চৌদ্দ-প্রদীপ


এক। আপনার অতীত আপনার বর্তমানকে চুরি করে ফেলতে পারে একমুহূর্তেই, যদি আপনি তা করতে দেন। ধরুন, দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ একটা অন্ধকার কক্ষে বসে বসে আপনি ভাবছেন তো ভাবছেনই---কী হলো আর কী হতে পারত, কেন এমন হলো বা অমন হলো, এবং এরকম আরও কিছু। আপনার জীবনে যা ঘটে গেছে, তা নিয়ে নিজের মনেই বিশ্লেষণ করতে করতে আপনার বর্তমানটাকে সহজেই নষ্ট করে দিতে পারেন, কিংবা যা চলে গেছে তা তো আর ফেরানো যাবে না, এটা মেনে বর্তমানটাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন। আপনি কোন পথে হাঁটবেন, তা আপনার উপর!


দুই। আপনার জীবনে সবাই-ই বা সব কিছুই শেষপর্যন্ত থেকে যাবে না; আপনি যতই চান না কেন, এটা সম্ভব নয়। অনেক কিছুই ঘটে যায়, যা আমরা চাই না, কিন্তু যা আমাদের মেনে নিতে হয়। জীবনের অনেক দিক থাকে, যা আমরা বুঝি না, কিন্তু যা আমাদের শিখে নিতে হয়…বাঁচার তাগিদেই। এমন কাউকে কাউকেও জীবন থেকে বিদায় জানাতে হয়, যাদের ছাড়া আমরা বাঁচতেই পারি না। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু মানুষ ও কিছু পরিস্থিতি আমাদের জীবনে আসে, যেগুলি আমাদের মনের দিক দিয়ে ক্রমেই শক্তিশালী করে গড়ে তোলে। একসময় আমরা বুঝতে পারি, আমাদের জীবনে ওসব ঝড় না এলে আমরা হয়তোবা মানুষের মতো মানুষ হতে পারতামই না!


তিন। সুখের মানে এ নয় যে আমাদের জীবনে কোনও সমস্যা থাকবে না, বরং সমস্যার মুখোমুখি হয়ে চলতে জানার নামই সুখ। আমাদের যা হারিয়ে গেছে, তার দিকে তাকানোর চাইতে বরং আমাদের যা আছে, তার দিকে তাকানোর নামই সুখ। হাতের কাছে যা আছে, যতটুকু আছে, তাকেই সবচাইতে চমৎকার উপায়ে কাজে লাগানোর নামই সুখ।


চার। মাঝে মাঝে, বেঁচে থাকতে হলে আমাদের আশেপাশে কী হচ্ছে বা কী হচ্ছে না, সেদিকে না তাকিয়ে নিজের সেরাটুকু ঢেলে দিয়ে কাজ করে যেতে হয়। সব দিকে তাকালে কোনও কাজই ঠিকভাবে হয় না।


পাঁচ। জীবনে যদি কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, হাতের মুঠোয় রাখতে হয়, তবে সে মানুষটি হোন আপনি নিজে। যা-কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যা-কিছু নিয়ে আমাদের সত্যিই কিছু করার নেই, যা-কিছু আমরা করতে চাইলেও করতে পারব না,…তা-কিছু নিয়ে চিন্তা করা আর নিজেকে যন্ত্রণার মধ্যে রেখে দেওয়া, একই কথা। সুখী হতে চাইলে অহেতুক, অনর্থক উদ্‌বেগকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিতে হবে।


ছয়। আপনি যা ঠিক বলে ধরে নিয়েছেন, তা অন্যদের কাছে ভুলও হতে পারে। অন্যরা যা ঠিক বলে ধরে নিয়েছে, তা আপনার কাছে ভুলও হতে পারে। এটা মেনে নিন। আপনি নিজে যা ভেবে শান্তি পাচ্ছেন, তা ভেবেই নিজেকে শান্তিতে রাখুন। অন্যরা যা ভেবে শান্তি পাচ্ছে, তা ভেবেই ওদেরও শান্তিতে থাকতে দিন। নিজেরটা অন্যের উপর চাপিয়ে দেবেন না, অন্যেরটা নিজের উপর চাপিয়ে নেবেন না। ভালো থাকার জন্য এর চাইতে সহজ বুদ্ধি আর নেই। বাঁচতে হলে নাচতে জানতে হয়। একেক জনের নাচের ধরন, তাল, লয়, ব্যাকরণ একেক রকম। প্রত্যেকটিই সঠিক, যদি তা কারওই নাচার পথে বিন্দুমাত্রও বাধার সৃষ্টি না। যে যেভাবে অন্যের ক্ষতি না-করে ভালো থাকে, তাকে সেভাবেই থাকতে দিন। এর নামই জীবনধর্ম।


সাত। কিছু মানুষ সব সময় থাকবেই, যারা আপনাকে আপনার মতো করে মেনে নিতে চাইবে না। তবুও নিজের মতো করেই বাঁচুন। এতে যদি আপনি কারও তাচ্ছিল্য বা হাসির পাত্র হন, ওতে কিছুই এসে যায় না। দিনের শেষে, আপনি কষ্টে থাকলে একমাত্র আপনিই কষ্টে থাকবেন, আপনি সুখে থাকলে সেই আপনিই সুখে থাকবেন। কিছু মানুষ আছে, যাদের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে গিয়ে যদি আপনি নিজের দুটো চোখও দিয়ে দেন, তা-ও তারা বলবে, ‘…এর মানে দাঁড়াল, তোমার বাম চোখটা আসলে ট্যারা ছিল!’ কিচ্ছু করার নেই, বাঁচতে হলে ওদের উপস্থিতি মেনে নিয়েই বাঁচতে হবে।


আট। সম্পর্ক টিকে থাকে সত্যের জোরে। যখন কোনও এক পক্ষ সত্যকে মেনে নিতে চায় না, আর অন্য পক্ষ মিথ্যের আশ্রয় নেয় সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, তখন ধীরে ধীরে সে সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার রাস্তা একটাই---সত্যকে মেনে নিয়ে কাউকে গ্রহণ করতে শেখা। যদি মনে হয়, সত্যটাকে আর মেনে নেওয়া যাচ্ছেই না, তবে সে সম্পর্ককে সুন্দরভাবে শেষ করে দেওয়াই ভালো। মাথায় রাখতে হবে, যা সত্য, তা সত্যই---আমি মানলেও সত্য, না-মানলেও সত্য। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, প্রায়ই দেখা যায়, যারা সত্যকে মেনে নিয়ে কোনও একটা সম্পর্কে টিকে থাকতে পারে না, তারা মিথ্যাকে বিশ্বাস করে পরের সম্পর্কে টিকে থাকে। সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মিথ্যেবাদী ও কপটরাই সবার চাইতে এগিয়ে। আমাকে আমার মতো করে মেনে নিয়ে এবং তাকে তার মতো করে মেনে নিয়ে যে ভালোবাসা তৈরি হয় না, সেটি ভালোবাসা নয়, অভিনয় মাত্র।


নয়। পৃথিবীটা কখন বদলে যাবে? যখন আমরা নিজেরা বদলে যাব। চোখ মেললে যা দেখি, তা স্বীকার না করে নিজের মতো করে কিছু একটা ভেবে নিলে বা বিশ্বাস করলে এই পৃথিবীকে বদলানো কিছুতেই সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আমাদের মনের মধ্যে থাকবে একটা পৃথিবী, বাস্তবে থাকবে আরেকটা পৃথিবী। পৃথিবীটা এরকম হওয়া উচিত, পৃথিবীটা ওরকম হওয়া উচিত, এ ধরনের হাজারো চিন্তা আমাদের বিশ্বাসে থাকতেই পারে, আমরাও ওসবকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতেই পারি, কিন্তু এতে করে পৃথিবীটা আমাদের মনের ভাবনার মতন হয়ে যায় না। পৃথিবী এমন একটা জায়গা, যেখানে উচিত অনুচিত বলে কিছুই নেই। এখানে যা আছে তা হলো---কী ঘটছে, কী ঘটছে না। ব্যস্‌, এর বাইরে আর কিচ্ছু নেই! আমরা তা মানছি কি মানছি না, ওতে কারও কিচ্ছু এসে যায় না! আমরা আসলে কেমন? আমাদের অভিজ্ঞতা ও বোধ আমাদের যেমন করে রাখে, ঠিক তেমনই। আজকের ভাবনা ও বিশ্বাস আমাদের যে পথে চালাচ্ছে, আগামীকাল আমরা ঠিক সে পথেই চলব। জীবনটাকে বদলাতে চাইলে প্রথমেই ঠিক এই মুহূর্তের চিন্তাভাবনা ও বিশ্বাসগুলিকে বদলে ফেলে পরিবর্তিত সমস্ত ধারণাকে সহজভাবে গ্রহণ করে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যেতে হবে। যে মানুষের মাথায় বাস্তবের পৃথিবীটার বাইরে অন্য একটা পৃথিবী ঘোরে, সে হয় ভণ্ড, নয় নির্বোধ।


দশ। আপনার সামনে দুটো পথ আছে---হয় সিদ্ধান্ত দিন, নতুবা অজুহাত দেখান। প্রথমটি আপনাকে দায়িত্ববান হিসেবে প্রমাণ করবে, দ্বিতীয়টি আপনাকে কাপুরুষ হিসেবে তুলে ধরবে। জীবন হচ্ছে একটা দীর্ঘ পরিসরের চর্চাকেন্দ্র, যেখানে নানান ধরনের শিক্ষণীয় সমস্যা সমাধান করে যেতে হয়। ভুল করা মানেই কিন্তু ব্যর্থতাকে বরণ করে নেওয়া নয়, যদি আমরা সেই ভুলটাকে সময়মতো শুধরে নিতে পারি।


এগারো। একটা মানুষের স্বপ্নকে খুন করার জন্য মাত্র কয়েকটি নেতিবাচক মন্তব্যই যথেষ্ট। একটি সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচার জন্য মাত্র দুইটি নিয়ম অনুসরণ করলেই হবে। এক, কারও স্বপ্ন নিয়ে বাজে কোনও মন্তব্য করা যাবে না। দুই, যারা ওরকম মন্তব্য করে, তাদের ধারে কাছেও নিজেকে রাখা যাবে না।


বারো। সব জায়গায় যেতে নেই, সবার সাথে মিশতে নেই। কিছু কিছু জায়গায়, কিছু কিছু লোকের কাছে---আপনার যোগ্যতাই আপনার সবচাইতে বড়ো অযোগ্যতা। ওরা অনেক চেষ্টা করেছে আপনার মতো হতে, কিন্তু পারেনি; চেষ্টা এখনও করে যাচ্ছে, তা-ও পারছে না। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, ওরা কেবল ওদেরকেই বুকে টেনে নেয়, যাদের যোগ্যতা ওদের চাইতে কম কিংবা ওদের সমান। যে সকল জায়গায় ওদের আধিপত্য বেশি, সে সকল জায়গায় যাবেন না। গেলে অপমানিত কিংবা হতাশ হবেন। এর চাইতে ঢের ভালো, নিজের কুঁড়েঘরটিতে একাকী বসে নিজের কাজটি মন দিয়ে করে যাওয়া। ওতে আর কিছু পান না পান, শান্তি তো পাবেন! কী দরকার যেচে যেচে নিজের মনের অসুখ বাড়ানোর? আপনার চাইতে অযোগ্য যিনি, তিনি যত বড়ো অবস্থানেই থাকুন না কেন, কখনওই তাঁর কথায় বা আচরণে প্রভাবিত হয়ে নিজের যোগ্যতা নিয়ে মনে কোনও সন্দেহ আনবেন না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, উঁচু অবস্থানের মানুষ তার চাইতে নিচু অবস্থানের কাউকে তার নিজের চেয়ে জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান হিসেবে মেনেই নিতে পারে না।


তেরো। কখনও কখনও, হাল ছেড়ে দেওয়াই জিতে যাওয়ার একমাত্র পথ। যারা আপনাকে বোঝেই না, তাদের কাছে আপনার নিজেকে ব্যাখ্যা করার মানেই হলো সময় ও শ্রম অপচয় করা। ওরা ওদের যা ইচ্ছা তা বুঝে খুশি থাকুক! একেবারে চুপচাপ নিজেকে ওদের কাছ থেকে সরিয়ে নিন। ওই সময়টা বরং নিজের কাজের পেছনে দিন। একসময়, ওরা সবই বুঝতে পারবে। উত্তরটা দিতে হয় কাজে, মুখে নয়।


চৌদ্দ। আপনি পৃথিবীর সবাইকে হারিয়ে দিয়ে জিতে গেলেও সেটা ততক্ষণ পর্যন্ত জয় নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের কাছেই হেরে বসে আছেন। নিজের সাথে জিততে চাইলে আগে নিজের কাছেই নির্মমভাবে হেরে যেতে হয়। নিজেকে বোঝাতে হয়, জিততে আমাকে হবেই, কেননা আমি হেরে বসে আছি। তারপর উঠে দাঁড়াতে হয় প্রবল শক্তিতে। এই নিজের কাছে হেরে যাবার ব্যাপারটা বেশ কঠিন, এর পরের ধাপটা, মানে ঘুরে দাঁড়ানো, ওটা তো আরও বেশি কঠিন! আমরা পুরো পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করতেই থাকি, আর এদিকে নিজের কাছে যে পরাজয়, তা আমাদের উপহাস করতেই থাকে।
Content Protection by DMCA.com