জগদ্ধাত্রী: ১২



শেষে বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন—“নমামি কমলাম্‌ অমলাং অতুলাম্‌ সুজলাং সুফলাম্‌ মাতরম্‌।”—আমি প্রণাম করি সেই কমলাকে, যিনি অমলা—অকলঙ্ক ও নির্মল, অতুলা—অতুলনীয় ও অতিপবিত্র, সুজলা সুফলা—যিনি পুষ্টি, শান্তি ও প্রাচুর্যের উৎস, সেই জননীকে প্রণাম। এখানে “কমলা” কেবল লক্ষ্মী নন; তিনি প্রকৃতির পোষকশক্তি, জীবনের স্থিতি ও সম্পদের প্রতীক। এই স্তব অংশে মাতৃভূমি হয়ে ওঠেন পবিত্রতা ও প্রাচুর্যের মিলনস্থল—যেখানে ভূমি, জল, বায়ু ও জীবনের প্রতিটি স্রোত মায়ার নয়, বরং দেবীচেতনার প্রকাশ।

এরপর বঙ্কিমচন্দ্র সমাপনী আহ্বান করেন—“বন্দে মাতরম্‌ শ্যামলাং সরলাং সুস্মিতাং ভূষিতাং ধরণীং ভরণীম্‌ মাতরম্‌।” আমি প্রণাম করি সেই শ্যামলা জননীকে, যিনি সরল—প্রকৃতির মতো সহজ, অন্তরঙ্গ ও স্নিগ্ধ, সুস্মিতা—যাঁর মুখে রয়েছে চিরস্থায়ী করুণার হাসি, ভূষিতা—সৃষ্টির অপরূপ অলংকারে শোভিত, যিনি ধরণী ও ভরণী—অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিকে ধারণ ও পোষণ করেন, সেই বিশ্বধারিণী, সেই জগদ্ধাত্রী মাকে প্রণাম।

এই সমাপনী স্তবকে ভারতমাতা রূপান্তরিত হন দেবী জগদ্ধাত্রীর প্রতিচ্ছবিতে। তাঁর শ্যামলতা তমোগুণের গভীর সম্ভাবনা—যেখানে বিশ্রাম ও সৃষ্টির বীজ নিহিত; তাঁর সরলতা সত্ত্বের নির্মলতা—শান্ত, জ্ঞানময় ভারসাম্যের প্রতীক; আর তাঁর সুস্মিতা রজোগুণের প্রেমময় প্রকাশ—যা কর্মে রূপ দেয় মমতাকে। তিনি ধরণী—অস্তিত্বের ভিত্তি, এবং ভরণী—জীবনের পোষকশক্তি।

এভাবে, বন্দে মাতরম্‌ শেষ হয় বিশ্বধারিণী শক্তির বন্দনায়, যেখানে ভারতমাতা কেবল একটি ভূমি নয়, বরং অদ্বৈত ব্রহ্মের স্থিতিশক্তির কাব্যিক প্রতিমূর্তি—জগদ্ধাত্রী স্বরূপা, যিনি ধারণ করেন, পোষণ করেন, ও চেতনার মধ্যেই বিশ্বকে জাগিয়ে রাখেন।

“বন্দে মাতরম্‌” কেবল রাজনৈতিক জাতীয় সংগীত নয়; এটি এক দার্শনিক স্তোত্র, যেখানে দেশপ্রেম আত্মজাগরণের প্রতীক। বঙ্কিমচন্দ্র এখানে জগদ্ধাত্রীকে জাতির আত্মা-রূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন—যিনি জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মকে ঐক্যে বেঁধে জাতিকে আধ্যাত্মিক মুক্তির দিকে চালিত করেন। তাঁর মাতৃরূপ কেবল আরাধনা নয়; এটি আত্মবোধের চূড়ান্ত প্রতীক—যেখানে দেশ, দেবী ও চেতনা একাকার হয়ে যায়। এই গান তাই কালের সীমা ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মহামন্ত্র হিসেবে—“বন্দে মাতরম্‌”—অর্থাৎ, প্রণাম সেই জগদ্ধাত্রীকে, যিনি ধারণ করেন বিশ্বকে, জাগিয়ে তোলেন আত্মাকে, আর স্থিতিশীল করেন চেতনার গগনে।

শৈল্পিক ও দার্শনিক উপস্থাপনা: দৃশ্যশিল্পে জগদ্ধাত্রীর রূপ এক সৌন্দর্য ও অন্তর্নিহিত তত্ত্বের সংমিশ্রণ—তিনি যেমন শৈল্পিক পরিমিতির প্রতীক, তেমনি দার্শনিক ভারসাম্যেরও মূর্ত প্রতিফলন। শিল্পকলায় তাঁকে সাধারণত শুভ্রা, শান্ত এবং অতুলনীয় রূপসী দেবী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এই রূপটি গভীর প্রতীকবাহী: এটি কেবল নান্দনিক আদর্শ নয়, বরং মহাশক্তির সূক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তিক রূপের প্রকাশ—যা শক্তি আর ক্রোধ নয়, বরং স্থিতি, জ্ঞান ও সংযমের মিলনে চূড়ান্ত রূপ নেয়।

এক প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়েছে—শিব একদিন কালীর শ্যামবর্ণ রূপ নিয়ে মৃদু কৌতুক করেন, তখন দেবী নিজের অপরিমিত শক্তির তেজ প্রশমিত করে, রূপান্তরিত হন এক শান্ত, উজ্জ্বল ও শুভ্রা রূপে—যা পরে “জগদ্ধাত্রী” নামে পরিচিত হয়। এই কাহিনি আসলে শক্তির অন্তর্মুখী রূপান্তরের প্রতীক—যেখানে কালী হলেন শক্তির বাহ্য বিস্ফোরণ, আর জগদ্ধাত্রী সেই শক্তির অন্তর্গত নিয়ন্ত্রণ। শক্তি এখানে ধ্বংসাত্মক নয়; বরং ধারণশীল—যিনি সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত তেজে স্থিত রাখেন।

এই আখ্যানের প্রতীকী অর্থ গভীর: কালী যদি শক্তির অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ হন—অসীম, উগ্র, অপ্রতিরোধ্য—তবে জগদ্ধাত্রী সেই শক্তির অন্তর্মুখ বুদ্ধি, সেই জ্ঞান, যা শক্তিকে আত্মসংযমে পরিণত করে। তাঁর শ্বেতবর্ণ তাই illumined consciousness বা আলোকিত চেতনার প্রতীক, যা অন্ধকার শক্তিকে অন্তর্গত সুষমায় রূপান্তরিত করে।

তাঁর কাঁধে ঝুলন্ত সাপের মালা এবং কপালে দীপ্ত তৃতীয় নেত্র ইঙ্গিত করে এক যোগিক ঐক্য—শক্তি ও চেতনার, নারী ও পুরুষ নীতির। সাপ এখানে কুণ্ডলিনীর প্রতীক, যা নীচ থেকে উপরে উত্থিত হয়ে চেতনার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছায়; তৃতীয় নেত্র শিবচেতনার প্রতীক, যার মধ্যে জ্ঞান ও দৃষ্টির পরম একতা বিদ্যমান। এই দুই প্রতীকের সমন্বয় দেখায়—জগদ্ধাত্রীর শক্তি ধ্বংসাত্মক নয়, বরং রূপান্তরকারী; তিনি কেবল শক্তিধারিণী নন, তিনি যোগিনী—যিনি শক্তিকে ধ্যান ও জ্ঞানের সুষম ভারসাম্যে স্থাপন করেন।

জগদ্ধাত্রী দেবীর শৈল্পিক ও দার্শনিক উপস্থাপনা এমন এক গভীর রূপতত্ত্ব, যেখানে শিল্প, প্রতীক, দর্শন ও আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাঁর প্রতিমা কেবল এক দেবীচিত্র নয়—এটি মহাশক্তির অন্তর্মুখ ধ্যানরূপ, যেখানে শক্তি আত্মসংযমে পরিণত হয়, জ্ঞান শান্তিতে রূপান্তরিত হয়, আর সৌন্দর্য চেতনার গভীর নীরবতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

দৃশ্যশিল্পে জগদ্ধাত্রীকে সাধারণত শুভ্রবর্ণা, শান্ত, সুসজ্জিত ও সুষম দেবী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। তাঁর মুখমণ্ডলে যেমন মাধুর্য ও স্থিরতা, তেমনি এক অপরিমেয় বুদ্ধিবৃত্তিক দীপ্তি—যা তন্ত্রদর্শনের “সত্ত্বগুণ”-এর প্রকাশ। তাঁর শুভ্র রং কেবল নান্দনিক নয়; এটি আলোকিত চেতনার প্রতীক—illumined consciousness—যেখানে রজঃ-তমঃ গুণ মিশে গিয়ে সত্ত্বে রূপ নেয়। তান্ত্রিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, জগদ্ধাত্রী “ধারয়িত্রী”—অর্থাৎ যিনি ধারণ করেন, সংযত করেন এবং রক্ষা করেন।

এই রূপের প্রতিটি উপাদানই গভীর দার্শনিক প্রতীক বহন করে। তাঁর কাঁধে সাপের মালা—যা কুণ্ডলিনী বা প্রাণশক্তির প্রতীক, যা নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়ে চেতনার সর্বোচ্চ বিন্দুতে মিলিত হয়। তাঁর কপালে তৃতীয় নেত্র—শিবচেতনার প্রতীক, যেখানে জ্ঞান ও দৃষ্টির ঐক্য ঘটে। সাপ ও তৃতীয় নেত্রের এই সমন্বয়ই যোগদর্শনের মূল—শক্তি ও চেতনার মিলন, যা পরম আত্মসচেতনতার রূপ।

তাঁর বাহন সিংহ প্রতীক বীর্য, সাহস ও ধৃতির—নিয়ন্ত্রিত শক্তির প্রতীক, যা রজঃ ও তমঃ-এর অতিরিক্ততা দমন করে সত্ত্বের স্থিতি প্রতিষ্ঠা করে। সিংহের নিচে পদদলিত হাতি—যাকে বলা হয় “করীন্দ্রাসুর”—অহংকার ও অবিদ্যার প্রতীক, যা দেবীর ধৃতিতেজে পরাজিত হয়েছে। এই দৃশ্য আসলে মানুষের অন্তর্গত সংগ্রামের প্রতীক—যেখানে অহং ও অজ্ঞান চেতনার জ্ঞানে দমন হয়, রূপান্তরিত হয় শান্তিতে।

জগদ্ধাত্রীর হাতে ধারণকৃত অস্ত্রগুলিও তত্ত্ববাহী—চক্র, শঙ্খ, ধনুক ও বাণ। চক্র (সুদর্শন) নির্দেশ করে সময় ও ধর্মচক্রের নিয়ম; এটি বিশ্বচেতনার আবর্তন—যা সৃষ্টিকে ধারাবাহিক রাখে। শঙ্খ আদিধ্বনি—“ওঁ”-এর প্রতীক, যেখান থেকে বিশ্বপ্রপঞ্চের প্রথম স্পন্দন উৎপন্ন হয়। ধনুক ও বাণ ইচ্ছাশক্তি ও মনোনিবেশের প্রতীক; ধনুকে টান মানে আত্মসংযম, আর বাণ মানে কেন্দ্রীভূত জ্ঞান—যা মায়ার আবরণ বিদীর্ণ করে সত্যকে প্রকাশ করে।

তাঁর প্রতিমায় ব্যবহৃত রংগুলিও প্রতীকী অর্থ বহন করে। লাল—শক্তির দীপ্তি, সবুজ—প্রাণশক্তির পুষ্টি, আর সোনালী—আধ্যাত্মিক উজ্জ্বলতা। এই তিনের মিলনে সৃষ্টি হয় এক সৌন্দর্যবোধ, যা নান্দনিক ও দার্শনিক উভয়ই। শিল্পী এখানে কেবল দেবীকে আঁকেননি; তিনি চেতনার স্থাপত্য নির্মাণ করেছেন—যেখানে প্রতিটি রেখা ও বর্ণ তত্ত্বের প্রকাশ।

কালী-দুর্গা-জগদ্ধাত্রী”, এই ত্রিরূপ দেবীর মধ্যে শক্তির তিনটি ধাপ বা তিনটি দিককে বোঝানো হয়েছে—প্রবৃত্তি, ক্রিয়া, এবং স্থিতি।

প্রথমত, কালী শক্তির কৃত্য বা প্রবৃত্তি। তিনি সেই আদিশক্তি, যিনি নিস্তরঙ্গ শিবচেতনা থেকে প্রথমে গতি সৃষ্টি করেন। তাঁর রূপ হলো চূড়ান্ত গতিশীলতা—অপ্রতিরোধ্য, অসংযত, সৃজন ও ধ্বংসের মিলিত বিস্ফোরণ। তিনি সময়, কাল ও প্রলয়ের প্রতীক। এই স্তরে শক্তি সর্বাধিক তেজময় ও বাহিরমুখী—“চলমান সত্তা”।

দ্বিতীয়ত, দুর্গা শক্তির ক্রিয়া বা সংরক্ষণ। তিনি সেই মধ্যম স্তরের শক্তি, যিনি এই প্রবৃত্তিকে সংগঠিত করে, সৃষ্টিকে ধারাবাহিক রাখেন। দুর্গা তেজকে দমন করেন না, বরং তাকে নৈতিক ও ধর্মনির্ভর পথে পরিচালিত করেন। তাঁর রূপ তাই কর্মশীল কিন্তু নিয়ন্ত্রিত—তিনি সংহারের নয়, রক্ষার দেবী। তাঁর ক্রিয়া মানে সমতা ও রক্ষা—বিশ্বের চলমান ভারসাম্য বজায় রাখা।

তৃতীয়ত, জগদ্ধাত্রী শক্তির স্থিতি—জ্ঞান, বুদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ। এখানে শক্তি আর বাহিরমুখ নয়, অন্তর্মুখ। এটি সেই স্তর, যেখানে শক্তি নিজেরই উৎসে ফিরে এসে নিজেকে ধারণ করে।

কালী যেমন বিস্ফোরিত আগুন, দুর্গা সেই আগুনের দ্যুতি, আর জগদ্ধাত্রী সেই আগুনের অন্তর্নিহিত উষ্ণতা—শান্ত, স্থির, কিন্তু জীবনধারী। তিনি শক্তির সেই বুদ্ধিবৃত্তিক রূপ, যিনি জানেন কখন, কোথায়, কতটা শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এই স্থিতি-শক্তি আসলে চেতনার অন্তঃস্থ স্থপতি—যিনি সমস্ত শক্তিকে সুষম ভারসাম্যে স্থাপন করেন, যাতে জগতের গতি ও স্থিতি উভয়ই অক্ষুণ্ণ থাকে।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে এটি ব্রহ্মচেতনার ত্রিগুণ রূপ—সৃষ্টি (ব্রহ্মা), স্থিতি (বিষ্ণু), সংহার (শিব)—যা শক্তির ত্রিবিধ প্রকাশ। জগদ্ধাত্রী এখানে সেই ত্রিগুণের মধ্যস্থ বিন্দু, “তুরীয়া শক্তি”—যিনি সব গতি ও কর্মের কেন্দ্রে অচল জ্ঞানের আসনে সাক্ষীরূপে অবস্থান করেন। তাঁর স্থিতি মানে স্থবিরতা নয়, বরং এক অন্তর্গত সুষমা—যেখানে শক্তি ও চেতনা, কর্ম ও ধ্যান, বাহির ও অন্তর—সব এক সাম্যের অক্ষের চারপাশে নৃত্য করে।

শক্তি কেবল গতি নয়, নিয়ন্ত্রণও শক্তি; জ্ঞান কেবল ধ্যান নয়, তা স্থিতিরও উৎস। জগদ্ধাত্রী সেই চূড়ান্ত উপলব্ধি—যেখানে কর্ম শান্তিতে, আর শান্তি কর্মে রূপান্তরিত হয়।

চিত্রকলায়ও তাঁর উপস্থিতি এই ভারসাম্যের ইঙ্গিত দেয়। তাঁর চোখে নেই রাগ বা উন্মাদনা, আছে এক গভীর সংযত প্রেম—যা মাতৃত্বের রূপে ধরা দেয়। তাঁর শ্বেত আভা যেন অন্তরচৈতন্যের প্রতীক; তাঁর সিংহ যেন নৈতিক সাহস; আর পদতলে হাতি যেন দমন-করা অহংকার।

এভাবে জগদ্ধাত্রীর শৈল্পিক রূপ কেবল দর্শন নয়, মনোবিজ্ঞানেরও প্রতিফলন—অজ্ঞান থেকে জ্ঞানে, বিশৃঙ্খলা থেকে সুষমায়, প্রবৃত্তি থেকে সংযমে উত্তরণের প্রতীক। তাঁর রূপের মধ্যে যে নীরব সৌন্দর্য, তা আসলে সেই চেতনারই দৃশ্যমান প্রকাশ, যা শক্তিকে শান্তিতে, কর্মকে ধ্যানে, আর জীবনকে ব্রহ্মে রূপান্তরিত করে।

জগদ্ধাত্রী দেবী শিল্পে যেমন সৌন্দর্যের প্রতিমা, দর্শনে তেমনি চেতনার স্থিতিশক্তির মূর্তি। তাঁর মূর্তিতে মিলিত হয়েছে কালী-র অগ্নি ও দুর্গা-র করুণা, যোগ-এর স্থিতি ও তন্ত্র-এর অন্তর্গত শৃঙ্খলা। তিনি কেবল শক্তিধারিণী নন; তিনি সেই বিশ্বধারিণী—যিনি ধারণ করেন আলো ও অন্ধকার উভয়কেই, আর সেই ধারণার মধ্যেই প্রতিষ্ঠা করেন চিরন্তন শান্তি ও সুষমা।

তাঁর সৌন্দর্য কোনো বাহ্য অলঙ্কার নয়, বরং চেতনার পরিশুদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। কালীর অগ্নিময় তেজ যেখানে অপ্রতিরোধ্য প্রবলতায় মুগ্ধ করে, জগদ্ধাত্রীর উজ্জ্বল প্রশান্তি সেখানে নিয়ন্ত্রিত আলো—যা দীপ্ত কিন্তু চোখ ঝলসে দিয়ে অন্ধ করে দেয় না। এ এক নান্দনিক দার্শনিকতা, যেখানে শক্তি ও বুদ্ধি, গতি ও স্থিতি, নারী ও পুরুষ নীতি পরস্পর-সম্পৃক্ত।

জগদ্ধাত্রীর এই তত্ত্ব আসলে শক্তির এক গভীর পরিণতি—যেখানে শক্তি আর কেবল প্রকৃতির অন্ধ গতি নয়, বরং আত্মবোধসম্পন্ন, জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক চেতনা-রূপ। শাক্ত দর্শনের প্রথম স্তরে শক্তি সাধারণত প্রাকৃত বা “প্রবৃত্তি”—যা সৃষ্টির মৌলিক গতি হিসেবে প্রকাশিত। কিন্তু জগদ্ধাত্রী সেই শক্তির উচ্চতর স্তর—যেখানে প্রাকৃত শক্তি আত্মসচেতনে রূপান্তরিত হয়েছে। এই উপলব্ধি-ই তান্ত্রিক ও বেদান্তীয় ভাবনার একত্রীকরণ—যেখানে শক্তি আর পৃথক কোনো জড় বল নয়, বরং চেতনারই গতিশীল প্রকাশ।

তন্ত্রে বলা হয়েছে—“শক্তিহি শিবরূপা চ, শিবশক্তিস্বরূপকঃ। শক্তিবিনাঽপ্যসৌ শম্ভু, শবত্বং প্রতিপন্নতে।” (মালিনীবিজয় তন্ত্র, ২.২৩-২৭)। এর অর্থ—শক্তিই শিবরূপা, আর শিবও শক্তিস্বরূপ; কিন্তু শক্তি ছাড়া শিব নিষ্ক্রিয়, জড় বা “শব”। এই সূত্রেই উঠে আসে সেই বিখ্যাত বচন—“শক্তি বিনা শিব শবঃ।” অর্থাৎ চেতনা বা শিবের অস্তিত্ব তখনই অর্থপূর্ণ, যখন তা শক্তির দ্বারা প্রকাশিত।