এই হালকাভাব কেবল বাহ্যিক নয়; এটি আধ্যাত্মিক মুক্তির চিহ্ন। কারণ, যতক্ষণ “আমার” ভাব বিদ্যমান, ততক্ষণ কার্মিক বন্ধন টিকে থাকে। কিন্তু যখন মানুষ বুঝতে পারে যে, কোনো কিছুরই স্থায়ী মালিকানা তার নয়, তখন সে স্বাভাবিকভাবেই দানশীল, উদার ও শান্ত হয়ে ওঠে। অপরিগ্রহ তখন এক মানসিক স্বচ্ছতা—যেখানে সম্পদের সীমা নয়, আকাঙ্ক্ষার সীমাই সত্যিকারের মুক্তির সূচনা।
এইভাবেই অপরিগ্রহ আমাদের শেখায়, ত্যাগ নয়—প্রবাহই জীবন। জিনিস, সুযোগ, সাফল্য—সবই আসে ও যায়; আমাদের কাজ হলো তাদের আঁকড়ে না ধরা, বরং সচেতনভাবে ব্যবহার করে ছেড়ে দেওয়া। যে দিতে জানে, সে-ই সত্যিকারের মুক্ত, কারণ তার কাছে কিছু হারানোর ভয় থাকে না। আর যেখানে ভয় নেই, সেখানেই শান্তি।
জৈন দর্শনে গৃহস্থ ও সন্ন্যাসী উভয়কেই একই মুক্তিপথে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে, শুধু পথের কঠোরতা ও প্রয়োগের মাত্রা আলাদা। সংসারে থেকে গৃহস্থের পক্ষে সম্পূর্ণ ব্রহ্মচর্য, অহিংসা বা অপরিগ্রহ কঠোরভাবে পালন করা সম্ভব নয়—তবু সংযম, সততা ও করুণার মূলচেতনা ধরে রেখে তিনি সম্যগ্চারিত্রকে জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রয়োগ করতে পারেন। এই কারণেই জৈন শাস্ত্রে গৃহস্থদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে বারোটি ব্রত (Dvādasha-vrata)—যা সাধকের পথকে সংসারের মধ্যেও আধ্যাত্মিক করে তোলে।
এই বারো ব্রত তিন ভাগে বিভক্ত—পাঁচ অনুব্রত, তিন গুণব্রত, এবং চার শিক্ষা-ব্রত।
গৃহস্থের জৈনজীবনে সংযমকে জীবন্ত করতে যে বারো ব্রতের কথা বলা হয়, তার প্রথম স্তরই হলো পাঁচ অনুব্রত—পাঁচ মহাব্রতের গৃহস্থরূপ। ‘অনু’ উপসর্গটি এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ; এটি বোঝায় পরিমিতি ও বাস্তবতা—সংসারে থেকে যতদূর সম্ভব কঠোর আদর্শের নিকটে যাওয়া।
অহিংসায় তাই গৃহস্থ প্রতিজ্ঞা করেন, জীবহিংসা যতটা সম্ভব এড়াবেন; খাদ্য, চলাফেরা, পেশা ও ভোগের ক্ষেত্রে এমন নির্বাচন করবেন যাতে অনর্থের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়।
সত্যে তিনি কেবল “মিথ্যা বলব না” বলে থামেন না, বরং ভাষাকে এমনভাবে শোধন করেন, যাতে অতিরঞ্জন, পরনিন্দা, বিদ্বেষ-উসকানি বা বিভ্রান্তিমূলক অর্ধসত্যও না বেরোয়—কারণ সত্যের উদ্দেশ্য হলো উপকারে বাস্তব প্রকাশ, আঘাতে নয়।
অস্তেয় মানে অনধিকার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা—শুধু জিনিস চুরি নয়, অন্যের সময়, কৃতিত্ব ও মানসিক শান্তিও ‘প্রাপ্য’; সেগুলো কেড়ে নেওয়াও চুরিরই সূক্ষ্ম রূপ।
ব্রহ্মচর্য গৃহস্থজীবনে রূপ পায় নৈতিক সংযমে—বৈবাহিক সম্পর্কের মর্যাদা রক্ষা, ইন্দ্রিয়ের আস্বাদের উপরে চেতনার স্থিতি, আকর্ষণের উপর দায়িত্বের জয়।
অপরিগ্রহ এখানে বাহুল্য কমানো এবং আকাঙ্ক্ষার স্রোতকে বশে আনা—যত কম আঁকড়ে ধরি, তত সহজে দিই; যত সহজে দিই, তত হালকা হই।
অনুব্রতগুলি তাই দমন নয়, দিশা—জীবনের ভেতরে থেকেও কষায়ের (ক্রোধ, মান, মায়া, লোভ) ঘনত্ব পাতলা করার প্রতিদিনের অনুশীলন।
এই ভিত্তির উপর দাঁড়ায় তিন গুণব্রত—এখানে ‘গুণ’ মানে গভীরতা ও শুদ্ধতা।
দিগ্ব্রত প্রথমেই চলাচল ও ক্রিয়ার সীমা নির্দিষ্ট করে; আমরা জানি, সীমা না থাকলে মন ছড়িয়ে পড়ে, আর ছড়িয়ে পড়া মনই সর্বাধিক জীবহিংসার কারণ। তাই গৃহস্থ নিজের দৈনন্দিন পরিসীমা ঠিক করেন—ব্যাবসা, ভ্রমণ, ভোগে অনাবশ্যক বিস্তার নয়; প্রয়োজননির্ভর সীমানা।
দেশাবাধব্রত সেই সীমাকে স্থানে স্থানে আরও নির্দিষ্ট করে—যেখানে থাকা দরকার, সেখানেই থাকা; অবকাশ, কৌতূহল বা লোভে অকারণ যাতায়াত নয়, কারণ চঞ্চলতা অহিংসা ও অপরিগ্রহকে শিথিল করে।
অনর্থদণ্ডব্রত হলো অভ্যন্তরীণ প্রহরী—অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর বা হিংসামূলক কাজ, কথা ও চিন্তা বন্ধ করা। গালগল্প, হিংস্র বিনোদন, পরের দুর্ভাগ্যে হাসি, অর্থহীন বিতর্ক—এসবই অনর্থ; এগুলো থামাতে পারলেই অনুব্রতগুলো হৃদয়ে গাঢ় হয়।
গুণব্রত আমাদের শেখায়, সংযম মানে শুধু বর্জন নয়; সচেতন সীমারেখা টানা—আর সেই সীমাই প্রকৃত স্বাধীনতার রক্ষাকবচ।
চার শিক্ষা-ব্রতের মর্ম বোঝাতে গেলে আগে বুঝতে হয়—‘শিক্ষা’ মানে কেবল নিয়ম শেখা নয়, বরং অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে নিজেকে ধাপে ধাপে শোধন করা। তাই এই স্তরে প্রতিটি ব্রতই আচরণের গঠনতন্ত্র বদলে দেয়: ভেতরে সমত্ব জন্মায়, বাইরে সংযম টেকে, আর দানের আনন্দে ‘আমার’-ভাব নরম হয়ে প্রবাহে মিশে যায়।
সমায়িক এখানে প্রতিদিনের সমতা-ধ্যান—একটি নির্দিষ্ট সময়ে বসে মনকে সমান তলে নামানো, যেন প্রশংসা বা নিন্দা, লাভ বা ক্ষতি, সুখ বা দুঃখ—কোনোটাই মনের কেন্দ্রকে টলিয়ে দিতে না পারে। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৫৫-৭২ শ্লোকে যে স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন—ইন্দ্রিয়-সংযত, রাগ-দ্বেষ-পার, সুখদুঃখে সমচিত—সমায়িক তারই দৈনন্দিন সাধনা; দ্বাদশ অধ্যায়ের ১৩-২০ শ্লোকে প্রিয়-ভক্তের যে নির্মল গুণাবলি—অদ্বেষ, মৈত্রি, ক্ষমা, সমবুদ্ধি—তারও ভিত সমায়িকেই দাঁড়ায়।
জৈন দৃষ্টিতে সমায়িকের লক্ষ্য দমন নয়, দিশা: উত্তেজনা উঠলেই শ্বাসে ফেরা, আনন্দ এলে কৃতজ্ঞ থাকা, আঘাত এলে প্রতিশোধ নয়—বোধে ফিরে যাওয়া। নিয়মিত এই সমতা-ধ্যান অহিংসাকে হৃদয়ে বসায়, সত্যবচনকে কোমল করে, আর বাকী সব ব্রতের জন্য স্থির ভিত গাঁথে।
এই ভিতের উপর দেশাবন্ধ শিক্ষা-ব্রত স্থিতির অনুশীলন হিসেবে কাজ করে। দেশাবন্ধ মানে নিজেকে কিছু সময় ও স্থানে বেঁধে রাখা—গৃহস্থের ক্ষুদ্র ‘বর্ষাবাস’, যেখানে বাইরে দৌড়ে সমস্যা সমাধান নয়, ভেতরে ফিরে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনা। দিনের একাংশ, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন, বা মাসের নির্দিষ্ট পর্ব—নিজের জন্য ছোট্ট এক আশ্রম তৈরি করে নেওয়া; ফোন, বাজার, ভোগ, ভ্রমণ—সব কিছুর ওপর অস্থায়ী সীমারেখা টেনে মনকে কেন্দ্রে ফেরানো।
এই সীমা কোনো বঞ্চনা নয়; এটি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। সীমা থাকলে মন ছড়িয়ে পড়ে না, ছড়িয়ে না পড়লে হিংসা-অহং-লোভের কষায় ঢোকার পথও সঙ্কুচিত হয়। ফলে দেশাবন্ধ বাইরে ‘কম করা’ নয়, ভেতরে ‘অধিক থাকা’—সংযমকে টেকসই করার নীরব কৌশল।
উপবাস এই স্তরে শরীর-ইন্দ্রিয়ের শৃঙ্খলা হিসেবে জেগে ওঠে। কখনো সম্পূর্ণ উপবাস, কখনো আংশিক; কখনো রস-নিয়ম—নির্দিষ্ট স্বাদ বা বস্তুর বিরতি; কখনো মন-নিয়ম—কথা, দর্শন কিংবা অনর্থ ভোগে সংযম। উদ্দেশ্য একটাই: আকাঙ্ক্ষাকে চেতনায় রূপান্তর করা, ভোগকে বোধে উত্তীর্ণ করা।
উপবাসে ক্ষুধা শুধু সহ্য করা নয়; ক্ষুধাকে শিক্ষক করা—উদয়-অস্তে ওঠানামা করা তরঙ্গের মতো প্রতিটি তীব্র তাড়নাকে দূর থেকে দেখতে শেখা। যখন দেহের দাবিকে হালকা করে দেখা শেখা যায়, তখন মনের দাবি-দাওয়াও নরম হয়ে আসে; ক্রোধের আগুন সহজে দাহ করে না, লোভের ফাঁদ সহজে জড়ায় না, কামনার ঢেউ সহজে ভাসিয়ে নিতে পারে না। উপবাস তাই জৈন দৃষ্টিতে আড়ষ্ট তপস্যা নয়; এটি সূক্ষ্ম সুর-টান—যেখানে ইন্দ্রিয়ের শক্তি নিঃশেষ না হয়ে স্থিতির আলোয় রূপান্তরিত হয়।
আতিথিসংবিভাগ শেষত দানের নিয়ম, কিন্তু তার ব্যাকরণে রয়েছে অপরিগ্রহের প্রাণ। অতিথি—বিশেষত সন্ন্যাসী, পথিক বা অভাবগ্রস্ত—এসে দাঁড়ালে ‘আমার’ ভাব গলে যায়; যা হাতে আছে, তা প্রবাহে ফিরে যায়। এখানে দান প্রদর্শন নয়; অংশীদারি—খাবারের থালা, সময়ের অংশ, মনোযোগের স্নেহ—সব কিছুতেই।
এই ভাগ করে দেওয়া গৃহস্থের সংসার-যাপনকেই তপস্যায় রূপ দেয়: রান্নাঘর এক ক্ষুদ্র যজ্ঞকুণ্ড, আয় এক সঞ্চারক, ঘর এক আশ্রয়ক্ষেত্র। যখন দান অভ্যাস হয়, তখন অধিকারবোধ আলগা হয়; যত সহজে দিই, তত হালকা হই; যত হালকা হই, তত গভীর শান্তি নেমে আসে। দানের সেই স্বস্তিতেই অহিংসা জীবন্ত, সত্যবচন কোমল, অপরিগ্রহ সজীব।
এই চার শিক্ষা-ব্রত একসঙ্গে কাজ করে—সমায়িক মনের সমতা আনে, দেশাবন্ধ সেই সমতাকে সীমার শিখরে ধরে রাখে, উপবাস ইন্দ্রিয়ের টানকে বোধে রূপান্তর করে, আর আতিথিসংবিভাগ ‘আমার’-কে ‘আমাদের’-এ গলিয়ে দেয়। ফলে আচরণ ও দর্শনের ব্যবধান কমে যায়: সম্যগ্দর্শনের আলো চোখে এসে পড়ে, সম্যগ্জ্ঞান বোধে ভিত গাঁথে, আর গুপ্তি-সমিতির সাথে এই শিক্ষা-ব্রতগুলো সেই আলোকে হাঁটা-বলা-ধরা-রাখা—জীবনের ক্ষুদ্রতম ছন্দে ছড়িয়ে দেয়। দিন যেতে যেতে কষায়ের ধুলো ঝরে, মন স্বচ্ছ হয়, সংযম কষ্ট নয়—স্বভাব হয়ে ওঠে; আর একসময় দেখা যায়, বাইরের কোনো বাহাদুরি নয়, অন্তরেরই দীপ্তি পথ দেখাতে শুরু করেছে—নীরবে, স্থিরে, মুক্তির দিকে।
এই তিন স্তরের ধারাবাহিক অনুশীলনে বোঝা যায়, ‘ব্রত’ মানে কেবল নিয়মের ভার নয়; ব্রত হলো রুচির রূপান্তর। অনুব্রত আমাদের হাতে-পায়ে সংযম শেখায়, গুণব্রত পরিসীমা গড়ে চিন্তার দিশা ঠিক করে, শিক্ষা-ব্রত প্রতিদিন ধুয়ে-মুছে মনকে স্বচ্ছ রাখে। ফলত সম্যগ্দর্শনের আলো চোখে আসে, সম্যগ্জ্ঞান বোধে ভিত গাঁথে, আর এই ব্রতসমূহ সেই আলোকে হেঁটে চলা, কথা বলা, লেনদেন করা, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম—জীবনের ক্ষুদ্রতম কাজে ছড়িয়ে দেয়।
গৃহস্থের জন্য এই পথ সংসারের মাঝেই মুক্তির প্রস্তুতি—কাজ করে, কথা বলে, ভালোবেসে—তবু কষায়ের দাস না হওয়া। আর এভাবেই আচরণ দৃষ্টিকে কলুষিত করে না, বরং জ্ঞানকে দেহে-দেহে দীপ্যমান করে; প্রতিদিন একটু একটু করে আত্মার ওপর জমে থাকা ধুলো ঝরে, আর ভেতরের দীপ্তিই পথ দেখাতে শুরু করে।
অন্যদিকে, সন্ন্যাসীদের জন্য একই চেতনা আরও সূক্ষ্ম ও কঠোর রূপে প্রয়োগ হয়। তাঁরা সম্পূর্ণরূপে সংসার ত্যাগ করেন—অহিংসা ও অপরিগ্রহকে জীবনের একমাত্র বিধান করে তোলেন। অপরিমিত চলাফেরা বর্জন মানে—অকারণে যাত্রা নয়, প্রয়োজনে ধীরে, নির্দিষ্ট সময়ে চলা; আহারের কঠোর বিধি মানে—নির্বাচিত সময়ে, নির্দিষ্ট পরিমাণে, দান হিসেবে প্রাপ্ত আহার গ্রহণ; নিঃস্বত্ব জীবন মানে—কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ, আশ্রয় বা দাবি ছাড়া বাঁচা। তাঁদের কাছে প্রতিটি কাজ—হাঁটা, কথা বলা, ভিক্ষা গ্রহণ, এমনকি নিঃশ্বাস নেওয়াও—অহিংসা ও সংযমের মাপকাঠিতে পরিমাপ করা হয়।
তবে এই দুই স্তরের পার্থক্য সত্ত্বেও লক্ষ্য এক: আচরণ যেন দৃষ্টিকে কলুষিত না করে, জ্ঞান যেন আচরণে দীপ্যমান থাকে। অর্থাৎ, জীবনের প্রতিটি কাজ যেন অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। গৃহস্থ হোন বা সন্ন্যাসী, উভয়েরই সাধনা হলো—দর্শন, জ্ঞান ও আচরণের সমন্বয়। জ্ঞান কেবল মুখস্থ থাকলে তা শুকনো বুদ্ধি, আচরণ কেবল রীতি হলে তা নিস্প্রাণ আচার; কিন্তু যখন জ্ঞান আচরণে জীবন্ত হয়, আর আচরণ জ্ঞানে আলোকিত হয়—তখনই জন্ম নেয় সম্যগ্চারিত্রের পূর্ণতা।
এই পূর্ণতা গৃহস্থের সংসারে আসে সংযমে, দানে ও দায়িত্বে; আর সন্ন্যাসীর জীবনে আসে নিস্তব্ধতা, ত্যাগ ও নিঃস্বত্বে। কিন্তু উভয়েই শেষ পর্যন্ত একই দিকে অগ্রসর—আত্মার কলুষ ঘুচিয়ে চেতনার নির্মল জ্যোতি প্রকাশ করা, যেখানে হিংসা, আসক্তি ও অজ্ঞানতা মিলিয়ে যায়, আর থেকে যায় কেবল শান্তি, সহিষ্ণুতা ও মুক্তির দীপ্তি।
সম্যগ্চারিত্র কেবল নিষেধের তালিকা নয়; এটি রুচি বদলানো। অভ্যাস যখন বদলায়, সুখের সংজ্ঞাও বদলায়—উত্তেজনার বদলে প্রশান্তি, অধিকারীর বদলে দাতার স্বস্তি, জেতার বদলে বোঝার আনন্দ। এই বদল টেকসই করতে জৈন সাধনায় নিয়মিত সমায়িক (সময় বেঁধে সমানচিত্ত ধ্যান), স্বাধ্যায় (শাস্ত্রপাঠ), প্রতিক্রমণ (ভুল স্বীকার ও নবসংকল্প) ও তপ (বাহ্য ও অন্তর—উপবাস, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, নম্রতা, অনুতাপ, সৎসঙ্গ, শৌচ) জুড়ে থাকে। তপের আগুনে কষায়ের ঘনতা কমে; প্রতিক্রমণের স্বীকারোক্তিতে অহংকার ভাঙে; সমায়িকের সমত্বে পক্ষপাত সরে গিয়ে সম্যগ্দর্শন টেকে; স্বাধ্যায়ে সম্যগ্জ্ঞান ধারালো হয়—এভাবেই সম্যগ্চারিত্রের মেরুদণ্ড শক্ত হয়।
“পারিষহজয়” জৈন দর্শনের এক গভীর তপস্যার ধারণা—যার মানে হলো, জীবনের অনিবার্য বাধা ও কষ্টগুলোকে জয় করা, কিন্তু প্রতিরোধ করে নয়, সহিষ্ণু সংযমে থেকে, শান্ত চিত্তে পার হয়ে। জীবনের পথে যেমন বাইরের বিপর্যয় আসে—শীত, উষ্ণতা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অসুখ, নিন্দা, প্রশংসা, একাকিত্ব বা জনসমাগম—তেমনি ভেতরেও ওঠে ক্রোধ, মান, মায়া, লোভের ঢেউ। এই দুই ধরনের প্রতিকূলতাই ‘পারিষহ’ নামে পরিচিত। এগুলি আত্মাকে পরীক্ষা করে—দেখে, সংযম কি শুধু সুবিধার সময়ে টিকে থাকে, না কি দুঃখের মাঝেও স্থির থাকতে পারে।