দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ১৩



দামোদর লীলার মাধ্যমে ঈশ্বর যেন শেখান, “আমি সেই প্রেমের জন্যই অসীম থেকেও সীমায় আসি, কারণ সীমা ছাড়া ভালোবাসা প্রকাশ পায় না।” তাই কৃষ্ণের বাঁধা পড়া কোনো পরাজয় নয়; এটি ঈশ্বরের প্রেমের বিজয়। ভক্তির এই অবস্থায় ঐশ্বর্য ও মাধুর্য, জ্ঞান ও স্নেহ, সীমা ও অসীম—সব একাকার হয়ে যায়। এটি সেই মুহূর্ত, যখন ঈশ্বর আর ভক্ত দুই নয়—এক, একীভূত চেতনার দুই দিক, যা প্রেম নামের একক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

দামোদর লীলা মানুষের হৃদয়ের এক চিরন্তন প্রতীক—যেখানে ভালোবাসা জ্ঞানের পরিণতি, আর আত্মসমর্পণ মুক্তির রূপ। মা যশোদার স্নেহে ঈশ্বরের হাসি যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি তাঁর ব্রহ্মস্বরূপও উজ্জ্বল হয়। ঈশ্বর বাঁধা পড়ে প্রমাণ করেন, তিনি প্রেমেরই অন্তর্গত; আর ভক্ত ভালোবাসতে গিয়ে প্রমাণ করেন, প্রেমই ঈশ্বর। সেই প্রেম, যা সীমাকে অসীম করে তোলে, সেটিই দামোদর তত্ত্বের পরম সংগীত—যেখানে প্রতিটি হৃদয়, প্রতিটি আত্মা শুনতে পায় সেই অনাহত নাদ, যে বলে, “ভালোবাসাই মুক্তি, ভালোবাসাই ব্রহ্ম।”

“অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব”—এই তত্ত্বটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের হৃদয়ে যেমন আলো হয়ে জ্বলে, তেমনি সমগ্র ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যের এক অনুপম সংহতি রচনা করে। শব্দটির অর্থ আপাত সহজ: ঈশ্বর ও জীব একই সঙ্গে ভিন্ন এবং অবিভাজ্য। কিন্তু এই ভেদাভেদ কোনো যৌক্তিক দ্বন্দ্ব নয়; এটি চেতনার এমন এক রহস্যময় সংগতি, যা বুদ্ধি দিয়ে মাপা যায় না, তাই এর নাম “অচিন্ত্য”—অর্থাৎ চিন্তার অতীত, কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্যে সম্পূর্ণ বাস্তব। এটি সেই দার্শনিক সূত্র, যেখানে অদ্বৈতের অনন্ততা, দ্বৈতের প্রেম, বৌদ্ধ শূন্যতার স্বাধীনতা, জৈন অনেকান্তবাদের বহুমুখিতা এবং কাশ্মীর শৈববাদের স্পন্দতত্ত্ব—সব মিলেমিশে এক গভীর অন্তর্দর্শনে পরিণত হয়েছে।

অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্বের মূল কথা হলো—অস্তিত্বের দুই দিক: ঐক্য ও পার্থক্য, পরস্পরবিরোধী নয়, বরং পরিপূরক। যেমন সূর্য ও তার কিরণ: কিরণ সূর্য থেকে পৃথক, কিন্তু সূর্য ছাড়া কিরণ অর্থহীন। জীব ঈশ্বরেরই অংশ—“মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ। মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি।। (১৫/৭)”—”এই জীবলোকে (সংসারে) যত জীব (জীবভূতঃ) রয়েছে, তারা সনাতনকাল থেকেই আমারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ (মমৈবাংশো)। এই জীবেরা মন এবং ছয়টি ইন্দ্রিয়কে (চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক এবং মন) আশ্রয় করে প্রকৃতির মধ্যে অবস্থানপূর্বক (দেহ ধারণ করে) সংগ্রাম করে (বা টেনে নিয়ে যায়)।” গীতার এই ঘোষণাই এই তত্ত্বের ভিত্তি।

জীব সীমিত, ঈশ্বর অসীম; কিন্তু সীমিত মানে ছিন্ন নয়—এটি অসীমেরই প্রকাশমান পরিধি। অদ্বৈত বেদান্ত যেখানে বলে—“ব্রহ্ম সত্যং জগৎ মিথ্যা”—সেখানে গৌড়ীয় দর্শন বলে, জগৎ মিথ্যা নয়, বরং ঈশ্বরেরই লীলাময় প্রকাশ। মায়া এখানে বিভ্রম নয়, বরং ঈশ্বরের আত্ম-প্রকাশের ছায়া; তিনি নিজেই সৃষ্টিতে নেমে এসেছেন, তাই বিভেদই আসলে ঐক্যের আরেক রূপ।

এই তত্ত্ব মনস্তত্ত্বেও এক বিপুল গভীরতা আনে। ফ্রয়েডের দ্বন্দ্বতত্ত্বে যেমন চেতনা ও অবচেতন ক্রমাগত টানাপোড়েন সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনি মানবমনও ঈশ্বরচেতনার ভেতরে সীমাবদ্ধ আত্মস্বরূপের সঙ্গে লড়াই করে চলে। অচিন্ত্য ভেদাভেদ বলে—এই দ্বন্দ্বই জীবনের স্পন্দন, কারণ সম্পূর্ণ ঐক্য থাকলে গতি থেমে যেত, আর সম্পূর্ণ বিভেদ থাকলে অস্তিত্ব ভেঙে পড়ত। মন ও আত্মার এই মৃদু কম্পনই সৃষ্টি করে অর্থ, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা যায় “dynamic integration”—বিভিন্ন মানসিক প্রবণতা এক উচ্চতর সংগতিতে মিলিত হয়, যেমন জীব ঈশ্বরের সঙ্গে মিলতে চায়, কিন্তু নিজের স্বাতন্ত্র্যও বজায় রাখে।

অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব এমন এক ভাবনা, যেখানে ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্টি একে অপরের থেকে আলাদা হলেও, আসলে তারা একই সত্যের দুই দিক। ঈশ্বর শুধু বাইরে থেকে জগৎ সৃষ্টি করেননি; তিনি নিজেই সেই জগতের ভেতরে, প্রতিটি জীবের মধ্যেও বিরাজমান। অর্থাৎ, স্রষ্টা আর সৃষ্টি একে অপরের বাইরে নন—তারা পরস্পরের মধ্যে প্রতিফলিত, যেমন ঢেউ ও সাগর।

এই ভাবনা এত গভীর যে, একে সাধারণ যুক্তি দিয়ে বোঝা যায় না—তাই এর নাম “অচিন্ত্য”, মানে যা চিন্তার সীমার বাইরে। এখানে চেতনা ও পদার্থ, আত্মা ও দেহ, পরম ও পার্থিব—সবই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত এক অবিচ্ছিন্ন চক্রে। যেমন কাশ্মীর শৈব দর্শন বলে, “চিত্‌–বিমর্শ” অর্থাৎ চেতনা নিজের শক্তি (বিমর্শা বা শক্তি) দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে—শিব তাঁরই প্রতিচ্ছবি শক্তির মধ্যে নিজেকে চিনে নেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে কৃষ্ণও তেমনি নিজের প্রেমশক্তি—রাধারূপে—নিজেকে উপলব্ধি করেন। অর্থাৎ, ঈশ্বর নিজের ভেতরেই নিজের প্রেমের প্রতিচ্ছবি দেখেন; তিনি প্রেমের মাধ্যমে নিজেকে জানেন ও প্রকাশ করেন।

এই তত্ত্ব কেবল দর্শনের নয়, গভীর আত্মমনোবিজ্ঞানেরও কথা বলে। এখানে প্রেম মানে কোনো আবেগ নয়, এটি চেতনার আত্মপ্রকাশ। ভালোবাসা তখন হয়ে ওঠে সেই শক্তি, যার মাধ্যমে ঈশ্বর নিজেকে অনুভব করেন, আর মানুষ ঈশ্বরকে চিনতে শেখে। তাই অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব আমাদের শেখায়—ঈশ্বর ও মানুষ, চেতনা ও জগৎ, প্রেম ও জ্ঞান—সব এক অন্তহীন স্রোতে যুক্ত, আলাদা মনে হলেও তারা একই সত্যের অনন্ত রূপ।

যদি আমরা একটু গভীরভাবে দেখি, তবে বৌদ্ধ নৈরাত্ম্যবাদ, জৈন অনেকান্তবাদ এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণবের অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব—তিনটিই এক মহৎ প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন উত্তর: বাস্তবতা কি এক, না বহু? আত্মা কি স্থায়ী, না সম্পর্কনির্ভর? আর ঈশ্বর, যদি থাকেন, তিনি এই বৈচিত্র্যের কোথায়?

বৌদ্ধ নৈরাত্ম্য (anātman) শেখায় যে, “আমি” বলে আমরা যা ভাবি, তা কোনো স্থায়ী বা চিরন্তন সত্তা নয়। আমাদের শরীর, মন, চিন্তা, অনুভূতি—সবই প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। যেমন নদীর জল এক জায়গায় স্থির থাকে না, তেমনি আমরাও একই রকম থাকি না; প্রতি মুহূর্তে বদলে যাই।

বুদ্ধ এই পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, মানুষের অস্তিত্ব গঠিত পাঁচটি উপাদানে—রূপ (শরীর), বেদনা (অনুভূতি), সংজ্ঞা (চেনা-বোঝা), সংস্কার (অভ্যাস ও প্রবণতা) এবং বিজ্ঞান (চেতনা বা জ্ঞানের প্রবাহ)। এই পাঁচটি একত্রে কাজ করলেও এর মধ্যে কোনো স্থায়ী আত্মা নেই, যে সব কিছুর মূল নিয়ন্ত্রক।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি সকালবেলা হাসিখুশি থাকতে পারেন, দুপুরে রেগে যান, রাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন—অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে আপনি বদলে যাচ্ছেন। এই পরিবর্তনশীলতাই মানুষের প্রকৃতি। যখন কেউ সত্যিই বুঝতে পারেন যে, সব কিছুই অনিত্য, তখন আঁকড়ে ধরা, “আমার” বলে ধরে রাখা, বা স্থায়ী সুখের প্রত্যাশা থেকে মুক্তি আসে।

এই উপলব্ধিই শান্তি আনে। কারণ “আমি” নামের কোনো স্থায়ী কেন্দ্র নেই—আছে কেবল ক্রমাগত পরিবর্তনের এক ছন্দময় প্রবাহ। সেই প্রবাহকে মেনে নিতে পারলেই মনের আসক্তি, ভয় ও দুঃখ দূর হয়ে যায়, আর জীবন তখন এক চলমান নৃত্যে রূপান্তরিত হয়—যেখানে কিছুই স্থির নয়, তবু সবই পরস্পর নির্ভর, গভীরভাবে যুক্ত।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন বৌদ্ধ নৈরাত্ম্যের গভীর অন্তর্দৃষ্টিকে অস্বীকার না করে, বরং তাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে এক নতুন সুরে। এই দর্শন বলে—হ্যাঁ, জীব সত্যিই অনিত্য; তার রূপ, ভাব, চিন্তা, অনুভূতি প্রতিক্ষণ পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের পেছনে আছে এক অচঞ্চল, চিরন্তন ভিত্তি—চেতনার সেই পরম উৎস, যাকে বলা হয় কৃষ্ণ, পরব্রহ্ম বা সচ্চিদানন্দ।

যেমন সমুদ্র অনন্ত ও অপরিবর্তনীয়, কিন্তু তার ঢেউগুলো প্রতি মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে ও বিলীন হচ্ছে—তবু প্রতিটি ঢেউ সাগরেরই জল; ঠিক তেমনি জীবের অনিত্যতা ঈশ্বর থেকে আলাদা নয়। এই ক্রমাগত পরিবর্তন আসলে ঈশ্বরচেতনার জীবন্ত নৃত্য, তাঁরই আত্মপ্রকাশের ছন্দ। জীবের ওঠানামা, সৃষ্টি ও বিলয়, আনন্দ ও বেদনা—সবই ঈশ্বরের অসীম আনন্দ-লীলা।

এখানে অনিত্যতা মানে শূন্যতা নয়, বরং পূর্ণতার স্পন্দন। পরিবর্তন এখানে অনুপস্থিতির লক্ষণ নয়, বরং চেতনার বিকাশের প্রমাণ। যেমন মা যশোদা প্রতিদিন কৃষ্ণকে নতুনভাবে অনুভব করেন—একদিন তিনি দুষ্টু শিশু, অন্যদিন অলৌকিক ঈশ্বর, কখনো আবার নিখাদ প্রেমের প্রতিমা। কিন্তু এই রূপভেদেও ঈশ্বর একই; কেবল তাঁর প্রকাশের রং ও ভঙ্গি বদলে যায়। প্রতিটি নতুন অভিজ্ঞতা তাঁরই এক নতুন ঢেউ, যা আসলে সেই অনন্ত সাগরেরই প্রকাশ।

জীব প্রতিক্ষণ নতুন রূপে জেগে ওঠে, আর সেই জাগরণে ঈশ্বর নিজের অসীমতাকে অনুভব করেন। তাই জীবের অনিত্যতা শূন্যতার নয়, বরং ঈশ্বরের লীলার স্বর, যেখানে পরিবর্তন মানে চেতনার গান—অসীম সাগরের অস্থির কিন্তু আনন্দময় ঢেউ।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব চিন্তা শেখায়—মানুষের বা জীবের জীবনে যে-পরিবর্তন, ওঠানামা, সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু, জ্ঞান-অজ্ঞান—এসব কিছুই কোনো অভিশাপ নয়, কোনো দুর্ভাগ্যের লক্ষণ নয়। এগুলি আসলে আত্মার পরিপক্বতার ধাপ, কৃষ্ণচেতনা বা ঈশ্বরচেতনার ধীরে ধীরে বিকশিত হওয়ার প্রক্রিয়া।

যেমন বীজ থেকে গাছ, গাছ থেকে ফুল, ফুল থেকে ফল—প্রতিটি স্তরই পরিবর্তন, কিন্তু সেই পরিবর্তন ধ্বংস নয়, বিকাশ; তেমনি জীবও নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজের ভিতরে থাকা ঈশ্বরসত্তাকে চিনে নিতে শেখে। প্রতিটি আনন্দ বা দুঃখ, লাভ বা ক্ষতি, সাফল্য বা ব্যর্থতা আসলে তাকে একটু একটু করে কৃষ্ণচেতনার দিকে এগিয়ে দেয়।

অর্থাৎ, জীবনের পরিবর্তন আমাদের পতন নয়; বরং আত্মার জাগরণের পথ। আমরা যেমন প্রতিদিন নতুন কিছু শিখি, তেমনি প্রতিটি অভিজ্ঞতা আমাদের চেতনার সীমানা প্রসারিত করে—এই ধারাবাহিক রূপান্তরই কৃষ্ণচেতনার বিকাশের সোপান, বা ঈশ্বরের দিকে ধীরে ধীরে ওঠার সিঁড়ি।

“অদ্বৈত বহুত্ববাদ” বা non-dual pluralism গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের এক গভীর ও সূক্ষ্ম তত্ত্ব, যা একদিকে অদ্বৈত বেদান্তের ঐক্যবোধকে গ্রহণ করে, আবার অন্যদিকে জীব ও জগতের বৈচিত্র্যকেও অস্বীকার করে না। এটি এমন এক দার্শনিক সংহতি, যেখানে ঐক্য (oneness) ও বহুত্ব (manifoldness) কোনো বিরোধ নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক।

সহজভাবে বলতে গেলে, ঈশ্বর ও জীব, চেতনা ও জগৎ—সব একই চেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। সূর্যের আলো যেমন নানা কাঁচে পড়ে নানান রঙে বিচ্ছুরিত হয়, কিন্তু উৎস তো একটিই—সূর্য, তেমনি এক পরম ঈশ্বরচেতনা অসংখ্য আত্মার মধ্য দিয়ে বহুরূপে দীপ্ত হয়। কেউ তাঁকে ভক্তির মাধ্যমে অনুভব করেন, কেউ জ্ঞানের দ্বারা, কেউ সেবার মধ্যে, কেউবা প্রেমের নৃত্যে; কিন্তু মূল চেতনা সর্বত্র এক, সর্বদা অবিভাজ্য।

এই দৃষ্টিভঙ্গি অদ্বৈত বেদান্তের সঙ্গে একাত্ম, কারণ এটি বলে—অন্তিম সত্য একমাত্র ব্রহ্ম; কিন্তু বেদান্ত যেখানে জগৎকে “মায়া” বা “অসত্য” বলে অগ্রাহ্য করে, গৌড়ীয় চিন্তা সেখানে বলে—না, এই বহুরূপ জগৎও ঈশ্বরের লীলার অংশ। বৈচিত্র্য এখানে বিভ্রম নয়; এটি সেই চেতনার আনন্দময় খেলা। এক সুর যদি একটানা বাজে, তা একঘেয়ে হয়ে যায়; কিন্তু নানা রাগ, নানা তাল মিলেই সংগীত তৈরি হয়। তেমনি ঈশ্বরচেতনার আনন্দ প্রকাশিত হয় অসংখ্য জীব, অনুভূতি, সম্পর্ক ও রূপের মাধ্যমে।

“অদ্বৈত বহুত্ববাদ” আসলে বলে—ঐক্য ও বৈচিত্র্য পরস্পরের শত্রু নয়। যেমন নৃত্যে নর্তক ও নৃত্য আলাদা হলেও একে অপরের মধ্যে মিশে যায়, তেমনি ঈশ্বর ও জীবও আলাদা হয়েও এক। জীব ঈশ্বরেরই দেহের কোষের মতো—স্বতন্ত্র, কিন্তু মূল সত্তা থেকে অবিচ্ছিন্ন। এই কারণে গৌড়ীয় দর্শনে প্রেমকে চেতনার পরম রূপ বলা হয়েছে, কারণ প্রেমই ঐক্য ও বৈচিত্র্যকে একই সঙ্গে ধারণ করে। প্রেমে আমরা অন্যকে আলাদা হিসেবেও অনুভব করি, আবার তার মধ্যেই নিজের অংশ দেখতে পাই—এই দ্বৈত অভিজ্ঞতাই “অচিন্ত্য ভেদাভেদ”-এর মর্ম।