জগদ্ধাত্রী পূজা মূলত কার্ত্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে পালিত হয়, যা সাধারণত নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে পড়ে। এই পূজাকে প্রায়ই “কার্ত্তিকের দুর্গাপূজা” বলা হয়, কারণ এর আচারে দুর্গাপূজার ছায়া স্পষ্ট। যদিও কিছু স্থানে দুর্গাপূজার মতো পাঁচ দিনব্যাপী আয়োজন দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর উপাসনা একত্রিত করে একদিনেই পূজার মূল অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। পূজার আচারে তন্ত্রসিদ্ধ নিয়মাবলি অনুসৃত হয়, এবং এখানে ‘বন্ধন’ আচারটি ব্যতিক্রম হিসেবে বাদ দেওয়া হয়।
দেবী সাধারণত সকালে বা দুপুরে পূজিত হন এবং সন্ধ্যায় বিশেষ আলোকসজ্জার মাঝে আরতি, ভোগ ও ধুনুচি নৃত্যের মাধ্যমে ভক্তরা দেবীর আরাধনা করেন। মন্ত্র, যজ্ঞ ও চণ্ডীপাঠে পরিবেশ আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠে। পূজার সমাপ্তির দিন বা পরের দিন অনুষ্ঠিত হয় বিসর্জন বা ভাসান, যা চন্দননগর ও কৃষ্ণনগর উভয় ক্ষেত্রেই উৎসবের চূড়ান্ত আকর্ষণ।
চন্দননগরে বিসর্জনকে কেন্দ্র করে আয়োজন হয় এক বিশাল আলোকিত শোভাযাত্রার, যেখানে দেবীর প্রতিমাগুলি সযত্নে সাজানো ট্রাক বা প্ল্যাটফর্মে শহর প্রদক্ষিণ করে। এই শোভাযাত্রা তার আলোকচিত্র, নকশা ও থিম্যাটিক দৃশ্যের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। চন্দননগরের একটি বিশেষ প্রথা হলো প্রতিমার ভিত্তিকে (base বা কাঠামোকে) সম্পূর্ণভাবে জলে বিলীন না করে এমনভাবে নিমজ্জিত করা, যাতে পরবর্তী বছরে সেটি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য থাকে—একটি পরিবেশবান্ধব ও সাংস্কৃতিকভাবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কৃষ্ণনগরে, ঐতিহ্যগতভাবে রাজবাড়ির সামনে ‘চোখের মোড়’-এ প্রতিমা আনা হয় এবং পরে তা জলঙ্গী নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়।
জগদ্ধাত্রী পূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি বৃহৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসরের প্রতীক। বিশেষ করে চন্দননগরে এর আলোকসজ্জা শিল্প আজ এক পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার কারিগর, বিদ্যুৎশিল্পী, সেট ডিজাইনার এবং রংকর্মী এই উৎসবের প্রস্তুতিতে মাসের পর মাস কাজ করেন। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতি যেমন সমৃদ্ধ হয়, তেমনই শিল্পকলা, প্রযুক্তি ও নকশার ক্ষেত্রে চন্দননগর একটি স্বতন্ত্র পরিচয় অর্জন করেছে।
আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগদ্ধাত্রী পূজা কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়—এটি ভক্তি, আত্মশুদ্ধি ও সামাজিক ঐক্যের এক গভীর প্রতীক। শাস্ত্রানুসারে, জগদ্ধাত্রী মূলত দুর্গার এক শান্ত, সাত্ত্বিক রূপ, যিনি “স্থিতি” বা ধৃতিশক্তির মূর্ত প্রতীক। তিনি ত্রিগুণের (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) মধ্যে সত্ত্বগুণের প্রতিনিধিত্ব করেন, অর্থাৎ সেই গুণ, যা জ্ঞান, স্থিরতা, স্বচ্ছতা ও সহমর্মিতার প্রকাশ ঘটায়।
তবে লোকবিশ্বাসে দেবীকে প্রায়শই লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কালী—এই তিন শক্তির সম্মিলনরূপে মানা হয়, যা যথাক্রমে ধন, জ্ঞান ও শক্তির প্রতীক। এই ধারণা সরাসরি কোনো বেদান্ত বা পুরাণগ্রন্থে উল্লেখিত না হলেও, এটি বাঙালি শাক্ত ভক্তির এক জনপ্রিয় ব্যাখ্যা—যেখানে জগদ্ধাত্রীকে দেখা হয় ত্রিশক্তির সুষমা, যিনি তিন গুণের ভারসাম্য রক্ষা করে জগৎকে স্থিতি দেন।
তাঁর উপাসনার আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য হলো—অহং, লোভ, ঈর্ষা, ভয় প্রভৃতি তামসিক ও রাজসিক বিকারকে অতিক্রম করে চিত্তে সত্ত্বের স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, তাঁর আরাধনা মানুষকে আত্মসংযম, সহমর্মিতা ও অন্তর্গত শক্তির পথে পরিচালিত করে।
জগদ্ধাত্রী পূজা কেবল দেবীর আরাধনা নয়, বরং এক সাত্ত্বিক সাধনা—যেখানে চেতনা, মন ও সমাজ একত্রে পরিশুদ্ধ ও সংহত হয়। তাঁর শান্ত শুভ্রবর্ণা রূপ স্মরণ করায়—সত্যিকার শক্তি কখনও আক্রমণে নয়, বরং স্থিতিতে নিহিত; এবং প্রকৃত ভক্তি মানে নিজের অন্তরেই সেই ভারসাম্যের আলো খুঁজে পাওয়া।