এই মূর্তি তাই কেবল ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর আনন্দমঠ-এ জগদ্ধাত্রী, কালী ও দুর্গা—এই তিন দেবীর রূপে ভারতমাতার তিন কাল ও তিন স্তরের প্রতীক নির্মাণ করেছেন। এটি কোনো কেবল পুরাণচিত্র নয়, বরং এক জাতীয় আত্মচেতনার দার্শনিক কাঠামো—যেখানে ইতিহাস, ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ পরস্পর মিশে গেছে এক চেতনা-স্রোতে।
প্রথমত, জগদ্ধাত্রী ভারতের গৌরবময় অতীতের প্রতীক। তাঁর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে সত্ত্বগুণ—জ্ঞান, ধৃতি ও শান্তির শক্তি। এই রূপে ভারত এক স্থিতধী সভ্যতার প্রতিরূপ, যেখানে ধর্ম, জ্ঞান ও নৈতিকতার সাম্য বজায় ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের বিচারে জগদ্ধাত্রী সেই “স্থিতিশক্তি”—যিনি জাতির সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক ঐক্যের ধারক। তিনি ভারতের “ধারণাশক্তি”, যিনি যুগে যুগে জাতিকে পতন থেকে রক্ষা করেছেন এবং আধ্যাত্মিক স্থিতির প্রতীক হয়ে থেকেছেন।
দ্বিতীয়ত, কালী প্রতিনিধিত্ব করেন বর্তমানের অন্ধকার যুগকে—এক বিশৃঙ্খল, বিভক্ত ও নিপীড়িত সমাজের প্রতীক, যেখানে তমোগুণের আধিপত্য স্পষ্ট। এই কালী রূপ ধ্বংসের নয়, বরং আত্মবিস্মৃত জাতির বাস্তব প্রতিচ্ছবি—যেখানে শক্তি সুপ্ত, জ্ঞান অবরুদ্ধ এবং চেতনা মায়ায় আচ্ছন্ন। বঙ্কিমের কালী সেই নিস্তব্ধ শক্তি, যা তমোগুণের গভীর থেকে জাতিকে জাগিয়ে তুলবে, যাতে রজোগুণের জাগরণ ঘটতে পারে।
তৃতীয়ত, দুর্গা ভবিষ্যতের প্রতীক—যেখানে রজোগুণের দীপ্তিতে জাতির পুনর্জন্ম ঘটবে। তিনি কর্ম, সংগ্রাম ও শক্তির মূর্তি—জাতীয় জাগরণের প্রতীক। দুর্গার মধ্যে রজোগুণ জাতিকে সক্রিয় করে তোলে, আত্মনির্ভরতার বীজ রোপণ করে, এবং শেষপর্যন্ত তাকে সাত্ত্বিক স্থিতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়—যেখানে জগদ্ধাত্রীর ধৃতি, শান্তি ও জ্ঞান পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই ত্রিগুণ কাঠামো—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে কেবল ধর্মীয় তত্ত্ব নয়; এটি ইতিহাসের চক্রাকার ছন্দের প্রতীক। তাঁর দৃষ্টিতে, ইতিহাস এক মহাজাগতিক গতি—যেখানে পতন ও জাগরণ, অন্ধকার ও আলো, তমঃ ও সত্ত্ব পরস্পর পরিপূরক। তিনি দেখিয়েছিলেন, জাতির জীবনচক্রও এই ত্রিগুণ গতি দ্বারা নির্ধারিত—কালী জাতিকে আত্মস্মরণ করান, দুর্গা তাকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন, আর জগদ্ধাত্রী স্থিতি ও জ্ঞানের দ্বারা জাতিকে পূর্ণতার পথে ফিরিয়ে দেন।
এভাবে বঙ্কিমচন্দ্র ধর্মতত্ত্বকে রূপ দিয়েছেন রাষ্ট্রতত্ত্বে, আধ্যাত্মিকতাকে রূপ দিয়েছেন জাতীয় চেতনার ভিত্তিতে। তাঁর দৃষ্টিতে জগদ্ধাত্রী ভারতের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি, কালী তার বিপর্যস্ত বর্তমান, আর দুর্গা তার পুনর্জাগরণের প্রতীক। আনন্দমঠ-এর জগদ্ধাত্রী তাই কোনো পৌরাণিক দেবী নন, বরং ভারতের আত্মার প্রতিচ্ছবি—এক “ধাত্রী”, যিনি জাতির সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ধারক।
বঙ্কিমচন্দ্র এই ত্রিগুণ রূপের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক আধ্যাত্মিক জাতীয়তাবাদ—যেখানে স্বাধীনতা মানে কেবল রাজনৈতিক মুক্তি নয়, বরং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ। তাঁর রচিত বন্দে মাতরম্—যা প্রথম প্রকাশিত হয় আনন্দমঠ-এ—আসলে জগদ্ধাত্রীরই আহ্বান। গানটি ভারতের মাতৃরূপ চেতনার এক ব্রহ্মার্পণ—এক প্রার্থনা, যেখানে মাতৃভূমি দেবীচেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে, আর মুক্তি মানে চেতনার জাগরণ।
এইভাবে আনন্দমঠ-এর জগদ্ধাত্রী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাত্ত্বিক মূর্তি। তাঁর মধ্যে মিলিত হয়েছে উপনিষদের জ্ঞান, তন্ত্রের শক্তি এবং মানবমুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তিনি সেই চিরন্তন মাতৃচেতনা, যিনি ব্রহ্মরূপে ধারণ করেন জীবন ও জাতিকে এক অখণ্ড ঐক্যে। এই রূপে বঙ্কিমচন্দ্র ভারতমাতাকে কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতীক নয়, বরং এক মহাজাগতিক চেতনার রূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন—যেখানে ধর্ম, দর্শন ও জাতীয়তা একত্রে মিলিত হয়ে ভারতের আত্মার মহাকাব্য রচনা করেছে।
বন্দে মাতরম্: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ-এর “বন্দে মাতরম্” কেবল একটি দেশপ্রেমমূলক স্তব নয়, বরং এক গভীর আধ্যাত্মিক রচনা, যেখানে ভারতমাতা হয়ে ওঠেন দেবী জগদ্ধাত্রীরই প্রতীক—চেতনার স্থিতিশক্তি, তন্ত্র ও বেদান্তের সংহত রূপ। এই স্তবের প্রতিটি পঙ্ক্তি একদিকে ভারতের প্রকৃতিকে মহিমাময় করে তোলে, অন্যদিকে দেবীচেতনার দার্শনিক রূপককে উন্মোচন করে। গানটির ধ্বনিতরঙ্গ যেন এক আধ্যাত্মিক মন্ত্রোচ্চারণ, যা আত্মা ও দেশ, প্রকৃতি ও ব্রহ্ম, মানব ও দেবীর মধ্যেকার গভীর ঐক্যকে স্পষ্ট করে।
প্রথম আহ্বান—“বন্দে মাতরম্”—আমি বন্দনা করি সেই মাতাকে; আমি প্রণাম জানাই জননীকে। (অর্থাৎ, যিনি এই দেশ, এই জীবন, এই চেতনার ধারিণী—তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করছি।) এর মধ্যে লুকিয়ে আছে আত্মসমর্পণ ও ব্রহ্মার্পণের তত্ত্ব। “বন্দে” মানে কেবল প্রণাম নয়, এটি আত্মাকে উৎসর্গ করার আহ্বান; আর "মাতরম্" শব্দটি মাতৃ (mātṛ) থেকে এসেছে, যার অর্থ "মা", যিনি “ধাত্রী” বা “ধারিণী”—যিনি জগৎকে ধারণ করেন, পালন করেন, স্থিতি দেন। এখানে ভারত কেবল ভূখণ্ড নয়; তিনি সেই চিরন্তন চেতনা, যিনি ব্রহ্মের প্রকাশরূপ। এই প্রণাম তাই জাতির মাটিকে নয়, বরং তার অন্তর্গত চৈতন্যশক্তিকে নিবেদিত—যিনি জগদ্ধাত্রী, বিশ্বধারিণী শক্তি।
পরবর্তী স্তবক—“সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং শস্যশ্যামলাং মাতরম্”—যিনি সুজল (পরিপূর্ণ জলে সঞ্জীবিত), সুফল (ফল-ফুলে পুষ্ট), মলয়বায়ুর মতো শীতল ও প্রশান্ত, আর যিনি শস্যশ্যামলা—অর্থাৎ ধানের সবুজে ভরা উর্বর ভূমি—সেই মাতাকে আমি প্রণাম জানাই। (অর্থাৎ, এই ভূমি মা—যিনি পুষ্টি, প্রশান্তি ও জীবনের ভারসাম্য দান করেন।) এখানে প্রকাশ পায় দেবীর সত্ত্বগুণময় দিক। এখানে জল, ফল, সুবাস ও শস্য—সবই জীবন, পুষ্টি ও শান্তির প্রতীক। তান্ত্রিক ব্যাখ্যায়, জল চেতনার প্রবাহ, ফল কর্মফলের ঐশ্বর্য, শ্যামলা ভূমি প্রকৃতির গর্ভশক্তি। এই চিত্রায়ণ জগদ্ধাত্রীর ধারণশক্তির রূপ—তিনি জীবনকে কেবল রক্ষা করেন না, বরং তার মধ্যে সুষম বৃদ্ধি ঘটান। এই স্তবকে তিনি মহামায়া নন, বরং “স্থিতিশক্তি”—যিনি অরাজকতা নয়, ভারসাম্য রক্ষা করেন।
বঙ্কিম লেখেন—“শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনীম্ ফুল্ল-কুসুমিত-দ্রুমদল-শোভিনীম্”—যিনি শুভ্র চাঁদের আলোয় স্নাত রজনীর মতো মনোহর, যাঁর বুকে ফুলে-ফলে ভরা বৃক্ষরাজি শোভিত, যিনি প্রকৃতির আনন্দ ও প্রস্ফুটনের রূপ—সেই মাতাকে আমি প্রণাম জানাই। (অর্থাৎ, তিনি চেতনার সৌন্দর্য ও সৃজনশীলতার প্রতিমা।) এখানে তিনি দেবীর চিদানন্দরূপ (যিনি চিত্ (শুদ্ধ চেতনা) ও আনন্দ (নির্বিকার পরমানন্দ)-এর অবিচ্ছিন্ন একত্বস্বরূপ; অর্থাৎ জ্ঞান ও সুখের ঐক্যময় সত্তা) প্রকাশ করছেন। শুভ্র চাঁদের আলো তাঁর করুণার প্রতীক, পুলকিত রাত্রি মানে অন্তর্জগতের আনন্দোদ্দীপনা, আর কুসুমিত বৃক্ষরাজি প্রতীক জীবনের বিকাশ। দেবী এখানে কেবল মাতৃপ্রকৃতি নন; তিনি ব্রহ্মচেতনার আনন্দস্পন্দন, যাঁর মধ্যে জ্ঞান, করুণা ও সৌন্দর্য একত্রে বিকশিত।
এই দেবী আবার “সুহাসিনীম্ সুমধুরভাষিণীম্ সুখদাং বরদাং মাতরম্”—যিনি সুহাসিনী—যাঁর মুখে সর্বদা স্নেহময় হাসি, যিনি সুমধুর ভাষিণী—যাঁর বাক্য শান্তি ও মাধুর্যে ভরা, যিনি সুখদা—সকল প্রাণীর কল্যাণদায়িনী, আর যিনি বরদা—করুণা ও জ্ঞানের বরদাত্রী, সেই মাতাকে আমি প্রণাম জানাই। (অর্থাৎ, তিনি করুণা, স্নেহ ও জ্ঞানের মূর্তি—জগদ্ধাত্রী স্বরূপা মা।) এই রূপে মাতৃস্নেহের প্রতিমা। তিনি সুহাসিনী—যাঁর মুখের হাসিতে শান্তি; তিনি সুমধুর ভাষিণী—যাঁর বাক্ই মন্ত্র, শব্দব্রহ্ম; তিনি সুখদা—যিনি দুঃখ নাশ করেন; আর বরদা—যিনি জ্ঞান ও স্থিতির বর দেন। বঙ্কিমচন্দ্র এই রূপে জগদ্ধাত্রীকে কেবল নিয়ন্ত্রণশক্তি নয়, বরং করুণাশক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন। এখানে শক্তি মানে ধ্বংস নয়; বরং সংযত করুণা—মায়ার শুদ্ধ রূপ, যা আবৃত করে, আবার মুক্তিও দেয়।
এরপর আসে এক তীব্র প্রশ্ন: “সপ্তকোটিকণ্ঠকলকলনিনাদকরালে, দ্বিসপ্তকোটীভুজৈর্ধৃতখর-করবালে, অবলা কেন মা এত বলে।”—কোটি কোটি কণ্ঠে তোমার নামের কলরব ধ্বনিত হচ্ছে, চৌদ্দ কোটি বাহু তোমার সেবায় কর্মে নিযুক্ত, তবু কেন তোমায় “অবলা” বলা হয়, হে জননী? (অর্থাৎ, মাতৃশক্তি অসীম—তাঁকে দুর্বল ভাবা অজ্ঞানতার চিহ্ন।) এই প্রশ্নে জাতির আর্তনাদ শোনা যায়—যে-মায়ের কোটি কোটি সন্তান তাঁর নাম জপ করছে, কোটি কোটি বাহু তাঁর সেবায় নিয়োজিত, তাঁকে কেন “অবলা” বলা হবে? এই “অবলা” শব্দে নিহিত আছে জগদ্ধাত্রীর আত্মনিয়ন্ত্রিত শক্তির ব্যাখ্যা। তিনি প্রবল, কিন্তু অন্তর্মুখ; তাঁর বল প্রকাশে নয়, সংযমে। তিনি সেই স্থিতিশক্তি, যিনি ক্রিয়াকে পরিচালনা করেন, কিন্তু নিজে অচঞ্চল। এইভাবে দেবী হয়ে ওঠেন সেই জাতীয় আত্মা, যিনি শক্তির উৎস, অথচ শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত। (তাঁর সময়ে ভারতের আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ কোটির কাছাকাছি; তার মধ্যে সক্রিয়, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে তিনি রূপকভাবে “চৌদ্দ কোটি বাহু” হিসেবে কল্পনা করেছেন—যেন মাতৃভূমির জন্য কর্মরত অসংখ্য সন্তানের সম্মিলিত শক্তি।)
পরবর্তী স্তব—“বহুবলধারিণীং নমামি তারিণীং রিপুদলবারিণীং মাতরম্”—আমি প্রণাম করি সেই মাতাকে, যিনি বহুবলধারিণী—অসীম শক্তির অধিকারিণী, যিনি তারিণী—দুঃখ ও বন্ধন থেকে উদ্ধারের কর্তা, যিনি রিপুদলবারিণী—অহং ও অজ্ঞানরূপ শত্রুদের দমনকারিণী। (অর্থাৎ, তিনি মুক্তি ও আত্মসংযমের দেবী।) এটি জগদ্ধাত্রীর ত্রিক্রিয়াশক্তিকে প্রকাশ করে। তিনি বহুবলধারিণী—অর্থাৎ শক্তির আধার; তারিণী—যিনি সংসারদুঃখ থেকে উদ্ধার করেন; রিপুদলবারিণী—যিনি অহং, অজ্ঞান ও লালসার শত্রুকে দমন করেন। তান্ত্রিক অর্থে, তিনি “ত্রিক্রিয়াময়ী শক্তি”—সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার—এই তিন কর্মে সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে জগদ্ধাত্রী দুর্গা ও কালী উভয়ের সমন্বয়রূপে আবির্ভূতা—নিয়ন্ত্রিত সংহারশক্তি, যা ধ্বংস নয়, রূপান্তর।
যখন বঙ্কিম লেখেন—“তুমি বিদ্যা তুমি ধর্ম্ম তুমি হৃদি তুমি মর্ম্ম, ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে”—”তুমি বিদ্যা—জ্ঞানরূপা, তুমি ধর্ম—নীতির প্রতিমূর্তি, তুমি হৃদয়—প্রেম ও সহানুভূতির কেন্দ্র, তুমি মর্ম—অস্তিত্বের অন্তর্গত সত্য, তুমি প্রাণ—জীবনের উৎস ও শক্তি। (অর্থাৎ, সমগ্র জীবনই তোমার চেতনার প্রকাশ।)”, তখন দেবী পরিণত হন অন্তর্গত চেতনার প্রতিমূর্তিতে। তিনি বিদ্যা—জ্ঞান; ধর্ম—নীতি; হৃদি—ভক্তি; মর্ম—অন্তর্গত সত্য; এবং প্রাণ—জীবনশক্তি। এইভাবে তিনি কেবল বহির্জগতের দেবী নন, বরং অন্তরাত্মার সত্তা, যিনি জ্ঞান, কর্ম ও প্রেমকে এক স্রোতে যুক্ত করেন।
এর পরের পঙ্ক্তি—“বাহুতে তুমি মা শক্তি, হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি, তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে”—বাহুতে তুমি শক্তি—কর্ম ও সাহসের উৎস, হৃদয়ে তুমি ভক্তি—নিবেদন ও প্রেমের মূর্তি, তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে—অর্থাৎ, বাইরের উপাসনা বস্তুত তোমার অন্তর্গত চেতনার প্রতিফলন। (অর্থাৎ, জগদ্ধাত্রী রূপে তিনি কর্ম, প্রেম ও উপাসনার ঐক্য।) দেবীর উপাসনাকে এই পঙ্ক্তি তন্ত্র থেকে ভক্তির দিকে নিয়ে যায়। বাহুতে শক্তি মানে কর্মশক্তি, হৃদয়ে ভক্তি মানে আত্মসমর্পণ; আর প্রতিমা মানে সেই চেতনার রূপায়ণ। এভাবে, উপাসনা হয়ে ওঠে অন্তরাত্মার প্রতিফলন—যেখানে মন্দির আর বাইরে নয়, অন্তরে।
পরবর্তী স্তবক—“ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী, কমলা কমল-দলবিহারিণী, বাণী বিদ্যাদায়িনী”—তুমি দুর্গা—দশপ্রহরণধারিণী, শক্তি ও সাহসের দেবী, তুমি কমলা—লক্ষ্মীর রূপ, সম্পদ ও পোষণশক্তির প্রতীক, তুমি বাণী—সরস্বতী, জ্ঞান ও বুদ্ধিদাত্রী, তোমায় প্রণাম করি, হে দেবী! (অর্থাৎ, তিন শক্তি—শক্তি, সম্পদ ও জ্ঞানের সংহত রূপই মা জগদ্ধাত্রী।) এখানে বঙ্কিমচন্দ্র দেবীর ত্রিশক্তির ঐক্য প্রকাশ করেছেন। দুর্গা—রজোগুণের কর্মশক্তি, কমলা—সত্ত্বের পোষণশক্তি, আর বাণী—জ্ঞানের প্রতীক। এই তিনেই মিলিত হয়ে জন্ম নেয় জগদ্ধাত্রী, যিনি ত্রিগুণাত্মিকা, অদ্বৈত চেতনার সক্রিয় রূপ।