তারকোভস্কির প্রথম ফিচারফিল্মের নাম ‘ইভানের শৈশব (১৯৬২)’, তখন তাঁর বয়স ২৮, ছবি বানাতে লেগেছে ৫ মাস। মূল গল্পের নাম ‘ইভান’, লেখক ভ্লাদিমির অসিপোভিচ বোগোমোলোভ। সিনেমাটি কী নিয়ে? তারকোভস্কির মুখেই শোনা যাক:
‘আমি এ সিনেমায় যুদ্ধগ্রস্ত মানুষের অবস্থাটা বিশ্লেষণ করতে চেয়েছি। যখন কাউকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়, তখন তার স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়, বিশেষ করে, একটা শিশুর ক্ষেত্রে এ প্রভাবটা পড়ে সরাসরি মনের উপর। এ সিনেমার নায়ককে আমি দেখিয়েছি এমন একটা চরিত্র হিসেবে, যুদ্ধের কারণে যাকে স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে সরে যেতে হয়েছে। ওই বয়সের একটা ছেলের জীবনে যা কিছু অস্বাভাবিক, তেমন অনেক কিছুই ইভানের ক্ষেত্রে ঘটেছে। যুদ্ধের অশুভ যত দিক আছে, সেগুলি যেন ইভানের উপর এসে ভর করেছে, এবং এর ফল হয়েছে ভয়াবহ।’
ইংমার বার্গম্যান, ক্রিস্টফ কিয়েলভ্স্কির মতো ফিল্মমেকাররা এ ছবির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বার্গম্যান বলেছিলেন, ‘তারকোভস্কির প্রথম ফিল্মের সাথে আমার যাত্রাটা ছিল একটা অলৌকিক ঘটনা। হঠাৎ, আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা কক্ষের দরোজার সামনে, যেটির চাবি আমার কাছে ছিল না। আমি বরাবরই সে কক্ষে ঢুকতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। আর তিনি কিনা সে কক্ষেই সাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন!’
‘আমার জীবনে দেখা সবচাইতে সুন্দর সিনেমাগুলির একটি ‘ইভানের শৈশব’।’ সিনেমাটি দেখার পর তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানাচ্ছেন ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্রে।
১২ বছরের ইভানের মা ও ছোটবোনকে হিটলারের নাৎসি বাহিনি হত্যা করেছে। তার বাবা সম্মুখযুদ্ধে মারা গেছে। ইভানের মনে এখন শুধুই ঘৃণা ও প্রতিশোধগ্রহণের স্পৃহা। তার শৈশব নষ্ট হয়ে গেছে, ইভানের শৈশব স্মৃতি হয়ে গেছে। এখন তার কেবল একটাই ইচ্ছা: নাৎসি বাহিনির বিরুদ্ধে সোভিয়েত সৈন্যদের যুদ্ধে যেকোনও মূল্যে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা।
তুমি কি দূরে চলে গেছো?
হ্যাঁ, অনেক দূরে।
সবাই দূরে চলে যায়। কেন যায়, জানি না।
…এমন কিছু দৃশ্যের সংলাপগুণে ‘ইভানস চাইল্ডহুড’ আপনাকে অনেক দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কোথায়, কেন, কখনও জানতেও পারবেন না। সিনেমা শেষ হলেও না।
বার্চগাছের বাগানে। সকল কষ্ট আর দুর্দশা থেকে দূরে, কোনও এক স্বপ্নভূমিতে…খোলিনের মাশাকে চুমু খাওয়ার দৃশ্যটি খুব উপভোগ্য। মাশা সারাক্ষণই কেমন একটা ভয় আর দ্বিধার মধ্যে থাকে। সে প্রথমে চুমু খেতে রাজি হয় না, ওদিকে খোলিন মাশাকে চুমু খাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। কিছু মেয়ে আছে, যারা নিজ থেকে কিছুতেই চুমু খাবে না, তবে কেউ ওকে ধরে চুমু খেয়ে ফেললে সে তেমন কিছু মনে করবে না, বরং এমন ভাব দেখাবে, যেন সে ওই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। মাশা মেয়েটা ওরকমই। খোলিন সেই বাগানের মাঝবরাবর চলেযাওয়া শুকনো পরিখাসদৃশ অংশের ফাঁকে মাশাকে জড়িয়ে ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে চুমু খায়। মাশা তখন খোলিনের বাহুবন্ধনে, তার পা দুইটি নিচে ঝুলছে, খোলিনের দুই পা ভি-আকৃতির হয়ে দুইদিকের ভূমিতে ধাক্কা দিয়ে দুইজনের ভারসাম্য ঠিক রাখছে। দূর থেকে গাল্টসেভ দৌড়ে এসে একটু দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখছে। মাশার গোঁয়ার্তুমি, খোলিনের তীব্র চাহনি, নানান ছলে আর কৌশলে মাশাকে কাছে আনা, এরপর সেই অতর্কিত চুম্বন! না, এখানেই শেষ নয়। চুমু খাওয়ার পর মাশা উত্তেজিত হয়ে যায়। তখন খোলিন মাশাকে চলে যেতে বলে। মাশা জিজ্ঞেস করে, কেন চলে যাব? উত্তরে খোলিন শুধু বলে, চলে যাও, মাশা, চলে যাও!
আর একটা দৃশ্য। ইভান স্বপ্ন দেখছে। বৃষ্টি নেমেছে। গ্রামের মেঠো পথ ধরে একটা আপেলবোঝাই গাড়ি আসছে। সে গাড়িতে আপেলের পাহাড়ের উপর ইভান আর তার ছোটবোন বসে আছে। ইভান একটা আপেল হাতে নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজাচ্ছে। বোন ইভানের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তাকে আপেল খেতে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সে খাচ্ছে না। হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেলো। আপেলের গাড়ি হতে অনেক আপেল নিচে বালুর উপর পড়ে গেছে। কয়েকটি ঘোড়া নিচে পড়ে-থাকা আপেল খাচ্ছে। দৃশ্যটির প্রথম দিকে আমার বারবারই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ইভানের মায়ের হাতটা আপেলের ওখানটায় দেখতে পাবো! মা ওদের আদর করে জড়িয়ে ধরবে! গাড়িটা যখন বালুর উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, সে মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল, যদি কোত্থেকে একটা গুলি এসে ইভানের বোনের গায়ে লাগে! আচ্ছা, সিনেমাদেখার সময় এইসব মাথায় আসে কেন?
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ইভানদের শৈশব কেড়ে নিয়েছে ধ্বংস ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ইভানদের চোখে সেসময় ছিল দুই পৃথিবী। এক পৃথিবী শৈশবের স্বপ্ন ও মধুর স্মৃতির পৃথিবী। আর এক পৃথিবী অন্ধকার, বীভৎস বাস্তবতার পৃথিবী। দেশ যখন সংকটে, ইভানদের পরিবারকে হত্যা করা হচ্ছে নির্বিচারে, তখন ইভানদের শৈশব কাটানোর কোনও সময় থাকে না। এ মুভি যতটা যুদ্ধের, ততধিক মানবিকতার। মুভির শেষে গাল্টসেভের একটা প্রশ্নই এ মুভির মূল সুর: এ যুদ্ধ কি সত্যিই পৃথিবীর শেষযুদ্ধ নয়? তারকোভস্কিসুলভ বেশ কিছু উপাদান এ সিনেমায় দেখতে পাই: ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘর, গাছের সারি, জলের দাগ, আপেলের ভাষা, ঘোড়ার উপস্থিতি। এরা সবাইই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়, কথা বলে। তারকোভস্কি এদের দিয়ে কথা বলান। কিছু দৃশ্যের বয়ান দিই।
– তাদের তো কবর দেওয়া প্রয়োজন।
ডায়লগটা ইভানের। যুদ্ধ চলছে, এমন সময় লাশের সৎকার করা না করায় কিছু এসে যায় না। এমন সময়ে মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়ার কাজটা শক্ত। দুইটি ছেলেকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, একটা প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে: স্বাগতম। এ দৃশ্য যেন মৃত্যুর দিকে পৃথিবীর মানুষকে স্বাগত জানাচ্ছে! দৃশ্যটি দেখলেই বীভৎস যুদ্ধের ভয়াবহতা বারবার মনে আসে। সিনেমার শুরু থেকেই আমরা ভাবতে থাকি: ইভানের ভাগ্যে কী আছে? ইভানকে নিয়ে তারকোভস্কির কোনও তাড়া নেই। বরং যুদ্ধের সময়ে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, মিথস্ক্রিয়া, প্রকৃতি, এবং একটা শিশু, যে তার কাছের মানুষদের হারিয়েছে যুদ্ধের কারণে, তার মনস্তত্ত্ব নিয়ে কথা বলে গেছেন সিনেমার শেষ অবধি।
– এটা তোমার কাজ নয়, এটা হচ্ছে যুদ্ধ।
– আমার কাজ না? তুমি কি কখনও ট্রস্টেনেটসে গেছো?
ইভানের বয়স কম, তার পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। যুদ্ধ করা তার কাজ নয়। তাকে যখন এটা বলা হল, তখন সে উল্টো প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে। ম্যালি ট্রস্টেনেটস একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নাম। নাৎসি বাহিনি ওখানে লোকজনকে ধরে নিয়ে অত্যাচার করতো, মেরে ফেলত। ইভানের পরিবারকে নাৎসিরা হত্যা করেছিল। এটা নিয়ে তার যে ক্রোধ ও ক্ষোভ, তা থেকেই সে তীব্র শ্লেষে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছে।
– তো, তুমি যদি আহত হও, তবে?
– এটা তোমার দেখার বিষয় নয়।
তারকোভস্কি এ সিনেমায় যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ইভানের যে মানসিক অবস্থা, তা দেখিয়েছেন ক্যামেরার প্রতি সততা রেখেই। গাছের ছায়া কিংবা নদীর কায়া, দুইই জানিয়ে দেয়, কেউ ভাল নেই, সবাইই উদ্বিগ্ন—নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য। নাৎসি বাহিনির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইভান আহত হতে পারে, এমন-কী মারাও যেতে পারে। সে এসবের কিছুই পরোয়া করছে না। এখন পরোয়া করার সময় নয়, এখন কেবলই প্রতিশোধ নেওয়ার সময়।
যেসকল সেনাসদস্যদের হয়ে ইভান কাজ করছে, তাদের তুলনায় সে গায়েগতরে অর্ধেক। প্রথম দেখায় ইভানের কথাবার্তায় ইভানকে কিছুতেই শিশু মনে হয় না, কিংবা তাকে দেখতে এমন কারও মতো লাগে না, যার একটা শৈশব ছিল। তার চেয়ে বয়সে ও শক্তিতে অনেক বড়ো সেনাসদস্যদের সাথে তার আচরণে ও আলাপে তাকে বয়সের তুলনায় বেশি পরিপক্ব মনে হয়। তার দেহের বয়স কম হলেও মনের বয়স বেড়ে গেছে বেপরোয়াভাবেই। সিনেমা যত এগোয়, ততই পরিষ্কার হতে থাকে যে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই ইভানকে এমন পরিপক্ব করে দিয়েছে। ইভানকে মাইলের পর মাইল পালিয়ে আসতে হয়েছে, কঠিন স্রোত সাঁতরে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে, সেই সময়টাই ইভানকে ওরকম দৃপ্তকণ্ঠ দিয়েছিল। যুদ্ধের সময়ে মানুষের মনস্তত্ত্ব কোনও ব্যাকরণে চলে না। প্রয়োজনই মানুষকে বদলে দেয়। ইভানের স্মৃতি ইভানকে স্বাভাবিক থাকতে দেয় না, তার সবসময়ই প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে রাখে, একটা দৃশ্যে সে একটা চাকু নিয়ে খেলতে থাকে, তাকে দেখলে মনে হয়, সে যেন নাৎসিদের সামনে পেলে এই মুহূর্তেই তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বদলা নেবে। সে একরোখা, জেদি, গোঁয়ার, ছেলেমানুষ স্বভাবের। তার এই ছবি যেন হাজারো ইভানের ছবি, যাদের কোনও ঘর নেই, বিপদের ভয় নেই, সব হারিয়ে যাদের হারানোর আর কিছুই নেই। ওদের চোখে নাৎসি বাহিনির জন্য কেবলই ঘৃণা আর বদলা নেওয়ার তীব্র ইচ্ছা। ওদের শৈশব শেষ, কেননা ওরা মৃত্যুকে দেখে ফেলেছিল। একদিন মরে যাব, সেই দিনটা হতে পারে আজকেও—এই উপলব্ধি শৈশবকে শেষ করে দেয়। ইভানের মনে একটাই প্রশ্ন: এ যুদ্ধের শেষ কোথায়?………এমন কারও মনে কোনও শৈশব থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।
আন্দ্রেই তারকোভস্কির বাবা বিখ্যাত রাশিয়ান কবি আর্সেনি তারকোভস্কির একটা কবিতার কিছু লাইন পড়া যাক:
যখন যুদ্ধ শুরু হয়নি, তখন একদিন ইভান জলের ধারে হেঁটে গিয়েছিল,
সে পথ ছিল উইলোগাছের ছায়ায় ঘেরা,
যে গাছগুলি জানতই না কেন ওরা ঠিক সেই জলের ধারেই জন্মেছে,
ওদের নাম ইভানোভা উইলো, জানত শুধু ছোট্ট ইভান।
তার বর্ষাতির তাঁবুতে, যুদ্ধশেষে ইভান এল ফিরে,
সেই উইলোগাছের ভিড়ে।
ইভানোভা উইলো,
ইভানোভা উইলো,
জানত কেবল ইভানই,
সাদা নৌকোর মতন ভাসতে গিয়ে পথ হারাল পথেরই ধারে।
ওঁরই লেখা আর একটা কবিতার দিকে তাকাই:
এ পৃথিবী ছেড়ে অনেক দূরে,
যেখানটায় আমরা আছি, সেখান থেকে অনেক দূরে,
ঢেউ মানে না তীরের শাসন,
একটি তারার সাথে একটি মানুষ, ওরা আছে পাখির সাথে, ঢেউয়ের গায়ে,
বাস্তবতা, স্বপ্ন কিবা মৃত্যু এলেও ঢেউ আছড়ে চলে ঢেউয়ের গায়েই।
প্রথম দৃশ্যে ইভান দৌড়ে যাচ্ছে, হাসছে, খেলছে। ইভানের মা সামনে এল, ইভানকে এক বালতি জল দিল। ইভান মুখ ডুবিয়ে জল খাচ্ছে। ইভানের মা মারা গেছে অনেক আগেই। ইভানের মা ইভানকে নিতে এসেছে। এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে যেতে হলে কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেখানে জলের ব্যবহার আছে। তারকোভস্কির ছবিতে জল থাকবেই, সাথে কিছু জলসম্পর্কিত মনস্তাত্ত্বিক সিনেমাক্রীড়া। ইভান ঘুম থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসে, মৃত্যুর রাজ্যে। নদী পার হয়ে রাশিয়ান সৈন্যদের ক্যাম্পে গেলে ওরা ওকে জিজ্ঞেস করে, কোত্থেকে আসছ? ও উত্তর দেয়, ওপার থেকে। উত্তরটা আমরা আক্ষরিক অর্থে কিংবা ভাবার্থে নিতে পারি।
ইভানের দ্বিতীয় স্বপ্নে যাওয়া যাক। সে একটা কুয়োয় পড়ে গেছে। সেখান থেকে তার মা তাকে টেনে তুলবে। কুয়ো হচ্ছে এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যাওয়ার রাস্তা, কুয়োর জল হচ্ছে ইভানের জীবনের দর্পণ। জঁ-পল সার্ত্রে তাঁর লেখায় জানাচ্ছেন: ‘এই শিশুটির কাছে দিনও যা, রাতও তা। আমরা তার সাথে হাঁটছি, কিন্তু সে আমাদের সাথে হাঁটছে না। তার পথ ভিন্ন, সে পথ আমরা চিনি না।’ মুভিতে ইভান ভয়ের সীমা অতিক্রম করে নির্ভয়ের দিকে চলে গেছে, সেখানে মৃত্যুও জীবনের মতো স্বাভাবিক, অনিবার্য, বেঁচেথাকার সময়টাতে লড়াই করে যাওয়াই তার একমাত্র নিয়তি। সে হার মেনে নেবে না, স্বাভাবিক নিয়মে বাঁচা তার জন্য নয়। যুদ্ধের সময় কেউই আর শিশু থাকে না, শিশুদের হয়ে উঠতে হয় বড়দের মতো সব কাজেই সক্ষম।
একটা দৃশ্যে দেখা যায়, ইভানের সাথে এক বৃদ্ধলোকের দেখা হয় যার সবকিছুই নাৎসি বাহিনির বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাকি আছে একটা স্টোভ, একটা মোরগ, একটা দরোজা। বৃদ্ধটি দরোজাটা বন্ধ করে দিচ্ছে। দেখলে মনে হবে, যেন ঈশ্বর ওই বৃদ্ধের উপর থেকে তাঁর আশীর্বাদ সরিয়ে নিয়েছেন। এই পুরো দৃশ্য তারকোভস্কির হাতে হয়ে উঠেছে অত্যন্ত বাস্তবানুগ, কবিতার মতো সুন্দর, ছবির চেয়েও সত্য।
আজ, এপ্রিলের ৪ তারিখ তারকোভস্কির জন্মদিন। তিনি বেঁচে থাকলে আজকের দিনে তাঁর বয়স হতো ৮৮। তিনি মারা যান ৫৪ বছর বয়সে। কিছু মানুষ আছেন, পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকতে যাঁদের অনেক দীর্ঘায়ু হতে হয় না। তারকোভস্কি তেমনই একজন। তাঁর সারাটা জীবনই ছিল সকল ধরনের শৃঙ্খলা থেকে শিল্পের মুক্তিতে নিবেদিত। তিনি প্রায়ই বলতেন, তিনটি জিনিস পেলে আমি ভালো কিছু তৈরি করে ফেলতে পারি—রক্ত, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস। তাঁর সম্পর্কে বলতে চাইলে খুব সহজেই তাঁরই ‘স্টকার (১৯৭৯)’ মুভির সংলাপ বলে দেওয়া যায়:
একজন মানুষ তখনই লেখেন যখন তিনি নির্যাতিত, যখন তাঁর মধ্যে সন্দেহ কাজ করে, নিজের ও অন্যদের কাছে তাঁর সারাক্ষণই নিজেকে প্রমাণ করার দরকার হয়। যদি কখনও এমন হয়, আমি জেনেই ফেললাম যে আমি একটা জিনিয়াস?…তখন আবার লিখতে কেন হবে? কীসের তাগিদে?
আমার নিজের মতো করে কিছু কথা লিখে শেষ করছি:
যতদিন পর্যন্ত আলোর প্রয়োজন হলে
আমরা নিজেকে নয়, আগুন জ্বালাব,
যতদিন পর্যন্ত বুটের আওয়াজ হলে
আমদের বুকের মধ্যে কাঁপুনি হবে,
যতদিন পর্যন্ত কাউকে অপছন্দ হলে
তার মাথাটা ঘাড় থেকে নামানো হবে,
যতদিন পর্যন্ত আমাদের সবার চোখে
মানুষ কেবলই বন্ধু কিংবা শত্রু হবে,
স্রেফ মানুষ হবে না…
ততদিনই আসবে, যাবে তারকোভস্কি
…নানান নামে, নানান বেশে, নানান দেশে!