোঝার মতো ম্যাচিউরিটি ছিল না তখন। রাত জাগতাম, ঘুমুতে পারতাম না; ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল। ধীরে ধীরে আমার নিউরোসমস্যা দেখা দিল।
আজ প্রায় ৯ বছর হতে চলল, ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্থির,শান্ত মেয়েটা আজ অস্থির, অশান্ত তিনটা বাবুর আম্মু। হা হা হা হা... মেয়েরা কখন যেন হঠাৎ করেই মেয়ে থেকে মা হয়ে যায়!
আজ ও পাকা গৃহিণী, মমতাময়ী মা, গুণবতী আদর্শ স্ত্রী। আমি ওকে হারিয়ে ফেলেছি অনেকগুলো 'যদি আর কিন্তু'র ভিতরে।
মাঝে মাঝে ভোরবেলায় কিংবা পড়ন্ত বিকেলে ছাদের এক কোনায় গিয়ে বসে থাকি। আজও বিকেলে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম, বাসায় কেউ ছিল না। এখনও দখিনা বাতাস চুলে খেলা করে যায়, কিন্তু প্রাণহীন সে বাতাসে কোনও এক বিরহব্যথা বেজে চলে। মানুষ সবকিছু হারাতে হারাতে একসময় স্থির হয়ে যায়।
হায়! সময় কতই-না দ্রুত ফুরিয়ে যায়... মনে হয়, এই তো সেদিন! সব কিছু অদৃশ্য হয়ে গিয়ে আজও চোখের সামনে ভাসছে। ওই তো অস্থির-অশান্ত জুঁই আর স্থিরশান্ত কেয়া ফুলগাছে পানি দিচ্ছে, ব্যাডমিন্টন খেলছে, পেয়ারা চিবুচ্ছে...