প্রতি বছর এভাবেই লক্ষ লক্ষ টাকা জমা হয় দেবীর আরাধনায়—কোনো প্রচার ছাড়াই, কেবল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রবাহে। এই স্বতঃস্ফূর্ত দানপ্রবণতাই “বুড়িমা”-কে কেবল ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, এক সামাজিক প্রতিষ্ঠান করে তুলেছে, যেখানে মানুষ একে অপরের সঙ্গে নয়, নিজেদের আত্মিক ঐক্যের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বুড়িমার প্রতিমা তাঁর গাম্ভীর্য ও নান্দনিক সৌন্দর্যের জন্য সুবিদিত। দেবীকে সাজানো হয় প্রায় ১৫ কেজি সোনার গহনায়—যার মধ্যে আছে প্রজন্মান্তরে চলে আসা রাজবাড়ির দান করা অলঙ্কার। স্থানীয় শিল্পীরা প্রতি বারই প্রতিমার মৃৎশিল্পে এক নিখুঁত শাস্ত্রীয় সৌন্দর্য বজায় রাখেন: শুভ্রবর্ণা দেবী, চারভুজা, সিংহবাহিনী, এক হাতে শঙ্খ, অন্য হাতে চক্র, ধনুক ও বাণ—চেতনার স্থিতি, কর্মের নিয়ন্ত্রণ, এবং জ্ঞানের দীপ্তি—এই তিন গুণের একক রূপে প্রতিভাত। তাঁর মুখে সেই অদ্বিতীয় প্রশান্ত হাসি, যা রজঃ-তমঃ-সত্ত্বের ভারসাম্যের প্রতীক হয়ে ওঠে।
এই প্রতিমায় ধাতু, রং, গহনা, আলোক—সব কিছুই যেন এক সূক্ষ্ম প্রতীকবাদে জড়িয়ে আছে। লাল ও সবুজ বস্ত্র জীবনের শক্তি ও পুষ্টির ভারসাম্য নির্দেশ করে; সোনার দীপ্তি সত্ত্বগুণের প্রতীক, যা আলো, জ্ঞান ও স্থিতি প্রকাশ করে। বুড়িমার মুখের শান্ত তেজ যেন কৃষ্ণনগরের নিজস্ব চেতনারই প্রতিফলন—সংযমে শক্তি, ভারসাম্যে সৌন্দর্য।
এই পূজার সমাপ্তি হয় এক ব্যতিক্রমী ও আবেগঘন প্রথায়। দেবীকে বিসর্জনের জন্য কোনো গাড়ি বা রথে তোলা হয় না—তাঁকে ভক্তরা কাঁধে করে রাজবাড়ি পরিক্রমা করিয়ে নিয়ে যান। শহরের রাস্তাজুড়ে তখন শঙ্খধ্বনি, ঢাকের তাল, প্রদীপের সারি, আর অসংখ্য ভক্তের চোখে অশ্রুসজল আনন্দবোধ। দেবীকে ঘোরানো হয় রাজবাড়ির চারপাশে—যেন রাজশক্তি ও প্রজাশক্তি একসূত্রে মিলিত হয়ে আশীর্বাদের মহামুহূর্ত সৃষ্টি করে। তারপর ধীরে ধীরে ভক্তরা তাঁকে বহন করে নিয়ে যান জলঙ্গীর ঘাটে, যেখানে রাতভর গান, ঢাক, শঙ্খ, ধূপ-ধুনোর মধ্যে সম্পন্ন হয় দেবীর বিসর্জন। বিসর্জনের সেই মুহূর্তটি যেন এক সামাজিক ঐক্যের সমাবেশ—যেখানে বয়স, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি সব সীমা মুছে যায়, এবং শহর একসঙ্গে বলে ওঠে, “জয় মা, বুড়িমা!”
২৫৩ বছর ধরে এই পূজার ধারাবাহিকতা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবের ইতিহাস নয়; এটি কৃষ্ণনগরের আত্মার ইতিহাস। এই পূজা বাংলার সামাজিক নন্দনতত্ত্বের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে ভক্তি ও সংস্কৃতি পরস্পরকে পুষ্ট করে। আধুনিকতার চঞ্চলতার মাঝেও বুড়িমা পূজা আজও সেই অপরিবর্তনীয় স্থিতির প্রতীক—যেখানে দেবীর জগদ্ধাত্রী রূপ হয়ে ওঠে বাংলার নিজস্ব ধৃতি, সেই শক্তি যা পরিবর্তনের মাঝেও ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।
দার্শনিকভাবে বুড়িমা পূজা অদ্বৈত ধারণার এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি। তিনি “ধারক শক্তি”—যিনি সৃষ্টিকে ধারণ করেন, সমাজকে স্থিতি দেন, মানুষকে চেতনার ভারসাম্য শেখান। কৃষ্ণনগরের মানুষের জীবনে বুড়িমা মানে কেবল দেবী নয়, এক স্নেহময় মাতৃস্বরূপ—যিনি তাঁদের ভক্তি, আশা, ক্লান্তি ও স্থিতির আশ্রয়।
তাই বলা যায়, কৃষ্ণনগরের বুড়িমা পূজা কেবল ২৫৩ বছরের এক উৎসব নয়; এটি বাংলার আধ্যাত্মিক চেতনার এক জীবন্ত উত্তরাধিকার, যেখানে দেবী, মানুষ ও সমাজ এক সুরে মিলেছে—যেমন এক বিশাল সঙ্গীতের মধ্যে প্রতিটি স্বর মিলে গড়ে তোলে এক অবিনশ্বর সংগতি, তেমনি বুড়িমা জগদ্ধাত্রী পূজা আজও সেই ঐক্যের সুরে প্রতিধ্বনিত হয়ে আছে কৃষ্ণনগরের প্রাণে—অভয়, স্থিতি ও প্রেমের এক চিরন্তন জাগরণরূপে।
খ. তুলনামূলক আচার এবং অনন্য প্রথা: বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারে জগদ্ধাত্রী পূজার এক স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে, যদিও এর মূল উৎস শাক্ত ঐতিহ্য এবং দুর্গাপূজার আচারিক ধারার সঙ্গে তা গভীরভাবে যুক্ত। তবে এর সময়, রূপ, আচার এবং দার্শনিক মনোভাব—সব কিছুতেই একটি সূক্ষ্ম কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, যা জগদ্ধাত্রী উপাসনাকে এক অনন্য সাধনা-সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করেছে।
১. সময় ও রূপ: দুর্গাপূজার প্রায় এক মাস পর, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে, সাধারণত নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে, জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সময়ের এই স্থানান্তর কেবল ক্যালেন্ডারে নয়, আধ্যাত্মিক আবহেও—দুর্গাপূজার রজোগুণময় উদ্দীপনা শেষে, জগদ্ধাত্রী পূজা আসে এক শান্ত, সাত্ত্বিক অন্তর্লীনতার পর্ব হিসেবে। দেবীর প্রতিমার রূপও এই পরিবর্তনের প্রতিফলন: দুর্গার যেখানে দৃষ্টি তেজস্বী, যুদ্ধংদেহী, সিংহের উপর গর্জনরত—সেখানে জগদ্ধাত্রী শান্ত, উপবিষ্ট, স্থিতধী। তাঁর মুখে জ্ঞানময় প্রশান্তি, ভঙ্গিতে সংযম ও ধৃতি; যেন বিশ্বকে ধারণ করছেন তার অন্তর্গত স্থিতির শক্তিতে, লড়াইয়ের বলপ্রয়োগে নয়।
২. আচারিক তাৎপর্য: জগদ্ধাত্রী পূজার আচারধারা মূলত তান্ত্রিক সাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী এখনও পর্যন্ত সেই প্রাচীন তান্ত্রিক পূজা-পদ্ধতি কঠোরভাবে অনুসরণ করে, যেখানে মন্ত্র, হোম এবং ধ্যান—এই তিন স্তরে পূজা সম্পন্ন হয়। বিশেষত্ব হলো—দুর্গাপূজার মতো পৃথক দিনে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী না পালিত হয়ে, এই তিনটি দিবসের পূজা একই দিনে, অর্থাৎ নবমীতে, সংহতভাবে সম্পন্ন করা হয়। এটি সময় ও ক্রিয়ার সমন্বয়ের এক প্রতীক—যেখানে আচার বাহ্য রূপে নয়, অন্তঃসাধনায় সংহত হয়ে এক কেন্দ্রে মিলিত হয়।
৩. ভোগ ও রসনাত্মক ঐতিহ্য: কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজায় মাছের ভোগের প্রথাটি প্রথম দেখায় যেন এক সাংঘাতিক ব্যতিক্রম—কারণ দেবী সত্ত্বগুণের প্রতীক, আর সত্ত্ব মানে শান্তি, স্থিরতা, সংযম ও নির্মলতা। কিন্তু এই আপাতবিরোধই আসলে বাঙালি শাক্ত তন্ত্রধারার গভীরতম দার্শনিক তত্ত্বের প্রতিফলন। এটি নিছক এক খাদ্যরীতি নয়; এটি এক চেতনার প্রতীক, এক আধ্যাত্মিক উপলব্ধির প্রকাশ—যা বামাচার দর্শনের অন্তর্গত সেই চিরন্তন নীতি বহন করে, যেখানে জগৎ ও শরীর, রসনা ও সাধনা, বস্তু ও ব্রহ্ম—সব কিছুই এক অখণ্ড ঐক্যের মধ্যে মিলিত।
তন্ত্রের ভাষায় “বামাচার” মানে “বাম পথ” বা “বিপরীতগামী সাধনা”—যেখানে নিষেধের পরিবর্তে গ্রহণই মূল নীতি। এই পথের ধারণা আসে সেই মৌলিক বোধ থেকে যে, জগৎ কোনো মায়িক বিভ্রম নয়, কোনো পাপভূমি নয়, বরং চৈতন্যেরই প্রকাশ, শক্তিরই বহিঃরূপ। শাক্ত ভাবনার প্রকাশ: “শক্তিরূপা বিশ্বং ভবতি”— বিশ্ব নিজেই দেবীর শরীর, তাঁরই স্পন্দন। অতএব, জীবনযাত্রার কোনো অংশই এখানে বর্জনীয় নয়; বরং প্রত্যেকটি উপাদান, প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুই হতে পারে মুক্তির দ্বার, যদি তা সচেতনতার আলোয় ব্যবহার করা যায়।
বামাচারের কেন্দ্রীয় তত্ত্ব এক গভীর দার্শনিক উপলব্ধি বহন করে—“যা ভোগ্য, তা-ই যোগ্য”, অর্থাৎ যদি মন চেতনার নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে ভোগও যোগে রূপান্তরিত হতে পারে। এখানে “ভোগ” কোনো নিম্নতর ইন্দ্রিয়সুখ নয়, বরং সেই অভিজ্ঞতা, যা জ্ঞানের আলোয় আত্মিক হয়ে ওঠে। এই তত্ত্বের প্রতীকী প্রকাশই হলো “পঞ্চ-মকার” (pañca-makāra)—মদ, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন। এই পাঁচটি উপাদানকে আক্ষরিক অর্থে নয়, বরং চেতনার পাঁচ স্তর বা energy transformation—এর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। তন্ত্রে এগুলির প্রতিটি মানে একেকটি অন্তর্জাগরণের স্তর, যার মাধ্যমে দেহ, মন ও আত্মার মধ্যে সুষম সেতু গড়ে ওঠে।
মদ (Madya) এখানে সংবেদন ও আনন্দবোধের প্রতীক—চেতনার প্রথম উত্তরণ। যখন ইন্দ্রিয়ের আনন্দ বোধ-বুদ্ধির অধীনে আসে, তখন তা আসক্তি নয়, বরং পরমানন্দ (ānanda) হয়ে ওঠে।
মাংস (Māṁsa) ইন্দ্রিয়তৃপ্তির প্রতীক, কিন্তু সাধনার দৃষ্টিতে এটি “ইন্দ্রিয়সংযম”-এর প্রতীক—যেখানে কামনাকে দমন নয়, সচেতনতার আলোয় রূপান্তর করা হয়।
মৎস্য (Matsya)—এখানেই নিহিত তত্ত্বের প্রাণ। মাছ প্রতীক জীবনশক্তির প্রবাহের, যা তান্ত্রিক পরিভাষায় বলা হয় “প্রাণ-বাহিনী শক্তি” (prāṇa-vāhini śakti)। ‘প্রাণ’ মানে জীবনীশক্তি, ‘বাহিনী’ মানে প্রবাহ, আর ‘শক্তি’ মানে সেই জীবন্ত সঞ্চার। অর্থাৎ, prāṇa-vāhini śakti হলো সেই নিরবচ্ছিন্ন প্রাণতরঙ্গ, যা চেতনার গভীরে অবিরত স্পন্দিত।
যেমন মাছ সর্বদা জলে চলমান থাকে, তেমনি প্রাণশক্তিও চেতনার জলে অবিরাম সঞ্চারমান। জল এখানে চেতনার প্রতীক—শান্ত, গভীর, অথচ প্রাণবন্ত। মাছ সেই জলে কখনও উপরে উঠে আসে, কখনও গভীরে ডুবে যায়—ঠিক যেমন মন কখনও বহির্মুখ হয়ে জগৎ-অভিজ্ঞতায় লিপ্ত হয়, আবার কখনও অন্তর্মুখ হয়ে আত্মচেতনায় নিমগ্ন হয়। তাই মৎস্য তন্ত্রে জীবনের প্রতীক, কিন্তু সেই জীবনের স্রোতকে দমন নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত, সজ্ঞান প্রবাহে পরিণত করাই সাধনার লক্ষ্য।
মুদ্রা (Mudrā) মনোসংযম ও চেতনার একাগ্রতার প্রতীক। এটি “seal of awareness”—যেখানে মন ও প্রণ এক হয়ে যায়।
মৈথুন (Maithuna) চূড়ান্ত ঐক্যের প্রতীক—শিব ও শক্তির মিলন, যা কোনো বাহ্যিক যৌনতা নয়, বরং আত্মা ও পরমাত্মার চেতনার সংযোগ।
এভাবে, পঞ্চ-মকার তত্ত্ব কোনো ভোগবাদী চিন্তাধারা নয়; এটি সেই রূপান্তরবাদী যোগতত্ত্ব, যেখানে জাগতিক অভিজ্ঞতাকে চেতনার আলোয় পরিশুদ্ধ করা হয়। মৎস্যভোগ তাই নিছকই কোনো খাদ্যরীতি নয়—এটি আসলে সেই অন্তর্জাগরণের প্রতীক, যেখানে জীবনের প্রাণশক্তিকে জাগ্রত চেতনার অন্তর্গত করা হয়। শ্রীমদ্দেবীভাগবত পুরাণ ও কুলার্ণব তন্ত্র প্রভাবিত শাক্ত দর্শন ও তন্ত্রশাস্ত্রের একটি সর্বজনীন স্বীকার্য সিদ্ধান্ত বা মহাবাক্য—“যদিদং সর্বং শক্তিরূপম্”—"এই যা-কিছু আছে, সবই শক্তিরূপ।" এটি ঘোষণা করে যে ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি অংশ স্বয়ং পরম শক্তি (দেবী, মাতৃকা বা মহাশক্তি)-র প্রকাশ মাত্র। জগৎ শক্তিরই প্রকাশ; অতএব ভোগকে যদি চেতনার সীমানার মধ্যে আনা যায়, তবে সেটিই যোগে রূপান্তরিত হয়।
বামাচারের দর্শনে মাছের প্রতীকটি এক গভীর তত্ত্বের ইঙ্গিত বহন করে। মৎস্য এখানে কেবল জীব নয়—এটি চেতনার এক দ্বৈত স্রোত: একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে গভীরতা। যেমন জল সর্বদা শান্ত, অথচ তার তলদেশ অসীম, তেমনি চেতনা বাহ্যত স্থির হলেও অন্তরে অনন্ত স্পন্দনে ভরপুর। মাছ সেই দুই স্তরের মধ্য দিয়ে অবিরত গমন করে—কখনও উপরিতলে, কখনও গভীরে; যেন আত্মা কখনও বহির্মুখ হয়ে জগৎ-অভিজ্ঞতায় লিপ্ত হয়, আবার কখনও অন্তর্মুখ হয়ে নিজের উৎসে ফিরে যায়। তাই তন্ত্রে মাছ হলো সেই সাধকের প্রতীক, যিনি ইন্দ্রিয়ের জলে ভেসে থেকেও আসক্ত নন, বরং সর্বদা পরম চেতনার স্রোতের সঙ্গে একাত্ম।
এই কারণেই মৎস্যকে বলা হয় “প্রাণ-তরঙ্গ” বা prāṇa-vāhini śakti—চেতনার জলরাশিতে অবিরাম সঞ্চারিত সেই জীবনপ্রবাহ, যা কখনও স্থির নয়, তবু সচেতনতার উপস্থিতিতে ভারসাম্যপূর্ণ। মাছ দমন করা মানে সেই জীবন্ত প্রবাহকে রুদ্ধ করা, আর মৎস্যভোগ মানে তাকে সজ্ঞানভাবে গ্রহণ ও সম্মান করা। এই দৃষ্টিতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মাছভোগ তত্ত্ব নিছক খাদ্যরীতি নয়; এটি এক গভীর আধ্যাত্মিক প্রতীক—বামাচার দর্শনের জীবন্ত উদাহরণ, যেখানে দেবী জগদ্ধাত্রী সেই শক্তির প্রতীক, যিনি জীবনের প্রতিটি স্রোতকে চেতনার নিয়মে স্থিতি ও পবিত্রতায় রূপ দেন।
তন্ত্র এইভাবেই শেখায় যে, ধর্ম মানে বর্জন নয়, বরং রূপান্তর। “যৎ পিণ্ডে, তৎ ব্রহ্মাণ্ডে”—অর্থাৎ, দেহেই ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিচ্ছবি। যদি দেহের সমস্ত প্রবৃত্তি চেতনার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তবে মুক্তি দেহের মাধ্যমেই সম্ভব। মাছের ভোগ তাই কোনো অপবিত্রতা নয়; বরং এটি সেই উপলব্ধির প্রতীক যে, জীবন নিজেই ব্রহ্ম—ভোগও যদি সচেতনতার আলোয় অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা যোগেরই এক রূপ।
এভাবেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মাছভোগের ঐতিহ্য হয়ে ওঠে এক মহত্তম দার্শনিক রূপক। এখানে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—তিন গুণই সমন্বিত। দেবী জগদ্ধাত্রী সত্ত্বের প্রতীক, কিন্তু তাঁর ভোগে রজঃ ও তমঃ-ও অন্তর্ভুক্ত—অর্থাৎ, তিনি কেবল শান্তির নয়, পূর্ণতার দেবী। তিনি শেখান, জীবনের প্রতিটি উপাদান, প্রতিটি প্রবণতা যদি জ্ঞানের দ্বারা আলোকিত হয়, তবে সেগুলো আর বন্ধন নয়, বরং মুক্তির মাধ্যম।