চার রকমের মন

সায়রার ভাষ্যমতে, ‘প্রচণ্ড’ শব্দটি দিয়ে বললেও হয়তো কম বলা হবে শোয়েবের ভালোবাসাকে। সারাক্ষণই শোয়েবের ফোন, মেসেজ, ভিডিয়োকল এসব নিয়েই থাকতে হয় তাকে, যদিও সায়রা এসবের নাম দিয়েছে ‘মিষ্টি মিষ্টি যন্ত্রণা’! শোয়েবের মতো আজকাল সায়রাও বিশ্বাস করে, চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল। ভালোবাসার মানুষকে সবসময়ই রাখতে হয় চোখে চোখে, চোখ সরালেই ফুড়ুৎ। তাই, ওরা দুজন কোনও-না-কোনও মাধ্যমে সারাদিনই প্রায় একসাথেই সময় কাটায়। দুজনের কে কখন বাথরুমে যায়, সেটাও অপরজন জানে।


পাশের বেডের সেতু সায়রার এসব ন্যাকামি দেখে খুবই বিরক্ত হয়। সে ভাবে, সারাদিন এসব কী করে সম্ভব? সেতু সায়রার বান্ধবী এবং রুমমেট। বছর দুই আগে ইউনিভারসিটির শুরুতে সেতুর প্রেম হয় শুভর সাথে। কিন্তু শুভ আর সেতুর কথা হয় দিনে একবার, কখনও সপ্তাহে একবার, আবার এমনও হয়েছে যে, দুই-তিন মাস চলে গেছে, অথচ শুভ কোনও যোগাযোগই করেনি। আর দেখা হওয়া, সে তো অনেক দূরের কথা! সায়রাকে দেখে দেখে বিকেলবেলায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আধশোয়া হয়ে সেতু প্রায়ই ভাবে, ‘আচ্ছা, শুভ কেন সারাক্ষণ মেসেজ পাঠিয়ে বা অযথা সন্দেহ করে করে ওরকম ‘মিষ্টি মিষ্টি যন্ত্রণা’ দেয় না আমাকে? শুভও তো করতে পারে এরকম, করে না কেন? ও কী এমন কাজ করে যে আমাকে দেবার মতন সময়ই হয় না?’ অবশ্য, ওসব কথা সেতু মনে মনেই বলে। ‘আমাকে কেন তুমি সময় দাও না?’ এ ধরনের কিছু কখনওই সে শুভকে বলতে পারবে না, আর বললেও শুভ এসব কথা গায়েও মাখবে না, এটা সেতু খুব ভালো করেই জানে। সেতু মাঝেমধ্যে সায়রাকে দেখে একেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেসব দীর্ঘশ্বাসের নানান অর্থ আছে।


সেতুর ডানদিকের বেডে থাকে আদিবা। এই মেয়েটা সারাদিনই দৌড়ের ওপরে থাকে। এই ক্লাস, টিউশনি, নিজের প্রাইভেট, রান্না করা। এভাবেই সারাটা দিন কেটে যায় আদিবার। ওকে ‘প্রেম করিস?’ কিংবা বয়ফ্রেন্ড আছে কি না জিজ্ঞেস করলে ও শুধু হাসে। ওই হাসির মানেটা আজ অবধি কেউ বের করতে পারল না। মাঝেমধ্যে আদিবা রাত তিনটে চারটের দিকে উঠে বারান্দায় যায়। সারাটা রুম পায়চারি করে আর কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘ঘুম আসছে না।’ সকালবেলা উঠে ওর ফোলা চোখদুটো দেখলে আর বলে দিতে হয় না, সে রাতভর কেঁদেছে। ওই আদিবাই আবার কিছুক্ষণ পর গিয়ে গোসল করে চা বানিয়ে নিয়ে এসে সবাইকে ওর বিছানায় ডাকে। আদিবা দারুণ চা বানায়! রাতের ঘটনা জিজ্ঞেস করলে কিছুই উত্তর পাওয়া যাবে না বিধায় কেউ ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না, চুপচাপ চা খেতে থাকে। কখনও কখনও, আদিবা বলে, ‘চল, আজকে চড়ুইভাতি করি, হুঁ? রান্না করবে সেতু, আর সায়রা গান গাইবে। আর আমরা সবাই আজকে শাড়ি পরে ছাদে যাব।’ এই ফূর্তিবাজ, হইহই-করা মেয়েটা মুহূর্তের মধ্যেই রুমের পরিবেশটা পালটে দেয়।


তাদের ঠিক পাশের বেড থেকে সবসময় সায়রা, সেতু আর রহস্যময়ী আদিবাকে লক্ষ করে যায় বিগত চার সেমিস্টারে সিজিপিএ তিন দশমিক আট-এর উপরে পাওয়া লুবনা। সে প্রেম-টেম করে না, শুধুই পড়াশোনা করে। ও টেবিল-চেয়ারে বসে বসে শুধু ভাবে, ‘এই তো সেদিন আসা মেয়েগুলো মাত্র দু-বছরে কতটা পালটে গেল! দুজনেই দুটো সম্পর্কে আছে, হয়তো আদিবাও আছে, কিন্তু তাদের চারজনের ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা। লুবনা প্রায়ই ভাবে, কার ভালোবাসা বেশি জোরালো? তাদের মধ্যে সত্যিকারের ভালোটা বাসে কে আসলে? সায়রা, সেতু, না কি আদিবা? ওরা তিনজনই তিনজনের প্রেমিককে নিয়ে এই সেই ভাবে, এটা সেটা বলে। আদিবাও বলে, হয় মুচকি হেসে, না হয় চুপ করে থেকে।


লুবনা ভাবে, এই ভালোবাসাটা কী এমন জিনিস! এই ছেলেগুলো কীসের মন্ত্র পড়ে যায় ওপাশ থেকে? এমন কী সে মন্ত্র, যা শুনে মেয়েগুলোর কেউ একজন একাকী হাসে, কেউ সেই হাসিকে হিংসে করে, আবার কেউ রাতে ঘুমোতেই পারে না! ভালোবাসার স্বাদটা আসলে কেমন? জোরালো কোনও ভালোবাসা কেন তার জীবনে এতদিনেও এল না? এসবই কি মোহ তবে? ভালোবাসা বলে বাস্তব জীবনে আদৌ কি কিছু নেই, যেমনটা ওর মনে হয়? না কি পরীক্ষায় বার বার প্রথম-হওয়া মেয়েটা ওদের সাথে এই ভালোবাসার জাদুর জগতে কোথাও-না-কোথাও প্রতিদিনই হেরে যাচ্ছে?
Content Protection by DMCA.com