আজও বেঁচে আছি কেবলই পরের লেখাটা লিখব বলে। এখনও এমন কিছুই লিখতে পারিনি, যা লিখে ফেলতে পারলে অনায়াসেই মরে যাওয়া যায়… আমি জানি, আমার কলম যা প্রসব করে চলেছে প্রতিদিন, সবকটারই ভ্রূণ হত্যা করে ফেললেও কিছুই এসে যেত না। তার সাথে, এ-ও জানি, এইসব অথর্ব লেখাই আমায় বাঁচিয়ে রাখছে। বহুদিন হলো, বেঁচে থাকবার আর কোনও পিছুটান আমি টের পাই না। তুমি কি বুঝতে পার, আমি আজও তোমার জন্যই লিখি? বেঁচে থাকলে হয়তো একদিন এমন কিছু লিখে ফেলব, যা দেখে তোমার ভালো লাগবে, তুমি একটু হাসবে… বুকের মধ্যে এমন একটা দুরাশা নিয়ে বেঁচে আছি, সুপর্ণা। জানো, ওরা আমায় প্রতিবন্ধী বলে! ওদের কেউ কেউ একের পর এক ভ্রুকুটিতে আমায় বিদ্ধ করে। হাতে ও বুকে কতটা কষ্ট মেখে লিখি, তার খোঁজ ওরা জানে না। আমি ওদের দোষ দিই না, একটুও রাগ করি না। আমি খুব বুঝতে পারি, আমি চলে যাবার পর অন্তত কিছু অক্ষর আমার জন্মের সাক্ষ্য দেবে। ওরা চলে যাবার পর ওদের জন্মের সাক্ষ্য দেবে কেবলই সেপটিক-ট্যাংক। ওদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে কিছু ব্যর্থতা নিয়ে, কিছু গ্লানি নিয়ে, কিছু ঈর্ষা নিয়ে। এমন মানুষের কোনও অপরাধ ধরতে হয় না। এমন মানুষের তাই কোনও ক্ষমাপ্রার্থনাও হয় না। কখনও কখনও আফসোস হয়। ওরা নাহয় না-বুঝেই অনেক কিছু বলে, সুপর্ণা, তুমি তো বুঝেও কখনও বলোনি কিছুই! এতটা পাথর হয়ে আছ…সুপর্ণা! তাকিয়ে দেখো, তোমার ঝরনা হবার দিনে, গলা ভেজাবে বলে একটা মানুষ কেমন প্রতীক্ষায় আছে! আমি তোমার জন্যে একটা কবিতা লিখব বলেই বেঁচে আছি, সুপর্ণা! অনেক বসন্ত চলে গেছে, অনেক শীত এসে হাড়গোড় কাঁপিয়ে গেছে, তবু তোমাকে পাবার মতো করে কিছুই পারিনি লিখতে আজও! ওদের মতোই, তুমিও বুঝি কেবল বৃষ্টি দেখেছ? দুচোখের জল কখনও দেখোনি, সুপর্ণা? জ্যৈষ্ঠের খররৌদ্র দেখেছ, এই বুকের ভেতর দহন দেখোনি! শরতের শিউলিতলা তোমার পায়ের নূপুর শুনেছে, বকুলের পাপড়ি এসে কত কত বার তোমার চোখ ছুঁয়েছে… শুধু আমিই কখনও পাইনি কিছুই! হেমন্ত এলে ওরা যখন সবাই মিলে উৎসবে মাতে, তখনও আমার চোখে ঠায় লেপটে রয় একজন্মের বৈরাগ্যসুর! এই বুকের কান্না তুমি বোঝোনি কখনও, বুঝেছ কেবলই…চোখের অসুখ। তোমায় পাইনি বলেই মুঠোয় মুঠোয় শব্দ পেয়েছি। ওরা এই বুকে বাসা বেঁধেছে…পাখিরা যেমন বাঁধে… তৃষ্ণার জল চেয়েছি, তার বদলে বাড়তি কিছু তৃষ্ণা পেয়েছি। তুমি আসোনি বলে সে কবে থেকেই চাঁদের গায়ে কলঙ্কই কেবল… এই এক জীবনের সমস্ত সাধ মিটিয়ে নেব তোমায় পেলে। যা পেয়েছি, একনিমিষেই বিলিয়ে দেবো তোমায় পেলে। পাইনি যা-কিছু, ভুলে যাব তা-ও…তোমায় পেলে। তোমায় পেলে খুব যত্ন করে পুষেরাখা কষ্টগুলো উড়িয়ে দেবো। সত্যি বলছি, তোমায় পেলে ঠিক তোমার মনের মতোই মানুষ হব!