চেতনার সহজ স্রোত




অদ্বৈত আত্মা: গভীর ঘুমে “আমি কর্তা” বলে কোনো অনুভূতি নেই, নেই জাগ্রত মন, নেই দেহ বা জগতের সঙ্গে পরিচয়। তবুও শ্বাস চলতে থাকে, হৃদয় স্পন্দিত হয়, হজম প্রক্রিয়া চলে, কোষেরা নিজেদেরকে মেরামত করে, অসংখ্য শারীরবৃত্তিক কাজ চলতে থাকে কোনো বাহ্যিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই। এটা প্রমাণ করে—জীবন বেঁচে থাকে আত্মার দ্বারা—সর্বজনীন, অদ্বৈত চেতনার দ্বারা—যেখানে আলাদা কোনো কর্তার প্রয়োজনই নেই।

দৈনন্দিন জীবন ও কর্ম: জেগে উঠলেই মন হাজির হয় এবং সাথে সাথেই দেহের সাথে চিন্তার পরিচয় তৈরি করে ফেলে। নানান কাজ ঘটতে থাকে—হাঁটা, কথা বলা, ভাবা, কাজ করা। কিন্তু বাস্তবে এসব কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে, জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহের অংশ হিসেবে—ঠিক যেমনি ঘুমে শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজটি ঘটে। আত্মা আলাদা কর্তা হয়ে কাজ করে না; বরং সমস্ত কাজই তার উপস্থিতির প্রকাশ, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো।

মালিকানার ভ্রম: “আমি কর্তা”—এই অনুভূতি আসে অহম্ থেকে, যা আসলে কেবল একটি ভাবনা—আত্মার উপর চাপানো এক ভ্রান্তি। অহম্‌ বলে: “আমি শ্বাস নিচ্ছি, আমি খাচ্ছি, আমি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, আমি অর্জন করছি।” কিন্তু সত্য হলো—যে-বুদ্ধি ঘুমের মধ্যেও হৃদয়কে চালিত করে, সেই একই বুদ্ধিশক্তিই জাগরণে দেহ ও মনকে চালিত করে। ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা আসলে পরিচয়ের একটি ভুল—যেমন দড়িকে কেউ কেউ সাপ ভেবে ভুল করে।

“তুমি”-র কাল্পনিক স্বরূপ: যে ব্যক্তিগত “তুমি” নিজেকে কর্তা ভাবে, তাকে সরাসরি খুঁজতে গেলে কিছুই পাওয়া যায় না—সে কেবলই কিছু চিন্তা ও পরিচয়ের সমষ্টি। আসল “আমি” হলো বিশুদ্ধ সচেতনতা, যা সর্বদা উপস্থিত, অপরিবর্তনীয়, অদ্বৈত। মিথ্যা “তুমি” হলো এক ছায়া: আত্মার আলো মনে এসে পড়লে সে দেখা দেয়, কিন্তু তার নিজস্ব কোনো সত্তা নেই।

ব্যাবহারিক তাৎপর্য: যখন এই সত্য ধরা পড়ে, কর্তার বোঝা তখন ঝরে যায়। কাজ চলতে থাকে, কিন্তু থাকে না আর আঁকড়ে ধরা, উদ্‌বেগ বা অহংকার। জীবন প্রবাহিত হয়—ঠিক যেমন ঘুমের সময় শ্বাস প্রবাহিত হয়—স্বতঃস্ফূর্তভাবে, সহজে, সমগ্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।

আত্মাই একমাত্র বাস্তব। সে-ই ঘুমে শ্বাস নেয়, জাগরণে ভাবে, জীবনকে চালিত করে। “আমি করছি”—অহংকারের এই দাবি নিছক কল্পনা, আত্মার সহজ ও স্বতঃসিদ্ধ কার্যপ্রবাহের উপর ভুল করে আমি-কে চাপানো। উপনিষদে “অহম্” বা “আমি আছি” কোনো ব্যক্তিগত ঘোষণা নয়; বরং সীমিত অভিজ্ঞতা লাভকারী ও অসীম উৎসের মাঝে এক সেতুবন্ধ। এ স্থানে আত্মা ও ব্রহ্ম একসাথে দীপ্ত হয়ে ওঠে।

ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে ভুল উপলব্ধি হয়—মনে হয়, যেন কোনো “উচ্চতর আত্মা” আলাদা সত্তা, যাকে খুঁজতে হবে বা অভিজ্ঞতায় লাভ করতে হবে। এই ভুল ধারণাই অনুসন্ধান চালিয়ে যায়। আসল সত্য হলো—জীবন নিজেই সেই উপস্থিতি, যা মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে ঘটে কোনো বাহ্যিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই। খোঁজার কিছু নেই, পাবার কিছু নেই। যখন ভ্রান্ত আত্মবোধ ভেঙে যায়, তখন রয়ে যায় শুধু জীবন / উপস্থিতি / সত্তা—যা নিজেই নিজেকে উন্মোচন করে।