ধাক্কা

সবারই নিজের একটা মানুষ থাকে।

সকালে ঘুম ভেঙে প্রথম তার মেসেজের টুং-শব্দে আড়মোড়া ভাঙে। তার মেসেজেই যেন সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা রাত…সব শুভ হয়ে ওঠে!

সকালে কী হলো, দুপুরে কী খেল, রাতে কী ঘটল, সবই যেন রীতিমতো নিয়ম করে মানুষটাকে বলা লাগে! একলা-খাওয়া বিরিয়ানির চাইতে বরং শেয়ার-করে-খাওয়া পান্তাভাত‌ই অনেক বেশি সুস্বাদু।

সারাদিন, রুমে-আটকানো ঘড়ির মতন, একটা মানুষ কারও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্যালেন্ডার হয়ে যায়। রুটিন মেপে সুখগুলি তার সাথে ভাগ করে দ্বিগুণ করা হয়, আর দুঃখরা অর্ধেক হয়ে যায় তার সাথে ভাগাভাগির পর। একা একা সুখী হবার চেয়ে কারও সাথে দুঃখী হ‌ওয়াও ভালো।

যত আজেবাজে আর অকেজো কথার স্তূপ, তা কেবলই ওই মানুষটাকে বলার জন্য জমা হয়। যত অ্যাডাল্ট জোক কিংবা সব মিনিংলেস মিম…সবার আগে বা কেবল তাকেই পাঠানো হয়। মানুষের কত কিছুই তো পাঠাতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পাঠানোর মানুষ ক‌ই!

আজ সারাদিন কী হলো, আগামীকাল সারাদিন কী ঘটবে, তার সবই বুকে জমা হয়ে থাকে—মানুষটাকে সব বলাই লাগে।

মানুষটা হয়ে ওঠে প্রতিদিনের ডায়েরি।

একটা অলিখিত সংসার, একটা বেনামি ঘরকন্না। এভাবেই কেটে যায় দিনদিন প্রতিদিন।

তারপর একদিন . . .

তারপর একদিন কী যেন হয়, আকাশের ঘন নীল রঙের গায়ে গাঢ় করে কালো দাগ লেগে যায়।

প্রতিদিনের অভ্যেস হয়ে-যাওয়া ডায়েরির পাতা থেকে শব্দ ক্রমশ বিলীন হতে থাকে।
হঠাৎ করেই মানুষটা কেমন জানি বদলে যায়।

কাঁধের উপর হেলান দিয়ে রাখা কাঁধটা হঠাৎ করেই সরে যায়। এই সরে যাওয়ায় হেলিয়ে-রাখা মাথাটায় হঠাৎ জোরে টান পড়ে। মাথা ঢুলে পড়ে যায় শূন্যে।

আমরা দিকবিদিক হারাই, হন্যে হয়ে কাঁধটা খুঁজি, তন্নতন্ন করে ডায়েরির পাতাগুলো খুঁজি। তবু কোথাও যেন কেউ নেই।

প্রতিদিনের অভ্যেস-হওয়া মানুষটার ধাক্কা সামলাতে আমাদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তাকে ছাড়া সকাল ফুটতে চায় না, দুপুর গড়াতে চায় না, রাত ফুরোতে চায় না। প্রতিটা মুহূর্তেই সে মানুষটা যেন ছায়ার মতন কামড়ে ধরে রাখে মগজের ইঞ্চি ইঞ্চি। তাকে সরানো যায় না, ভোলাও যায় না, আবার তাকে আগের মতন খুঁজেও পাওয়া যায় না।

যাকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যায় না, কেবলই তাকে খুঁজে পাওয়ার চেয়ে কষ্টের আর কী আছে!

তোমার সাথে আমার যাবে না, আমাদের মেনে নেবে না ফ্যামিলি…এমন‌ অনেক অজুহাতে চাপা পড়ে মরে পচে গলে যায় কিছু টাটকা আবেগ। এভাবে একদিন আমরা হাসতে ভুলে যাই, কাঁদতে ভুলে যাই। সবাই বাঁচে না, কারও কারও শুধু আয়ু ফুরোয়।

কিছু মানুষ—মানুষ নয়, টাটকা আবেগ।

তবু একসময় তাকে ছাড়াও বাঁচতে শিখে যাই। তারপর আমাদের জীবনে তার মতন তীব্র একটা আবেগ হয়ে কেউই আর জড়াতে পারে না। কেউ সত্যি করে আসতে চাইলেও, কঠিন করে ভালোবাসতে চাইলেও আমরা কিছুতেই তাকে ভেতর থেকে গ্রহণ করতে পারি না। মানুষ তো কত‌ই পাওয়া যায়, কিন্তু ভরসা করতে পারার মতন মানুষ পাওয়া বড়ো কঠিন।

এভাবেই একদিন সেই কবে কোন ভরদুপুরে মানুষটা…"তোমার সাথে থাকা সম্ভব না!" বলে চলে-যাওয়া মানুষটা...আমাদের সুখ, ভালোথাকা, হাসিখুশি সব চুরি করে নিয়ে চলে যায়। আমরা দ্বিতীয় বার আর ভেতর থেকে হাসি না, দ্বিতীয় বার আর কাউকে নিয়ে ভাবতে সাহস করি না।

এভাবেই একদিন আমাদের সুখী-করা মানুষগুলোই আমাদের সুখহরণের কারণ হয়ে যায়। সুখ গেলে সুখ আবার ফিরে পাওয়া যায়, কিন্তু সুখ দেবার মানুষটা চলে গেলে সুখ আর মানুষ দুই-ই হারায়।