ভক্তি এখানে কোনো কাব্যিক আবেগ নয়; এটি আত্মসমর্পণের জ্ঞান। ভক্ত যখন বলে “তুমি,” তখন সে পরোক্ষে বলে “আমি নই”—এই “আমি নই” জ্ঞানযোগের “নেতি নেতি”-রই জীবন্ত রূপ। জ্ঞান যোগে আত্মা চেতনার সাক্ষী; ভক্ত যোগে সেই সাক্ষী হয়ে ওঠে প্রিয়জন—“সখা,” “পুত্র,” “প্রাণ”—যার মধ্যে জ্ঞান ও প্রেম অবিচ্ছিন্ন। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৬/২৩) বলে—যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ যথা দেবে তথা গুরৌ। তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ।।—অর্থাৎ, “যে-ব্যক্তির ঈশ্বরের প্রতি শ্রেষ্ঠ (পরা) ভক্তি আছে, ঈশ্বরের প্রতি যেমন, গুরুর প্রতিও ঠিক তেমন (সমান ভক্তি) আছে, সেই মহাত্মার কাছেই (গুরু বা শাস্ত্র দ্বারা) কথিত এই সকল রহস্যময় অর্থ (তত্ত্ব) প্রকাশিত হয়।”
এই শ্লোকটি নির্দেশ করে যে, আধ্যাত্মিক সত্য বা পরম জ্ঞান কেবল পাণ্ডিত্য বা মেধা দিয়ে লাভ করা যায় না। এটি লাভ করার জন্য গুরু ও ভগবানের প্রতি সম্পূর্ণ ও অবিচল বিশ্বাস (Unflinching Faith) থাকা আবশ্যক। গুরুর প্রতি ঈশ্বরের মতোই ভক্তি না থাকলে শাস্ত্রের গভীর অর্থ উন্মোচিত হয় না। যার ঈশ্বরে গভীর ভক্তি আছে, তার মধ্যেই জ্ঞান জাগে। অর্থাৎ, ভক্তি জ্ঞানের দরজা খুলে দেয়, আর জ্ঞান সেই ভক্তিকে গভীর করে তোলে।
শ্রীমদ্ভাগবত বলে—ভক্তিয়োগেন মনসি সম্যক্ প্রণিহিতেঽমলে। অপশ্যৎ পুরুষং পূর্ণং মাযাঞ্চ তদপাশ্রয়াম্।। (১/৭/৪)—ভক্তিযোগের দ্বারা মনকে সম্যকরূপে (সঠিকভাবে) এবং অমল (নির্মল বা পবিত্র) অবস্থায় একাগ্র করার পর তিনি সেই পূর্ণপুরুষকে (ভগবানকে) দর্শন করলেন এবং তাঁকেই আশ্রয় করে থাকা মায়াকেও (তাঁকে অবলম্বন করে থাকা তাঁর শক্তিকেও) দর্শন করলেন।
এই শ্লোকটি বোঝায় যে, কেবল জ্ঞান বা যোগের মাধ্যমে নয়, পবিত্র (অমল) ও একাগ্র (সম্যক্ প্রণিত বা যথার্থ বা সম্পূর্ণরূপে একাগ্রচিত্ত) ভক্তিমূলক মন (ভক্তিয়োগেন)-এর মাধ্যমেই পূর্ণ ব্রহ্মের স্বরূপ এবং তাঁর লীলাশক্তি 'মায়া'—উভয়কেই যথাযথভাবে জানা সম্ভব।
ভক্তি-যোগের দ্বারা মনকে ঈশ্বরে নিবিষ্ট করলে আত্মা নিজের স্বরূপে স্থিত হয়। এখানে জ্ঞান কোনো পৃথক সাধনা নয়; ভক্তি নিজেই জ্ঞানের শুদ্ধ রূপ। যশোদার মাতৃত্ব তাই ঈশ্বরপ্রেমের সর্বোচ্চ প্রকাশ—তিনি জানেন না কৃষ্ণ পরব্রহ্ম, তবু তাঁর নিঃস্বার্থ প্রেমে ব্রহ্ম নিজেই ধরা দেন। এই অজ্ঞান-ভিত্তিক প্রেমই আসলে জ্ঞানের সর্বোচ্চ রূপ, কারণ এখানে জ্ঞান অহংকারে নয়, নম্রতায় পরিণত হয়েছে।
দামোদর লীলা তাই জ্ঞানযোগের সত্য ও ভক্তিযোগের সৌন্দর্যকে একসঙ্গে ধারণ করে। জ্ঞান বলে, “আমি ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১/৪/১০)—আমি সেই চেতনা, যা সর্বত্র; ভক্তি বলে, “তুমি আমার সব”—তুমি-ই চেতনা, আমি তোমারই অংশ। একে অপরের মধ্যে প্রবেশ করলে দেখা যায়, এরা আলাদা নয়—“তৎ ত্বম্ অসি” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৮.৭)—তুমিই সেই। যখন জ্ঞানের সাক্ষী-চেতনা প্রেমের স্রোতে গলে যায়, তখন আত্মা ও ঈশ্বরের মধ্যে আর কোনো দূরত্ব থাকে না। গীতার (৭/১৭) ভাষায়—”... প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোঽত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ।।”—এই শ্লোকটিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চার প্রকার ভক্তের কথা বলার পর, জ্ঞানী ভক্তকে (যিনি জ্ঞান সহকারে ভজনা করেন) শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেন এবং তাঁদের সাথে নিজের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন: "জ্ঞানী ভক্ত সর্বদাই আমাতে যুক্ত এবং একনিষ্ঠ ভক্তিমান, সে-ই শ্রেষ্ঠ। কারণ আমি সেই জ্ঞানীর কাছে অত্যন্ত প্রিয়, আর সেই জ্ঞানীও আমার অত্যন্ত প্রিয়।"
"মদ্ভক্তো মম প্রিয়ঃ" বা "স চ মম প্রিয়ঃ" এই উক্তিটি জ্ঞান সহকারে ভক্তিতে নিবেদিত আত্মার সাথে ভগবানের পারস্পরিক ভালোবাসার সম্পর্ককে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। কৃষ্ণ বলেন, ভক্ত আমারই রূপ, আমিই তার মধ্যে আছি। যশোদার কোলে শিশুকৃষ্ণ সেই সচ্চিদানন্দের মানবরূপ—আনন্দময় চেতনার প্রকাশ। তাঁর হাসি, দুষ্টুমি, ভয়, সবই চেতনার স্বাভাবিক লীলা। আর যশোদার ভক্তি সেই প্রেম, যা জ্ঞানকে পূর্ণ করে তোলে।
দামোদর লীলা তাই শুধু এক মাতৃস্নেহের গল্প নয়; এটি চেতনার ব্রহ্মোপলব্ধির এক নৃত্য, যেখানে প্রেমই সর্বোচ্চ জ্ঞান, আর আত্মসমর্পণই পরম মুক্তি। গীতায় (৬/৩০) যেমন বলা হয়েছে—যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।—এই শ্লোকটিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই যোগীর (Yogī) অবস্থা বর্ণনা করেছেন, যিনি ব্রহ্মোপলব্ধি (Brahman realization) করেছেন: যিনি সর্বত্র আমাকে (ঈশ্বরকে) দর্শন করেন, এবং সমস্ত কিছুকে আমাতেই (ঈশ্বরের মধ্যে) দর্শন করেন, আমি তাঁর কাছে কখনও অদৃশ্য হই না (প্রণষ্ট বা অদৃশ্য বা লুপ্ত হই না), এবং তিনিও আমার কাছে কখনো অদৃশ্য হন না (প্রণষ্ট হন না)।
এটি হলো যোগের সেই সর্বোচ্চ স্তর, যেখানে যোগী সর্বব্যাপী ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করেন। এই অবস্থায় ভক্ত বা যোগী আর ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হন না, বরং তাঁদের মধ্যে একটি অবিচ্ছিন্ন এবং প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দামোদরের সেই বাঁধন তাই কোনো শৃঙ্খল নয়, এটি প্রেমের মৃদু আশ্রয়—যেখানে ঈশ্বর স্বেচ্ছায় বাঁধা পড়ে, আর মানুষ মুক্ত হয়।
মা যশোদার ভক্তি সেই প্রেম, যা জ্ঞানের ঊর্ধ্বে, অথচ জ্ঞানকেও পরিপূর্ণ করে। তিনি ঈশ্বরকে উপাসনা করেন না, কারণ তাঁর কাছে ঈশ্বর কোনো দূরের তত্ত্ব নয়; কৃষ্ণ তাঁর কোলে বসা, তাঁর চোখের সামনে দুষ্টুমি করা এক জীবন্ত বাস্তবতা। এই বাস্তবতা বৌদ্ধ বা বেদান্তীয় নৈরাত্ম্যের শূন্যতায় নয়, এটি পূর্ণতার অনুভবে ভরা—যেখানে ভালোবাসা, রাগ, দয়া, উৎকণ্ঠা সব মিলেমিশে এক অনবচ্ছিন্ন চেতনার প্রবাহ। যশোদার ভক্তি সেই জীবনেরই স্বাভাবিক ছন্দ, যা উপনিষদের “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩/১৪/১) অর্থাৎ, "এই সমস্ত কিছুই নিশ্চয়ই ব্রহ্ম।" কথাটিকে মর্ত্যে নামিয়ে আনে।
ঈশ্বর এখানে কোনো পরম ধারণা নন, তিনি মানুষের আবেগের মধ্যেই বেঁচে আছেন—মায়ের ভয়ে লুকোনো ঈশ্বরই আসলে সেই ব্রহ্ম, যিনি আনন্দরূপে প্রকাশিত। এই লীলায় অসীম কোনো দূরের মহিমা নয়, বরং ঘরের মাটিতে খেলা করা এক শিশুর হাসি; সেখানে তত্ত্ব মানব হয়ে ওঠে, আর মানুষ প্রেমে দেবত্বে উত্তীর্ণ হয়।
ভক্তিযোগ এই রসকেই ধর্মের হৃদয় বলে। গীতায় (৯/২৬) কৃষ্ণ বলেছেন—”পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি। তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্রয়তাত্মনঃ।।” অর্থাৎ, “যে-ব্যক্তি ভক্তি সহকারে (প্রেমভরে) আমাকে (ঈশ্বরকে) পাতা, ফুল, ফল অথবা জল নিবেদন করে—আমি সেই শুদ্ধচিত্ত (প্রয়তাত্মনঃ) ভক্তের ভক্তিপূর্ণ (ভক্ত্যুপহৃতম্) উপহার সাদরে গ্রহণ করি (অশ্নামি)।” এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, উপাসনার বাহ্যিক আড়ম্বর বা অর্পণের মূল্য নয়, বরং অর্পণের পিছনের ভক্তি ও শুদ্ধতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেমই যশোদার হাতে ধরা দড়ি—যা শাস্তি নয়, আশ্রয়।
এখানে ভক্ত ঈশ্বরকে প্রভু নয়, প্রিয়জন ভাবে; তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক শ্রদ্ধার নয়, স্নেহের। বাৎসল্য রস এই প্রেমের এমন এক রূপ, যেখানে ঈশ্বরকে সন্তান হিসেবে অনুভব করা যায়—”সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।” (গীতা ১৮/৬৬)—”সকল প্রকার ধর্ম (বা কর্তব্যকর্ম) পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার (ঈশ্বরের) শরণ গ্রহণ করো। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক কোরো না বা ভয় কোরো না।” এটি হলো গীতার চূড়ান্ত আশ্বাস। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, মানুষ যদি সব কিছু ত্যাগ করে কেবল তাঁর প্রতি শরণাগত হয়, তবে তিনি নিজেই তার সমস্ত পাপ ও কর্মফল থেকে তাকে রক্ষা করার এবং মোক্ষ লাভের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এই মুক্তির প্রতিশ্রুতি তখন কোনো বিমূর্ত জ্ঞান নয়, বরং মায়ের নিঃশর্ত মমতা, যা সন্তানের সব দোষ ভুলে যায়। ভাগবত পুরাণের দশম স্কন্ধে বর্ণিত ভক্তি তত্ত্বের চূড়ান্ত দার্শনিক ব্যাখ্যা এই মাধুর্যভরা সম্পর্ককেই ভক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ বলে, যা ষড়গোস্বামী (Rūpa Gosvāmī) এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্যগণ কর্তৃক মাধুর্য রস (Madhura Rasa) বা কান্তা ভাব (Kāntā Bhāva)-এর নিবিড় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ফল—যেখানে ভয় বা কর্তব্যবোধ নেই, আছে শুধু অন্তরঙ্গতা। যশোদা যখন কৃষ্ণকে ধমক দেন, তখনও তাঁর ভেতরে ঈশ্বরের প্রতি অপরিসীম করুণা কাজ করে; সেই ধমকই আসলে লালন—প্রেমের এক ভিন্ন ভাষা।
অদ্বৈত বেদান্ত বলে, জ্ঞানই মুক্তির পথ, কিন্তু ভাগবত দেখায়, প্রেমই সেই জ্ঞানের পরিণতি। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন (যেমন রূপ গোস্বামীর 'ভক্তিরসামৃতসিন্ধু' বা জীব গোস্বামীর 'ষট্ সন্দর্ভ')-এর গভীর তত্ত্ব থেকে নিষ্কাশিত সূত্র—“ভক্তির্ জ্ঞানবিকাশকঃ”—"ভক্তিই জ্ঞানের বিকাশ ঘটায়" বা "ভক্তি জ্ঞানের উদঘাটক।" এর কারণ, জ্ঞানের নিস্পৃহতা ভক্তির উষ্ণতায় জীবন পায়। এটি জ্ঞান ও ভক্তির মধ্যেকার সম্পর্কের উপর জোর দেয়।
সাধারণত মনে করা হয় যে, জ্ঞান থেকেই ভক্তি আসে, কিন্তু এই সূত্রটি বিপরীতটি দাবি করে—যখন হৃদয়ে শুদ্ধ ভক্তি জন্ম নেয়, তখন সেই ভক্তির প্রভাবেতত্ত্বজ্ঞান বা আত্মজ্ঞান (Self-realization) আপনা-আপনিই বিকশিত হয় বা প্রকাশিত হয়। এটি বোঝায়, প্রেমময় ভক্তির পথ অনুসরণ করলে জ্ঞানের জন্য আলাদা করে কঠোর বৌদ্ধিক বা তাত্ত্বিক সাধনার প্রয়োজন হয় না; ভক্তিই মনকে পবিত্র করে জ্ঞানের পথ পরিষ্কার করে দেয়। যশোদার স্নেহে ঈশ্বর মানুষ হন, মানুষও নিজের মানবিক সীমা ছাড়িয়ে দেবত্ব স্পর্শ করে।
এই পারস্পরিক রূপান্তরই অদ্বৈতের প্রাণ—“তৎ ত্বম্ অসি” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৮.৭)—তুমিই সেই। জ্ঞানযোগে এই কথাটি যুক্তির পথে পৌঁছায়, ভক্তিযোগে তা হৃদয়ে রক্তস্রোতের মতো বইতে থাকে। কৃষ্ণের প্রতি যশোদার মাতৃস্নেহে কোনো আড়ম্বর নেই, কোনো দার্শনিক জটিলতাও নয়; সেখানে প্রেমই দর্শন, আর স্নেহই সাধনা। তিনি কৃষ্ণকে শাসন করেন, কারণ ভালোবাসেন; আর ভালোবাসেন বলেই ঈশ্বর সেই শাসনকে আশীর্বাদে পরিণত করেন। এই প্রেমেই লীন হয়ে যায় সব পার্থক্য—জ্ঞান ও ভক্তি, দেহ ও চেতনা, মানুষ ও ঈশ্বর—সব মিলেমিশে যায় এক অনন্ত রসধারায়, যেখানে প্রতিটি হৃৎস্পন্দন হয়ে ওঠে এক প্রার্থনা, আর প্রতিটি নিশ্বাসে ঈশ্বরের হাসি প্রতিধ্বনিত হয়।
বাৎসল্য রসে ঈশ্বরের ঐশ্বর্য যেন ইচ্ছাকৃতভাবে আচ্ছাদিত। ভক্ত এখানে ঈশ্বরকে তাঁর মহিমায় নয়, মানবীয় কোমলতায় অনুভব করেন। কিন্তু এই লুকানো ঐশ্বর্যই আসলে ঈশ্বরের প্রকৃত প্রকাশ—কারণ ঈশ্বরের স্বরূপই প্রেম। তিনি ব্রহ্ম হিসেবে অসীম, কিন্তু সেই অসীম যখন ভক্তির আলোর মধ্যে আসে, তখন তাঁর প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণের দুষ্টুমি, যশোদার ঘাম, সেই দুই আঙুলের দড়ি—সবই চেতনার প্রতীক।
সেই দুই আঙুলের ব্যবধানের একটি দিক মানুষের প্রচেষ্টা, আর অন্যটি ঈশ্বরের করুণা। যতক্ষণ এই দুই মিলিত না হয়, ততক্ষণ ঈশ্বরকে বেঁধে রাখা যায় না। তাই মা যশোদার বারংবার চেষ্টা বৃথা যায়, যতক্ষণ না তিনি ক্লান্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ মুহূর্তেই দড়ি যথেষ্ট হয়ে যায়। এখানেই কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ একত্রে মিলিত হয়—প্রচেষ্টা, উপলব্ধি, এবং অবশেষে প্রেমে বিলয়।
দামোদর লীলা এভাবেই চেতনার এক প্রতীকী মানচিত্র হয়ে ওঠে। প্রথমে আছে জ্ঞান—যেখানে ঈশ্বরকে বোঝার চেষ্টা; তারপর আছে কর্ম—যেখানে তাঁকে অর্জনের চেষ্টা; কিন্তু এই দুটি পথই অসম্পূর্ণ, যতক্ষণ না সেখানে ভক্তির আত্মসমর্পণ যুক্ত হয়। যখন ভক্ত বুঝতে পারে যে, ঈশ্বরকে অর্জন করা যায় না, কেবল ভালোবাসা যায়, তখনই সম্পূর্ণতার দরজা খুলে যায়। যশোদার সেই ভালোবাসাই ঈশ্বরকে বাঁধে। তাঁর দড়ি ভক্তির মন্ত্র, তাঁর স্নেহ চেতনার অনন্ত সুর, আর তাঁর অশ্রু ব্রহ্মের করুণার প্রতীক।