১. “ব্রহ্মার সৃষ্টিশক্তি তাঁর মধ্য দিয়ে কার্যকর”—ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, কিন্তু সৃষ্টি কেবল তখনই ঘটে, যখন শক্তি বা চেতনা তাঁর মধ্যে প্রবাহিত হয়। জগদ্ধাত্রী সেই চেতনার উৎস। তিনি ব্রহ্মার অন্তরে সৃষ্টির “ইচ্ছা” জাগিয়ে তোলেন, রূপ ও সম্ভাবনাকে প্রকাশে আনেন। অর্থাৎ, সমস্ত সৃষ্টির প্রেরণা, গতি ও প্রাণ তাঁর থেকেই উৎপন্ন। তিনি না থাকলে সৃষ্টি নিস্তব্ধ, নির্জীব। তাই ব্রহ্মার সৃষ্টিশক্তি তাঁর মাধ্যমে কাজ করে—তিনি সৃষ্টির প্রেরণাশক্তি ও কার্যকারণ উভয়।
২. “বিষ্ণুর সংরক্ষণশক্তি তাঁর করুণারূপে প্রকাশিত”—বিষ্ণুর কাজ হলো জগৎ রক্ষা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এই রক্ষণশক্তির মূলই করুণা—কারণ রক্ষা মানে কেবল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নয়, বরং জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করা, অশুভ থেকে শুভের পথে ফিরিয়ে আনা। জগদ্ধাত্রীর করুণা-ভাব বা সত্ত্বগুণই বিষ্ণুর এই সংরক্ষণশক্তির রূপে প্রকাশিত হয়। তাঁর মৃদু হাসি, শান্ত ভঙ্গি ও আশীর্বাদময় করুণা ইঙ্গিত করে—তিনি সেই মা, যিনি জগৎকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে ধারণ করেন, তার ভারসাম্য রক্ষা করেন।
৩. “শিবের সংহারশক্তি তাঁর জ্ঞানরূপে নিয়ন্ত্রিত”—শিবের সংহার মানে ধ্বংস নয়; বরং রূপান্তর—পুরোনো রূপ বিলুপ্ত করে নতুনের জন্মের সুযোগ করে দেওয়া। এই সংহার প্রক্রিয়া যদি জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে তা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। জগদ্ধাত্রীর অন্তর্গত জ্ঞানরূপ দীপ্তি এই সংহারশক্তিকে নিয়ন্ত্রিত রাখে। অর্থাৎ, তিনি ধ্বংসের মধ্যে অর্থ ও উদ্দেশ্য স্থাপন করেন—বিলোপকে পরিণত করেন পুনর্জন্মে। তাঁর জ্ঞানই শিবের সংহারকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যায়।
তিনটি দিক মিলিয়ে বোঝা যায়—জগদ্ধাত্রী সেই এক মহাশক্তি, যাঁর মধ্যে সৃষ্টির প্রাণ, রক্ষার করুণা ও সংহারের জ্ঞান—এই তিনটি বিশ্বপ্রবাহ একত্রে সক্রিয়। তিনি কেবল ত্রিমূর্তির শক্তির আধার নন; তিনি তাঁদের মূলে থাকা সেই এক চেতনা, যিনি সবকিছুকে এক সুরে বেঁধে রাখেন—যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় কোনো পৃথক প্রক্রিয়া নয়, বরং এক চেতনার তিন তরঙ্গ।
ব্রহ্মার সৃষ্টিশক্তি তাঁর মধ্য দিয়ে কার্যকর, বিষ্ণুর সংরক্ষণশক্তি তাঁর করুণারূপে প্রকাশিত, আর শিবের সংহারশক্তি তাঁর জ্ঞানরূপে নিয়ন্ত্রিত।
এইভাবে তাঁর চারটি হাত সেই মহাজাগতিক সমন্বয়-এর প্রতীক—যেখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার কোনো আলাদা প্রক্রিয়া নয়, বরং এক চেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ।
তাঁর হাতে-থাকা অস্ত্রগুলি কেবল দেবীর শৌর্য, বীরত্ব বা যুদ্ধপ্রবণতার প্রতীক নয়; বরং এগুলি বোঝায় যে, জগদ্ধাত্রী হলেন সেই সর্বময় শক্তি, যিনি সমগ্র মহাবিশ্বের ক্রিয়ার ধারাকে এক কেন্দ্রে—নিজের চেতনার স্থিতিতে—সংহত করে রেখেছেন।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে জগদ্ধাত্রীর প্রতিটি অস্ত্র, অলঙ্কার ও ভঙ্গি কেবল ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং চেতনার রূপক প্রকাশ—যেখানে ব্রহ্ম, শক্তি ও বিশ্বপ্রপঞ্চ এক অবিচ্ছিন্ন ধারায় যুক্ত হয়ে যায়। অদ্বৈত বলে, ব্রহ্ম এক ও অখণ্ড; জগৎ, দেবতা বা রূপাবলি তারই প্রকাশ। তাই জগদ্ধাত্রীর হাতে-থাকা অস্ত্রসমূহকে যদি ব্রহ্মচেতনার বিভিন্ন কার্যরূপ হিসেবে দেখা যায়, তবে তাঁর রূপটি কোনো পৌরাণিক কল্পনা নয়, বরং নিরাকার সত্যের গতিময় প্রতিফলন।
তাঁর প্রথম দুটি হাতে দেখা যায় বিষ্ণু-গুণাবলী—সুদর্শন চক্র ও পাঞ্চজন্য শঙ্খ। অদ্বৈত তত্ত্ব অনুসারে, বিষ্ণু মানে রক্ষাকারী কোনো আলাদা দেবতা নন; বরং ব্রহ্মচেতনার সেই দিক, যা বিশ্বকে ধারাবাহিক রাখে, সময় ও ধর্মের নিয়মে স্থিত করে। চক্র তাই কেবল অস্ত্র নয়, বরং ধর্ম ও মহাজাগতিক নিয়মের প্রতীক, যেখানে সময়ের অবিরাম ঘূর্ণন সৃষ্টি করে কারণ ও ফলের শৃঙ্খল। ব্রহ্মচেতনা এই চক্রের মধ্য দিয়েই নিজেকে প্রকাশ করে—অচল নিত্যসত্তা থেকেই প্রকাশিত হয় গতিশীলতা, আর সেই গতি নিজেরই নিয়মে বাঁধা থাকে। চক্র এই স্ব-নিয়ন্ত্রণের প্রতীক, সেই মহাজাগতিক “ধর্মচক্র”, যার দ্বারা মায়ার জগৎও ব্রহ্মের শৃঙ্খলার মধ্যে পরিচালিত হয়।
অন্যদিকে, শঙ্খ বা পাঞ্চজন্য হলো ধ্বনিব্রহ্মের প্রতীক—তার ধ্বনি ‘ওঁ’ সেই আদিস্পন্দন, যেখান থেকে বিশ্বপ্রপঞ্চের প্রথম তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। কেন উপনিষদে বলা হয়েছে—“ব্রহ্মণঃ শব্দঃ”—অর্থাৎ, ধ্বনি-ই ব্রহ্মের প্রথম প্রকাশ। এইভাবে, শঙ্খ নির্দেশ করে সেই “নাদ” বা মহাস্পন্দন, যা নীরব পরব্রহ্ম থেকে জগতের সৃষ্টিকে জাগিয়ে তোলে। জগদ্ধাত্রী এই চক্র ও শঙ্খ একত্রে ধারণ করে বোঝান—তিনি কেবল রক্ষিকা নন, বরং সৃষ্টির অন্তর্নিহিত ছন্দের ধারকাও, যিনি গতি ও স্থিতির ভারসাম্যে বিশ্বকে টিকিয়ে রাখেন। তাঁর মধ্য দিয়েই বিষ্ণু-তত্ত্বের পোষকশক্তি সক্রিয় হয়, কিন্তু সেই পোষণও জ্ঞানের ও সংযমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
তাঁর অন্য দুই হাতে দেখা যায় শিব ও পার্বতী-গুণাবলী—ধনুক ও বাণ, যা যোগিক আত্মসংযম ও কেন্দ্রীভূত জ্ঞানের প্রতীক। ধনুক বোঝায় ইচ্ছাশক্তি বা মায়াশক্তির টান—চেতনা নিজের মধ্যেই নিজেকে জানতে চায়; আর বাণ হলো সেই ইচ্ছার কেন্দ্রীভূত প্রকাশ, যা সত্যের দিকে লক্ষ্য স্থির করে মায়ার পর্দা ভেদ করে যায়। এই ধনুক ও বাণ আসলে মন ও জ্ঞানের দুই রূপ—যেখানে একটির টানে আরেকটি শাণিত হয়ে উঠে আত্মসিদ্ধির পথে। অদ্বৈত ভাষায় বলতে গেলে, ধনুক হলো “ইচ্ছা শক্তি” (icchā śakti) আর বাণ হলো “জ্ঞান শক্তি” (jñāna śakti); এদের মিলনেই মায়া বিদীর্ণ হয় এবং আত্মা নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করে।
জগদ্ধাত্রীর কপালে তৃতীয় নেত্র এই আত্মবোধেরই প্রতীক—এটি সেই জ্ঞানাগ্নি, যা সমস্ত দ্বৈত বিভ্রম দগ্ধ করে ফেলে। যখন চেতনা উপলব্ধি করে যে, দর্শন, দর্শক ও দৃশ্য—এই তিনটি আসলে এক, তখনই ঘটে অদ্বৈত অভিজ্ঞতা। তৃতীয় নেত্র সেই উপলব্ধির আগুন—যেখানে অহংকারের অন্ধকার পুড়ে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে শুধু চেতনার দীপ্তি।
তাঁর বাম কাঁধে আবিষ্ট নাগ নির্দেশ করে কুণ্ডলিনীর জাগরণ—সেই সুপ্ত শক্তি, যা মূলাধার থেকে উঠতে উঠতে সহস্রারে মিলিত হয়, এবং এই যাত্রাই যোগের পরম উদ্দেশ্য। কিন্তু জগদ্ধাত্রী এই শক্তিকে সংযত রাখেন; তিনি কুণ্ডলিনীর প্রখর প্রবাহকে স্থিত বুদ্ধিতে পরিণত করেন, যাতে শক্তি উত্তেজনায় নয়, জ্ঞানে বিকশিত হয়।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে দেখা যায়—বিষ্ণু-গুণাবলী ও শিব-গুণাবলী আসলে দুটি দিক মাত্র এক চেতনার। চক্র ও শঙ্খ যেখানে বহির্জগতের ছন্দ ও নিয়মের প্রতীক—সৃষ্টি ও স্থিতির গতি, সেখানে ধনুক, বাণ, তৃতীয় নেত্র ও নাগ অন্তর্জগতের প্রতীক—সংযম, জাগরণ ও আত্মদর্শনের ধারা। এই দুই দিক মিলেই গঠিত হয় পূর্ণতা; জগদ্ধাত্রী সেই চেতনার রূপ, যেখানে স্থিতি ও গতি, নীরবতা ও শব্দ, রূপ ও আরূপ—সব মিলেমিশে এক হয়।
তিনি অদ্বৈত সত্যের জীবন্ত প্রতিমা, যেখানে ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করে নিজেরই মায়ায়, আবার সেই মায়াকে আলোকিত করে নিজের চেতনার দীপ্তিতে। তাঁর হাতে থাকা প্রতিটি অস্ত্র যেন ঘোষণা করে—বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় কোনো আলাদা শক্তির কাজ নয়; এগুলি এক পরম চেতনার তিন ভিন্ন তরঙ্গ মাত্র। জগদ্ধাত্রী সেই চেতনার দৃশ্যমান প্রতীক—যিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, এই বহুবর্ণ মহাবিশ্বের ভেতরেও এক নীরব, অপরিবর্তনীয় আলো অবিচ্ছিন্নভাবে জ্বলছে—সে-ই ব্রহ্ম, সে-ই তিনি।
অদ্বৈত বেদান্তের আলোকে জগদ্ধাত্রীর রূপ এক গভীর তত্ত্বকে প্রকাশ করে—ঐশ্বরিক শক্তি এক ও অবিভাজ্য, যার বিভিন্ন প্রকাশ মাত্রই আমরা ব্রহ্মার সৃষ্টি, বিষ্ণুর সংরক্ষণ এবং শিবের সংহার বলে চিহ্নিত করি। বাস্তবের স্তরে এই তিনটি কার্য ভিন্ন মনে হলেও, পরম সত্যের স্তরে এগুলি একক চেতনার তিনটি ছন্দমাত্র—যেমন তরঙ্গ, ফেনা ও জল এক সাগরেরই রূপভেদ। জগদ্ধাত্রী সেই এক চেতনার দৃশ্যমান প্রতিমা, যিনি সৃষ্টির, সংরক্ষণের ও লয়ের সমস্ত গতিকে এক ভারসাম্যে স্থাপন করেন। তিনি না শিবের অধীন, না বিষ্ণুর প্রতিরূপ; বরং সেই মূল শক্তি, যিনি তাঁদের কার্যধারাকে সচল রাখেন—যেমন বিদ্যুৎ বাল্ব, পাখা ও হিটার—তিন যন্ত্রে তিনরূপে প্রকাশিত হলেও শক্তি একটিই। জগদ্ধাত্রীই সেই তুরীয়া মহাশক্তি—যিনি জাগ্রত, স্বপ্ন, সুপ্ত—এই তিন অবস্থার সীমা অতিক্রম করেন, মহাজাগতিক স্থিতিতে অবিচলভাবে বিরাজমান থাকেন।
তাঁর দেহবর্ণ ও বস্ত্রও এই দার্শনিক একত্বের ইঙ্গিত দেয়। জগদ্ধাত্রী পরিধান করেন গাঢ় লাল ও সবুজ বস্ত্র। লাল রং প্রকাশ করে সক্রিয় শক্তিকে—রজোগুণের দীপ্তি, যা সৃষ্টির উদ্দীপনা ও কার্যক্ষমতার প্রতীক। আর সবুজ নির্দেশ করে পোষণ ও স্থিতির নীতি—সত্ত্বগুণের পুষ্টি ও ভারসাম্য। এই দুই বিপরীত শক্তির সংমিশ্রণ বোঝায়, তিনি সৃষ্টির উচ্ছ্বাস ও স্থিতির শান্তি—উভয়কেই একীভূত করে রাখেন। ধ্বংস ও সৃষ্টির, তেজ ও মাধুর্যের, কর্ম ও জ্ঞানের মধ্যে যে সুনিপুণ ভারসাম্য মহাজগতকে স্থিতিশীল রাখে, জগদ্ধাত্রী সেই ভারসাম্যের কেন্দ্রবিন্দু।
অদ্বৈত দৃষ্টিতে তাঁর মূর্তি তাই কেবল এক দেবীর চিত্র নয়, বরং ব্রহ্মচেতনার দৃশ্যমান স্থাপত্য—যেখানে রূপের মাধ্যমে আরূপের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁর চার হাত ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণের প্রতীক; তাঁর বাহন সিংহ প্রাণশক্তির প্রতীক, যা চেতনার নির্দেশে সংযত; তাঁর অস্ত্রসমূহ মহাজাগতিক ক্রিয়ার প্রতিরূপ; আর তাঁর মুখের শান্ত দীপ্তি সেই আত্মসাক্ষীর প্রতীক, যিনি কর্মের মাঝেও অচঞ্চল। এইভাবে জগদ্ধাত্রী হয়ে ওঠেন অদ্বৈত সত্যের জীবন্ত প্রতিমা—নির্গুণ ব্রহ্ম যখন নিজেকে সগুণ শক্তি হিসেবে প্রকাশ করে, তখনই তিনি এই রূপে উদ্ভাসিত হন। তাঁর মধ্যে ব্রহ্মের নীরবতা ও জগতের গতি একে অপরের বিপরীত নয়, বরং পরস্পরের প্রতিফলন। তিনি সেই চেতনা, যিনি নিস্তব্ধ জ্ঞানে বিশ্বকে ধারণ করেন, আর সেই ধারণার মধ্যেই বিশ্বচক্র অনন্তকাল ঘুরে চলে—যেন নীরব ব্রহ্মেরই স্পন্দন হয়ে প্রতিটি প্রাণে, প্রতিটি সত্তায় তিনি অনন্তভাবে প্রতিধ্বনিত হন।
খ. বাহন এবং অহংকারের পরাজয়: জগদ্ধাত্রীর প্রতিমার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হল তাঁর বাহনের অনন্য বিন্যাস—এক সিংহ, যে এক হাতির উপর বিজয়ী ভঙ্গিতে আরোহী, আর সেই হাতি চাপা পড়ে আছে তার শক্তির ভারে। এই প্রতিমা এক গভীর অন্তর্নিহিত দর্শনের দৃশ্যরূপ—এক আধ্যাত্মিক নাট্য, যেখানে প্রাণশক্তি, অহং এবং চেতনার সংঘাত এক প্রতীকে মিলিত হয়েছে।
জগদ্ধাত্রী যখন সিংহের পিঠে আসীন, তখন তাঁর এই রূপে প্রকাশিত হয় চেতনার নিয়ন্ত্রিত শক্তি—যে-শক্তি আর বহির্মুখ নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণের দীপ্ত রূপ। বেদান্ত বলে, চেতনা (চিত্) নিজে কোনো কর্মশক্তি নয়; কিন্তু যখন সেই চেতনা মায়া বা প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তাতে উদ্ভূত হয় তিন গুণ—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১৪.৫) কৃষ্ণ বলেন—“সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ প্রকৃতিসম্ভবাঃ। নিবধ্নন্তি মহাবাহো দেহে দেহিনমব্যয়ম্।।” অর্থাৎ, “হে মহাবাহু অর্জুন, সত্ত্ব, রজ ও তম—এই তিনটি গুণ প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন। এই গুণগুলিই দেহের মধ্যে অবস্থিত অব্যয় (অবিনাশী) আত্মাকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে রাখে।” এই তিন গুণই জীবকে দেহ ও মন-এর সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ রাখে।
(সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ) সত্ত্ব, রজ ও তম—এই তিনটি গুণ। এগুলো হলো প্রকৃতির মৌলিক উপাদান, যা জগৎ ও বস্তুর সৃষ্টি করেছে।
(প্রকৃতিসম্ভবাঃ) প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন। এই গুণগুলি আত্মার অংশ নয়, বরং প্রকৃতির (জড় শক্তি) অংশ।
(নিবধ্নন্তি) নিগূঢ়ভাবে বাঁধন দেয় বা বন্ধন সৃষ্টি করে। এই গুণগুলি সুতো বা রশির মতো আত্মাকে বেঁধে রাখে।
(মহাবাহো) হে মহাবাহু (অর্জুন)। অর্জুনকে সম্বোধন করা হয়েছে।
(দেহে দেহিনম্ অব্যয়ম্) দেহের মধ্যে অবস্থিত অব্যয় (অবিনাশী) দেহী (আত্মা)-কে। আত্মা বিনাশহীন ও কর্মমুক্ত হলেও, এই গুণগুলির কারণে সে দেহের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
এই শ্লোকটি বন্ধন-এর কারণ ব্যাখ্যা করে—
বন্ধনকারী: আত্মা নিজে অবিনাশী, শুদ্ধ ও মুক্ত। কিন্তু সত্ত্ব, রজ ও তম—এই তিনটি গুণ হলো সেই অদৃশ্য রশি, যা আত্মাকে দেহ ও মনের সঙ্গে বেঁধে দেয়।