(ডিসক্লেইমার: এই লেখাটি মৌলিক নয়। ইন্টারনেট ও কিছু বই থেকে পড়াশোনা করে তৈরি করেছি। লেখার শেষে সহায়ক উৎসগুলির তালিকা আছে।)
দুর্গাপূজার প্রকৃত কালক্রমিক ইতিহাসনির্মাণ এখনো সম্ভব হয়নি। এ কাজের উপযোগী সুস্পষ্ট ও অনুপুঙ্খ ধারাবাহিক তথ্যউপাত্তও পাওয়া যায়নি। এখনো পর্যন্ত কেউই এ উৎসবের উদ্ভব ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপঞ্জি নির্ভরযোগ্য দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি। ফলে, কখন, কীভাবে দুর্গাপূজা শুরু হলো, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে পুরাণ, মহাভারত, রামায়ণ, নানান ধর্মীয় কাব্য ও ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থসূত্র থেকে এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। কৃষির সঙ্গে শারদীয়া দুর্গাপূজার নিবিড় সম্পর্ক আছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের ‘দুর্গোৎসব তত্ত্ব’ গ্রন্থে। এ পূজাতে সারা শরীর লতাপাতায় সাজিয়ে ও কাদামাটি মেখে লোকে উৎসবে অংশগ্রহণ করতো। দুর্গাপূজার সঙ্গে মিলে আছে অরণ্য ও কৃষি-প্রধান সংস্কৃতির ধারার। দুর্গাপূজার সঙ্গে কৃষি-সম্পর্কের প্রমাণ মেলে রঘুনন্দনের ‘ধত ভবিষ্য’ বচনে। ইতিহাসবিদ এবং পুরাতত্ত্ববিদ রামপ্রসাদ চন্দের লিখিত ‘দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে: “……….সুতরাং দুর্গা যদি মূলত শস্য-প্রসবিনী দেবী হন, তবে মহিষাসুরকে শস্য নামক বন্য পশুর এবং অনাবৃষ্টির বিগ্রহ মনে করা যাইতে পারে। সুতরাং মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার মুখ্য উদ্দেশ্য হইতেছে শস্য উৎপাদনের এবং রক্ষার জন্য বসন্তে এবং শরতে শাকম্ভরীর প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন এবং আনন্দউৎসব।” (মার্কণ্ডেয় পুরাণমতে, দেবী আদ্যাশক্তির অন্যতম নাম শাকম্ভরী। শত বার্ষিক অনাবৃষ্টি হইলে দেবী নিজ দেহোৎপন্ন জীবনধারক শাকদ্বারা চরাচর লোককে পোষণ করিয়াছিলেন, তজ্জন্য তাঁহার এই নাম হয়।)
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন অদ্বৈতবাদী। শাস্ত্রসম্মত দুর্গাপূজার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ১৯০১ সালে বেলুড়মঠে দুর্গাপূজার ব্যবস্থা করেছিলেন। অনেকের ধারণা, এটা ছিল শাস্ত্রশাসন আর লোকাচারের সঙ্গে তাঁর আপস। তবে একথাও ঠিক, তাঁর অদ্বৈতবাদের উপলব্ধি শেষ পর্যন্ত উত্তরিত হয়েছিল মানবিকতাবাদে। সর্বোচ্চ মনুষ্যত্বকেই তিনি ঈশ্বরজ্ঞান তুল্য বিবেচনা করতেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্ম’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। পরে সেই বিশ্বাস কেন্দ্রীভূত হয়েছিল দরিদ্র-শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। তবুও তিনি দুর্গাপূজার বিরোধিতা করেননি, আবার দুর্গাপূজার লৌকিকতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়েও পড়েননি। সেকালের কলকাতার একজন উল্লেখযোগ্য পুরুষ হচ্ছেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন বলে দুর্গাঠাকুর দেখতে যেতেন না। একবার তাঁর বন্ধু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁকে দুর্গাঠাকুর দেখার নেমন্তন্ন করেছিলেন, কিন্তু রামমোহন তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বিদ্যাসাগর দুর্গাপূজার ব্যাপারে কৌতূহলী ছিলেন না। পূজার সময় তিনি দরিদ্র গ্রামবাসীদের কাছে চলে যেতেন। ১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোস জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে পূজা উত্সবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্গাপূজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সেসময় দেবী দুর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে জাগ্রত হন। যেমন, কবি নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ কবিতা (পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় সংগীত) ভারতবর্ষের মানুষকে স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে। বৃটিশশাসিত বাংলায় এই পূজা ধীরেধীরে বৃদ্ধি পায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারি বা কমিউনিটি পূজা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর দুর্গাপূজা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উত্সবের মর্যাদা পায়।
দুর্গাপূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর আরাধনার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের, আর অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের। দেবীরা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতাশক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে ওঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারণা। ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী-সংস্কৃতির ধারণা বেশ প্রাচীন। ইতিহাস বলে, প্রায় ২২ হাজার বছর আগে ভারতে পুরাপ্রস্তর যুগের জনগোষ্ঠীর মধ্যেই দেবীর পূজা শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা, তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি, তাঁর নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তাঁর নেতৃত্বে শত্রুনাশ হয়, আর তাই মাকে সামনে রেখে দেবী-বিশ্বাস গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে শাক্ত সম্প্রদায় মত ও পথ। দেবী হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরমব্রহ্ম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। অন্যান্য দেবদেবী মানুষের মঙ্গলার্থে নানান রূপে তাঁরইপ্রকাশমাত্র। মহাভারত অনুসারে, দুর্গা বিবেচিত হন কালীশক্তির আরেক রূপে। নানা অমিল ও বৈচিত্র্য, এমন-কী স্বকীয়তা থাকা সত্ত্বেও কালী কীভাবে দুর্গার রূপের সাথে মিশে এক হয়ে গেল, সে রহস্য আজো অজানা। কেউকেউ ধারণা করেন, সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা) দেবীমাতার, ত্রিমস্তক দেবতার ও পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দুর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী, সেই হিসেবে অথবা দেবীমাতা হিসেবেও দুর্গার পূজা করা হয়ে থাকতে পারে।
বাল্মীকির মূল রামায়ণে দুর্গাপূজার কোনো অস্তিত্ব নেই, তবে কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে। নিজের পরিচয়ের ভণিতায় কৃত্তিবাস বলছেন, তিনি গৌড়েশ্বরের আদেশে রামায়ণ অনুবাদ করতে করেন। ধারণা করা হয়, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি কৃত্তিবাস ওঝা যে গৌড়েশ্বরের কাছ থেকে বাল্মীকি রামায়ণের সহজবোধ্য বাংলা পদ্যানুবাদ করার নির্দেশ পেয়েছিলেন, তাঁর নাম রাজা গণেশ। গণেশ ১৪১৫ থেকে ১৪১৮ পর্যন্ত বাংলার শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণ লিখতেলিখতেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে যায়। ১৪১৮ সালে জালালউদ্দীন মাহমুদ শাহ ক্ষমতায় এসে পড়েন। জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ ছিলেন রাজা গণেশের পু্ত্র। তাঁর বাল্য নাম ছিল যদু এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে তাঁর নতুন নামকরণ করা হয় জালালুদ্দীন মুহম্মদ। কৃত্তিবাস নতুন মুসলিম শাসককে খুশি করতে গিয়ে রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকিকে রত্নাকর দস্যুতে পরিণত করেন, যে কাহিনি মূলত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার (১২৩৮-১৩২৫)। (আশুতোষ চৌধুরী সংগৃহীত ‘নিজাম ডাকাতের পালা’র কাহিনির সাথে রত্নাকর দস্যুর কাহিনি তুলনা করলে এটি বুঝতে অসুবিধে হয় না।) বাঙালির আবেগ, অনুভূতি ও রুচির দিক লক্ষ্য রেখে সর্বজনবোধ্য পদ্যে মূল সংস্কৃত রামায়ণের ভাবানুবাদ করায় কৃত্তিবাস অনূদিত পদ্য-রামায়ণের ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ ঘটে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। কৃত্তিবাস রামায়ণ-বহির্ভূত অনেক গল্প এই অনুবাদে গ্রহণ করেছিলেন। তদুপরি বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানান অনুষঙ্গের প্রবেশ ঘটিয়ে তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের বঙ্গীকরণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, এই কাব্যে “প্রাচীন বাঙালি সমাজই আপনাকে ব্যক্ত করিয়াছে।” অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের এমনভাবে বঙ্গীকরণ বা বাঙালিকরণ করেন, যা পড়লে মনে হবে, রামায়ণের ঘটনা সে সময়ের সমাজেরই আদি কাহিনি।
কৃত্তিবাস ত্রিমাত্রিক এবং পয়ার ছন্দে রামায়ণ লেখেন, যা পুরোপুরি পাঁচালি এবং সুর করে পড়ার উপযুক্ত। এই কৃত্তিবাসী রামায়ণ আর বাল্মীকির রামায়ণ বহু তফাত। কিন্তু বাঙালির মনে কৃত্তিবাসী রামায়ণ স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়। বাঙালি বাল্মীকির ‘ব্যাকরণসম্মত’রামের চেয়ে কৃত্তিবাসের ভাবানুবাদ এবং নিজের মনমতো কাহিনিজুড়ে তৈরিকরা কমললোচন রামচন্দ্রকে বেশি পছন্দ করে। কৃত্তিবাসের অকালবোধনের জনপ্রিয়তার কারণে বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলন ব্যাপকভাবে শুরু হয়। এ গ্রন্থে তিনি কালিকাপুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দুর্গাপূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজো বসন্তকালেইবিধেয়। কিন্তু রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করার পূর্বে ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র দুর্গাপুজো করেছিলেন আশ্বিন মাসে, তখন ছিল সূর্যের দক্ষিণায়ণ। দেবতারা সব ঘুমিয়ে। ফলে, অকালবোধনের মাধ্যমে দেবতাদের জাগিয়ে পূজা নিবেদন করেন রামচন্দ্র। সেই থেকেই ষষ্ঠীর দিনে বোধনের রীতি চলে আসছে। প্রথমে হয় কল্পারম্ভ, প্রক্রিয়াটি শুরু হয় সকালবেলাতেই। সকল শাস্ত্রীয় রীতিনীতি মেনে পুজো যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, সেজন্য এই আচার। ঘট ও জলপূর্ণ তাম্রপাত্র মণ্ডপের এককোণে স্থাপন করে দুর্গা ও চণ্ডিকার পুজো করা হয়। এরপর দেবীর বোধন, অর্থাৎ দেবীকে জাগরিত করা হয়। তারপরই হয় অধিবাস এবং আমন্ত্রণ। বোধনের পর বিল্বশাখায় দেবীকে আবাহন করা হয়। রীতি হল: অশুভ শক্তিকে দূর করার জন্য ঘটের চারদিকে তীরকাঠিতে লালসুতো বেষ্টন করা হয়, এরপর আমন্ত্রণ প্রক্রিয়া। এভাবেই মহাষষ্ঠীর আচার শেষ হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে পুজোর উপাচার শুরু ষষ্ঠী থেকেই। সিদ্ধিদাতা গণেশকে দিয়েই শুরু হয় পুজো। তারপর হয় দেবী দুর্গার পুজো।
অকালবোধন হল শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি অথবা শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গার পূজারম্ভের প্রাক্কালে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, শরৎকাল দেবলোকের রাত্রি দক্ষিণায়নের অন্তর্গত। তাই এই সময় দেবপূজা করতে হলে, আগে দেবতার বোধন (জাগরণ) করতে হয়। কৃত্তিবাসী রামায়ণে উল্লেখ আছে যে, রাবণবধের পূর্বে রাম দেবী দুর্গার কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বিল্ববৃক্ষতলে বোধনপূর্বক দুর্গাপূজা করেছিলেন। শরৎকাল দেবপূজার ‘শুদ্ধ সময়’ নয় বলে রাম কর্তৃক দেবী দুর্গার বোধন ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত পায়। উল্লেখ্য, শাস্ত্রমতে বসন্তকাল দুর্গাপূজার প্রশস্ত সময় হলেও, আধুনিক যুগে শারদীয়া দুর্গাপূজাই অধিকতর প্রচলিত। রামায়ণের প্রকৃত রচয়িতা বাল্মীকি মুনি রামায়ণে রামচন্দ্রকৃত দুর্গাপূজার কোনো উল্লেখ করেননি। কৃত্তিবাস ওঝা যে কাহিনি সংকলন করেছেন, তা রামচন্দ্রের প্রকৃত জীবনী বাল্মীকি-রামায়ণে বা রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদসমূহ যেমন, তুলসীদাস রচিত হিন্দি রামচরিতমানস, তামিলভাষায় কাম্ব রামায়ণ, কন্নড় ভাষায় কুমুদেন্দু রামায়ণ, অসমিয়া ভাষায় কথা রামায়ণ, ওড়িয়া ভাষায় জগমোহন রামায়ণ, মারাঠি ভাষায় ভাবার্থ রামায়ণ, উর্দু ভাষায় পুথি রামায়ণ প্রভৃতিতে উল্লেখিত হয়নি। এছাড়াও যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণেও উক্ত হয়নি। তবে কৃত্তিবাস ওঝা সৃষ্ট প্রচলিত তথ্যাদি অনুসারে স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে শরৎকালে দুর্গাপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, “…….অকালবোধন শরতে বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ ছাড়া আর কিছুই না।”
এই দিনে কালীঘরে গিয়ে তো বটেই, অন্য সময়েও প্রায়ই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গাইতেন:
পড়িয়ে ভবসাগরে ডুবে না তমুর তরী।
মায়া-ঝড় মোহ তুফান ক্রমে বাড়ে গো শঙ্করী।।
একে মন-মাঝি আনাড়ি, তাহে ছজন গোঁয়ার দাঁড়ি,
কুবাতাসে দিয়ে পাড়ি, হাবুডুবু খেয়ে মরি।
ভেঙ্গে গেল ভক্তির হাল, ছিড়ে পড়ল শ্রদ্ধার পাল,
তরী হল বানচাল উপায় কি করি;—
উপায় না দেখি অরি, অকিঞ্চন ভেবে সার,
তরঙ্গে দিয়ে সাঁতার, শ্ৰীদুৰ্গা নামের ভেলা ধরি।।
গানটির পদকার ছিলেন দেওয়ান রঘুনাথ রায়। গানটির মর্মার্থ: সংকটের সময় দুর্গা নামের ভেলায় ভবনদী পার হতে হবে।
শ্রীশ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ের অংশে মহর্ষিগণ দেবীর স্তব করেছেন। তাঁরা এই শক্তিরূপার মঞ্জুল শোভা (স্বর্গীয় সৌন্দর্য) প্রত্যক্ষ করেছেন:
সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রেক্ষা চতুর্ভির্ভুজৈঃ।
শঙ্খং চক্রধনুঃশরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা।।
আমুক্তাঙ্গদহার কঙ্কণরণৎ কাঞ্চীক্কণন্নূপুরা।
দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্লসৎকুণ্ডলা।।
অর্থ: সিংহারূঢ়া শশিশেখরা, মরকতমণির তুল্য প্রভাময়ী, চারিহস্তে শঙ্খ, চক্র ও ধনুর্বাণ-ধারিণী, ত্রিনয়ন দ্বারা শোভিতা, কেয়ূর, হার ও বলয় এবং মৃদুমধুর ধ্বনিযুক্তা চন্দ্রহার ও নূপুর-পরিহিতা এবং রত্নে উজ্জ্বল কুণ্ডলভূষিতা দুর্গা আমাদের দুর্গতি নাশ করুন।Top of Form
Bottom of Form
তাঁরা প্রতি পদক্ষেপেই মহামায়া দুর্গাকে স্মরণ করেছেন:
ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরণন্তবীর্যা।
বিশ্বাস্য বীজং পরমাসি মায়া।।
সম্মোহিতং দেবি সমস্তশেতৎ।
ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তি-সিদ্ধিহেতুঃ।।
অর্থ: মা সিংহবাহিনী, তোমার শক্তি, তোমার বীর্য অনন্ত অপার। তুমিই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের জগৎপালিনী শক্তি। এই ব্রহ্মাণ্ডের তুমিই আদির আদি কারণ মহামায়া। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডজগৎকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছ, কিন্তু তুমি প্রসন্না হলে শরণাগত মুক্তিসিদ্ধি লাভ করে।
…………….এটাই হল বোধনের আদি মন্ত্র।
‘বোধন’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘বোধ’-এর ‘অনট্’ ধাতু, অর্থাৎ জাগ্রত করা---জাগতিক ধীশক্তি দিয়ে অধিজাগতিক মহাশক্তিকে বোধিত্বে,অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় অধিষ্ঠিত করা, প্রতিষ্ঠিত করা। সংস্কৃত ‘অকাল’ ও ‘বোধন’ শব্দ দুইটি বাংলাভাষায় তৎসম শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ‘অকাল’ শব্দের অর্থ ‘অসময়, শুভকর্মের অযোগ্য কাল বা অনুপযুক্ত কাল’। অন্যদিকে ‘বোধন’ শব্দটির অর্থ ‘উদ্বোধন, নিদ্রাভঙ্গকরণ, বা জাগানো’। ফলে ‘অকালবোধন’ শব্দবন্ধটির অর্থ ‘অসময়ে বোধন বা জাগরণ, (হিন্দু সংস্কারে) অসময়ে দেবী দুর্গার আরাধনা’। এই প্রসঙ্গে পন্ডিত জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস লিখেছেন:
“যে সময় (শ্রাবণ হ’তে পৌষ) দুর্গাপূজা হয় তখন সূর্য্যের গতি দক্ষিণ দিক্ দিয়া হয়। এই ছয় মাস দক্ষিণায়ণ। অপর ছয় মাস (মাঘ হ’তে আষাঢ়) উত্তরায়ণ। উত্তরায়ণ দেবতাদের দিন এবং দক্ষিণায়ণ রাত্রি। রাত্রিকালে দেবী [দুর্গা] নিদ্রিত থাকেন বলিয়া তাঁহার বোধন করিয়া পূজা করিতে হয়। সাধারণত ষষ্ঠীতেই বোধন আরম্ভ হয়, পূজার পূর্ব্বদিন সায়ংকালে ষষ্ঠী না থাকিলে ও তৎপূর্ব্বদিনে থাকিলে তৎপূর্ব্বদিনেই বোধন হয়।”
অপরদিকে, দুর্গাপূজার বিধিসম্মত সময়কাল হল চৈত্রমাস, সে পূজা বাসন্তীপূজা নামে পরিচিত। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থে রয়েছে, রাজা সুরথ তাঁর সঙ্গী সমাধি বৈশ্যকে সাথে নিয়ে সত্যযুগে চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে শাস্ত্রবিধিমতে মৃন্ময়ীরূপে দেবী দুর্গতিনাশিনীর (দুর্গার) পূজা করেছিলেন। বসন্তকাল উত্তরায়ণের অন্তর্গত। উত্তরায়ণে দেবতারা জাগ্রত থাকেন বলে বাসন্তীপূজায় বোধনের প্রয়োজন হয় না। দেবীর বোধনের আলোচনা পাওয়া যায় মৎস্যপুরাণ, মার্কেণ্ডয়পুরাণ, শ্রীশ্রীচণ্ডী, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ এবং দেবী ভাগবতে।
পরবর্তী যুগে,অর্থাৎ ত্রেতাযুগে রাবণও চৈত্রমাসে দেবী দুর্গার আরাধনা করতেন। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাহিনি অনুসারে, লঙ্কা থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাম-রাবণের অবশ্যম্ভাবী যে যুদ্ধ, সেখানে রাবণকে বধ করার জন্য রামচন্দ্রকে দেবীর শরণাপন্ন হতে হয়। কঠোর তপস্যায় দেবাদিদেব মহাদেবকে তুষ্ট করে রাবণ বরলাভ করেছেন। দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপের একনিষ্ঠ সাধক ও পূজারি হলেন রাবণ। যুদ্ধক্ষেত্রে মহাকালী স্বয়ং রাবণকে নিজের কোলে স্থান দেন। এহেন রাবণকে বধ কীকরে সম্ভব হবে? রাম পড়লেন দুশ্চিন্তায়। দেবরাজ ইন্দ্রও দুশ্চিন্তায়। এদিকে অশুভশক্তি অহংকারী দাম্ভিক রাবণের বিনাশ ঘটবে রামের হাতে, এই ছিল দৈববাণী। তাই দেবতারা প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণ নিলেন। তখন মহামায়া একাক্ষরী আদ্যাদেবী মা দুর্গা সমাধিনিদ্রায় নিদ্রিতা। ব্রহ্মার স্তব-স্তুতিতে জাগ্রত হলেন দেবী মহামায়া। তিনি উগ্রচণ্ডি রুপে আবির্ভূত হলে ব্রহ্মা বললেন, “রাবণবধে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে অকালে জাগরিত করেছি। যতদিন না রাবণ বধ হয়, ততদিন তোমার পূজা করব। যেমন করে আমরা আজ তোমার বোধন করে পূজা করলাম, তেমন করেই মর্ত্যবাসী যুগযুগ ধরে তোমার পূজা করবে। যতকাল সৃষ্টি থাকবে, তুমিও পূজা পাবে এইভাবেই।” একথা শুনে চণ্ডিকা বললেন, “সপ্তমী তিথিতে আমি প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে রাম-রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুণ্ড বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমুণ্ড আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।’’
রামকে দেবীর নির্দেশের কথা বললেন ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। যদিও সময়টা শরৎকাল, রামচন্দ্র নিজের হাতে দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরি করে পুজো করলেন, অকালে বা অসময়ে প্রকট হওয়ার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা করলেন। ব্রহ্মা স্বয়ং দুর্গার বোধনপূজা করেন। পূজার প্রারম্ভে স্বয়ং প্রজাপতি পদ্মযোনি ব্রহ্মা দেখেছিলেন, সাগরের বালুকাবেলার অনতিদূরে গভীর অরণ্যের প্রান্তসীমায় একটি বিল্ববৃক্ষের নীচে আট থেকে দশ বছরের একটি বালিকা আপনমনে খেলছে। ব্রহ্মা ধ্যানস্থ হয়ে জানলেন, সেই বালিকাই স্বয়ং গৌরী---কন্যকা। ব্রহ্মা চোখ মেলতেই সেই বালিকা ওই বিল্ববৃক্ষে লীন হয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে ব্রহ্মা স্থির করলেন, দেবী দুর্গার সেই বোধনের পূজার্চনা হবে ওই বিল্ববৃক্ষের নীচে। তাই আজও দেবীর বোধনের পূর্বে বিল্বশাখা বা বিল্ববৃক্ষকে পূজা করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হয় দেবীর মৃন্ময়ী বিগ্রহের মহাঘটে। শুরু হয় ‘বোধন’-এর আরাধনা, বেজে ওঠে শঙ্খ, ঢাক। বোধন হল মহাপূজায় দেবী মা দুর্গার প্রারম্ভিক আবাহন, যা সুদূর অতীত যুগ থেকে পরম্পরাগতভাবে প্রবহমান। বসন্তকালের সঙ্গে ত্রেতাযুগে যুক্ত হল শরৎকাল, অকালে হল দেবীর বোধন, তাই এর নাম অকালবোধন।
আমাদের দেশে দেবীপূজার দুইটি রূপ—বাসন্তীপূজা, দুর্গাপূজা। বাসন্তীপূজা করার নিয়ম এক, দুই বা তিন দিন; আর দুর্গাপূজার বিধি একদিন হতে আরম্ভ করে একপক্ষ পর্যন্ত। সাধারণতঃ বাসন্তীপূজা তিনদিনের পূজা। ষষ্ঠীতে সায়ংকালে বিল্ববৃক্ষ-মূলে ‘আমন্ত্রণ’ ও প্রতিমার ‘অধিবাস’ করতে হয়, পরদিন সপ্তমীতে আমন্ত্রিত বিল্বশাখা কেটে যথাবিধানে পূজা করতে হয়। বসন্তের ও শরতের পূজার পার্থক্য আছে। বাসন্তীকে কালোচিত পূজা বলে, শারদীয়া পূজাকে অকাল পূজা বলে, এইটুকুই প্রধান ভেদ। অকাল বলতে কী বোঝায়? সৌরবর্ষের মকর সংক্রান্তি হতে ৬ মাস, অর্থাৎ মাঘ হতে আষাঢ় পর্যন্ত উত্তরায়ন; কর্কট সংক্রান্তি হতে ৬ মাস অর্থাৎ শ্রাবণ হতে পৌষ পর্যন্ত দক্ষিণায়ন। শাস্ত্রের বিধি অনুসারে, এক অয়নে দেবতারা জাগ্রত থাকেন অপর অয়নে নিদ্রিত। যখন তাঁরা জাগ্রত তখন ‘কাল’, যখন নিদ্রিত তখন ‘অকাল’। উত্তরায়নে দেবতারা জাগ্রত এবং দক্ষিণায়নে নিদ্রিত, তাই—উত্তরায়নের বাসন্তী কালের পূজা, আর দক্ষিণায়নের শারদীয়া অকালের পূজা। আর অকালের পূজা বলেই এই পূজার এত আদর। অকালে দেবতাদের নিদ্রা, কাজেই দেবীকে জাগাতে হয়, সেইজন্যই বোধনের ব্যবস্থা। বাসন্তী পূজার মতো শারদীয়া পূজার শুধু আমন্ত্রণ ও অধিবাস করলেই চলে না, এ পূজায় বোধন করতে হয়। আর এই বোধনই এই পূজায় বিশেষ আচার।
বাসন্তীপূজার প্রবর্ত্তনকাল সম্বন্ধে ব্ৰহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ (প্রকৃতি থণ্ড, ৬২ অধ্যায়) গ্রন্থে আছে, প্রথমে কৃষ্ণ গোলোকে রাসমণ্ডলে মধুমাসে (চৈত্রমাসে) দুর্গাদেবীর পূজা করেন। (প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা।) এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গাপূজা করেছিলেন। ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শিব বিপদে পড়ে তৃতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনিঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষেরা নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গাপূজা করে আসছে। শাক্তধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসক হয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে মাটির দুর্গামূর্তি তৈরি করে পূজা করেন। জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে ঋষি মাণ্ডব্য, হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারে সুরথ রাজা ও বৈরাগ্য লাভের জন্য সমাধি বৈশ্য, কার্তাবির্জাজুন বধের জন্য বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দুর্গার আরাধনা করেন।
শাস্ত্রে দুর্গাপূজায় রামচন্দ্রের পূজার কোনো বিধান নেই। তাই সম্ভবত বাংলায় অকালবোধন থিমের আকাল। তবে অকালবোধনের গল্প বাঙালিরা শিশুকাল থেকে শুনে আসছে। গল্পটা কৃত্তিবাস ওঝার বানানো। পনেরো শতকের এই বাঙালি রামায়ণ অনুবাদক বেশ ফলাও করেই রামচন্দ্রের দুর্গাপুজোর গল্প শুনিয়েছেন। গল্পটা সবিস্তারে জানা যাক:
যুদ্ধে একেএকে মারা পড়েছেন লঙ্কার সব বড়োবড়ো বীর। রাবণ তখন একা কুম্ভের মতো রক্ষা করছেন লঙ্কাপুরী। তিনিও শ্রান্ত, বিধ্বস্ত। এমনকি একবার তো হনুমানের হাতে প্রচুর মার খেয়ে অজ্ঞানই হয়ে গেলেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে রাবণ দেবীঅম্বিকার স্তব করলেন:
করুণা-নয়নে চাও কাতর কিঙ্করে।
ঠেকিয়াছি ঘোর দায় রামের সমরে৷
আর কেহ নাহি মোর ভরসা সংসারে।
শঙ্কর ত্যজিল, তেঁই ডাকি মা তোমারে।।
উল্লেখ্য, অকালবোধনের সাথে জড়িত শরৎবিষুব। বৈদিক যুগে একসময় শরৎকালে বছর শুরু হতো। আর নতুন বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হতো রুদ্রযজ্ঞ। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে শরৎকেই অম্বিকা বলা হয়েছে।
রাবণেরকাতর স্তবে হৈমবতীর হৃদয় টলল। তিনি কালীরূপে রাবণকে কোলে তুলে নিয়ে তাঁকে দিলেন অভয়। এই খবর রামের কানে যেতেই তিনি গুনলেন প্রমাদ। ওদিকে দেবতাদের ঘুম উড়ে যাওয়ার যোগাড়! ইন্দ্র ব্রহ্মার কাছে গিয়ে কাকুতিমিনতি করে কিছু একটা করার অনুরোধ জানালেন। বুড়ো ঠাকুরদাদা ব্রহ্মা এসে রামকে পরামর্শ দিলেন, “দুর্গাপূজা করো। আর কোনো উপায় নেই।” রাম বললেন, “তা কেমন করে হয়? দুর্গাপূজার প্রশস্ত সময় বসন্তকাল। শরৎকাল তো অকাল। তাছাড়া বিধান রয়েছে, অকালবোধনে নিদ্রা ভাঙাতে হবে কৃষ্ণানবমীতে। সুরথ রাজা প্রতিপদে পূজারম্ভ করেছিলেন। কিন্তু সেকাল তো আর নেই। পূজা করি কীভাবে?” ব্রহ্মা বললেন, “আমি ব্রহ্মা, বিধান দিচ্ছি, শুক্লাষষ্ঠীতে বোধন করো।” শুনে রাম মহাখুশি হলেন।
চণ্ডীপাঠ করি রাম করিলা উৎসব।
গীত নাট করে, জয় দেয় কপি সব।।
প্রেমানন্দে নাচে আর দেবী-গুণ গায়।
চণ্ডীর অর্চ্চনে দিবাকর অস্ত যায়।।
সায়াহ্ন-কালেতে রাম করিলা বোধন
আমন্ত্রণ অভয়ারে বিবাধিবাসন।।
চণ্ডীতে আছে, সুরথ রাজা দুর্গার মাটির মূর্তি গড়ে পূজা করেছিলেন: ‘তৌ তস্মিন্ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্বা মূর্ত্তিং মহীময়ীম্। অর্হণাঞ্চক্রতুস্তস্যাঃ পুষ্পধূপাগ্নিতর্পণৈঃ।।’ রামচন্দ্রও পূজা করেছিলেন নিজের হাতে তৈরি মাটির প্রতিমায়: ‘আপনি গড়িলা রাম প্রতিমা মৃন্ময়ী।/হইতে সংগ্রামে দুই-রাবণ-বিজয়ী।’ ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বেলগাছতলায় হল দেবীর বোধন। অধিবাসের সময় রাম নিজহাতে বাঁধলেন নবপত্রিকা।
সায়াহ্ন-কালেতে রাম করিলা বোধন।
আমন্ত্রণ অভরায় বিল্বাদি-বাসন।।
……………………………………………….
আচারেতে আরতি করিলা অধিবাস।
বান্ধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।।
সপ্তমীর দিন সকালে স্নান করে রাম বেদবিধিমতে পূজা করলেন। অষ্টমীর দিনও তা-ই। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজা করলেন। দুইদিনই রাতে চণ্ডীপাঠ ও নৃত্যগীত হল।
রামচন্দ্রের নবমী পূজার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন কৃত্তিবাস। বহুরকম বনফুল ও বনফলে পূজার আয়োজন হল। তন্ত্রমন্ত্রমতে পূজা হল। কিন্তু দেবী দর্শন দিলেন না। তখন বিভীষণ উপদেশ দিলেন, “নীলপদ্মে পূজা করুন। দেবী নিশ্চয় দর্শন দেবেন।” কিন্তু নীলপদ্ম দুর্লভ। দেবতারাও তার খোঁজ রাখেন না। পৃথিবীতে একমাত্র দেবীদহ নামক হ্রদেই নীলপদ্ম মেলে। কিন্তু সেও লঙ্কা থেকে দশ বছরের পথ। শুনে হনুমান নিমেষে উপস্থিত হলেন দেবীদহে। এনে দিলেন একশো আটটি নীলপদ্ম। কিন্তু দুর্গা ছলনা করে একটি পদ্ম রাখলেন লুকিয়ে। রাবণকে তিনি কথা দিয়ে রেখেছিলেন কিনা! কিন্তু রামও ছাড়বার পাত্র নন। একটি নীলপদ্মের ক্ষতিপূরণে তিনি নিজের একটি চোখ উপড়ে নিবেদন করতে চাইলেন।
চক্ষু উৎপাটিতে রাম বসিলা সাক্ষাতে।
হেনকালে কাত্যায়নী ধরিলেন হাতে।।
কর কী কর কী প্রভু জগত গোঁসাই।
পূর্ণ তোমার সঙ্কল্প চক্ষু নাহি চাই।।
বাধ্য হয়েই দুর্গা রামচন্দ্রকে রাবণবধের বর দিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন:
অকালবোধনে পূজা কৈলে তুমি দশভুজা
বিধিমতে করিলা বিন্যাস।
লোকে জানাবার জন্য আমারে করিতে ধন্য
অবনীতে করিলে প্রকাশ।।
এরপর রাম দশমী পূজা সমাপ্ত করে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন দিলেন। সবশেষে রাবণবধ।
রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার এই ইতিহাস বাল্মীকি রামায়ণে নেই, আছে দেবীভাগবতপুরাণ ও কালিকাপুরাণ-এ। খ্রিস্টীয় নবম-দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লেখা এই দুই পুরাণ বাঙালি স্মার্তদের দুই মহাকীর্তি। কৃত্তিবাসের আগেও যে বাংলায় দুর্গাপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল, তার প্রমাণ ভবদেব ভট্টের মাটির মূর্তিতে দুর্গাপূজার বিধান (একাদশ শতাব্দী), জীমূতবাহনের (আনুমানিক ১০৫০-১১৫০) দুর্গোৎসবনির্ণয়, বিদ্যাপতির (১৩৭৪-১৪৬০) দুর্গা ভক্তি-তরঙ্গিণী, শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) দুর্গোৎসব-বিবেক। চতুর্দশ শতাব্দীতে মিথিলার কবি বিদ্যাপতির ‘দুর্গা ভক্তি-তরঙ্গিণী’ ও নব্যস্মৃতির প্রবর্তক বাঙালি পণ্ডিত শূলপাণির ‘দুর্গোৎসব-বিবেক’ বই দুইটি থেকে দুর্গাপূজার কথা জানা যায়। দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব অনুধাবনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রঘুনন্দনের (১৫শ-১৬শ শতক) দুর্গাপূজাতত্ত্ব, তিথিতত্ত্ব গ্রন্থ। নবদ্বীপের এই স্মার্ত পন্ডিতের লেখা গ্রন্থ দুইটিতে দুর্গাপূজার যাবতীয় বিধান রয়েছে। পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র থেকে প্রমান সংগ্রহ করে পূজা পদ্ধতি লিখেছেন তিনি। এছাড়া বাচস্পতি মিশ্রের (১৪২৫-১৪৮০) ক্রিয়াচিন্তামণি গ্রন্থে দুর্গাপূজার বিস্তৃত বর্ণনা থাকায় অনুমান করা হয় যে, কৃত্তিবাসের যুগে (পঞ্চদশ শতাব্দীতে), এমন-কী তার আগেই (চতুর্দশ শতাব্দী) দুর্গাপূজা ছিল বাঙালির এক প্রধান উৎসব। আর সেইজন্যই তিনি রামচন্দ্রকে দিয়ে দুর্গাপূজা করালেন সনাতন বাঙালি পন্থায় এবং জনপ্রিয়ও হলেন, যদিও কৃত্তিবাসী রামায়ণের দুর্গোৎসব বিবরণের সঙ্গে পৌরাণিক দুর্গোৎসব বিবরণ ঠিক হুবহু মেলে না। যেসব পুরাণমতে আজ বাংলায় দুর্গাপূজা হয়, তার একটি হল কালিকাপুরাণ। এই পুরাণে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বর্ণনা পাই। বাংলায় অনূদিত কালিকাপুরাণ-এর ষাট অধ্যায়ের ২৬ থেকে ৩৩ সংখ্যক শ্লোকগুলির গদ্যরূপ:
পূর্বে রামের প্রতি অনুগ্রহ করে রাবণবধে তাঁকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা রাত্রিকালে (সূর্যের দক্ষিণায়নের, অর্থাৎ দেবতাদের ঘুমানোর সময়) এই মহাদেবীর বোধন করেছিলেন। বোধিতা হয়ে দেবী গেলেন রাবণের বাসভূমি লঙ্কায়। সেখানে তিনি রাম ও রাবণকে দিয়ে সাতদিন ধরে যুদ্ধ করালেন। নবমীর দিন জগন্ময়ী মহামায়া রামের দ্বারা রাবণবধ করেন। যে সাতদিন দেবী রাম-রাবণের যুদ্ধ দেখে আনন্দ করলেন, সেই সাতদিন দেবতারা তাঁর পূজা করেন। রাবণ নিহত হলে নবমীর দিন ব্রহ্মা সকল দেবতাকে সঙ্গে নিয়ে দেবীর বিশেষ পূজা করলেন। তারপর দশমীর দিন গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে কাদা মেখে শবরোৎসব উদযাপিত হল। শেষে দেবীর বিসর্জন হল।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এই পুরাণের মতে, কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গের পর রামচন্দ্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় দেবতারা শঙ্কিত হলেন। তখন ব্রহ্মা বললেন, দুর্গাপূজা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাই রামচন্দ্রের মঙ্গলের জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা যজমেনে করতে রাজি হলেন। তখন শরৎকাল। দক্ষিণায়ণ। দেবতাদের নিদ্রার সময়। এতএব ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করলেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতারাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি পরমাসুন্দরী বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধনস্তবে তাঁকে জাগরিত করলেন। ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধরলেন। ব্রহ্মা বললেন, “রাবণবধে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে অকালে জাগরিত করেছি। যতদিন না রাবণবধ হয়, ততদিন তোমার পূজা করব। যেমনি করে আজ আমরা বোধন করে তোমার পূজা করলাম, তেমনি করেই মর্ত্যবাসী যুগযুগ ধরে তোমার পূজা করবে। যতকাল সৃষ্টি থাকবে, তুমিও পূজা পাবে এইভাবেই।” একথা শুনে চণ্ডিকা বললেন, “সপ্তমী তিথিতে আমি প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে রাম-রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুণ্ড বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমুণ্ড আবার জোড়া লাগবে। নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।” হলও তা-ই। মহাবিপদ কেটে গেল অষ্টমীতে; তাই অষ্টমী হল মহাষ্টমী। রাবণবধ করে মহাসম্পদ সীতাকে লাভ করলেন রাম; তাই নবমী হল মহানবমী।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুর্গাপূজা করেছিলেন রাম। কিন্তু পুরাণ বলে, রামের মঙ্গলের জন্য দেবগণ করেছিলেন পূজার আয়োজন। পুরোহিত হয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। কৃত্তিবাসের দুর্গাপূজা বিবরণে বাংলায় প্রচলিত লৌকিক প্রথার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। সেই বিবরণ সম্পূর্ণরূপে শাস্ত্রানুগ নয়, যদিও কৃত্তিবাসকে সঠিক ধরে লোকে মনে করে, শরৎকালের দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন রাম। কিন্তু এই সম্মান ব্রহ্মারই পাওয়া উচিত---বাংলার লক্ষলক্ষ দুর্গাপূজায় আজও বোধনের মন্ত্রে উচ্চারিত হয়:
ওঁ ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যস্তয়ি কৃতঃ পুরা।।
অহমপাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়মি বৈ।
অর্থ: হে দেবী, রাবণবধে রামকে অনুগ্রহ করার জন্য ব্রহ্মা তোমার অকালবোধন করেছিলেন, আমিও সেইভাবে আশ্বিন মাসের ষষ্ঠী তিথিতে সন্ধ্যায় তোমার বোধন করছি।
দুর্গাপূজার সবচাইতে বিশদ বর্ননা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণে, যেটি মহর্ষি জৈমিনি ও মহর্ষি মার্কণ্ডেয়ের মধ্যকার কথোপকথন আকারে রচিত। গ্রন্থের অধ্যায়সংখ্যা ১৩৪। ৫০-৯৭ অধ্যায়সমূহে রয়েছে ১৪টি মন্বন্তর বা মনুর সময়কালের বিবরণী। এর মধ্যে তেরোটি অধ্যায় (অধ্যায় ৭৮-৯০) একত্রে দেবীমাহাত্ম্যম্ নামে পরিচিত। এ তেরোটি অধ্যায়ে মোট ৭০০ শ্লোক বর্তমান। এই অংশে মহিষাসুরকে পরাজিত করে দেবী দুর্গার বিজয়কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থটি দুর্গা সপ্তশতী বা কেবলমাত্র সপ্তশতী, চণ্ডী বা চণ্ডীপাঠ নামেও পরিচিত--যা দুর্গাপূজার প্রধান ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পূজার আসরে স্থায়ী হয়ে গেছে। সনাতন ধর্মের আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন।
পরিব্রাজক, বৌদ্ধ পণ্ডিত হিউয়েন সাংকে নিয়ে দুর্গাপূজার(মতান্তরে কালী/চণ্ডী/বনদেবী-পূজার) একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। চীনাভাষায় রচিত বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাখায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি মূল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের কাজে ৬৩০ সালে ভারত সফরে আসেন। ভারতবর্ষের নানান বিহারে থেকে বিদ্যা অর্জন করেন। ৬৩৫-৬৪৩ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর তিনি হর্ষবর্ধনের রাজসভায় ছিলেন। তিনি তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছেন, হর্ষবর্ধনের সময়ে দস্যুতস্করের উপদ্রব খুব বেশি ছিল এবং তিনি নিজেও একাধিকবার দস্যুর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। তাঁর প্রবাসজীবনের কোনো এক সময়ে গঙ্গাপথে (প্রাচীন নাম গঙ্গাঋদ্ধি) এই পরিব্রাজক এক বৌদ্ধবিহারে যাচ্ছিলেন। পথে দস্যুর কবলে পড়লেন। দস্যুরা তাকে দেবী দুর্গার সামনে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর কাহিনিটি দুর্গা, কালী, বনদেবী, নাকি মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী দেবীর সমন্বয়ে তৈরি চণ্ডী-কে নিয়ে, তা নিয়ে মতভেদ আছে। বেশিরভাগই মনে করেন, দেবীটি ছিলেন বনদেবী বা কালী, কারণ প্রাচীনকালে নরমুণ্ড ভোগ দেবার বিষয়টি বনদেবী বা কালীদেবীর জন্যইপ্রযোজ্য ছিল, যা সময়ের বিবর্তনে এখন পাঁঠাবলি দিয়ে পূরণ করা হয়, অপরদিকে, দুর্গাকে খুশি করার জন্য নরমুণ্ড ভোগ দেবার বিষয়টি ইতিহাস থেকে জানা যায় না। যা-ই হোক, বলির পূর্বপ্রস্ততি প্রায় শেষ, এমন সময় প্রচণ্ড বেগে ঝড় এল। সব আয়োজন ঝড়ের কবলে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। ডাকাতরা জান বাঁচাতে পালাতে লাগল। সেই সুযোগে হিউয়েন সাংও পালিয়ে যান।
ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতির মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দুর্গার, যা সংস্কারের ফলে মূল চেহারা হারিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন গঠনশৈলী বৌদ্ধ মন্দিরের মত। দশম শতকে এখানে বৌদ্ধ মন্দির ছিল, পরবর্তীতে সেন আমলে কীভাবে হিন্দু মন্দির হল, ইতিহাসে তা লেখা নেই। ১১শ বা ১২শ শতক থেকে এখানে কালীপূজার সাথে দুর্গাপূজাও হত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণশৈলীর সাথে এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠনে ও স্থাপনায় নানা ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালীমন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং এখানেও কালী পূজার সাথে দুর্গাপূজা হত।
মধ্যযুগেরবাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার কথা পাওয়া যায়। ১১শ শতকের দিকে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ‘অভিনির্ণয়’লিখতে গিয়ে দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী-তে দেবী দুর্গার বেশ স্তববন্দনা করেন। তবে বিদ্যাপতির দুর্গাবন্দনা পড়ে মানুষ দুর্গাপূজা করতে শুরু করে দেয়, এটা হয়তো নয়। ঘটা করে দুর্গাপূজা চালুর আগে কিছুকিছু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের গৃহকোণে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে ঘরোয়া পরিবেশে এই পূজা চালু ছিল। কখন থেকে ঘটা করে এই পূজা চালু হল--তা নিয়ে স্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যতটুকু জানা যায়, তা হল, ১৪৮০ সালের দিকে রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ রায় একদিন পণ্ডিতদের সভায় বিনম্রস্বরে বললেন, ‘আমি একটি মহাযজ্ঞে ব্রতী হতে চাই। আপনারা আমাকে শাস্ত্রানুমোদিত একটি মহাযজ্ঞের নির্দেশ ও ব্যবস্থা দিন।’ বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্যরা বংশানুক্রমে তাহিরপুরের ভূস্বামীদের কুলপুরোহিত ছিলেন। এই বংশের বিখ্যাত তান্ত্রিক রমেশ শাস্ত্রী তখন বাংলা, বিহার, ওড়িশার সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। রাজা কংসনারায়ণের সেই সভায় রমেশ শাস্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। রাজার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘শাস্ত্রে বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ—এই চারটি মহাযজ্ঞের বিধি আছে। কিন্তু প্রথম দুটি যজ্ঞের অধিকারী দেশপতি সার্বভৌম সম্রাট। যেহেতু তুমি সম্রাটের অধীন একজন ভূস্বামী, তাই ওই দুই যজ্ঞের অধিকারী তুমি নও। শেষের দুটি যজ্ঞ অশ্বমেধ ও গোমেধ কলিতে নিষিদ্ধ এবং উভয় যজ্ঞই ক্ষত্রিয়ের করণীয়, ব্রাহ্মণের নয়।’ রাজা বিমর্ষভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তবে কি কলিতে এমন কোনো যজ্ঞের ব্যবস্থা নেই, আমি যাতে ব্রতী হতে পারি?’ রমেশ শাস্ত্রী উত্তর দিলেন, ‘আছে। কলিতে একমাত্র মহাযজ্ঞ হচ্ছে দুর্গোৎসব। এই যজ্ঞ সব যুগে সব জাতিই করতে পারে। এই এক যজ্ঞে সব যজ্ঞের ফল লাভ হয়। সত্য যুগে সুরথ রাজা এই যজ্ঞে ব্রতী হয়ে কাম্য লাভ করেন। ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র রাবণবধের উদ্দেশ্যে অকালে এই মহাযজ্ঞ করেছিলেন। তদবধি শাস্ত্রপুরাণের মধ্যেই এই যজ্ঞ আবদ্ধ হয়ে আছে। যদি তোমার সাহস থাকে, তুমি রাজসিকভাবে দুর্গোৎসব যজ্ঞে ব্রতী হতে পারো।’ রাজা কংসনারায়ণ তা-ই করলেন। রাজসিকভাবে শুরু করলেন দুর্গোৎসব যজ্ঞ। সেই আমলে আট লাখ টাকা খরচ করে কংসনারায়ণ দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। তান্ত্রিক রমেশ শাস্ত্রীর বিধানে প্রণীত হলো শাস্ত্রানুমোদিত আধুনিক দুর্গোৎসব পদ্ধতি। ফলে, পরিবারসমন্বিতা প্রতিমায় বাংলাদেশেই প্রবর্তিত হয়েছিল প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসব। প্রসঙ্গত, কংসনারায়ণের বংশে প্রথম দুর্গাপূজার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ঠাকুরদা উদয়নারায়ণ। রঘুনন্দন ভট্টাচার্য তখন বাঙালি হিন্দুসমাজের অন্যতম প্রতীক।
কারো মতে, ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দুর্গাপূজা করেন। ১৫১০ সালে কুচবংশের রাজা বিশ্বসিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দুর্গাপূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার দুর্গার ছেলেমেয়ে-সহ সপরিবার-পূজা চালু করেন। ১৭১১ সালে অহম রাজ্যের (অধুনা রংপুরের কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলা) রাজধানী রংপুরের শারদীয় পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার। নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লার আক্রমণে কলকাতার একমাত্র চার্চটি ধ্বংস হবার পর সেখানে কোনো উত্সব করার অবস্থা ছিল না। পলাশীর যুদ্ধে বিজয়লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভাবাজারের রাজবাড়িতে রাজা নব কৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে দুর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয়উত্সবের আয়োজন করেছিলেন। এছাড়াও অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ও চিল্কিগড়ের সামন্ত রাজা গোপীনাথ মত্ত গজসিংয়ের দুর্গাপূজার ইতিহাস জানা যায়। পুরনো অনেক বাঙালি বাবু দুর্গাকে মনে করতেন মেয়ে আর শিবকে মনে করতেন জামাই। দশমীর দিন তাঁরা দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে মেয়ে দুর্গাকে জামাই শিবের কাছে পাঠিয়ে দিতেন বলে কল্পনা করতেন। জামাইয়ের কাছে তাই আগাম খবর তারা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতেন বিজয়ার দিন নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে। ভারতের কলকাতার শোভাবাজারের নবকৃষ্ণের বাড়িতে আর চোরাবাগানের মল্লিকবাড়িতে এই প্রথা এখনো চালু আছে। হাওড়া জেলার ডাঁসাই গ্রামের কাঙালীচরণ শিকারি এই দুটি বাড়িতে নীলকণ্ঠ পাখি জোগান দিতেন বলে জানা যায়। বাবুদের সংস্কার অনুসারে নীলকণ্ঠ পাখি হচ্ছে পবিত্র বার্তাবাহক।
আধুনিক দুর্গাপূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮ শতকে শুরু। নানান বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসায়ী ও রাজদরবারের রাজকর্মচারী পর্যায়ে পুজোর প্রচলন ছিল। বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে ১৭৬৭ সালের দিকে দুর্গাপূজা হত বলে লোকমুখে শোনা যায়। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দুর্গাপূজার ওয়াটারকালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। ওড়িশার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। জমিদারবাড়ি থেকেই এই পূজার প্রচলন হয়েছিল। বর্তমানে দুর্গাপূজা দুইভাবে হয়ে থাকে: ব্যক্তিগতভাবে---পারিবারিক স্তরে ও সমষ্টিগতভাবে--- প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা পাড়াকেন্দ্রিক স্তরে। পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা প্রধানত ধনী পরিবারগুলিতেই আয়োজিত হয়। কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারগুলির দুর্গাপূজা ‘বনেদি বাড়ির পূজা’ নামে পরিচিত। পারিবারিক দুর্গাপূজাগুলিতে শাস্ত্রাচার পালনের উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়। পূজা উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয়-সমাগম হয়ে থাকে। প্রতি বছরই বিভিন্ন ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে পূজা আয়োজিত হয়। অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে এক একটি অঞ্চলের বাসিন্দারা যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন তা বারোয়ারি পূজা বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত। ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বজনীন পূজা শুরু হয়। মুলত দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারতমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারনা বিপ্লবের আকার নেয়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দে মাতরম্ গানটি রচনা করেন যা ছিলভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র। সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ বিল্পবী ও জাতীয়তাবাদী নেতারা বিভিন্ন সর্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। এখন সর্বজনীন পূজায় ‘থিম’ বা নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক মণ্ডপ, প্রতিমা ও আলোকসজ্জার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। থিমগুলির শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কারও দেওয়া হয়।
১৭৯০ সালের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়াতে বারজন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে প্রথম সর্বজনীনভাবে বড় আয়োজনে দুর্গোৎসব পালন করেন--যা বারোইয়ার বা বারবন্ধুর পূজা নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। সেই বারো-ইয়ারি পুজোই আজকের বারোয়ারি পুজো। কাশিম বাজারের রাজা হরিনাথ ১৮৩২ সালে বারোইয়ারের এই পূজা কলকাতায় পরিচিত করান। পরে তাঁদের দেখাদেখি আস্তেআস্তে তা উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালি জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই থেকে বারোয়ারি পূজার শুরু। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্ম উত্সাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসুঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে একই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারি পূজার আয়োজন করে। বারোয়ারি দুর্গাপূজা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের চাঁদার টাকায় অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু সর্বজনীন দুর্গাপূজা হয়ে থাকে জনসাধারণের চাঁদার টাকায়। চাঁদা তোলার সময় উদ্যোক্তারা ধনী, দরিদ্র সবারই দ্বারস্থ হয়। অনেকসময় বাড়াবাড়িও করত (এখনো করে)।
সর্বজনীন দুর্গাপূজার পত্তন হয় কলকাতায়, ১৯২৬ সালে। সিমলা আর বাগবাজার—এ দুই জায়গায় সে বছর সর্বজনীন দুর্গাপূজা হয়। সিমলা ব্যায়াম সমিতির অতীন্দ্রনাথ বোস ছিলেন প্রথমটির উদ্যোক্তা। সিমলার প্রতিমাটি তৈরি করেছিলেন কুমোরটুলির বিখ্যাত মৃৎশিল্পী নিমাই পাল। প্রথম বছরে মূর্তিটি ছিল একচালা বিশিষ্ট। সে বছর অতীন্দ্রনাথ বোস জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে পূজাউৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারি বা কমিউনিটি পূজা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। উল্লেখ্য, বাগবাজারে দুর্গাপূজা সর্বজনীন নামে অভিহিত হয় ১৯২৬ সালে। এই পূজা আগে ছিল বারোয়ারি। সূচনাকাল ১৯১৮ (মতান্তরে ১৯১৯) সালে। স্থানীয় কিছু যুবক এক ধনীলোকের বাড়িতে দুর্গাঠাকুর দেখতে গিয়ে অপমানিত হন। পরের বছর তাঁরা বারোয়ারি পূজা চালু করেন এবং সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন পূজামণ্ডপের দ্বার। পূজার উদ্যোক্তা ছিলেন: রামকালী মুখার্জি, দীনেন চ্যাটার্জি, নীলমণি ঘোষ, বটুকবিহারী চ্যাটার্জি প্রমুখ। সঠিক অর্থে এই পূজাই ছিল কলকাতা তথা তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা। প্রথম সর্বজনীন পূজায় বাধার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন অনেক রক্ষণশীল পণ্ডিত। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন পণ্ডিত দীননাথ ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে। এখন সর্বজনীন দুর্গাপূজার ছড়াছড়ি। এই পূজারই রমরমা। বাড়ির পূজা আজ স্তিমিত।
১৯৩৮ সাল থেকে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর গণেশ প্রত্যেকের জন্য আলাদাআলাদা চালের ব্যবস্থা হয়। শুরু হয় কুমোরটুলি সর্বজনীন দুর্গাপূজা থেকে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পৌরোহিত্যে। ১৯৩৮ সালে সে পুজোর নতুন সভাপতি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ পুজো চলছে, পঞ্চমীর দিনই ঘটে গেল মহাবিপত্তি৷ মণ্ডপে চলে এসেছে একচালার ঠাকুর (সেইসময় একচালার প্রতিমায়ই পুজো হত), হঠাৎ বিকেলে মণ্ডপে আগুন লেগে যায়৷ মণ্ডপ, প্রতিমা, সব পুড়ে ছাই৷ অথচ পরের দিনই বোধন৷ নেতাজি ছুটে গেলেন শিল্পী গোপেশ্বর পালের কাছে৷ বললেন, যে করেই হোক, এক রাতের মধ্যে ঠাকুর তৈরি করে দিতেই হবে৷ সেকথা শুনে তো শিল্পী অবাক! তা কী করে সম্ভব? মুহূর্তের মধ্যে নেতাজি সিদ্ধান্ত নিলেন আলাদাআলাদা করে প্রতিমা গড়া হবে৷ গোপেশ্বর বাবু দুর্গা প্রতিমা গড়লেন৷ আর অন্যান্য শিল্পীরা গড়লেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ৷ একচালা প্রথা ভেঙে তৈরি হল পাঁচচালার ঠাকুর৷ একরাতের মধ্যেই সব তৈরি৷ ষষ্ঠীর দিন মণ্ডপে এল প্রথম পাঁচচালার ঠাকুর, যা সম্ভব হয়েছিল নেতাজির জন্যই৷ পুজো কমিটির বহু পুরনো সদস্য সংবাদমাধ্যমকে জানাচ্ছেন, সেবার একে তো পাঁচচালা, আর তার উপর দেবীর জমকালো সাজসজ্জা দেখে পুরোহিতসমাজ বেঁকে বসেছিল৷ তারপর শিল্পীর সঙ্গে বহু আলোচনার পর মেলে পুজোর পুরোহিত৷ তবে এটাই শেষ প্রথাভাঙা ছিল না৷ পরের বছর নেতাজি পুজো কমিটির সভাপতি থাকাকালীন কুমোরটুলি সর্বজনীন পুজোয় দেবী দুর্গার গায়ে উঠেছিল সত্যিকারের বাঘের ছাল, তা যদি আজকের দিনে হতো, তবে নিশ্চিতভাবে গণপ্রতিবাদের মুখে পড়তে হতো পুজো কমিটিকে৷