জগদ্ধাত্রী: ২



জগদ্ধাত্রী কেবল এক দেবী নন; তিনি চেতনার স্থায়িত্ব, ধৈর্য ও সাম্যের প্রতিমূর্তি—যিনি পরম অদ্বৈত ব্রহ্মকে প্রপঞ্চের বহুরূপে প্রকাশিত করেন, আবার সেই বহুরূপতাকে অন্তরে পুনরায় ঐক্যে ফিরিয়ে আনেন। তিনি সৃষ্টির স্থায়িত্বের অভিভাবিকা, মহাজগতের ভারসাম্যের নেপথ্য আত্মা, এবং ব্রহ্মের অন্তহীন নীরবতাকে জগতের স্পন্দনে পরিণত করার চিরন্তন শক্তি।

খ. কেনোপনিষদের যোগসূত্র এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা: জগদ্ধাত্রীর দর্শন কেন উপনিষদে উত্থাপিত সেই মৌলিক প্রশ্নের প্রতিধ্বনি, যেখানে মানবচেতনা প্রথম বার নিজের উৎস সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল।

উপনিষদের প্রশ্ন—“কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ?” (১/১)—এর অর্থ, “মন কার দ্বারা প্রেরিত হয়ে চিন্তা করতে শুরু করে? কে সেই শক্তি, যিনি আমাদের ভাবনা, ইচ্ছা ও কর্মকে চালিত করেন?” এটি কেবল মানসিক কৌতূহল নয়; এটি সমগ্র ভারতীয় দর্শনের ভিত্তি—যেখানে অনুসন্ধান করা হয়, চেতনার গতি ও অভিজ্ঞতার অন্তর্নিহিত উৎস কী।

এই প্রশ্নের তাৎপর্য হলো—আমরা সবাই চিন্তা করি, অনুভব করি, কাজ করি, কিন্তু কখনও ভাবি না—আমাদের এই চিন্তার পেছনে, ইচ্ছার পেছনে, কর্মের পেছনে কোন শক্তি কাজ করছে? কে মনকে চিন্তা করতে শেখায়? কে প্রাণকে চালায়? কে চোখকে দেখতে ও কানকে শুনতে সক্ষম করে?

উপনিষদ এই গভীর অনুসন্ধানের শেষে বলে—এই চালিকাশক্তি কোনো ব্যক্তি বা পৃথক দেবতা নন, বরং সেই ব্রহ্মচেতনা, যিনি সব কিছুর মধ্যে বিরাজমান। তিনি ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি—সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তিনি নিজে কিছু করেন না, কিন্তু তাঁর উপস্থিতিতেই সব কিছু ঘটে। তিনি যেমন ক্রিয়ার উৎস, তেমনি ক্রিয়ার ঊর্ধ্বে—একজন সাক্ষীচেতনা বা “সাক্ষীস্বরূপ আত্মা”—যিনি সব দেখেন, কিন্তু কিছুতে জড়িয়ে পড়েন না।

এই ধারণার সঙ্গে জগদ্ধাত্রীর তত্ত্ব গভীরভাবে যুক্ত। জগদ্ধাত্রী সেই শক্তি, যিনি এই পরম চেতনার সক্রিয় প্রকাশ। ব্রহ্ম নিজে যদি নিস্ক্রিয়, শান্ত ও নিরাকার, তবে জগদ্ধাত্রী সেই ব্রহ্মশক্তি, যিনি সেই নিস্ক্রিয় চেতনার মধ্যে গতিশীলতা আনেন—মনকে প্রেরণা দেন, প্রাণকে সঞ্চালিত করেন, ইন্দ্রিয়কে কর্মক্ষম করেন।

এই উপনিষদীয় প্রশ্ন থেকে বোঝা যায়—জগদ্ধাত্রী কেবল দেবী হিসেবে পূজিতা নন, তিনি সেই প্রেরণাশক্তির প্রতীক, যিনি নিস্তব্ধ চেতনার মধ্যে প্রাণ, গতি ও কর্মের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন। তিনি ব্রহ্মচেতনার সেই অংশ, যা নীরব তত্ত্ব থেকে সক্রিয় সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়—অর্থাৎ, তিনি চেতনার গতির প্রথম স্পন্দন, সমস্ত জীবনের অন্তর্নিহিত “ধারক শক্তি।”

এই অন্তর্গত দর্শনই পরবর্তীকালে পৌরাণিক আখ্যানের মাধ্যমে প্রতীকার্থে প্রকাশ পায়। দেবী দুর্গা যখন মহিষাসুর বধের পর দেবতাদের শক্তি ফিরিয়ে দেন, তখন তাঁরা আত্মগর্বে বিভোর হয়ে পড়েন। তাঁদের মনে হয়, এ জয় তাঁদের নিজের পরাক্রমের ফল। সেই আত্মমোহ ও অহংকার ভাঙার জন্যই চেতনা-মাতার লীলা শুরু হয়।

পার্বতী—যিনি তান্ত্রিক ব্যাখ্যায় জগদ্ধাত্রী ও মহাদুর্গার ঐক্যরূপা—এক অলৌকিক পরীক্ষার আয়োজন করেছিলেন দেবতাদের অহংকার ভাঙার জন্য। দেবতারা—অগ্নি, বায়ু, বরুণ প্রভৃতি—দৈব বিজয়ের পর নিজেদের শক্তিতে গর্বিত হয়ে উঠেছিলেন, ভুলে গিয়েছিলেন যে, তাঁদের শক্তির উৎস আসলে অন্যত্র। তখন পার্বতী তাঁদের সামনে একটি ক্ষুদ্র তৃণখণ্ড স্থাপন করেন এবং বলেন, “এই তৃণখণ্ডটি সরাও, অথবা দগ্ধ করো।” অগ্নি জ্বালাতে চেষ্টা করেন, বায়ু উড়িয়ে দিতে চান, বরুণ তা ভিজিয়ে নষ্ট করতে চান—কিন্তু কেউই সফল হন না। দেবতারা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান। তখন তাঁদের উপলব্ধি হয়, তাঁদের তথাকথিত শক্তি আসলে তাঁদের নিজের নয়; তাঁরা কেবল সেই এক পরম শক্তির অংশ, যার উৎস দেবী নিজে।

এই মুহূর্তেই দেবী উমা হৈমবতী-রূপে আবির্ভূত হন—দীপ্ত, শান্ত, জ্ঞানময়। তিনি দেবতাদের জানান, “যে-শক্তি দ্বারা তোমরা কর্ম করো, যে-বুদ্ধি দ্বারা চিন্তা করো, যে-প্রাণ দ্বারা জীবন ধারণ করো—সেই শক্তি আমি।” এই এক বাক্যে প্রকাশ পায় ভারতীয় দর্শনের অন্যতম মৌল সত্য—সব কার্য, চিন্তা ও জীবনই এক পরম চেতনার দ্বারা চালিত; ব্যক্তিগত শক্তি বলে কিছু নেই।

গীতার ৭/১০, ৭/১১ শ্লোকদুটিও একই দর্শনের কথা বলে—”আমিই সকল প্রাণীর মধ্যে জীবন (জীবন ধারণের শক্তি) এবং তেজস্বীদের মধ্যে তেজ। আমিই বুদ্ধিমানদের মধ্যে বুদ্ধি এবং সকল প্রাণীর মধ্যে কাম ও রাগবিহীন বল।” এর মাধ্যমে গীতা এই অদ্বৈতবাদী তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা করে—

আমাদের জীবাত্মা পৃথক মনে হলেও, তার কর্মের ক্ষমতা (শক্তি), চিন্তার ক্ষমতা (বুদ্ধি) এবং বেঁচে থাকার ক্ষমতা (প্রাণ)—সবই পরমাত্মা (ঈশ্বর) থেকে আসা শক্তি মাত্র। ঈশ্বর কোনো দূরবর্তী সত্তা নন; তিনি প্রতিটি জীবের চেতনা, ক্ষমতা ও অস্তিত্বের মূলে নিহিত। একজন ভক্ত বা যোগী যখন উপলব্ধি করেন যে, তাঁর নিজের শক্তি বা জ্ঞান বলে কিছুই নেই, সবই ঈশ্বরের দান বা তাঁরই প্রকাশ, তখনই তিনি অহংকারমুক্ত হন এবং তাঁর সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন।

এটি ঈশ্বরকে আমাদের অস্তিত্বের কেন্দ্র এবং চালিকা শক্তি হিসেবে দেখার এক গভীর উপলব্ধি। এখানেই দেবী তিন রূপে প্রকাশিত হন—পার্বতী, উমা, এবং হৈমবতী—যাঁদের তিনটি নাম, তিনটি স্তরে, একই চেতনার বিভিন্ন মাত্রা প্রকাশ করে।

পার্বতী শব্দের অর্থ “পর্বতের কন্যা”—অর্থাৎ হিমবানের সন্তান। তিনি শক্তির আদিম উৎস, প্রকৃতি নিজেই। তাঁর মধ্যেই নিহিত আছে সৃষ্টির সম্ভাবনা, মাতৃত্ব, এবং জগৎকে ধারণ করার ক্ষমতা। তান্ত্রিক দৃষ্টিতে পার্বতী মানে সেই মহাশক্তি, যিনি কালী, দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী—সব রূপের মধ্যে ঐক্য রচনা করেন। তিনি প্রকৃতির গতিশীল শক্তি, যা সৃষ্টিকে গতি দেয়, কিন্তু বিশৃঙ্খলায় নয়—সমন্বয়ে।

উমা, উপনিষদীয় অর্থে, জ্ঞানের আলোকরূপা। কেন উপনিষদে তিনি সেই শক্তি, যিনি দেবতাদের মূর্খতা ভেঙে সত্যের দিকে নিয়ে যান। তিনি অহংকারের অন্ধকারে জ্ঞানের দীপ্তি জ্বালিয়ে দেন। তাঁর আবির্ভাব মানে চেতনার জাগরণ—যে-মুহূর্তে জানা যায়, “আমি কর্তা নই; আমার মধ্যে যিনি কর্ম করান, তিনিই পরম চেতনা।” তাই উমা জ্ঞানশক্তির প্রতীক, যেখানে শক্তি আর ক্রোধ নয়, বুদ্ধি ও অন্তর্জ্ঞান হয়ে ওঠে।

হৈমবতী, যার অর্থ “হিমবানের কন্যা,” পার্বতীরই এক যোগিক রূপ। “হিম” মানে ঠাণ্ডা, স্বচ্ছ, স্থির—যা চেতনার নির্মলতা ও স্থিতির প্রতীক। তাই “উমা হৈমবতী” মানে সেই দেবী, যিনি শক্তি ও জ্ঞানের ভারসাম্যে প্রতিষ্ঠিত। তিনি তীব্র শক্তি হলেও তা উত্তেজনা নয়; বরং সেই স্থিত, প্রশান্ত দীপ্তি, যার মধ্যে শক্তি জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

এই আখ্যান তাই কেবল এক পৌরাণিক কাহিনি নয়, বরং আত্মসচেতনতার এক দার্শনিক প্রতীক। দেবতারা এখানে মানুষেরই প্রতিরূপ—যে-মানুষ নিজের শক্তি, প্রতিভা বা সাফল্যকে নিজের বলে মনে করে, অথচ উপলব্ধি করে না যে, সেই শক্তির উৎস এক গভীর, সর্বব্যাপী চেতনা। উমা হৈমবতী-রূপে সেই পর্দা সরিয়ে দেন, যা আমাদের অহংকারের কারণে সত্যকে ঢেকে রাখে।

এই উপলব্ধিই হলো এক epistemological awakening—অর্থাৎ জ্ঞানের ভেতরে জ্ঞানের উদয়। যখন জানা যায়, “আমার চিন্তা, বুদ্ধি, প্রাণ, সবই তাঁর দ্বারা চালিত”—তখন অহংকার বিলীন হয়, আর আত্মসচেতনতার আলো জ্বলে ওঠে।

পার্বতী, উমা ও হৈমবতী—তিনটি রূপে এক চিরন্তন সত্য প্রকাশিত হয়। পার্বতী প্রকৃতির সৃজনীশক্তি, উমা জ্ঞানের আলোকশক্তি, হৈমবতী চেতনার স্থিতিশক্তি।

এই তিন মিলে তিনি জগদ্ধাত্রী—বিশ্বের ধারক ও রক্ষিকা, যিনি শক্তিকে জ্ঞানে, গতিকে স্থিতিতে, আর মায়াকে চেতনায় রূপান্তরিত করেন। তাঁর মাধ্যমে মানুষ শেখে—অহংকার নয়, আত্মবোধই প্রকৃত শক্তি; আর চূড়ান্ত জাগরণ আসে তখনই, যখন কর্ম, চিন্তা ও জীবন—সব এক পরম চেতনার সুরে মিলেমিশে যায়।

জগদ্ধাত্রী তাই কেবল অসুরবিনাশিনী নন, বরং জ্ঞানরূপা, সেই বিদ্যার মূর্ত প্রতীক, যা অহংকারের বিলোপ করে সত্যচেতনার জাগরণ ঘটায়। কেনোপনিষদের প্রশ্ন “কে প্রেরক?”-এর উত্তর—জগদ্ধাত্রী নিজেই, কারণ তিনি সেই চেতনা, যিনি প্রাণ, মন, ইন্দ্রিয়, এবং দেবত্বের সমস্ত শক্তির নেপথ্যকারিণী। তাঁর লীলায় শারীরিক যুদ্ধ আত্মিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়; বাহ্যিক শক্তির গৌরব আত্মজিজ্ঞাসার নীরবতায় বিলীন হয়।

কেনোপনিষদের এই উপাখ্যান জগদ্ধাত্রীকে কেবল এক দেবী নয়, বরং এক দার্শনিক সত্যের উন্মোচক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে—যিনি স্মরণ করিয়ে দেন, সমস্ত শক্তি, বুদ্ধি ও জীবনের গতি সেই এক পরম চেতনারই প্রকাশ; আর জ্ঞানের পরম লক্ষ্য হলো এই উপলব্ধি যে, জগৎ ও জ্ঞান, শক্তি ও চেতনা—সবই শেষপর্যন্ত সেই একক ব্রহ্মের স্বরূপ।

গ. তান্ত্রিক সম্পর্ক এবং কাঠামোগত অবস্থান: জগদ্ধাত্রী শাক্ত ঐতিহ্যের বিশাল ধারার মধ্যে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন—তিনি কেবল এক নির্দিষ্ট দেবী নন, বরং তন্ত্র, বেদান্ত ও যোগচেতনার সংমিশ্রণস্থলে এক দার্শনিক প্রতীক। তাঁর মূর্তি, মন্ত্র ও উপাসনা সকলই ইঙ্গিত করে যে, তিনি সেই শক্তি, যিনি “স্থিতি” ও “সচেতনতা”—এই দুই পরস্পরবিরোধী অথচ পরিপূরক নীতিকে একাত্ম করে রাখেন।

তান্ত্রিক দৃষ্টিতে, তিনি সেই মহাশক্তি, যিনি বিশ্বচেতনার ভারসাম্য রক্ষা করেন। কাত্যায়নী তন্ত্রে তাঁকে বলা হয়েছে—“মহাদুর্গা মহাশক্তিঃ জগদ্ধাত্র্যভিধানকাঃ”—অর্থাৎ, মহাশক্তির রূপেই তিনি জগদ্ধাত্রী—জগতের ধারক ও রক্ষিকা। এই বক্তব্যের মধ্যে দুটি দিক স্পষ্ট হয়: প্রথমত, দুর্গা এখানে কেবল অসুরবিনাশিনী নন; তিনি সেই স্থিতিশক্তি, যিনি বিশৃঙ্খলার মাঝেও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয়ত, জগদ্ধাত্রী এই দুর্গাশক্তির রূপান্তর—যেখানে যুদ্ধের চাঞ্চল্য রূপ নিয়েছে চেতনার শান্ত দীপ্তিতে।

বেদান্তের আলোকে, তিনি ব্রহ্মচেতনার সেই প্রকাশ, যা পরিবর্তনের মধ্যে স্থিতি বজায় রাখে। ব্রহ্ম নিজে নিরাকার, অদ্বিতীয় ও নিত্য—কিন্তু যখন তিনি মায়াশক্তির মাধ্যমে রূপ ও গতি ধারণ করেন, তখন “স্থিতি” নামক এক অভ্যন্তরীণ শক্তি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। জগদ্ধাত্রী সেই শক্তিরই প্রতিমূর্তি। তাঁর নামেই তা নিহিত—“জগৎ” মানে চলমান সৃষ্টি, আর “ধাত্রী” মানে ধারণকারিণী। তিনি সেই নীতি, যিনি জগতের বহুবিধ গতিশীল শক্তিকে একত্রে ধারণ করেন, যেন এক বৃহৎ সুরের মধ্যে সমস্ত নোট বা স্বর মিলেমিশে যায়। তাঁর মধ্যে সত্ত্বগুণের প্রতিফলন—শান্তি, স্বচ্ছতা ও জ্ঞান—যা বেদান্তের “সৎ-চিত্-আনন্দ” ধারণার সঙ্গে একাত্ম।

জগদ্ধাত্রীর মধ্যে সত্ত্বগুণের প্রতিফলন মানে তিনি সেই চেতনার প্রতীক, যেখানে শান্তি, স্বচ্ছতা ও জ্ঞান একত্রে অবস্থান করে। দর্শনের ত্রিগুণ তত্ত্ব অনুযায়ী—সৃষ্টির প্রতিটি স্তরে তিনটি মৌলিক প্রবণতা কাজ করে: সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ। রজঃ গতি, আকাঙ্ক্ষা ও ক্রিয়ার শক্তি; তমঃ জড়তা, অন্ধকার ও অবিদ্যার শক্তি; আর সত্ত্ব হলো আলো, জ্ঞান ও ভারসাম্যের শক্তি।

জগদ্ধাত্রী এই তিনের মধ্যে সত্ত্বের রূপ—অর্থাৎ সেই শক্তি, যা সমস্ত গতি ও পরিবর্তনের মাঝেও স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। তাঁর শান্ত মুখাবয়ব, উপবিষ্ট ভঙ্গি ও মৃদু হাসি ইঙ্গিত করে এক প্রশান্ত আত্মবিশ্বাস—যেখানে ক্ষমতা আছে, কিন্তু সেই ক্ষমতা আত্মসংযম ও জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাঁর সিংহবাহিনী রূপও এই ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি প্রবল প্রাণশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন; সেই শক্তি তাঁকে চালায় না, তিনি সেই শক্তিকে চালনা করেন।

এই অবস্থাই বেদান্তে “সৎ-চিত্-আনন্দ” নামে পরিচিত। “সৎ” মানে অস্তিত্ব, “চিত্” মানে চেতনা বা জ্ঞান, আর “আনন্দ” মানে আনন্দ বা পূর্ণতা। অদ্বৈত বেদান্ত বলে—যেখানে সত্যিকার জ্ঞান উদ্‌ভাসিত হয়, সেখানে অস্তিত্ব ও আনন্দ স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রকাশ পায়, কারণ চেতনা নিজেই সুখের ও স্বয়ংসম্পূর্ণ।

জগদ্ধাত্রী সেই অবস্থারই প্রতীক, যেখানে অস্তিত্ব (সৎ) স্থিতিশীল, চেতনা (চিত্) জাগ্রত, এবং আনন্দ (আনন্দ) নিঃশব্দে বিকশিত। তাঁর উপাসনা তাই কোনো বাহ্যিক যুদ্ধ বা আড়ম্বরের নয়; এটি অন্তরের ভারসাম্যের সাধনা, আত্মচেতনার শুদ্ধতার পথ।

অর্থাৎ, জগদ্ধাত্রী সেই শক্তি, যিনি দেখান—চলমান বিশ্বচক্রের মাঝেও যে-শান্তি অটল থাকে, যে-জ্ঞান বিভ্রান্তির ভেতরেও দীপ্তি ছড়ায়, যে-আনন্দ ক্রিয়ার পরিণতিতে নয় বরং চেতনার স্থিতিতেই উদ্‌ভাসিত হয়—সেই চিরন্তন “সৎ-চিত্-আনন্দ”-ই আসল বাস্তবতা। তাঁকে উপলব্ধি করা মানে এই ত্রৈধ সত্যকে নিজের মধ্যেই জাগিয়ে তোলা।