দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ৭



এই পারিষহগুলো জয় করাই “পারিষহজয়”—অর্থাৎ বাহ্যিক ও অন্তর উভয় প্রতিকূলতাকে শান্ত সহিষ্ণুতায় অতিক্রম করা। জৈন সন্ন্যাসীরা বলেন, শীত লাগলে শরীর কাঁপে, কিন্তু মন যেন না কাঁপে; ক্ষুধা এলে পেট ফাঁকা থাকে, কিন্তু চিত্ত যেন ভারী না হয়। এটি দমন নয়, বরং একপ্রকার আত্মদর্শন—যেখানে অনুভবকে অস্বীকার না করে, কিন্তু তার দ্বারা আক্রান্ত না হওয়া শেখা হয়।

২.১৫, ২.৫৬, ২.৬৪—গীতার এই শ্লোকগুলি স্পষ্ট করে যে, শারীরিক কষ্ট (শীত, ক্ষুধা) বা মানসিক আনন্দ (সুখ, তৃপ্তি) স্বীকার করার পরেও মনকে তার দ্বারা বিচলিত হতে দেওয়া যাবে না—এটাই স্থিতাবস্থা। চোখ যেমন রূপ দেখছে, বা পেট যেমন ক্ষুধা অনুভব করছে, তা চলতে থাকুক (বিষয়ানিন্দ্ৰিয়ৈশ্চরন্), কিন্তু মন যেন সেই অনুভবের প্রতি আসক্ত বা বিতৃষ্ণ না হয়। মনকে অনুভবের 'কর্তা’ নয়, বরং'দ্রষ্টা' বা সাক্ষী হিসেবে রাখার শিক্ষা দেয় এই দর্শন।

এখানেই সম্যগ্‌চারিত্র মূল অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। কারণ যখন আচরণ দৃষ্টির সঙ্গে, আর দৃষ্টি জ্ঞানের সঙ্গে সুর মেলায়, তখন বাইরের ঝড় ভেতরের সিদ্ধান্ত নাড়াতে পারে না। মানুষ তখন কষ্টকে দেখে, কিন্তু কষ্টের দ্বারা নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে না। অপমান আসে, কিন্তু ক্রোধ জাগে না; প্রশংসা আসে, কিন্তু গর্বে মন ফুলে ওঠে না। পারিষহজয়ের এই অবস্থা হল আত্মার দৃঢ়তা—যেখানে সংযম আর প্রাকৃতিক হয়ে যায়, তপস্যা রূপান্তরিত হয় প্রশান্তিতে।

গীতায়ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় ভক্তের (যোগীর) লক্ষণ বর্ণনা করার সময় বিশেষভাবে প্রশংসা-নিন্দা, মান-অপমানের প্রতি সমতার ওপর জোর দিয়েছেন—১২.১৮, ১২.১৯ শ্লোকে। গীতা শেখায় যে, বাহ্যিক ঘটনা (অপমান, প্রশংসা) ঘটবেই, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতির অর্থ হলো সেই ঘটনাগুলির মানসিক প্রতিক্রিয়া (ক্রোধ, গর্ব) তৈরি না হতে দেওয়া।

জৈন আচার্যরা বলেন, এই সহিষ্ণুতাই আত্মার পরিচয়। কারণ যে-আত্মা সত্যিই জেগে আছে, তার ক্ষতি কেউ করতে পারে না। ধীরে ধীরে কায় (দেহ), মন ও বাক্যের প্রতিটি ক্রিয়া যখন সমত্বে স্থিত হয়, তখন আর নতুন কার্মিক কণা আকর্ষিত হয় না; পুরোনো কার্মিক আবরণও ঝরতে শুরু করে। কষায়ের গ্রন্থি আলগা হয়, কারণ ক্রোধ, মান, মায়া, লোভ—এই চারটি বিষ তখন মনকে বিষাক্ত করতে পারে না। আত্মা নিজের স্বাভাবিক স্বচ্ছতা ফিরে পায়, এক গভীর, স্থির শান্তিতে জেগে ওঠে।

এই জাগরণে কোনো আড়ম্বর নেই, কোনো অলৌকিকতার দাবি নেই। এটি নীরব, সূক্ষ্ম ও প্রতিদিনের। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ছোটো সিদ্ধান্তে—ক্রোধের মুহূর্তে নীরব থাকা, ক্ষুধায় সংযম রাখা, অপমানে স্থির থাকা—এই ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলোতেই গড়ে ওঠে মুক্তির ভিত্তি। পারিষহজয় মানে তাই দুঃখ দমন নয়, দুঃখের প্রতি মনোভাব বদলে ফেলা—যেখানে প্রতিটি যন্ত্রণা এক শিক্ষক হয়ে ওঠে, আর প্রতিটি বাধা আত্মার দীপ্তিকে আরেকটু উজ্জ্বল করে তোলে।

সম্যগ্‌চারিত্র হলো জৈন মুক্তিপথের চলমান সেতু—দর্শনের আলো ও জ্ঞানের দিশা যে-সেতু পেরিয়ে জীবনের মাটিতে নামতে পারে। যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে অহিংসা আত্মাকে আচ্ছাদন দেয়, সত্য বাক্যকে স্বচ্ছ করে, অস্তেয় অন্যের প্রাপ্য ফিরিয়ে দেয়, ব্রহ্মচর্য শক্তিকে স্বচ্ছ রাখে, অপরিগ্রহ হৃদয়কে হালকা করে। এই ধারাবাহিক অনুশীলনেই আচরণ ধীরে ধীরে চরিত্রে, চরিত্র সাধনায়, আর সাধনা মুক্তির স্বাদে রূপ নেয়—যেখানে আত্মা অনুভব করে, বাহিরে কিছু জয় করার নেই; জয় তো ভেতরেই, আসক্তিহীন, নির্মল, সমবেত করুণার নীরব দীপ্তিতে।

এই তিনটির একত্র সাধনেই জৈন আত্মা মুক্তির পথে এগোয়। শুধু জ্ঞান থাকলে তা অহংকারে রূপ নেয়, আর আচরণ থাকলেও জ্ঞান না থাকলে তা যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। তাই সম্যগ্‌দর্শন জ্ঞানের দিকনির্দেশ দেয়, সম্যগ্‌জ্ঞান চিন্তার গভীরতা আনে, আর সম্যগ্‌চারিত্র সেই ভাবনাকে কর্মে রূপ দেয়।

জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে এই তিনটির ভারসাম্য স্থাপনই আসল সাধনা। বর্ষাবাসের সময় সন্ন্যাসীরা নিরিবিলি আশ্রমে বা গুহায় বসে আগম, সূত্র ও তত্ত্ব পাঠ করেন। আগম হলো জৈন ধর্মগ্রন্থসমূহের সামষ্টিক নাম, যা তীর্থঙ্কর মহাবীরের উপদেশ থেকে উদ্ভূত। সূত্র হলো তত্ত্ব, আচরণ ও শৃঙ্খলার মূলনীতি, আর উপাঙ্গ ও নিদান হলো সেই সূত্রের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ। এই গ্রন্থপাঠের লক্ষ্য কেবল মুখস্থ বিদ্যা নয়; বরং একেকটি বাক্যের মাধ্যমে নিজের অন্তরকে পরিষ্কার করা।

জ্ঞানচর্চার সময় যে কয়েকটি দর্শনমূলক ধারণা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, সেগুলো হলো অনেকান্তবাদ, নয়বাদ এবং স্যাদ্বাদ।

জৈন দর্শনের কথোপকথনে অনেকান্তবাদ, নয়বাদ ও স্যাদ্বাদ—এই তিনটি যেন একটিমাত্র সেতুর তিনটি ধাপ, যেখানে সত্যকে দেখা, বলা ও বোঝার ভঙ্গি ধীরে ধীরে নম্র, প্রসারিত ও শর্তনির্ভর হয়ে ওঠে।

অনেকান্তবাদ প্রথমে আমাদের চেতনার দরজা খুলে দেয়—বাস্তবতা একমাত্রিক নয়, বহু-মুখী; কোনো একটিমাত্র দৃষ্টিকোণকে “চূড়ান্ত” বলে বসা আসলে মায়া। অন্ধরা আর হাতির গল্পে প্রত্যেকে নিজের স্পর্শে যে-অংশটি পেল—দাঁত, কান, লেজ বা পা—তাকেই সম্পূর্ণ ভেবে বসেছিল; কিন্তু হাতি তো সব মিলিয়ে একটি সমগ্র। এখানেই অহংকার গলে: “আমারটুকুই সত্য”—এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আমরা স্বীকার করি—অন্যের কাছে এমন কিছু দিক ধরা পড়ে, যা আমার চোখ এড়ায়; তাই শুনতে, দেখতে, শিখতে হবে। এই স্বীকৃতিই সহিষ্ণুতার বীজ, কারণ বহুমুখী সত্য মানে বহু কণ্ঠ, বহু অভিজ্ঞতা, বহু প্রমাণ—যাদের সাথে সংলাপ না করলে সমগ্রটি ধরা পড়ে না।

এই বহুমুখিতা স্বীকার করার পর নয়বাদ দেখায়, কীভাবে কথা বলতে হয়। “নয়” মানে দৃষ্টিকোণ; নয়বাদ বলে, যে-কোনো বক্তব্যই একটি নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে সত্য, অবস্থান বদলালে তার রূপও বদলে যাবে। চিকিৎসকের কক্ষে রোগী “অনুভব”-এর নয় থেকে ব্যথাকে সত্য বলেন; পরীক্ষাগারের নয় থেকে রক্তপরীক্ষা আরেক সত্য বলে; নীতির নয় থেকে “রোগীর স্বায়ত্তশাসন” আবার অন্য এক সত্য জোর দিয়ে তোলে। এই ভিন্ন নয়দের সহাবস্থান বিরোধ নয়; এরা পরস্পর-সম্পূরক। নয়বাদ আমাদের শেখায়—বিচার বা প্রস্তাব দেওয়ার আগে বলো, “কোন নয় থেকে বলছি”—ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নয়, বৈজ্ঞানিক পরিমাপের নয়, নৈতিক মূল্যবোধের নয়, না কি আইনি প্রক্রিয়ার নয়। দৃষ্টিকোণ ঘোষণা করলে বাক্য নম্র হয়, ভুলের সম্ভাবনা কমে, আর সংলাপ ফলপ্রসূ হয়।

স্যাদ্বাদকে বুঝতে হলে আগে মনে রাখতে হয়—জৈন যুক্তি কোনো একরেখায় ঠাসাঠাসি করে সত্যকে বেঁধে ফেলতে চায় না; বরং বহুতা (অনেকান্ত) ও দৃষ্টিকোণ (নয়)-কে “শর্তের ভাষা”-য় নামিয়ে এনে কথাকে বিনয়ী ও দায়িত্বশীল করে তোলে। “স্যাত্” মানে “যথাযথ শর্তে”; তাই স্যাদ্বাদ বলছে, কোনো উক্তি নিঃশর্তে ও চরম অর্থে সত্য নয়—উক্তির সত্যতা নির্ভর করে কোন শর্তে, কোন কালে, কোন স্থানে, কোন প্রেক্ষাপটে এবং কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হচ্ছে, তার উপর। এই শর্তনির্ভর কথনকে জৈন আচার্যরা সাতটি সম্ভাব্য ভঙ্গিতে ভেঙে দেখিয়েছেন—সপ্তভঙ্গী নয়বাদ—কিন্তু সাতটি আলাদা “দাবি” হিসেবে নয়; একটিই বাস্তব, যাকে সাতটি ভিন্ন আলো থেকে দেখা ও বলা যায়।

শর্তসাপেক্ষে “অস্তি” অর্থাৎ “আছে” বলতে আমরা বুঝি, নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে এটি সত্য। যেমন, “ঘটটি আছে”—ঘরের তাকের প্রেক্ষাপটে, এই মুহূর্তে, দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে—এটি সত্য। শর্ত বদলালে সঙ্গে সঙ্গে ভাষ্য বদলায়; ঘরের বাইরে কেউ বলল, “ঘটটি নেই”—সে বলছে “নাস্তি”, এবং সেটিও সত্য—কারণ আঙিনার প্রেক্ষাপটে ঘট অনুপস্থিত। এইভাবে “অস্তি-নাস্তি”—দুই-ই একসঙ্গে প্রযোজ্য হতে পারে, যদি আমরা দুই ভিন্ন দিক, সময় বা নয় একই কথায় ধরতে চাই; যেমন সোনার গহনা “অস্তি” গহনার রূপে, আবার “নাস্তি” বিশুদ্ধ সোনার রূপে—দৃষ্টিকোণ বদলালেই বাচ্য বদলে যায়।

কখনো এমনও হয় যে, যা বলতে চাই, তা এইমুহূর্তের ভাষায় নিখুঁত ধরা পড়ে না—ধরা পড়লেও বিভ্রান্তি হতে পারে; তখন উক্তি “অবক্তব্য”—শর্তসাপেক্ষে বাক্যটি অব্যক্ত রাখাই যথাযথ। “অবক্তব্য” মানে অবাস্তব নয়; বরং ভাষা, শ্রোতার প্রস্তুতি, প্রেক্ষাপট—সব মিলে যে-সূক্ষ্মতা চাই, তা অনুপস্থিত। এই চারটির সঙ্গে আরও তিনটি মিশ্র ভঙ্গি যুক্ত হয়—“অস্তি-অবক্তব্য”, “নাস্তি-অবক্তব্য”, এবং “অস্তি-নাস্তি-অবক্তব্য”—যেখানে সত্য, অসত্য ও অব্যক্ত—তিনটি সম্ভাবনা শর্তের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে একসঙ্গে জায়গা পায়।

এখানে প্রতিটি পরিভাষার ভিত আলাদা করে ধরলেই স্যাদ্বাদের মর্ম খুলে যায়। “শর্ত” মানে কেবল বাহ্য কারণ নয়; এখানে সময়—এইমাত্র/আগামীকাল, স্থান—ঘর/আঙিনা/শহর, প্রেক্ষাপট—ব্যাবহারিক/তাত্ত্বিক/আধ্যাত্মিক, এবং “নয়”—অর্থাৎ আমরা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করছি—এ সবই জড়িত।

“অবক্তব্য” মানে নীরবতা-সাধনা নয়; এটি বোধের সততা: এই মুহূর্তে ‘ঠিক’ বললে ভুল বোঝাবুঝি হবে—তাই শর্ত পাকা না হলে নীরব থাকা বা কথা স্থগিত রাখা অধিক দায়িত্বশীল। “অস্তি-নাস্তি”র একসঙ্গে প্রয়োগ কোনো আত্মবিরোধ নয়; এটি বহুস্তর বাস্তবতার সহাবস্থান। যেমন দই “অস্তি” দুধ-নির্ভর রূপান্তরের ফল, আবার “নাস্তি” দুধ—কারণ সেই নির্দিষ্ট গুণাবলি আর নেই; আবার তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বললে “অস্তি-নাস্তি”—দুই-ই, শর্তভেদে সত্য।

বাস্তব উদাহরণে দেখলে স্যাদ্বাদের শ্বাস-প্রশ্বাস বোঝা যায়। চিকিৎসা-কক্ষে রোগী বলেন, “আমার ব্যথা আছে”—এটি অভিজ্ঞতার নয়ে “অস্তি”; পরীক্ষাগারের প্রতিবেদন বলল “কোনো ফাইন্ডিং নেই”—এটি জৈব-মাপের নয়ে “নাস্তি”; চিকিৎসা-নীতির নয়ে বলা যায়, “এখনই রোগনির্ণয় সম্পর্কে বলা যাচ্ছে না”, যা অবক্তব্য—অর্থাৎ আরও তথ্য ছাড়া দৃঢ় উক্তি বিভ্রান্তিকর। তিনটিই সঠিক, কারণ তিনটি ভিন্ন শর্ত-নয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একে যদি স্যাদ্বাদের ভাষায় বলি, “স্যাত্—ব্যথা আছে”, “স্যাত্—ফাইন্ডিং নেই”, “স্যাত্—নির্ণয় এখন অবক্তব্য”—তাহলে কথাগুলো ঝগড়া না বাড়িয়ে বোঝাপড়া বাড়ায়।

এই শর্ত-সচেতনতা অহংকার কমায়, কারণ আমরা আর “আমার উক্তিই চূড়ান্ত” বলে বসি না; বরং বলি “আমার উক্তি এই নয়ে, এই শর্তে সত্য”—অর্থাৎ বাক্য বিনয়ী হয়। যুক্তিবোধও শৃঙ্খলিত হয়; কারণ শর্ত না জেনে ‘হ্যাঁ/না’ ঘোষণা না দিয়ে “এভাবে বলা যায়”—এই ভঙ্গিতে কথা বলা শেখে। গবেষণাগারে এটি হাইপোথিসিসের ভাষা, আদালতে এটি প্রমাণের ভারসাম্য, সম্পর্কের জগতে এটি সহিষ্ণুতার ব্যাকরণ। এমনকি অন্তর্দর্শনেও স্যাদ্বাদ কাজ করে—আজ যে-বিষয়ে আমার ক্রোধের নয় থেকে বিচার করেছি, আগামীকাল শান্ত নয় থেকে দেখলে উক্তিটাই বদলে যায়; তাই আত্মসমালোচনায় আমরা শর্ত লিখে রাখি—“এ কথা বলছি ক্লান্তি/ভয়/রাগের পরিস্থিতিতে”—তখন সত্যের দিকে যাত্রা সৎ ও ধীর হয়।

স্যাদ্বাদ কোনো কূটকৌশল নয়; এটি সত্যের প্রতি নম্রতার শিল্প। “যথাযথ শর্তে”—এই ছোটো শব্দবন্ধই কথাকে ঝুলিতে নয়, প্রেক্ষাপটে বসায়; বিরোধকে শত্রুতে নয়, সহাবস্থানে রূপ দেয়; এবং জ্ঞানের দাবিকে মুকুটে নয়, দায়িত্বে নামিয়ে আনে। এইভাবেই স্যাদ্বাদ অনেকান্তের প্রশস্ততা ও নয়বাদের শৃঙ্খলাকে একত্রে বেঁধে দেয়—ফলে সম্যগ্‌দর্শন টেকে, সম্যগ্‌জ্ঞান ধার পায়, আর সম্যগ্‌চারিত্র দৈনন্দিন ভাষা ও ব্যবহারে এক সূক্ষ্ম, শান্ত আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে।

এই তিনটি স্তম্ভ মিলেই জৈন সংলাপের নৈতিকতা গড়ে ওঠে। অনেকান্তবাদ অহংকার ভাঙে—আমি-দেখা সব নয়; নয়বাদ বুদ্ধিকে শৃঙ্খলায় আনে—কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি, তা জানাই; স্যাদ্বাদ বাক্যকে মৃদু ও শর্তনির্ভর করে—যথাযথ শর্তে এ কথা সত্য। এর বাস্তবে ফল কী? বিতর্কে ‘জিততে’ চাওয়ার প্রবণতা কমে, বোঝার আগ্রহ বাড়ে; নীতিনির্ধারণে এক-চোখা ফতোয়া কমে, বহুমাত্রিক প্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত এগোয়; আন্তঃসম্পর্কে তড়িঘড়ি বিচার নয়, প্রেক্ষাপট-সহানুভূতি বাড়ে।

এমনকি নিজের ভেতরও এই ত্রয়ী কাজ করে—আত্মসমালোচনায় আমরা দেখি, কোনো একদিন আমার “রাগের নয়” থেকে দেখেছি, অন্য একদিন “ভয়ের নয়” থেকে; তখন সিদ্ধান্ত মোলায়েম হয়, ক্ষমা সহজ হয়, আর সত্যের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়।