যেতেই হবে? থেকে যাওয়া যায় না? কোনওভাবেই? তুই কখনও চলে গেলে আমার তখন কেমন লাগবে, এমন কথা আমাকে অনেক বার বলেছিলি। আমি শুধু শুনতাম আর হাসতাম। ভাবতাম, পাগলিটা কী যে বলে! এরকম করে আগে কখনও অনুভব করিনি রে! ভাবতাম, তুই তো আছিস, থাকবি। ব্যস্! এর বাইরে আরও কিছু ভেবে রাখতে হয়, এটা কখনওই মনে আসেনি। তবে কি এই পৃথিবীতে কোনও কিছুই চিরদিনের নয়? আচ্ছা, মনে কি সত্যিই আসে কারও? তুই ছিলি একটা অভ্যেসের মতো, একটা নির্ভরতার মতো, একটা অস্তিত্বের মতো। এইসব চট করে বদলে ফেলা যায়, বল? আমি না থাকলে আর কাকে এমন করে যত খুশি বকতে পারবি, বল? তুই ক্রমাগত আমার ভুল ধরিয়ে না দিলে পুরো জীবনটাই আজ ভুলে ভর্তি হয়ে যেত! তোর জন্য আমি নিজেকে অনেক অনেক বদলে ফেলেছি, আমার জন্য তুইও তো আর কম বদলালি না! যাবিই যদি, এইসবের আর কী মানে থাকল তবে? যেদিন তোর সাথে দেখা হতো, সেদিন আমি সারা দিন না খেয়ে থাকতাম বিকেলে তোর হাতের নুডলস-পাকোড়া খাব বলে। আমার আর কোনও দিনই এমন না খেয়ে থাকা হবে না রে! তোকে কখনও মুখে কিছু বলতে পারিনি। বলতে আমি অতটা পারিও না। আমি মুখচোরা বলেই তো তোর কাছে আসতে পেরেছিলাম! আজ সত্যিটা বলছি। আমার প্রতিটি কাজের ছায়ায় তোকে আমি দেখতে পেতাম, অনুভব করতে পারতাম। আমার কাজগুলো আর আগের মতো ভালো হবে না, দেখিস! অর্ধেক অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থেকে দারুণ কিছু করা যায় না রে! আমাদের একটা মেয়ে হবে, ওর নামটাও আমরা ঠিক করে রেখেছি, তোকে ওর নামটা উচ্চারণ করে ওর মা হিসেবেই ডাকি, তুইও আমাকে ডাকিস ওর বাবা বলেই, মেসেঞ্জারে আমাদের নিকনেইমও ওরকম করেই সেট করেছি আমরা। তুই আমার কাছে ওকে খুব করে চাইতিস! মা হতে চাওয়ার সে কী এক আকুলতা ছিল তোর কণ্ঠে, চোখে, হৃদয়ে! এ সবই ভুলে যাবি, না? আমাদের অপেক্ষাগুলো বড়ো সুন্দর ছিল। আমাদের সময়গুলো বড়ো সুখের ছিল। আমাদের মুহূর্তগুলো শুদ্ধতম অনুভবে টইটম্বুর ছিল। আমাদের পরস্পরের প্রতি টান ও শ্রদ্ধাবোধটা অকৃত্রিম ছিল। তোর মনে কি সত্যিই আর পড়বে না, তোর নিজেরও যে একটা 'তুই' ছিল? তোর হাতের রান্নাটা খুব মিস করব। এক মায়ের হাতের রান্না বাদে আর কারও রান্না খাওয়ার জন্য অতটা অপেক্ষা করে কখনও থাকিনি। তোর প্রতিটি ছেলেমানুষির কথা মনে করে ভীষণ ভীষণ কান্না পাবে। তোর চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে আমৃত্যুই ইচ্ছে করবে। তোকে খ্যাপাতে, রাগিয়ে দিতে, আদর করে করে অভিমান ভাঙাতে খুব করে মন চাইবে। আমাকে একটু দেখার জন্য আর কেউ কখনও অস্থির হয়ে থাকবে না, আমাকে একটি গোছানো সংসারের স্বপ্ন আর কেউ কখনও দেখাবে না, আমার মায়ের চাইতে বেশি ভালো আমাকে আর কোনও নারী কখনওই বাসবে না। এতটা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে, এমন কারও সাথে দেখা এ জীবনে আমার আর হবে না। তুই আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়ে দিয়ে নিজেই চলে যাচ্ছিস রে? পারবি আমাকে ছেড়ে থাকতে? সত্যিই পারবি? পারবি এমন করে নতুন মানুষটাকে বকতে? পারবি অন্য কারও সামনে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলতে? হাত ধরে হাসার মতো মানুষ হয়তো পাবি, জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে যার বুকের লোম ভিজিয়ে দেওয়া যায়, এমন মানুষ... সত্যিই আবার পাবি? আমার চোখের সামনে আমার সংসারটা ভেঙে যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে, তোকে আটকে রাখি, আমার পাগলিটাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে লুকিয়ে রাখি! তুই চলে গেলে আমাকে আমার নিজের চাইতে বেশি ভালো আর কে বাসবে, বল? এই এলোমেলো মানুষটাকে আর কে এতটা মুখ বুজে সহ্য করবে, বল? নিজেকে নিয়ে আমার সমস্ত ভাবনার দায়িত্বটুকু আমি আর কাকে দেবো নির্ভার হয়ে? তোর যখন খুব কান্না পাবে, তখন কাকে ফোন করবি? তোর বিষাদে-ঘেরা স্ট্যাটাস কিংবা মাইডে দেখামাত্রই কে তোকে নক করবে? বাসায় পরার পুরনো গেঞ্জি চাইবি আর কার কাছ থেকে? আর কার গায়ের ঘ্রাণটা শরীরে মেখে শুয়ে থাকবি? কার শার্ট ঘড়ি রুমালের ছবি তুলে তুলে মাইডে দিবি? কার জন্য অপেক্ষা করতে করতে লুচি ভাজবি, ফ্রিজ থেকে বের করে গরুর মাংসের ভুনা গরম করবি? কার মনের মতো করে নিজেকে গুছিয়ে ফেলবি পুরোপুরি? কার কথা ভেবে ভেবে ঈশ্বরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আয়ুভিক্ষা করবি? তবু, আমরা দুজনেই হয়তো দিব্যি বেঁচে থাকব। হাসব, খেলব। আমরা নিজেদেরকে নিজে নিজে গোছাতে শিখে যাব একসময়। লোকে আমাদের বেঁচে থাকতে দেখবে। আমরা দুজনেই হয়তো একটা-না-একটা 'তুমি' ঠিকই পেয়ে যাব, তবে 'তুই'টা আর কখনও পাবো না। তুইও পাবি না, আমিও পাবো না। আমার জীবনে অনেক ক্লান্তি আসবে, অতৃপ্তি আসবে। পুরনো যন্ত্রণাগুলো একটা একটা করে ফিরে আসবে। তুই আমাকে অনেক ভালোবেসেছিস। এতটা ভালো হয়তো এই পৃথিবীর কেউ কাউকে কখনও বাসেনি। তুই চলে গেলে আমি মানুষটা অর্ধেক হয়ে যাব রে! তুই আমার একটা সংসার ছিলি, আমাদের চিরঅনাগত সন্তানের মা ছিলি, আমার পুরো পৃথিবীটা ছিলি, আমার একমাত্র সুখ আর স্বস্তি ছিলি। আমার বাঁচার একমাত্র মানেটাই তুই ছিলি। মৃত্যুর পর আরেকটা পৃথিবী থাকে যদি, সেখানে আবার আমাদের দেখা হবে। আমাকে এতদিন অনেক ভালো রেখেছিস রে! তুই আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিস। তোকে ধন্যবাদ!