এক। সেদিন হাজার লোকের ভিড়েও যে সহজ সত্যটি সহজভাবে আমি বলে যেতে পারিনি, তা হলো: আমার সকল অস্তিত্বে তুমি মিশে আছ। খুব করে চেয়েও আমি এ কথাটি স্বীকার করতে পারিনি যে, আমি কেবল তোমার সাথে থেকেই চামড়ার ভাঁজে সময়কে লুকোতে চেয়েছি সবসময়।
আমার না পারার লিস্টটাই কেবল বড়ো হতে থাকে!
জানো, পাহাড়ের গায়ে গায়ে যেমন গুল্ম-লতারা জড়িয়ে থাকে, আমি তেমনি করে তোমার স্মৃতিকে জড়িয়ে রেখেই একটু একটু করে আদিম হই। তোমার অপেক্ষায় আমার গায়ে মেখে নিই ইতিহাস।
এই তো সেদিন, সূর্যডোবা সন্ধ্যায় হালকা উষ্ণ বাতাসেরা চারিদিকে সোঁদা গন্ধ ছড়াচ্ছিল। ওরা বলছিল, মাটির বুকে বৃষ্টির ক্রন্দনেই এমনটা হয়, কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, এ যেন তোমার অশ্রুজলের ঘ্রাণ!
তুমি কি কাঁদছিলে সেদিন? তোমারও কি তবে মনে পড়ে আমায়?
তুমি বলেছিলে, অন্ধকার এলেই তুমি কোথায় যেন হারিয়ে যাও। আমি যে প্রতিরাতেই নগরীর শেষ নিয়ন আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ি তোমার জানলায়, তুমি টের পাও না, না? আলো হয়েও কেন আমি তোমায় হারাই! বলতে পারো?
হয়তো খুব ভালো কিংবা মন্দবাসা প্রকাশ করতে আজও শিখিইনি আমি। নয়তো, লিখে-রাখা চিঠিগুলো অমন বুকপকেটেই কেন জমল? কতজনই তো শিশির মাড়িয়ে ঘাসের ডগায় লিখে দেয় ‘ভালোবাসি’! আমার যে তা-ও হলো না।
আমারই কেবল বলা হয়ে ওঠে না, আর অমনি প্রতিদিনই না পারার লিস্টের ঢিবি আকাশ ছোঁয়। বুঝি সেই অভিমানেই শিশিরেরাও কেমন যেন উবে যায়! তুমিই কি তবে হিমের শিশির?
দুই। আমি নিজেকে দেখেছি মৃত্যুকে বরণ করে নিতে। সমুদ্রের জলের মতোই স্বচ্ছ সে মৃত্যু! জলের নিচে আছে পাথুরে অতল। চুনো আর দানবাকৃতির ওই পাথরকে ঢাকতে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে শৈবালের জাল। সেখানে রুবি, ব্লুস্ট্রাইপ স্ন্যাপার আর নিডারিয়ার লুকোচুরি চলে সারগাসের এলোচুলের আড়ালে। আহা! কী সুন্দর!
আমি দেখি, সে গভীরে সূর্যের চেরা-আলো কতই-না নৈপুণ্য নিয়ে এগিয়ে যায়, আর... আর… যেই না সে আলো ইউফোটিক সীমা অতিক্রম করে, অমনিই ওকে আস্ত গিলে নেয় সমুদ্র গোধূলি!
আমি বহু বার চেয়েছি সে আলোকে বাঁচাতে। কিন্তু গোধূলি পেরিয়ে মধ্যরাতে আলো ছড়াতে পারিনি! কত বার মুঠোয় মুঠোয় আলো নিয়ে ফিরে এসেছি…পারিনি…পারিনি একফোঁটাও আলো নিতে। প্রতি বারই আঙুল গলে বেরিয়ে গেছে আলো, মিশে গেছে স্বচ্ছ জলে, তবু সে জল গোধূলি পেরুতে পারেনি!