চিরকাল শুনে আসছি—জগৎ দুঃখময়। যতগুলি দর্শন আছে, সবকটিরই শুরু দুঃখবাদে এবং সেই দুঃখ হতে মানুষ কী উপায়ে পরিত্রাণ পেতে পারে, সেই উপায় নির্ধারণ করাই প্রতিটি দর্শনের মুখ্য উদ্দেশ্য। আমরা যা শুনে আসছি, তা-ই মনের মধ্যে কোনো সংশয় না রেখেই বিশ্বাস করি। এক বারও আমরা স্থিরচিত্তে, একাগ্রভাবে বিচার করে দেখি না, দেখার চেষ্টাও করি না যে, যা শুনে আসছি, তা সত্য কি না। এই যে একটা বিশ্বাস আমাদের সবার মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে, তা আমাদেরকে এতটাই মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, আমরা তা হতে একচুলও এদিক-ওদিক যাবার সাহস পাই না।
মানুষ যে চিরদিন বা সারাক্ষণই দুঃখে মগ্ন, একথা বিশ্বাস করা যায় না; সে ক্ষণিক সুখী, ক্ষণিক দুঃখী—এটা বিশ্বাস করতে পারি। যে-ব্যক্তি সাময়িকভাবে সুখভোগ করছে, তাকেও জিজ্ঞেস করলে, সে-ও নির্বিকারভাবে বলবে যে, তার জীবনে আদৌ কোনো সুখ নেই। এমন মানুষ আমাদের আশেপাশে অনেক আছে। এমন লোককে কী বলব? তাকে মিথ্যুক বলা যায় না; কারণ তার মনে এই ধারণা আছে যে, মানুষ মাত্রেই অসুখী, সুতরাং সুখও যা, তা-ও তার কাছে দুঃখ বলে পরিগণিত। সে যা বলছে, তা হয়তো ঠিক, কিন্তু তার উপলব্ধির সাথে মুখের কথার মিল নেই, এখানেই হলো মূল সমস্যা।
ধরুন, কোনো ব্যক্তি নিজেকে সুখী বলে প্রচার করল। এখন কী হবে? তার আর রক্ষে নেই, অমনিই লোকে তাকে পাগল বলে উড়িয়ে দেবে। লোকে চায়—সকলেই বলুক, সংসার দুঃখময়। যদি তা-ই হয়, তাহলে পৃথিবীতে হাসির সৃষ্টি হলো কেন? ফুল ফুটলে, চাঁদ উঠলে, কোকিল ডাকলে, শিশু হাসলে প্রাণটা নেচে ওঠে কেন? স্নিগ্ধ বাতাস, রাতের নিস্তব্ধতা, নদীর ঢেউ, আকাশের গভীরতা—এ সব সত্তা কি বিষাদমাখা, না এ সবের দিকে তাকালে প্রাণটা দুঃখে আকুল হয়ে ওঠে? মা স্নেহভরে মধুর সম্ভাষণে কাছে ডাকলে, প্রেমময়ী সহধর্মিণী গদগদভাবে সামনে এসে দাঁড়ালে, সন্তানসন্ততি প্রাণের আবেগে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লে পাথরের মতন কঠিন দুঃখও কি দূর হয়ে যায় না?
যদি সকলই দুঃখোৎপাদক হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বলতে হবে যে, এই ধরা দুঃখভরা। একদিকে যেভাবে পৃথিবীর চারিদিকে আনন্দের প্রবাহ ছুটছে, সুখের তরঙ্গে চারিদিক কল্লোলিত হচ্ছে, অন্যদিকে আবার দুঃখও যে নেই, তা নয়। সুখের মতন দুঃখেরও একই রকমের প্রবাহ আছে, উত্তাল তরঙ্গ আছে, বিপুল বিভীষিকা আছে, বিয়োগ-বিরহ, জ্বালা-কর্কশতা, ব্যাধিবিকার…এ সকলই দুঃখের সহচর, অনুচর। এতেই যেন বোঝা যায় যে, জগৎ কেবল দুঃখময় নয়, সুখময়ও বটে। কিন্তু কীসের মাত্রা অধিক—দুঃখের, না সুখের?
যে দুঃখের চোখে পৃথিবীর দিকে তাকায়, সে সব জায়গায় দুঃখই দেখে; কিন্তু যে সুখের চোখে দেখে, সে সুখও দেখে, দুঃখও দেখে। এটাই হলো দুঃখের ও সুখের চোখের মধ্যে পার্থক্য। যে কেবলই দুঃখ দেখতে বদ্ধপরিকর, সে চিরদিন দুঃখই দেখবে। ইহজন্মে সুখ উপভোগ করা তার আর হবে না, সুখের মুখ দেখা কিছুতেই তার জীবদ্দশায় ঘটবে না।
তুমি দুঃখ ভালোবাসো? খুবই ভালো; তাহলে তুমি দুঃখ নিয়ে নীরবে থাকো, তোমার দুঃখ জাহির করে জগতের মানুষকে পাগল কোরো না, অপরের সুখের হন্তারক হয়ো না। মানুষ মাত্রেই সুখী, জীব মাত্রেই সুখী। সুখই জীবের লক্ষ্য, সুখই তার আদর্শ। দুঃখ ক্ষণিকের, কিন্তু সুখ অনন্তকালের। দুঃখ ভগবানের সৃষ্টি নয়, সুখই তাঁর সৃষ্টি। যিনি আনন্দময়, যিনি আনন্দের মধ্যে বিচরণ করেন, আনন্দই যাঁর ঐশ্বর্য, আনন্দই যাঁর সম্পদ, তাঁর দ্বারা দুঃখক্লেশের সৃষ্টি হতে পারে না। আমাকে দুঃখ দিয়ে তাঁর লাভ কী? ভগবান দু-জন থাকলে নাহয় বিশ্বাস করতে পারতাম যে, এক ভগবান সুখ, অন্য ভগবান দুঃখ সৃষ্টি করেন; এবং এভাবেই দুই জন ভগবান নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শনে ব্যাপৃত। কিন্তু তা তো নয়, ভগবান যে একমেবাদ্বিতীয়ম্!
যিনি সকল সৃজনের পালন-লয়কারী, তিনি আমাকে দুঃখ দিয়ে কী এমন মজা দেখবেন? আর আমি ক্ষুদ্র কীটাণুকীটের মধ্যে একজন, আমাকে আবার তিনি পরীক্ষা করবেনটা কী? তিনি জীবকে পরীক্ষা করেন, একথা মনে করলেও মনে পাপ এসে জমা হয়। আমাদেরকে দুঃখক্লেশ দেওয়াই যদি তাঁর অভিপ্রেত হতো, তাহলে সৃষ্টি করারই-বা কী প্রয়োজন ছিল? যদি সৃজনই করলেন, তবে আমাদের সুখ-সম্ভোগের জন্য এত আয়োজন করে রেখেছেন কেন? যাঁরা বলেন, জন্ম-মৃত্যু-জরা এ সবই দুঃখকর, আর পৃথিবীতে এলেই এ সব অবশ্যই ভোগ করতে হবে, তাদের হাত এড়ানোর জো নেই! ভাবুন তো, ওসব দুঃখ, না কি সত্য? যা সত্য, তা তো এড়ানো যায় না; তাহলে তা নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে মুহ্যমান থেকে কী হয়?
জন্মালে কীসের কষ্ট? যে মুহূর্তে শিশুর মাতৃজঠরে জন্মলাভ হলো, সেই মুহূর্ত হতেই মা তাকে পালন করতে লাগলেন—পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার আগে থেকেই মাতৃস্তনে অমৃতসমান স্তন্য এসে সঞ্চিত হলো। যে জন্মাল, এখানে তার দুঃখ কোথায়? ওই অবস্থায় তার ভালো-মন্দ বোঝার সামর্থ্যই-বা কোথায়? এখানে যদি দুঃখ ভোগ করার কেউ থাকে, তাহলে তিনি হচ্ছেন মা। এর কারণ, তিনি সন্তানকে ভ্রূণ অবস্থা হতে দু-শো আশি দিন সময়কাল নিজের শরীরের মধ্যে রক্ষা করে লালন-পালন করেছেন; পাছে গর্ভস্থ শিশু কোনোভাবে কষ্ট পায়, এই ভয়ে সারাক্ষণই সতর্ক, সারাক্ষণই চিন্তিত থেকেছেন মা! শিশুটির জন্য মা কত কত ত্যাগস্বীকার করেছেন, তার সীমা নেই। এখানে শিশুর দুঃখ কী? ভূমিষ্ঠ হলে শিশু ব্যাধিবিকারের অধীন হয় বটে, কিন্তু সে অবস্থায় তার তো কিছুরই অনুভূতি উৎপন্ন করার সামর্থ্য জন্মে না। যতদিন না সে আত্মনির্ভর হতে পারে, ততদিন তার লালন-পালন ও সুখ-দুঃখ সব কিছুই মা-বাবা'র উপর নির্ভর করে।
তারপর দেখি, জন্মালে রোগশোক আছে বটে, কিন্তু তা কি প্রতিদিনের, না প্রতিক্ষণের? আগেই বলেছি, তা-ও ক্ষণিকের, এবং তার স্মৃতিও ক্ষণিকের। যিনি স্বয়ং আনন্দময়, তিনি যে জগতকে আনন্দে নিমজ্জিত করে রেখেছেন, তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। তবে যে শোক-তাপ ও জরা-ব্যাধি দেখি, তাদের অধিকাংশই নিজ নিজ কৃত দোষের ফল কিংবা সত্য-স্বাভাবিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি 'সত্যস্য সত্যম্' (বৃহদারণ্যকোপনিষদ্)। সুতরাং আমরাও যখন তাঁরই এক-একটি অংশ অনেক রূপে বিদ্যমান রয়েছি, আমরাও সৎ বা ব্রহ্ম বাদে অন্য কিছুই নই। সৎকে অ-সৎ বা অনস্তিত্বশীল কখনও স্পর্শ করতে পারে না।
বহুরূপে আমরা যখন প্রেরিত হয়েছি, আর এই সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে ও টিকে আছি, তখন আমাদেরকে প্রকৃতির সাথে খেলা করতেই হবে। সময়ে সময়ে পদস্খলন হয়, এটাই হলো দুঃখের কারণ। পথ দেখে চললে হোঁচট লাগে না। ভগবানে লক্ষ্যস্থির রেখে চললে কোটি কোটি দুঃখ এসেও কিছুই করতে পারে না। সুতরাং তখন আনন্দের আর অভাব থাকে না। জগতে আনন্দে চলতে হবে, কোনোমতেই দুঃখকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না। দুঃখ এক মহান শিক্ষক, দুঃখ এক পরিস্থিতি মাত্র—তাই জীবনে দুঃখের প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা মেনে নেওয়াই সুখী হবার প্রথম ধাপ।
আরেকটা কথা। মানুষ স্বভাবতই সুখী। সুখ নিয়েই সে জন্মেছে, এজন্যই সুখের কথা সে আলাদা করে ভাবে না, দুঃখে পড়লেই হা-হুতাশ করে। যদি দুঃখেরই প্রাধান্য হতো, তাহলে দুঃখে দুঃখে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যেতাম, দুঃখের বিষয়ে আলাদা করে ভাবতাম না, দুঃখ হতে পরিত্রাণের চেষ্টা করতাম না। আমরা সুখময় জীব বলেই সামান্য দুঃখের সংস্পর্শে ব্যাকুল ও বিকল হয়ে পড়ি। সৃষ্টির সঙ্গে যেমন নানা সামগ্রী দিয়ে ঈশ্বর আমাদের সকল অভাব পূরণ করে রেখেছেন, অন্যদিকে কতগুলি নিয়ম করেও দিয়েছেন। সেগুলি কার্যকারণ আকারে এতটাই শৃঙ্খলাবদ্ধ যে, কোথাও সামান্য ভ্রম বা পদস্খলন হলে খুব সহজে তা হতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না।
এ কারণেই ভগবানের প্রতি দৃষ্টি রেখে, সেই দৃষ্টিতে নিজেকে স্থির করে বিভিন্ন জরুরি নিয়মের মধ্য দিয়ে চলে গেলে দুঃখের আঁচটাও গায়ে লাগবে না। যেখান হতে এসেছি, সেখানেই ফিরে যেতে হবে, কেউই এখানে থেকে যেতে পারবে না। মানুষ শূন্য থেকে এসে শূন্যতেই মিলিয়ে যায়। এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে না হবে, তা এক ঈশ্বরই জানেন। তাই তাঁর সম্পদ ও শক্তিকে উপেক্ষা না করে প্রফুল্লচিত্তে একমনে ও একধ্যানে তাঁর অভিপ্রেত কাজ করে যেতে হবে। সংসারে এসে কাজের ভার ত্যাগ করে নির্জন অরণ্যে লুকিয়ে থাকলে চলে না। এটাই বাস্তবতা, এটাই সত্য, এটাই স্বাভাবিক। এটা মেনে নেবার অক্ষমতার নামই দুঃখ, যা মানুষের নিজেরই কল্পনা বা সৃষ্টি।