দুখাই

সংসারে দুখাইয়ের আর কেউ নেই; ছোটো মিনিই তার সংসারের একমাত্র অবলম্বন—মিনিই তার বুকের একমাত্র ধন। দুখাই গরিব বলে পরের বাড়িতে সত্তর-আশি টাকা রোজ হিসাবে কাজ করে কোনোমতে কায়ক্লেশে দিন কাটাত। দা-খানা হাতে করে দুখাই অতিপ্রত্যূষে একখানা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো পরে কাজের উদ্দেশ্যে কোনো নিকটবর্তী গ্রামে চলে যেত।




তারপর সুয্যিমামা যখন সোনার মেঘের মাঝে লুকিয়ে যেতেন, তখন আধসের চাল, দশ টাকার লঙ্কা, দশ টাকার নুন ও দা-খানা হাতে করে নিয়ে দুখাই বাড়ি ফিরত। বাড়ি এসে মিনির ও নিজের জন্য রাঁধত; বাপে-ঝিয়ে খেত, আর মিনির পরদিনের খাবার জন্য কিছু রেখে দিত। তারপর ছেঁড়া মাদুরের উপর শত শত তালির কাঁথাখানা পেতে বাপে-ঝিয়ে শুয়ে পড়ত। মিনির হাজার হাজার প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে তারা উভয়েই ঘুমিয়ে পড়ত। এমনি করে দুঃখের ভেতর দিয়ে তাদের দিনগুলি একরকম কাটছিল।




সেবার দেশে ভারি দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। দেশময় হা অন্ন! হা অন্ন! রব। অনাহারে দেশময় কত যে লোক মরতে লাগল! দুর্ভিক্ষের তীব্র আঘাতে সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহও যেন কমে এল। পুত্রের মুখের গ্রাস কেড়ে খেতে মায়ের হৃদয়ে লাগল না—সন্তানের আকুল কান্নায় হৃদয় টলল না। মহামারী ভৈরবী মূর্তি ধরে দেশে দেখা দিল। সর্বত্র হায়! হায়! রব পড়ে গেল।




এই দুর্ভিক্ষের দিনে দুখাইয়ের অবস্থাটা এক বার ভাবো তো! ভাবো তো, কেমন করে তার দিনগুলো কাটছিল। চারিদিকে হায়! হায়! রব। গরিব দুখাইয়ের দিন চালানো ভার হয়ে উঠল। এখন সে কোথাও কাজ পায় না, কাজেই কোনোদিন অনাহারে, কোনোদিন-বা অর্ধাহারে তার দিনগুলো কাটতে লাগল। নিজের জন্য তার কোনো চিন্তাই ছিল না, কিন্তু মাতৃহারা মিনির মলিন মুখের দিকে তাকালেই তার বুক ফেটে যেত। নীরবে সে তার মেয়ের গালে চুমু খেত।




সে আর-একদিনের কথা। সারাদিন ধরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল। দুখাই কোথাও কাজে যেতে পারেনি বলে দু-দিন যাবৎ তারা অনাহারী। তাই দুখাই নিকটবর্তী দোকানে তার কিছু ঘটি ও বাটি বন্ধক দিয়ে এক পোয়া চাল এনে কোনোমতে সেই দিনটা কাটাল।




এদিকে সন্ধ্যার একটু পরেই তার মনিব বৃষ্টিতে ভিজে সেই পর্ণকুটিরে এসে উপস্থিত। মনিব গোলকবাবুকে সে একটি ছোটো চৌকিতে বসতে দিল, কিন্তু তিনি বসলেন না। ব্যস্তসমস্তের মতো মনিবমশাই বললেন, “দুখাই, আমি তোর এখানে বসতে আসিনি রে।” কম্পিত স্বরে দুখাই বলল, “তা কীয়ের লাইগ্যা, কর্তা?” শোন, বলছি। গিরিশ বোসের নামে যে একটা মামলা রজু করেছি, তোর তাতে সাক্ষ্য দিতে হবে।” দুখাই কোনোদিনই আদালতে যায়নি বলে শুষ্কমুখে বলল, “না, কর্তা, মুই তা পারুম না।” গোলকবাবু বললেন, “পারবি না কেন? আমি দুটো কথা শিখিয়ে দেবো, তুই তা-ই বলবি।” দুটো মিছে কথা না বললে চৌধুরিদের বাগানটা আমার হাতছাড়া হয়ে যায়। বুঝলি, দুখাই?"




একে তো সাক্ষ্য দিতে হবে; তার উপর আবার মিথ্যা কথা। দুখাইয়ের মাথায় বজ্রাঘাত হলো। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “মিছা কথা…মিছা কথা, কর্তা, কইবার পারুম না। মুই জান দিতে পারুম, কর্তা, কিন্তু মিছা কথা কইবার পারুম না।”




“আরে ব্যাটা, তুই কি আর অমনি অমনি মিছা কথা বলবি?” এই বলে গোলকবাবু পকেট থেকে বের করে তার হাতে দুটি হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেন, “এই নে, কিন্তু কথা ঠিকমতো বলা চাই।” দুখাই নোট দু-খানা নেড়েচেড়ে বলল, “কর্তা, মোরে দিয়া মিছা কথা ক‌ওয়াইবার পারবেন না। মুই মিছা কথা কইবার পারুম না।”




গোলকবাবু তখন তাকে বললেন যে, এই দুইটা নোটই কেবল তাকে দিলেন না, মোকদ্দমায় জিতলে আরও দু-হাজার টাকা তাকে দেবেন। মিনির মুখের দিকে চেয়ে দুখাইয়ের মনটা একটু বিচলিত হলো বটে, কিন্তু পরক্ষণেই সে বলে উঠল, “না, কর্তা, মুই মিছা কথা কইবার পারুম না।”




উত্তেজিত হয়ে গোলকবাবু বলে উঠলেন, “বটে! পারবি না?” “আজ্ঞে না, কর্তা।” “আচ্ছা, দেখা যাবে।” বলেই গোলকবাবু ঘর থেকে দ্রুতপদে চলে গেলেন। কিন্তু আবার কী মনে করে যেন ফিরে এলেন। দুখাইকে লক্ষ করে গম্ভীর স্বরে বললেন, “দুখাই, দুখাই রে, পয়সা নাহয় আর‌ও কিছু বাড়িয়ে নিস। এখনও ভেবে দ্যাখ, পারবি কি না, নইলে তোর একদিন কি আমার একদিন!” দুখাইয়ের মুখ থেকে তেমনিই উত্তর এল, “না, কৰ্তা, মুই পারুম না।” “ছোটোলোক না হলে এরকম দুর্বুদ্ধি আসবে কোত্থেকে?” বলেই সেই বৃষ্টির মধ্যে গোলকবাবু হনহন করে চলে গেলেন।




ওই যে, ওই ওই দ্যাখ ভাই, দুখাই বিষাদভারাক্রান্ত হৃদয়ে শ্মশানঘাটে জ্বলন্ত চিতার পাশে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার বুকের উপর অশ্রুর বান বয়ে চলছে। জগতে কারও চিরদিন সমান যায় না; সবই কালের পরিবর্তন। দুখাইয়ের বেলাতেও তা-ই হয়েছে, তার দিনগুলিও সমান যায়নি।




গোলকবাবুর পক্ষে দুখাই মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়নি বলে তাঁর মিথ্যা সাক্ষীর অভাব হয়নি, তাই মামলায় জিতে চৌধুরির বাগান তিনিই পেয়েছেন। এখন আর গোলকবাবুকে পায় কে? মিথ্যা দেনার নালিশ করে তিনি দুখাইকে ভিটেছাড়া করলেন। গৃহহীন হয়ে দুখাই পথের ভিখিরি হলো। গোলকবাবু শুধু তাকে ভিটেছাড়া করেই ক্ষান্ত হলেন না, গ্রাম থেকে তার মুষ্টিভিক্ষা পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন। নিরুপায় হয়ে সে সংসারের অথ‌ই সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগল। কোনোদিন কেউ গোপনে কিছু খাবার দিলে সে তার ছোট্ট মেয়েটিকে খাওয়াত, নইলে অনাহারে বাপ-বেটির দিন কাটত।




অনশনের পর অনশনে ছোট্ট মেয়ে মিনি ক্রমশই নানা রোগে আক্রান্ত হতে লাগল। তারপর একদিন মিনির প্রচণ্ড জ্বর এল। গরিবের মেয়ের আর চিকিৎসাই হলো না ঠিকভাবে। চিকিৎসা ও খাবারের অভাবে ক্রমেই সে শীর্ণ হতে লাগল। হঠাৎ একদিন মিনি তার দু-চোখ বুজল, আর খুলল না। দুখাই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেই মলিন মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর উচ্ছ্বসিত হৃদয়াবেগে বালকের মতো হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। জগতের স্বাভাবিক নিয়মেই, কেউ এই দরিদ্রের দুঃখে দুঃখিত হলো না।




মনিব গোলকবাবুর ভয়ে কেউ মিনিকে এমনকী পোড়াতে পর্যন্ত এল না। অগত্যা নিজহাতেই দুখাই নিজের ছোট্ট মেয়েটিকে পোড়াল। চিতানলে মিনির ছোট্ট দেহখানি ভস্মীভূত হলো—এ নিষ্ঠুর জগৎ থেকে সে চিরদিনের মতো চলে গেল। চিতানলের মতো দুখাইয়ের হৃদয়েও যেন আগুন হু-হু করে জ্বলতে লাগল। শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে পাগলের মতো সেই চিতাভস্ম গায়ে মেখে দুখাই কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।




সাড়ে তিন বছর পর। তখন বেলা অপরাহ্ণ; বর্ষার বারিধারা ও নদীর উত্তাল তরঙ্গ তীরে এসে ভীষণ বেগে প্রতিহত হচ্ছিল। সেই সময় তরতর করে নদীবক্ষে একখানি ছোট্ট নৌকা উজান বেয়ে যাচ্ছিল। নৌকার যাত্রী মনিব গোলকবাবু, তাঁর স্ত্রী, ঝি আর বহু সাধনার ধন তাঁদের চার বছরের ছোট্ট ছেলে প্রতুল।




প্রতুল ভারি দুষ্টু। নৌকায় বড্ড তছনছ করছিল। হঠাৎ চিৎবাক্ খেয়ে নদীর জলে সে পড়ে গেল; অমনিই গোলকবাবু হায়! হায়! করে উঠলেন। তাঁর স্ত্রী উচ্চস্বরে চিৎকার করে কেঁদে উঠেই ঝির কোলে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ পার থেকে কে যেন নদীবক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব দিল। দেখা গেল, কিছুক্ষণ পরে প্রতুলকে কোলে করে লোকটা নৌকার উপর এসে উঠল। গোলকবাবু সবিস্ময়ে চেয়ে দেখলেন, সে আর কেউ নয়—সে হচ্ছে সেই বিতাড়িত ও লাঞ্ছিত দুখাই।
Content Protection by DMCA.com