ঘুলঘুলির ফোকর পেরিয়ে রাত

মাঝেমাঝে অশ্রু কেমন যেন রক্ত হয়ে ঝরে!
জানো, কথা আছে কিছু, কখনওই যা হয় না বলা?
কেন জানি না, অনুভূতি কিছু ঠিক যায় না বোঝানো!
কেন কিছু কথা প্রকাশের ভাষা নেই কোনও?
কেন হয় এমনই? কেন হয় না জীবন যেমন হলে ভালোই হতো?
ভালোবাসা কেন হলো অপারগ এই এতটাই?
কেন সে এমন দুর্বল এত আর অসহায়?


তুমি আমায় নিলে, আমার নিজের যে একটা পৃথিবী ছিল, তাও নিলে!
আমার একাকিত্ব গ্রাস করলে, পূর্ণতা যা…তুমিই দিলে,
আর নিজের কাছে করলে নিজেকে ছদ্মবেশে শূন্য শুধুই!
যেমনি করে ওই চাঁদটা খেয়েই ফেলে সূর্যমশাই,
সেভাবেই তুমি নিলে আমাকে পূর্ণগ্রাসে…
তবুও তোমায় পেলামই-বা কই?
কেন তুমি এক এমন তুমি, যে ‘তুমি’টা আমারই তো নয়?
তুমি যে এখানে নেই এখনও, এর চেয়ে বড় শূন্যতা আর কী-ইবা আছে?
তুমি ওখানে থাক, সেখানে থাক,
ভেতরে তুমি, বাইরেও তুমি…সবখানে শুধু তোমাকেই দেখি…
কেন তারপরও দেখি শূন্য সবই?


তোমার এই না-থাকা আমার রক্ত ঝরায়…
তুমি পাশে নেই, এইটুকুতেই এতটা যদি হই বিহ্বল,
যে-দিন তুমি চলেই যাবে, সে-দিন আমি বাঁচব কীসে?
কার কাছে করব সে-দিন এত অভিযোগ? এত অনুযোগ শুনবে কে আর?
কোন সে বুকে মুখ লুকিয়ে রাগে-অভিমানে কাঁদব সে-দিন?
কার কাছে যাব, করে বসব আদরের এই আবদার যত?
বলব কাকে…ভালোবাসি তো!
নিজে ফুরোবার আগেই আমার কবর খুঁড়ে রেখেই গেলে, তাই না, বলো?
দেখো, যেন খুব অভিমানে আর কুণ্ঠায় আগে আমিই ফুরিয়ে না যাই!
তখন নাহয় রেখো তোমার অবহেলা সব শিকেয় তুলে!


মাঝেমাঝে মনে এসে যায়, এই আত্মাটা কোথাও যেন আটকে আছে…
শুধু ছটফট করে দূরের খাঁচায় বন্দি হয়ে!
এ জীবনে বুঝি আর কখনও ছাড়া পাবে না!
শুনেছ এমন, কারও শরীর এখানে, অথচ তার মনটা কোথায় যেন আটকে আছে?
কথাগুলি কেমন উদ্ভট আর অদ্ভুতুড়ে, মনে হয় না এমন?
হাস্যকরও শোনায় নাকি? বিদ্রূপে বেঁধে ছুড়ে ফেলতে লাগে দারুণ নাকি?
…আমারও হতো! একটাসময় এসব নিয়ে হাসতাম খুব!
হেসে উড়িয়ে মজা লুটতাম!
সেই আমি আজ মনকে বাঁধি, বৃথাই রাখি ব্যস্ত কাজে…
করেছি তো এমন, করেছি আগেও…অনেকবারই!


নতুন কোনও বাঁধন এলে পুরনো বাঁধন মৃত্যু ডাকে?
জীবনে যখন নতুন মানুষ, এর মানে কি পুরনো মানুষ মরেই গেছে?
দেখেছি অনেক, আবছায়াতেও হয় না এমন! হয় না কেন?
যারা নতুন আসে, ওরা খুব কায়দা করে মানিয়ে চলে,
আমায় ভালো রাখে, গুছিয়ে বাঁধে…ওদের চেষ্টাটুকু চোখে পড়ে খুব!
অথচ দেখো! কাউকেই আমার ধরে না মনে!
ভুলেও কখনও আসে না মনে, আমার পৃথিবী যেমন, সেখানে তুমি ছাড়া আছে অন্য মানুষ!
তুমিও কীভাবে বলে ফেল দেখি…অন্য কারও হাত ধরতে,
অন্য ঘরে ঘর বাঁধতে, অন্য চোখে আলো খুঁজতে!


ওসব রঙিন স্বপ্ন দেখাও সুযোগ পেলেই!
আমি কি আর বুঝি না এসব?
বুঝতে তো পারি আমায় নিয়ে সত্যি তোমার চিন্তা ভারি!
বোঝাও আমায় অন্য ঘরে সুখে থাকব ঠিক এমনই,
আবার এও বল, তখনও তুমি থাকবে পাশে!
থাকবে তুমি সারাটি জীবন এমনি করেই আমার হয়ে।
তোমার কথার অর্থ যে কী, আমি তার বুঝি না কিছুই…এমন তো নয়!
চেষ্টা যে তার করিনি এখনও, বলব না তাও।
আজকাল এই মনকে বেঁধে বাধ্য করে কিছুই আমি করতে পারি না!
করেছি তো অনেক, এখন আর সত্যি ওসব হয় না, জানো?


একটা কথা। এই যে তুমি বলেই ফেল, আছই পাশে, থাকবে এমনই…
আসলে তুমি কোথায় আছ, বলতে পার?
সত্যি তুমি আছ এখনও?
একেও তুমি বলছ থাকা?
কীভাবে আছ, বলো তো ভেবে?
আমি তোমাকে নিজের করে পাই কখনও?
কখনও ভেবে বুকের উপর হাতটা রেখে দাও তো বলে…
এই সময়টাকে তোমায় দিলাম! এ সময় শুধুই তোমার সময়!
এই সময়টাতে অন্য কারও কোনও ভাগ নেই!
…হোক সে-সময় অল্প খুবই, সেই অল্পটাও আছে কি আদৌ?


মানলাম তো, মেনেই নিলাম, আমায় তুমি রাখতে পার না,
তোমার স্পর্শও সবটা সময়ই পাব না আমি!
তাই বলে কি কথাবলাও যায় না নাকি?
‘আমার জন্য সময়’ বলে নেই কি কিছুই তোমার কাছে?
দূর থেকেও ভালোবাসা যায়, কাছে থাকা যায়…মন চাইলে।
কী? যায় না, বলো?
তুমি রাখ না কাছে, থাক না কাছে,
ছাড়ছই না, আবার ধরছই-বা কই?
মাঝেমাঝে মনে কী হয়, জানো?
মনে হয়, এই মন বাঁধতে আর বাধ্য হওয়ার অভিনয়েই একটাসময় সত্যি বুঝি পাগলই হব!


বলতে পার, আর কতই আমি মানিয়ে নেব?
আর কতটা বড় হলে তবে ভুলব তোমায়?
আর কবেই বুঝব এই জীবন কেমন?
তুমি যে আমার নও কখনও, ছিলেও তো না!
থাকতে যদি, পারতে কি তবে এই হৃদয়ে ছোরা বসাতে এমনি করে?
পারতে কি দিতে এত ক্ষতের সারি?
পারতে বলো, এমন ভুলিয়েভালিয়ে হয় হোক যা, একটা কিছু বুঝিয়ে দিতে?
জানি, সত্যি এমন পারতেই না!
অথচ দেখো, হাজারটা ক্ষণ রেখেছ আমায় এমনি করেই!
এভাবে কেউ রাখে কাউকে ভালোবাসে যাকে?
পাইনি যাকে, এই এক জীবনে কেবল তাকেই পেলাম!


আজ আমি থাকব না চুপ, করবই আজ শুধু অভিযোগ!
ইচ্ছে কি আমার হয় না বলো তোমার সাথে একটু হলেও কথা বলি…তোমার ওই কণ্ঠ শুনি?
এই অপেক্ষাটা আর করব কত?
সত্যি তোমাকে পাবই না আর?
ভিখিরিকে যদি ভিক্ষে না দেবে, তবে রেখেছ কেন দাঁড় করিয়ে?
তাকে নাহয় দাও তাড়িয়ে! তাকে আজ মরতেই বলো!
যাক গে সে অন্য দোরে, নয়তো না-খেয়ে সে মরুক এবার!
মরতে দাও, সেও ভালো…কাউকে তবু বেঁধো না আশায়!


আজকাল যখনই আয়না দেখি, নিজেকে খুবই লাগে বেমানান!
যেখানে যাই, সেখানেই নাকি খুব মানিয়ে আর গুছিয়ে চলতে পারি…
সবাই খুব ভালোই বলে, কাছেও টানে!
সবার সাথে সব জায়গায়…পরিস্থিতি হোক যেমনই, ঠিক মিশে যাই!
মানিয়েই নেয়, খুব বিনয়ে স্বর নামিয়ে কথা বলে যে,
আমোদ করে, সবাইকেই যত্ন করে, তেমনই এক মানুষ আমি…একদম সবার মনের মতন!
আমি এক এমন মানুষ…সবারই যেন খুব আদরের কাঠের পুতুল!
নিজের এই রূপ দেখলে আজকাল খুবই বিতৃষ্ণা ধরে!
আমি এমন, আমি তেমন…অথচ এর মাঝে কোথায় আমি?
এ তো সবই ওদের আমি, আমার আমি থাকছেটা কই?


কী চাই আমি?
সবার সাথে, হাওয়া বুঝে মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে গিয়ে নিজেকেই আজ হারিয়ে ফেলেছি!
নিজের সেই অস্তিত্বটাই পাই না খুঁজে!
না, এখানে আমি আর থাকি না।
তবে আমি কোথায় থাকি? সত্যি আমি নেই কোথাও!
এ যে নই সত্যি আমি, এ শুধুই আমার শরীর,
আমার মৃত অবয়ব, আমার ক্লীবলাশটি!
আমি এমন ছিলাম না তো, কখনও এমন ছিলাম না তো…
আমি ছিলাম মুক্ত আকাশ কিংবা ওই ডানা মেলে ওড়া পাখির মতন।
যখন খুশি, যেভাবে খুশি উড়েছি আমি সকাল-বিকেল।
অন্য কারও মনের মতন ছিলাম তো না, অমন হতে চেষ্টাও আমি করিনি কখনও।
আমি ছিলাম আমারই মতো, নিজের ইচ্ছে-স্বাধীন ছিলাম আমি একেবারেই!


দেখো না, আকাশের যত রঙিন পাখি…সবাই কেমন সাজিয়ে রাখে!
পুরলে খাঁচায় পাখির প্রাণটা কি আর পাখির থাকে?
তখন তো সে ঘর-সাজানোর শোপিসই এক!
সে ডানা ঝাপটায় শুধু অন্যের মন রাঙাতে!
আর আমি বুঝি এখন তেমনই কিছু!
সবাই সাথে রাখে যত্ন করে, রেখে দেখায়, তাদেরও একটা পাখি আছে।
কত সুন্দর…তাকে শেখানো বুলি বলতে দিলে পাখিটিও গড়গড় করে দিব্যি বলে!
মুগ্ধ সবাই, হাততালি পড়ে!
এই আনন্দমাঝে সেই পাখিটির মনের খবর কে-ইবা রাখে?
আকাশের যে মুক্ত পাখি, সে ছোট্ট পাখি খাঁচায় বাঁচে কেমন করে?


সেই পাখিটি রোদে কি ঝড়ে, শীত-বর্ষায় থাকে ঠায় দাঁড়িয়ে…
তার কাছে সবই যেন একই লাগে!
পাখিটি একঘর ছাড়ে, যায় অন্যঘরে।
যে-ঘরে যায়, সে-ঘরেরই আসবাবে পাখি মিশে যায় খুব!
পাখিকে কেউ আলাদা করে দেখেই না তো, তাকেও এক আসবাবই ভাবে!
পাখিটি যখন যা খেতে পায়, খেয়ে ফেলে তা-ই,
যেখানে দেয় থাকতে ওরা, থাকে সেখানেই।
সময় হলে ডিম দিয়ে দেয়, কখনওবা বাচ্চা ফোটায়, ওইটুকু কাজ…আর কী তবে!
এভাবেই খেয়ে বেঁচেবর্তে জিরিয়ে ফুরিয়ে একদিন পাখি ঠিক মরে যায়।
সেই পাখি কখনও ছাড়া পাবে না?
পারবে না সে মুক্ত আকাশে মেলতে ডানা?
আর বোধহয় হবে না ওড়াই মরার আগে!


বড্ড আমি খেলনা এখন, তাই না, বলো?
আজ এ নাচায়, কাল সেও নাচায়!
এবার যে পেয়েছ তুমি, থাকতে সময় নাও নাচিয়ে!
আমি যে এক খেলনা ছাড়া কিছুই না আর!
তোমারও তো ইচ্ছে অমন…নতুন একটা নাটক লিখবে,
সে-নাটকে নাচব আমি ঠিক তেমনই, যেমনটা চাও!
অথর্ব এই মনটা আমার থাকবে শুধুই তোমার হাতে,
ঘোরাবে তুমিই নাটাই-সুতো, উড়বে ঘুড়ি ওই আকাশে!
শরীরটাও জানি অমনই, চাও যে তুমি শুধু ওসবই,
অন্য কেউ আসবে যখন, ছিনিয়ে নেবে, তার পরেও
যখনই তোমার চাহিদামতো লাগবে আমায়, অমনিই তুমি ধরবে সুতো হ্যাঁচকা টানে!
আরও একটানে নিয়ে নেবে কাছে,
ওদিকে আমি দেখব কেবলই রঙ্গলীলা!


ঘুড়ি কি আর নাটাই ছাড়া পারে উড়তে?
ঘুড়ি কি পারে নিজের নাটাই ধরতে নিজেই?
আর ঘুড়ির সুতো কাটলে পরে…ও কি আর ওড়ে কখনও…
ওই আকাশে, মুক্ত বেশে?
সে যে মুখথুবড়ে মাটিতে পড়ে, নয়তো উঁচু কোনও ডালে কিংবা তারে বাঁধা পড়ে যায়,
ভীষণ ছটফটিয়ে একটাসময় ধীরেধীরে শেষ হয়ে যায়!
বলতে পার, আমার আর ওই ঘুড়ির মধ্যে পার্থক্যটা?
এসো না কাছে, দিয়ো না সময়,
বেসো না ভালো, কোরো না আদর,
রেখো অবহেলায়, অযত্নে কেবল!
সত্যিই যে-দিন ফুরিয়ে যাব, এভাবে যখন আর পাবে না এই এতটা,
চাইলেও যখন পারব না আর আসতে কাছে, সেদিন বুঝো, বুঝেই নিয়ো,
না-পাওয়ার ক্ষত গভীর কত, ঠিকই কত রক্ত ঝরে ভেতর ভেতর!
Content Protection by DMCA.com