ধূসরিমা

পুবের জানালাটা খুলে দিলে বড়ো রাস্তার অনেকটা চোখে পড়ে। মোড়ের আইল্যান্ডের ওপর কৃষ্ণচূড়া গাছটা ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে। গাছটায় যখন প্রাণ আসে, লাল আর সবুজ, সীমা তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে জানালার পাশে। কৃষ্ণচূড়ার লালফুল, রং-বেরঙের গাড়ির ছুটোছুটি আর বিচিত্র পোশাক-পরা মানুষের ব্যস্ততা দেখে দেখে বিকেলের নিঃসঙ্গ সময়টা ভালোই কাটে ওর। যখন বিধবার সাজ পরে, ও আর জানালার পাশে বসে না তখন। গাছটার মতো ওর মনের সব সবুজও ধূসর আর মলিন হয়ে আসে।

গাছটায় এখন পাতা নেই, ফুল নেই। কতগুলো মৃতপ্রায় ডালপালা ছড়িয়ে দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। সীমা এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখে। পুবের জানালাটা খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না আর। মা হয়তো এখনই গরম দুধ নিয়ে আসবে। মাকে কত বার বলেছে যে, দুধ খেয়ে তার কিচ্ছু হবে না। তবুও মাকে গ্লাস হাতে নিয়ে আসতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “আমি বাঁচব না, তা তো জানিই, তোমরাও জানো। মিছেমিছি কেন তোমরা সবাই আমার জন্য এত কষ্টভোগ করছ? ডাক্তার তোমাদের মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছে।”

মা হাসেন এসব শুনে, আর বলেন, “পাগলি মেয়ে, কে বলেছে, তুই বাঁচবিনে? আজকাল এ রোগ তো হরহামেশাই হচ্ছে। আগে মানুষ মরত, এ রোগের কোনো ওষুধ ছিল না বলে। এখন তেমন আর ভয় নেই। দেখলি না মিনির বড়ো মামা কেমন মরে মরেও বেঁচে উঠলেন যক্ষার কবল থেকে?” সীমার সামনে সান্ত্বনামূলক এসব কথা হেসে হেসে বললেও সালেহা বেগমের বুক কেঁপে ওঠে থেকে থেকে। চোখে পানি আসে।

প্রথম প্রথম সীমার ভীষণ খারাপ লাগত সারাদিন শুয়ে থাকতে। চুপি চুপি দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াত। কোনো কোনোদিন নেমে যেত উঠোনে, তারপর বাগানে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে। মা দেখতে পেলে রক্ষে নেই—ধীরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেবেন। ডাক্তারকেও গালাগালি করত মনে মনে। এখন আর তত খারাপ লাগে না। সারাদিন-রাত শুধু শুয়ে শুয়ে থাকে। আর ভাবে, কতদিন নিচে যাইনি, বাগানে যাইনি। কয়েক মাস তো হবেই। খুব অবাক লাগে ওর। এতদিন নিচে না নেমে শুধু এ ঘরে কাটাল কী করে!

রাতে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখে ওর ঘুম ভেঙে গেল। কবরের মাটি খুঁড়ে একটা নতুন কবর থেকে লাশ টেনে তুলছে তিনটে শেয়াল। তারপর কাফনের কাপড়টা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল। একটা শকুনের বাচ্চা অবিকল ছোটো ছেলেদের মতো কাঁদতে লাগল গাছে বসে। দুটো শকুন নেমে এল লাশটার ওপর। তারপর পাঁচটা প্রাণীই আস্তে আস্তে লাশটার মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল। বিছানায় বসে আলো জ্বালল সীমা। স্বপ্নটার কোনো অর্থ খুঁজে পেল না সে। ভীষণ ভয় পেল মনে মনে। ঘুমুতে চেষ্টা করেও ঘুম এল না। চোখ বুজলেই স্বপ্নের দৃশ্যটা হুবহু ভেসে ওঠে। বাকি রাত আর ঘুম হলো না।

সকালে কাউকেই বলল না সে স্বপ্নের কথা। একসময় ও নিজেই ভুলে গেল। রাতে আবার জেগে উঠল আগের রাতের সেই স্বপ্নটা দেখে। বাতি জ্বালল। জগ থেকে পানি ঢেলে খেলো এক গ্লাস। আস্তে আস্তে উঠে খোলা জানালাটা ভালো করে লাগিয়ে দিল। দরজাটা দেখল একবার। তারপর আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। ঘুম এল না আর। জেগে কাটাল সারারাত। এরকম হলো পরের দিনও। ও ভয় পেল খুব।

অবাকও হলো ভীষণ। কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছে না, কেন এমন হলো! হঠাৎ করেই মনে হলো, ও কি তবে বাঁচবে না আর? এ স্বপ্ন কি তারই পূর্বাভাস!

স্বপ্নটার আগাগোড়া বলল মাকে। “স্বপ্ন স্বপ্নই। ও কখনো সত্যি হয় নাকি? বোকা মেয়ে। এসব নিয়ে মন খাবাপ করিস না। ধর, দুধ নিয়ে এসেছি। চটপট খেয়ে নে।” হেসে বললেও সালেহা বেগমের বুক কাঁপতে লাগল। গলাটা শুকিয়ে এল। উনি বড়োদের কাছে শুনেছেন, অমঙ্গলের চিহ্ন নাকি অনেকে স্বপ্নে আগেই জানতে পারে। নাস্তার পর একান্তে স্বামীকে জানালেন সব। রহমান সাহেব এসব হেসে উড়িয়ে দিলেন। তারপর সীমার কাছে এসে বললেন, “সীমু, মা আমার, স্বপ্নে নাকি তুমি কীসব দেখেছ? ওসব কিচ্ছু না। তুমি মন খারাপ কোরো না যেন!” তিনি বেরিয়ে যান।

এমনিভাবে আরও কয়েক দিন কাটে একই ধরনের স্বপ্ন দেখে। আজকাল চোখ বুজলেই শুধু সাদা কাফনে জড়ানো লাশের ছবি ভাসে সীমার চোখে। খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম এল। ওর চোখের কোণে যেন কালি। চুল উসকো-খুসকো। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। শুধু চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। মা বকেন, আবার আদরও করেন। কিন্তু কোনো পরিবর্তনই আসে না। নীরবে কাঁদেন সালেহা বেগম। স্বামীকে বলেন একটা-কিছু করতে।

ক-দিনের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে সীমার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে শুরু করল। বুকের ব্যথাটা বাড়ল। কাশির সাথে সাথে রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল আগের চেয়ে বেশি। ভয় পেলেন সবাই। ডাক্তারও ভয় পেয়ে গেলেন। রোগীকে আয়ত্তের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করলেন প্রাণপণে। কিন্তু সব কিছু যেন খারাপের দিকেই যেতে লাগল। ডাক্তার নিরুপায় হয়ে বললেন বিদেশে কোথাও নিয়ে যেতে। আরও ভালো চিকিৎসা ও চেঞ্জের দরকার, যা একমাত্র বিদেশেই সম্ভব। সীমা দেশ ছাড়তে রাজি হলো না কিছুতেই। বাবা বোঝালেন, মা বোঝালেন, ডাক্তার বললেন। শেষ পর্যন্ত রাজি হলো সে। যাবার বেলায় মা ও মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে কান্নাকাটি করল। তারপর তিনি সীমাকে চুমু দিয়ে বিদায় দিলেন।

পাঁচ দিন পরেই ফিরে এলেন রহমান সাহেব সীমাকে নিয়ে। সাদা চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে সীমা কফিনে। আজ আর মায়ের গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় বলল না ও, “আমি আর দুধ খাব না, মা।”
Content Protection by DMCA.com