জীবন কাঁপানো ১০ দিন

(নিচের লেখাটি ৩৬তম বিসিএস-এর পরীক্ষার্থীদের জন্য লিখেছিলাম।)

আজকের দিনটি তো শেষই! সো, এটা বাদ। বাকি থাকল আর কয়দিন? ১০। ওকে ফাইন! ধরেই নিচ্ছি, এতদিন যাকিছু পড়েছেন, সেসবের কিছুই এই মুহূর্তে মাথায় নেই। কিংবা, এতদিন তেমন কিছুই পড়েননি। ও আচ্ছা, মাথায় আছে একটুআধটু? যদি মাথায় থাকেও, একটু কষ্ট করে সবকিছু ভুলে যান। সব সঞ্চিত স্মৃতিকে গুডবাই বলে শুরু করা যাক। পুরোপুরি ফাঁকা একটা মাথা! এই মাথা দিয়েই বিসিএস হয়ে যাবে! ভাবছেন, এই ব্যাটা এ কী উদ্ভট ভিত্তিহীন লেখা লিখতে বসলো? লোকটা বড্ডো বেশিই বকে! পুরাই ফাউল লোক একটা! নিজেকে যে কী ভাবে! মনে যা আসে, তা-ই বকে, যেন আর কেউই কোনওদিন বিসিএস ক্যাডার হয়নি! খালি ফালতু প্যাঁচাল পাড়ে! আজাইরা ভাব নেয়! ইত্যাদি, ইত্যাদি। আচ্ছা, আমি যদি বলি, “আরে ভাই, আপনি তো কিছুই পারেন না, আপনার পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ?” তাহলে কি খুব উপকার হবে? কাউকে কিছু বলতে হলে ভালকিছু বলাই তো ভাল, তাই না? ভালকিছু বলার না থাকলে চুপ করে থাকাটা আরও ভাল।

জীবনে পরীক্ষা আসার ব্যাপারটা অন্যের প্রাক্তন কুদর্শন প্রেমিকের/প্রেমিকার সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসার ঘটনার মতোই সুনিশ্চিত। দুটোই—আসবেই আসবে, ঘটবেই ঘটবে! পরীক্ষার সবচাইতে বাজে দিকটি হল, চাই না চাই, পরীক্ষা দিতে হয়। দিতে হবেই যখন, তখন একটু বুদ্ধি করে এই ১০টা দিনকে কাজে লাগান না! কীভাবে? আমি যা বুঝি, যাকিছু মাথায় আসছে এই মুহূর্তে, তা-ই লিখছি। এই ধরনের মনস্তাত্ত্বিক টেকনিক আমি কাজে লাগাচ্ছি সেই ক্লাস এইট থেকে। আমি পরীক্ষার ১০ দিন আগে ধরেই নিতাম, আমি কিছুই পারি না, কিছুই বুঝি না, কিংবা আমি যা পড়েছি, তার কিছুই আমার মাথায় নেই। একেবারে শূন্য থেকে ওঠার অনুভূতিটাই অন্যরকম! যা-ই হোক, আপনাদের নতুন যাত্রাটা শুরু হোক তবে! ভয় পাবেন না, আমি পাশে আছি। আমার হাতটা ধরুন! এ যাত্রা কেউ-না থেকে কেউ-একজন হওয়ার দিকে যাত্রা!

এক। যা শিখেছেন, তার কিছুই মনে রাখার চেষ্টা করবেন না। তা-ই বলে কি কিছুই মনে থাকবে না? থাকবে, কিংবা আপনার আগের বেসিক, কিছু জিনিস আপনি চান না চান, মাথায় রেখে দেবে। ওতে আপনার কোনওই হাত নেই। আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি শুরু করছেন একেবারে শূন্য থেকে। শুরু না করার চাইতে শূন্য থেকে শুরু করা অনেক ভাল, যাতে পরবর্তীতে এই আফসোসটা কাজ না করে, “ইসস্! ওইসময়েও শুরু করলে আমিও পারতাম!”

দুই। অন্যজগতে যেতে চাইলে নিজেকে অন্যমানুষ করে ফেলতে জানতে হয়। চাকরি-নেই আর চাকরি-আছে—এই দুটো অনুভূতির মধ্যে যোজন-যোজন দূরত্ব। এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আপনার হাতে আছে মাত্র ১০ দিন। জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো ১০ দিন’ পড়েছেন না? অক্টোবর বিপ্লবের সময় মাত্র ১০ দিনেই তৎকালীন রাশিয়ার বাকি ইতিহাস লেখা হয়ে গিয়েছিল। আর আপনি আপনার এই ছোট্ট জীবনের বাকি ইতিহাসটা লিখতে পারবেন না? নিজের সবটুকু দিয়ে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করুন, সত্যিই পারবেন।

তিন। এই ১০ দিনে অতি প্রয়োজন ছাড়া আপনি যে রুমটাতে পড়াশোনা করেন, সে রুম থেকে বের হবেন না। গোসল/স্নান, খাওয়া, প্রাকৃতিক কাজকর্ম আর প্রার্থনা ছাড়া আর কোনও কাজে রুম থেকে বের হওয়ার কিছু নেই বলেই তো মনে হয়। সারাজীবন সমাজে মাথা উঁচু করে চলার জন্য এই ১০ দিন নাহয় একটু অসামাজিকই হলেন, ক্ষতি কী? এই ১০ দিনের সামাজিকতা আপনাকে সারাজীবনের জন্য অসামাজিক করে দিতে পারে। এই ১০ দিনে পেপারটেপার পড়বেন না। গড়ে প্রতিদিন গুনেগুনে ১৬ ঘণ্টা করে মোট ১৬০ ঘণ্টা পড়াশোনা করবেন। কী? পারবেন না? পারবেন, পারবেন। জীবনের বাকি ৩০ বছর আরামে কাটানোর জন্য এই ১০ দিন এই সামান্য কষ্টটা করতে পারবেন না? পারবেন না, এটা মাথায় এসে যাচ্ছে বারবার? আপনার চাকরিটা আসলেই দরকার তো, নাকি? লাইফটা ফাজলামো নাকি, ভাই?

চার। এই ১০ দিনে বিসিএস নিয়ে কারওর সাথেই কোনও কথা বলবেন না; ফোনেও না, সাক্ষাতেও না। আপনি এই ১০ দিন প্রায়সময়ই আপনার মোবাইল ফোনটা অফ করে রাখলে কি বাংলাদেশের জিডিপি একটুখানি কমে যাবে? নাকি, তৃতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে? পারতপক্ষে আপনার বাসায় কাউকে আসতে দেবেন না, আপনিও কারওর বাসায় যাবেন না। ফেসবুক কিংবা অন্য কোথাও যে যাকিছুই বলুক না কেন, সেগুলির দিকে বিন্দুমাত্রও খেয়াল করার কোনওই দরকার নাই। আপনি যা পারেন, যা পারেন না, সেটা দিয়েই আপনার পরীক্ষা আপনি দেবেন। এই ১০ দিনে এটা বিশ্বাস করতে শিখুন, আপনি যা পারেন না, তা পরীক্ষায় আসবে না। কেউ আপনার চাইতে বেশি জানার মানে এই নয় যে, সে পরীক্ষার হলে আপনার চাইতে বেশি লিখতে পারবে। খেলা হবে খেলার দিন মাঠে, মাঠের বাইরে কোনওকিছুর সাথেই খেলার ফলাফলের কণামাত্রও সম্পর্ক নেই। আমি অনেক ভাল প্রস্তুতি-নেয়া ক্যান্ডিডেটকে ব্যর্থ হতে দেখেছি। ওরা কেন ব্যর্থ হলেন ভাল প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও, তার কারণ আমি আজও বের করতে পারিনি। সৃষ্টিকর্তা কিছু জায়গায় রহস্য রেখে দেন। কেন দেন? সত্যিই এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। কিংবা এ ব্যাপারটা নিয়ে আমার মাথায় কিছু ভাবনা এলেও তা এ নোটের পরিসরের বাইরে বলে লিখছি না। তবে, সহজভাবে একটা বুদ্ধি দিতে পারি। জীবনে কখনও কারও ক্ষতি করবেন না, করলে আপনার জীবনের কোনও না কোনও সময়ে তার দ্বিগুণ ফেরত পাবেন। পাবেনই! বিশ্বাস হল নাতো? জীবনের সফর এখনও শেষ হয়নি, বন্ধু! অপেক্ষা করুন, উত্তর পেয়ে যাবেন। প্রকৃতি সবকিছুই ফেরত দিয়ে দেয়!

পাঁচ। সিভিল সার্ভিসে নেই, কিংবা আগের কোনও বিসিএস-এ ব্যর্থ, এমন কারওর সাথে এই ১০ দিনে কোনও বিষয়েই কোনও আলাপ করবেন না। আপনার আচরণে অনেকেই আপনাকে পাগল বলবেন (যদি উনি সুস্থ হন)। কেয়ার করার দরকার নেই। দুনিয়ায় চলার একমাত্র নিয়ম, সবাইকে কেয়ার করা যাবে না। এই পৃথিবীর ইতিহাস যুগে-যুগে পাগলরাই লিখেছে। আপনার স্বপ্ন, আপনার জীবন, আপনার পাগলামি—এই দুনিয়ায় সবচাইতে দামি ৩টি রত্ন! এই ১০ দিন পাগলদের দিন। সুস্থ মানুষের দিন এই ১০ দিন নয়।

ছয়। পরীক্ষা যখন চলবে তখন পরেরদিন পরীক্ষা থাকলে আগের রাতে আপনি নিশ্চয়ই অন্তত ৮-৯ ঘণ্টা ঘুমাবেন। যে করেই হোক, ঘুমাবেনই। এর মানে হল, পরীক্ষা চলার সময়টাতে আপনি শুধু ২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছাড়া আর একদিনও মনের মাধুরী (কিংবা ঐশ্বরিয়া) মিশিয়ে পড়ার সময় পাবেন না। তাই, যা করবার এখনই করতে হবে। এখনই সময়! আজকে বসে ১ ঘণ্টা সময় নিয়ে এই ১০ দিন + ওই ৬ দিনের রুটিনটা করে ফেললে কেমন হয়?

একজন সাধারণ মানের ক্যান্ডিডেট, যে পরীক্ষা দেবে এবং ৩৬তম বিসিএস-য়েই ক্যাডার হয়ে যাবে, বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্ব বিচারে তার জন্য রুটিনটা হতে পারে মোটামুটি এরকমঃ

২২ তারিখ সকালবিকালরাত, ১ তারিখ বিকালঃ মানসিক দক্ষতা।

২৩ তারিখ সকালবিকালরাত, ২৪ তারিখ সকালবিকালরাতঃ বাংলা।

২৫ তারিখ সকালবিকালরাত, ২৬ তারিখ সকালবিকালরাতঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।

২৭ তারিখ সকালবিকালরাত, ২৮ তারিখ সকালবিকাল, ১ তারিখ রাতঃ আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি।

২৮ তারিখ রাত, ২৯ তারিখ সকালবিকালঃ বাংলাদেশ বিষয়াবলি।

২৯ তারিখ রাত, ৩০ তারিখ সকালবিকালরাত, ৩১ তারিখ সকালবিকালরাতঃ ইংরেজি।

৩০ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে সঠিক নিয়মে অংক করবেন (আরও ভাল হয়, হাতে না করে বারবার দেখলে)। ৩ তারিখ পরীক্ষা দিয়ে এসে পরেরদিন ৪ তারিখ পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পড়াশোনা করার জন্য যে সময়টা পাবেন, সে সময়টাতে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ১ ঘণ্টার বেশি সময় না পড়লেই ভাল।

সাত। এই সময়টাতে ডাইজেস্ট পড়বেন (অন্তত ২টা পড়তে পারলে ভাল হয়)। রেফারেন্স বই পড়ার কোনও দরকার নেই। প্রত্যেকটা বিষয়ের সিলেবাস ধরে-ধরে সব টপিক খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও একবার ‘টাচ করে’ যাওয়াটা ভাল। এই সময় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ার সময় নয়, এই সময় অতি দ্রুত চোখ বুলিয়ে পড়ার সময়। একবার হলেও মোটামুটি প্রত্যেকটা জিনিস দেখে না গেলে পরীক্ষার হলে বানিয়ে-বানিয়ে লেখার সময় আত্মবিশ্বাসটা ঠিকমতো আসে না।

আট। কঠিন এবং মনে-থাকে-না টাইপের জিনিসপত্র এই সময়ে পড়বেন না। একটা প্রশ্নের উত্তর আপনাকে মনে রাখতেই হবে কেন? ওটা পরীক্ষায় আসবেই, এটা কে বলল? আর যদি এসেও যায়, অথবা-টা উত্তর করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?

নয়। সবকিছুই পড়তে ইচ্ছে করছে? কী এমন হবে, পড়ুন না! আপনার জন্য ৪০তম বিসিএস প্রতীক্ষা করছে! (তাও যদি ভাগ্যে থাকে আরকি!) যেকোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভাল করতে হলে অবশ্যই সবকিছু পড়ার সহজাত লোভ সামলাতে হবে। সাজেশনস্ ধরে-ধরে যতটুকু সম্ভব, কম সংখ্যক জরুরি প্রশ্ন বেশিবার পড়ুন।

দশ। পড়তে-পড়তে পাগলপাগল কিংবা আউলাঝাউলা লাগলে একটু ব্রেক নিয়ে হাতপা ছোঁড়াছুড়ি করে নাচতে আর গাইতে পারেন, কিংবা ১০-১৫ মিনিট প্রিয়জনের সাথে গল্প করে নিতে পারেন, কিংবা কোনওভাবেই ঘুমিয়ে পড়বেন না—এই কঠিন শর্তে কিছু সময়ের জন্য বিছানায় শুয়ে পড়তে পারেন। কিংবা ওইসময়ে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে লেখা আমার ফেসবুক নোটগুলি দেখতে পারেন। ৩৫তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা নিয়ে এরকম তিনটি লেখার লিংক নিচে দিয়ে দিলামঃ

(লেখাগুলি আজ আর নেই। কিছু মানুষ সেগুলিকে গায়েব করার সকল পাকা বন্দোবস্ত করেছেন, সফল হয়েছেন, আনন্দ পেয়েছেন।)

অনেক কথা হল। আমি একটু বাচাল প্রকৃতির মানুষ তো, তাই আরও কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। শেষ করিয়াও করিবো না শেষ! অহেতুক আত্মকথন বাদ দিয়ে বলেই ফেলি!

ধরা যাক, ৩৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় ‘সবচাইতে ভাল প্রস্তুতি’ যতটা নেয়া সম্ভব, সেটার তুলনায় আপনার প্রস্তুতি ৪০%, আর আপনার এক বন্ধু, যার প্রস্তুতি আপনার তুলনায় খুবই ভাল, উনার প্রস্তুতি ৬৫%। এই ১০ দিনে আমার এই লেখাটি ফলো করে (কিংবা না করে) খুব বেশি চেষ্টা করেটরে আপনি আপনার প্রস্তুতিকে নিয়ে গেলেন ৬৫%-এ, আর আপনার বন্ধুটি নিয়ে গেলেন ৯০%-এ। কথা সেটা নয়। কথা হল এই, ‘সবচাইতে ভাল প্রস্তুতি’ বলে আসলে কিছু নেই। সবচাইতে ভাল প্রস্তুতির কোনও দামই নেই, যদি পরীক্ষাটা ভাল না হয়। আপনি নিজের প্রবল ইচ্ছেশক্তি আর আত্মবিশ্বাসের জোরে আপনার ৬৫% প্রস্তুতির ১০০%-ই পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দিতে পারেন, যেখানে আপনার বন্ধুটি উনার ৯০% প্রস্তুতির ৫০% পরীক্ষায় কাজে লাগাতে পারার কারণে আপনার চাইতে ২০% মার্কস কম পেয়ে চাকরিটা হারাতে পারেন। এবং, প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষাতেই এটা খুব খুব কমন একটা ঘটনা। আপনি যা পড়েছেন, তার কিছুই মনে না থাকলে, আমি বলবো, আপনি একজন সুস্থ-স্বাভাবিক ক্যান্ডিডেট। আমি প্রায়ই বলি, শতভাগ শিখেছি ভেবে তার ষাটভাগ ভুলে গিয়ে বাকী চল্লিশভাগকে ঠিকমতো কাজে লাগানোই আর্ট৷ কথাটা এমনি-এমনি বলি না। পরীক্ষা দিন, নিজেই বুঝতে পারবেন।

আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই ১০ দিনকে ঠিকমতো কাজে লাগান, আপনি নিশ্চয়ই পারবেন। ভাবছেন, চাপাবাজি করছি? ব্যাপার না, ওরকম ভাবতে থাকুন। পারব না—এটা বিশ্বাস করে কেউ কোনওদিনই ক্যাডার হয়নি, ক্যাডার হয় না, কখনওই ক্যাডার হবেও না। প্লিজ, ওদের দলে যাবেন না, ওদের দলটাই ভারি, কারণ ওই দলে যাওয়াটা পৃথিবীর সবচাইতে সহজ কাজ। আবারও বলছি, আপনি পারবেন, এই ৩৬তম বিসিএস-য়েই আপনার হবেই হবে!

গুড লাক উইথ দ্য থার্টিসিক্সথ!!

৩০তম বিসিএস পরীক্ষার প্রথম ১০জন

…………………………………………………………

প্রায়ই আমাকে একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়: ভাই, আপনি যে ৩০তম বিসিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট হইসেন, তার প্রমাণ কী?

দুঃখজনকভাবে আমি তো আর বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশনের অ্যানুয়াল রিপোর্ট সাথে নিয়ে ঘুরি না, তাই ‘নগদ প্রমাণ’ দেখিয়ে উনার অহেতুক কৌতূহলটা তখুনিই নিবৃত্ত করতে পারি না। পরের বৌ সুন্দরী হওয়ার দুঃখে উনি কাঁদতে থাকেন, আর মনেমনে আমাকে বলেন, “শালা বাটপার!” (ভাবখানা এমন, যেন আমি নিজেই পিএসসি’র কর্ণধার হয়ে নিজেকে প্রথম ঘোষণা করেছি!)

গতকাল ‘বিসিএস: আওয়ার গোল’ গ্রুপে এটা নিয়ে একজন অতি উৎসাহী ভদ্রলোক একটা পোস্ট দিলেন। লোকজন প্রবল উৎসাহে আমাকে পচানোর জন্য জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ওই ভদ্রলোকসহ আরও কিছু ব্যক্তি খুব কটুকটু কথাবার্তা লিখে কিংবা সমর্থন জানিয়ে (মানে, লাইক দিয়ে) এই সিদ্ধান্তে এলেন, “সব মিডিয়ার সৃষ্টি। সুশান্ত একটা ফাউল, নিজেকে আজাইরা হুদাই ফার্স্ট বলে জাহির করে।” (পোস্টটি এখন আর নেই। ওই ভদ্রলোক সরিয়ে ফেলেছেন। আমি পোস্টটি রিমুভ না করার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করেছিলাম। পোস্টটি রাখতে ওই মেরুদণ্ডহীন ভদ্রলোকের সাহসে কুলায়নি। কারণ, উনি নিজেও খুব বাজেবাজে কথা লিখে যাচ্ছিলেন আমার সম্পর্কে এবং অন্যান্য বাজে কমেন্টগুলিতেও লাইক দিয়ে সমর্থন জানাচ্ছিলেন।)

বই পড়ছিলাম, তাই ফেসবুকে ছিলাম না, ইনবক্সে অনেকেই এই ব্যাপারটা নিয়ে টেক্সট পাঠিয়েছেন, ছিলাম না বলে খেয়াল করিনি; এক ছোটভাই ফোন করে ফেসবুকে আসতে বলল, ওর কথায় এলাম, এসেই দেখলাম, সানি ভাই উনার কথার সমুচিত জবাব দিয়েছেন আমাদের রেজাল্ট বের হওয়ার বছরের (২০১১) বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনের মেধাতালিকার পৃষ্ঠাটির ছবি তুলে শেয়ার করে দিয়ে। আমার অনুপস্থিতিতে এই অস্পষ্টতা দূর করার কাজটি করে উনি আমার আপন ভাইয়ের কাজটিই করলেন, যে কাজটি সবসময়ই করে থাকে আমার আরও কিছু খুব-খুব প্রিয় মানুষ। শুধু আপনার ভাইই আপনার পাশে থাকবে, এমনকি যখন পুরো পৃথিবী আপনার পাশ থেকে দূরে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে।

আমার হাতের কাছে এই মুহূর্তে বার্ষিক প্রতিবেদনটি নেই, তাই সানি ভাইয়ের দেয়া ইমেজ ফাইল দুটিই শেয়ার করলাম।

যাঁদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, তাঁদের জন্য আমি মেধাতালিকাটা নিচে লিখে দিচ্ছি:

প্রথম. সুশান্ত পাল (বিসিএস শুল্ক ও আবগারি)

দ্বিতীয়. ফারহানা হামিদ টিনা (বিসিএস স্বাস্থ্য)

তৃতীয়. সৈয়দ শাহ্ সাদ আন্দালিব (বিসিএস পররাষ্ট্র)

চতুর্থ. এ এস এম সায়েম (বিসিএস পররাষ্ট্র) ……… (ক্যাডারের নামটা ভুল টাইপ করা হয়েছে)

পঞ্চম. মোঃ গোলাম সাকলায়েন (বিসিএস পুলিশ)

ষষ্ঠ. মোঃ মনোয়ার মোকাররম (বিসিএস পররাষ্ট্র)

সপ্তম. মোঃ বশির (বিসিএস পররাষ্ট্র)……… (ক্যাডারের নামটা ভুল টাইপ করা হয়েছে)

অষ্টম. মোঃ রিয়াজুল ইসলাম (বিসিএস শুল্ক ও আবগারি) ……… (ক্যাডারের নামটা ভুল টাইপ করা হয়েছে)

নবম. মোঃ বেলাল হোসেন (বিসিএস পররাষ্ট্র) ……….. (হোসেইন টাইপ করা হয়েছে, গেজেটে হোসেন আছে)

দশম. ফজলে লোহানী বাবু (বিসিএস পররাষ্ট্র)

লিখিত পরীক্ষায় আমি পেয়েছিলাম ৬৪৪। ভাইভা পরীক্ষার মার্কস জানা যায় না।

যাঁরা বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন, তাঁদের জন্য একটা ক্যুইজ: ৩০তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের মেধাতালিকায় ফারহানা হামিদ টিনা ষষ্ঠ হয়েছিলেন, প্রথম হয়েছিলেন রেবেকা সুলতানা। তাহলে, সম্মিলিত মেধাতালিকায় ফারহানা হামিদ টিনার নাম এল, কিন্তু রেবেকা সুলতানার নামটা এল না কেন?

কেউ এটার সঠিক উত্তর দিতে পারলে, (শুধু প্রথম উত্তরদাতাকে) সত্যিই কফি খাওয়াবো।

(অনেক পুরনো লেখা)

৩৪তম বিসিএসে প্রথম-প্রথমা বিতর্ক

……………………………………………………………

একটুআগে ওয়ালিদ ভাই ফোন দিলেন জাপান থেকে। উনি ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন। উনার কিছু কথা শেয়ার করছি।

# আমার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পেছনে ৫০% কন্ট্রিবিউশন আপনার আর মাসফি ভাইয়ের। এটা আমার ওপেনলি কনফেস করা উচিত।

# পেপারে দেখলাম, সব কোচিং সেন্টারই আমাকে ওদের স্টুডেন্ট বানায়ে দিসে। আজাইরা সব লোকজন!

# আমার ইনবক্সে গত ৩ দিনে যা হইসে, সত্যিই আমি তা কখনও ভাবতেও পারি না। লোকজন আসলে সহজে কোনওকিছু গ্রহণ করতে পারে না। আপনি এই সেক্টরে অন্তত প্রিপারেশন নেয়ার টেকনিকের ক্ষেত্রে পুরাই লিভিং লিজেন্ড। জানি, ওরা আপনাকেও ছাড়ে না, কিন্তু আবার আপনার টেকনিকগুলিকেও ফলো করে। কিছু ভেস্টেড গ্রুপ আছে যারা এই ধরনের কথাবার্তা বলে নিজেরা পপুলার হতে চায়। চিপ!!!

# আমি প্রায়ই ভাবি, আপনি কীভাবে এতকিছুর পরও এভাবে করে মানুষকে ইন্সপায়ার করে যাচ্ছেন! আপনি আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করসেন, ভাই। ……….. ৬৪৪! এই সংখ্যাটাই আমাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসছে। আমি প্রায়ই আপনার রিটেনের মার্কসটা মাথায় রাখতাম আর একেবারেই খুব সাইলেন্টলি আপনার সব পোস্ট খুব মন দিয়ে পড়তাম। নিজেকে শুধু বলতাম, ৬৪৪কে বিট করতে হবে, যে করেই হোক!

# ভাই, আমি কিন্তু ৩৩তম প্রিলিতে ফেলকরা ক্যান্ডিডেট। পরবর্তীতে ৩৪তম বিসিএস প্রিলির আগে ১ সপ্তাহ খুব ভাল করে পড়সি। রিটেনের আগে ২-৩ সপ্তাহ সবকিছু ছেড়ে পড়াশোনা করে আজকে চাকরিটা পাইসি।

# আমি সাধারণত বইটই খুব একটা পড়ি না, ধৈর্য কম। কোনকালেই কারওর লেখা তেমন একটা মন দিয়ে পড়সি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু জীবনে ২ জন ব্যক্তির লেখা কোন ক্লান্তি ছাড়াই পড়সি। গ্রাজুয়েশনে থাকার সময় যার লেখা পড়ে মুগ্ধ হইসিলাম, উনি আনিসুল হক, মাসফি ভাইয়ের খুব অপছন্দের মানুষ। হাহাহাহা………. পোস্টগ্রাজুয়েশনে যার লেখা সবসময়ই পড়তাম, উনি হলেন আপনি। আপনার লেখার সাবলীলতা আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। সবসময়ই চেষ্টা করতাম, আপনাকে রেপ্লিকেট করতে। যখনই কিছু লিখতাম, ভাবতাম, আপনার মতন হচ্ছে কি না। আপনার স্টাইলটা ফলো করার চেষ্টা করসি। একটা সত্যি কথা বলি ভাই। কেউ বিশ্বাসও করতে পারবে না। ৩৪তম বিসিএস রিটেনের সময় বাংলাদেশ অ্যাফেয়ার্স আর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স পরীক্ষার আগের রাতে আমি বসে বসে যা পড়সি, তা হল আপনার আর মাসফি ভাইয়ের লেখা। একেবারে খুব মন দিয়ে পড়সি আর ভাবসি, কালকে পরীক্ষায় এভাবে করেই লিখব। আমি এসব কথা কোনওদিনও আপনাকে বলি নাই। বললে ভাবতেন, তেল মারতেসি। আজকে তো আর বলতে কোন বাধা নাই। তাই আপনাকে থ্যাংকস দিয়ে নিজেকে হাল্কা করতেসি ভাই। দেশে থাকলে আপনার সাথে দেখা করতাম অ্যান্ড ইউ উড সি টিয়ার্স ইন মাই আইজ।

# এই যে আপনি ইয়াং জেনারেশনকে হেল্প করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এটা সবাই মনে রাখবে। আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ক্যারিয়ার আড্ডায় যে কথা বলেন, এর জন্য আপনি কী পান? কিছুই না। পেপারে যে পোলাপানের জন্য এত এত লিখেন, অনেক কষ্ট হয় ভাই। আমার নিজেকেও ডিবেট করার সূত্রে লেখালেখি করতে হইসে, কথা বলতে হইসে, তাই আমি বুঝি। এই যেমন সেদিন প্রথম আলো’তে যে লিখসেন, ৩৫ পয়েন্টে ৩৫তম, এরকম ছোট্ট একটা লেখা কত মানুষকে যে চাকরি পাওয়ায়ে দিবে, আপনি তা ভাবতেও পারবেন না। আমি আজকে কনফেস করতেসি ভাই, আপনি ছিলেন আমার আইডল। আমার চেষ্টাই ছিল আপনি যা করসেন, আমাকেও সেটা করতে হবে। যত কষ্টই হোক। অংক, বিজ্ঞান এসব জিনিস পারা যায়। কিন্তু যেগুলিতে অনেককিছু লিখতে হয় সেগুলিতে আমি সিমপ্লি যা করসি, তা হল, আপনার লেখার স্টাইলটা ফলো করে লেখার ট্রাই করসি। কথাগুলি কাউকে কখনও বলি নাই। আজকে আপনাকে বলতে পেরে খুব ভাল লাগতেসে।

ওপরের কথাগুলি বলার এক পর্যায়ে ওয়ালিদ ভাই বললেন, “ভাই, পরশুদিন আমার টনসিলের অপারেশন। দোয়া কইরেন।” আমি বললাম, “ভাই, আপনি টনসিলের ব্যথা নিয়ে এত কথা বলতেসেন কেন?” “ভাই, আপনি ব্যস্ত থাকেন, তাই ফোন দিই না। আজকে সুযোগ পাইসি। আমাকে বলতে দেন।”

আমি এমনিতেই ইমোশনাল মানুষ, উনার এ কথা শোনার পর চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারলাম না। এই মানুষটাকে গত ৩দিন ধরে যেসব নোংরা কথা সহ্য করতে হয়েছে, ভাবতেও কষ্ট হয়! অনেকে আমাকেও জিজ্ঞেস করেছেন, দাদা, আসল ব্যাপারটা কী? কে ফার্স্ট হইসে? পরিষ্কার হওয়া দরকার। ……… আহা! মানুষের যে কত আজাইরা টাইম! ভাবলেও হিংসা লাগে!!

কিছু কথা বলে ফেলি। রাগ করবেন না। করলে করেন! কিছুই করার নাই।

এক। ওয়ালিদ ভাই যে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম হয়েছেন, এটা মেনে নিতে অনেকেরই কষ্ট লাগতে পারে। এটা পুরোপুরি জানতে একটু অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। কিন্তু এই মানুষটা তো ফরেনের মতন একটা শীর্ষস্থানীয় ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন, তাই না? যারা আজেবাজে কথা বলছেন, তাঁদের ফুল ফ্যামিলি মিলে বিসিএস পরীক্ষা দিলেও কি ফরেনে প্রথম হয়ে দেখাতে পারবেন? জ্বি ভাই, ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলাম। পারলে রাস্তার বাজে লোকজনের মত গলাবাজি না করে হয়ে দেখান। Your actions talk much louder than your words!

দুই। যারা সেকেন্ড ইয়ার থার্ড ইয়ারে পড়ছ, সামনে কখনও বিসিএস পরীক্ষা দেবে, অথচ আজেবাজে মন্তব্য করেছ, তাদেরকে বলি। অনার্সের পর প্রিলিতে পাস করে দেখাতে পারবে? বিসিএস পরীক্ষা কী, কোন ন্যূনতম ধারণাও আছে তোমাদের? ফরেনে ফার্স্ট হওয়া কী জিনিস, বোঝো? একটুখানি বুঝলেও তোমাদের কথা বলতে বুক কেঁপে উঠত। আর যারা সিভিল সার্ভিসে আসবেই না বলে ঠিক করে রেখেছ, তারা এটা নিয়ে এত চ্যাঁচামেচি করছ কেন? তুমি যা করবে বলে ঠিক করেছ, সেটা নিয়ে আমরা কি কোনও বাজে মন্তব্য করছি? সমস্যা কী, তোমাদের?

তিন। কে ফার্স্ট হল, আর কে সেকেন্ড হল, এটা নিয়ে ঝগড়া করলে কি আপনি চাকরিটা পাবেন? ঝগড়া এত টাইম পান কই? ওই সময়ে পড়াশোনা করতে পারেন না? অন্য মানুষের ঘরে সুন্দরী বউ দেখলে এত গা জ্বলে কেন? এই পরস্ত্রীকাতরতা ছেড়ে লাইনে আসুন।

চার। অনেকে প্রাইভেট ভার্সিটি বনাম পাবলিক ভার্সিটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। আজব! প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে পাস করে বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার বিধান তো আমাদের সরকার রেখেছেন। এটা নিয়ে কথা বলার আপনি কে? প্রাইভেট ভার্সিটিতে কি সব গাধা পড়ে নাকি? ওসব মান্ধাতা আমলের চিন্তাভাবনা নিয়ে সিভিল সার্ভিসে আসার স্বপ্ন দেখেন? প্লিজ, এখানে আসবেন না। এরকম সংকীর্ণ চিন্তার মানুষ সিভিল সার্ভিসে না এলেই দেশের জন্য মঙ্গল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যান্ডিডেটরা এবারের মেধাতালিকার প্রথম দিকে একটু কম আসতে পেরেছেন। এটা নিয়েও কিছু কুৎসিত মন্তব্য আমাদেরকে পড়তে হয়েছে। অন্যান্য বিসিএসে যে বিভিন্ন প্রথমসারির ক্যাডারে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েছে এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, সেকথা হয়তো আপনার জানা নেই। জানা না থাকলে, জেনে নিন। এরকম আজেবাজে মন্তব্য করে নিজেকে রামছাগল প্রমাণিত করবেন না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে আপনি যদি সবসময়ই কারওর মেধা বিচার করেন, তবে আপনার মূল্যায়ন প্রায়ই ভুল হবে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একথা বলছি। আপনি বড় ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন, খুব ভাল কথা, শুনে খুশি হইসি। এখন পাস করেন, ভাল কিছু করে দেখান, এরপর বড়বড় লেকচার মারতে আসেন।

পাঁচ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই সেরা, একথা বারবার বলার কী আছে? এটা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করবে, এমন গর্দভ আছে বলে তো মনে হয় না। ওয়ালিদ ভাই মাস্টার্স করেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমি নিজেও মাস্টার্স করেছি এখান থেকে। অন্যান্য ভার্সিটিও তো ছিল, তাই না? আমরা যে দুটো বিষয়ে মাস্টার্স করেছি, দেশের সেরা ভার্সিটির ওই দুটো বিভাগে ভর্তির সুযোগ না পেলে হয়তোবা অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখতাম। শুধু সিভিল সার্ভিসেই নয়, কর্পোরেট সেক্টরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই জয়জয়কার। মানছি, এটা নিয়ে বেশি লাফালাফি করার মানে অবশ্যই আছে, কারণ ৩৪তম বিসিএসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট সত্যিই অনেকবেশি গৌরবের। আমার ভার্সিটি, আমি এটা নিয়ে গর্ব করি, ওয়ালিদ ভাইও তা-ই করেন। তাই বলে অন্যকোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ছোট করলে, আজেবাজে মন্তব্য করলে কিন্তু ওখানকার স্টুডেন্টদেরও কষ্ট লাগে; ততটাই, যতটা ঢাকা ভার্সিটি নিয়ে কেউ বাজে কিছু বললে আমার নিজের লাগত। আমার মা ভাল, এর মানে এটা হওয়া উচিত না যে বাকি সবার মা খারাপ।

শচীন টেন্ডুলকার বড়, নাকি ব্রায়ান লারা বড়, এ বিতর্ক এখনও এতদিন পরও কাউকে-কাউকে করতে দেখি। অথচ দেখুন, এ নিয়ে ওই দুজন গ্রেট ক্রিকেটারের কারওর কোনও মাথাব্যথা ছিল না। ওদের সময় কোথায় অতো? ওরা তো নিজেকে ছাড়িয়ে যেতেই ব্যস্ত। সমালোচকদের একমাত্র পুরস্কার — আত্মতৃপ্তি। ওদের যেহেতু বড় হওয়ার কোনও যোগ্যতাই নেই, সেহেতু ওরা সবসময়ই লুজারদের কিংবা বড়োজোর মিডিওকারদের দলে। দেখুন, আমরা এত চিল্লাচিল্লি করছি, অথচ মৌসুমী আপু কিংবা ওয়ালিদ ভাই তেমন কোনও উচ্চবাচ্য করছেন না। কেন করছেন না? উত্তরটা দিচ্ছি আমার একটা পুরনো ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে………..

যারা বেশি বোঝেন, আমি তাদের কম বুঝি। বোঝার চেষ্টাও করি না। সময় নাই। He who can, does; he who cannot, teaches. আমার ভীষণ পছন্দের একটা টিভি অ্যাডের কথা মনে পড়ে গেলো। চকোলেটের অ্যাড। একটা চকোলেট সম্পর্কে বিভিন্নজন বিভিন্ন মন্তব্য করছে। কেউ বলছে চকোলেটটা ভালো, কেউ বলছে খারাপ, কেউ-কেউ বা কনফিউসড্। একজন কিছুই বলছে না। মুখ বন্ধ। সবাই জিজ্ঞেস করলো, কী ভাই, কিছু বলছেন না কেনো? উনি কোনোরকমে মুখ খুলে উত্তর দিলেন, ভাই, বলবো কীভাবে? আমি তো খাচ্ছি! . . . . . . . এটা আমার দেখা সেরা অ্যাডগুলোর একটা। আপনি হয় আপেল খাবেন, নতুবা মুখটা খোলা রাখবেন। মুখ খোলা রেখে আপেলের স্বাদ উপভোগ করা সম্ভব নয়। যারা চেঁচায়, ওরা এক দলের; আর যারা এগোয়, ওরা অন্য দলের। বুদ্ধিমানরা তর্ক করেন, প্রতিভাবানরা এগিয়ে যান। একথা সবসময়েই সত্যি। বিল গেটসকে দেখুন, জুকারবার্গকে দেখুন, স্টিভ জবস্‌কে দেখুন। আরো কতো আছে! আমরা ওদের নিয়ে কত তর্জমায় মাতি, আর ওদের সময়ই নেই আমাদের নিয়ে ভাববার; ওরা যে ভীষণ কাজে ব্যস্ত! পৃথিবীর যাবতীয় অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয় কাজের জন্যে, সমালোচনার জন্যে নয়। একদল নীরবে কাজ করে, আরেকদল সরবে সমালোচনা করে। যারা লিখতে পারেন, তারা লিখে যান। যারা লিখতে পারেন না, তারা বকে যান। দুই দলই আসলে সময় কাটান। যে যেভাবে করে সময় কাটিয়ে সুখ অনুভব করে আরকি! আমরা যা-ই করি না কেন, আমরা প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত সময়টুকু কাটাই—আমাদের পছন্দ অনুযায়ী, আমার সুযোগ অনুযায়ী, আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী, আমাদের প্রাপ্তি অনুযায়ী। কারো সময় কাটানোর ধরনই বলে দেয়, উনার দৌড় কতদূর! সম্মানিত স্বীকৃত শ্রদ্ধেয় হন সাহিত্যিকরা, সমালোচকরা নন। সমালোচকদের জন্যে সান্ত্বনা পুরস্কার শুধুই নিভৃত আত্মতৃপ্তি। ঈশ্বর ওদের সুবুদ্ধি দান করুন।

কী বুঝলেন? মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে? মেনে নিন, মেনে নিন, কারণ এটাই বাস্তবতা। সফল হওয়ার পূর্বশর্ত: সাফল্য সহ্য করা শিখতে হবে। যে জিনিস আপনি সহ্যই করতে পারেন না, সে জিনিস ঈশ্বর আপনাকে দেবেন কেন? বদহজম হয়ে যাবে তো! জীবনে বড় হতে হলে হ্যাবিচুয়াল ‘সেলফিশ’ উইকনেস টু গ্রেটনেস থাকাটা জরুরি। যারা নিজনিজ ক্ষেত্রে সফল, তাদের গুণগুলোকে রেপ্লিকেট করার চেষ্টা করুন। যে লক্ষ্যেই পৌঁছাতে চান না কেনো, সেই লক্ষ্যের প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাবোধ রাখুন। আপনি সাফল্য পাননি? তো কী হয়েছে? আবারও চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে যাঁরা সফল হতে পেরেছেন, তাঁদের কাছ থেকে নীরবে বিনীতভাবে শিখুন, কীভাবে ও পথে হাঁটতে হয়। আমার ব্যর্থতার দায়ভার তো আর আমি অন্যের সাফল্যের ঘাড়ে চাপাতে পারি না, তাই না?