গৃহহীন জ্যোৎস্না

তারপর গৃহহীন জ্যোৎস্নার মতো তোমার দরোজায় আমার শরীরী প্রত্যাবর্তন...আরও একবার!
তুমি কি শুনতে পাচ্ছ লৌকিক সাক্ষাতের মৃদু গুঞ্জন?
যদি বলো, পাহাড়ি বিকেলে শুনিনি প্রবঞ্চনা; তবে মন আর মানতে চাইবে না আমার বিবিধ সুখ কিংবা অসুখের ফিরিস্তি।




বলছিলাম চাঁদের বাড়ি যাবার গল্প।
জোছনাজলে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম এক-আধটা রাত,
দেখেছি তারাদের জলজ উন্মাদনা; ওরা বলে, পাথরে নাকি নদীর স্পর্শ লেগেছে!
আর আমি, তুমিহীন দিনগুলো কুড়িয়ে নিয়েছি; মালা গাঁথিনি, শুকিয়ে যাবার ভয়ে!




অদূরে একটি ফুলেল বৃক্ষ আর একটি ক্যাকটাস ধ্রুপদী নিষিদ্ধতায় জড়ানো! সরল, সুন্দর কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে খুব নিকটেই ওরা করে জ‍্যোৎস্নাবিলাস!
সবাক আমি নির্যাস গিলে নির্বাক হয়ে দেখি, ওধারে নিষিদ্ধ বাসর সাজানো, হাওয়ায় ভাসে মহুয়ার মদির গন্ধ; অথচ এদিকে আমি বহুবছরের বাতিল মানুষ!
তবুও চেয়েছি, সে জানুক, আমি কতকাল নির্ঘুম; দেখে যাক, প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে কেমন পুড়েছি নেতিয়ে-পড়া এক সলতের মতন!




ওদিকে মধ্যবিত্ত কড়চায় এক পেগ খুশির দামে চাল, ডাল কিনতে গেল রমেশ শীল; আজ মেয়েটার শবানুগমন!
কুসুমের নগ্ন ঠোঁটে জমেছে সুখ; বেসামাল পুরুষ!
আমি কোন ছার, জমে-থাকা ছাইভস্ম, যেন অচ্ছুৎ...অনাদিকালের অচেনা প্রাণ এক!




ধমকে উঠে কে যেন বলল, ভদ্দরনোক হয়ে থাক; বিলেতি উষ্ণতা মধ্যবিত্তের নয়,
জানিস না, মধ্যবিত্ত কড়চায় জীবনের দরদাম হয় না!
তামাটে কৃষক পলিময় পতিত জমিতে তামাকচাষ করবে, এটাই সভ্য নীতি; তা বাপু গোলাপচাষে মন দাও কেন!




চেয়ে দেখি, বিপন্ন প্রেমিকের ধ্বসে-যাওয়া অস্তিত্বে পা তুলে বসে থাকে কতিপয় স্থূল শকুন;
মহুয়া নারী বলেছিল, জোছনার হাটে দেখা হবে, দু-জনে নিমগ্ন হব, ঘন হয়ে বসে কথা হবে কপালে কপাল ছুঁইয়ে; সুখবসন্তের যে-কটা উৎসব জমা ছিল, তার সব‌ই একটা একটা করে পূর্ণতা পাবে!




কথা রাখেনি নারী; বেসামাল আমি; রমেশ, একটা সেবার বোতল দিয়ে যা!
ভালো থাকতে থাকতে আজ পচে গেছে আত্মা, আর কত ভালো থাকব আমি! ভালো-থাকার ক্লান্তি যে ফুরোয় না আর!
ভৈরবী বাউলের কাছে গচ্ছিত কিছু ভেষজ স্বপ্ন ছিল, ফিরিয়ে এনেছি; উপলে-গরলে এবার তবে কাটাকাটি হয়ে যাক!




শকুনেরা আবার বধূপূর্ণিমা চিনতে শিখল কবে, হ্যাঁ!
কেমন হলো রে, রমেশ? হলুদ বিকেলগুলো যে আজ সূর্যচিতায় জ্বলে; ধূমায়িত পঙ্‌ক্তি হয় পরবাসী!
সব শপথ মনে রাখতে নেই, তুই ভুলে যাস; বলি, আমাকেও ভুলে যা!
মনে রাখিস, একটুকরো সুখ বাকিতে আর কেউ দেবে না, কেউ দেয় না!
বুঝলি রমেশ, কুঞ্জবনে হেম আর মনু ভাঙাগাড়ির পা-দানিতে বসে রোজ কথা কয়; শরীরী সীমানা কেউ ডিঙোয় না, অথচ রক্তস্রোতে প্রণয় ছোটে পাগলাঘোড়ার তালে; শোন, একেই বলে নিষিদ্ধ প্রেমের বিশুদ্ধ বুনন।
অতৃপ্তির এত সুখ...এত সুখ, ভালোবাসার আরেক নাম তবে রেখে দিলাম অতৃপ্তি, কী বলিস!




শীতলক্ষ‍্যা-কন্যা বলছিল, আমার সঙ্গে জলের মতো মিশে যেতে চায়, এ-ই তার দাবি; জলের সঙ্গে জলই মেশে...মানুষ মেশে আর কই! শরীর তো ভাসে!
আর দাবি? মহুয়া নারী জানে না, বৃক্ষের কেবল জীবনদায়‌ই আছে, কোনও দাবি নেই!
আচ্ছা, স্ববিরোধী কথা বললাম নাকি রে?
আসলে দাবির উপলক্ষ্য মানুষের মতো যাপিত জীবন; গৃহবাদী মানুষের যা হয়, বুঝলি!
বিশুদ্ধ সম্পর্কগুলো মূলত স্বকীয় আবরণে গড়ে ওঠে, সেখানে বিমূর্ত দায়বদ্ধতা থাকে শুধু, কোনও দাবি ওতে থাকতে নেই।




কতকাল হলো, চৌকাঠে কপাট এঁটেছে শীতলক্ষ‍্যা-নারী,
মেঘকালো সুখ তবে তোমার জন্য থাক! আমি বরং মৃত বসন্তের আড়ৎ খুলে দেখি, ক'টা অমাবস্যা জমা হলো!
তোমায় ডেকে বলা হয়নি, এত এত বিষণ্ণতা...তবুও নীল-ফাগুনের গল্প শুনি;
চাও তো পুড়িয়ে দিতে পারো তা-ও, আমি বৃষ্টিদিনে ডানা-মেলা চিলের পাশে ফিরে যাব তখন!
তোমাকে নিজের করে আমি কি তোমার হলাম, নারী? না কি আমাকে তুমি কিশোরবেলার মার্থা এবং নিয়ন আলোয় রেখে যেতে চাও!!




তা যেন না হয়, মেয়ে! আমাদের গল্পটা সবুজমাত্রার নিষিদ্ধ সুন্দরের এক ধ্রুপদী গল্প হোক!
হয়তো আমরা কখনও মুখোমুখি মানুষ হব না, হয়তো হতেও পারি;
আমাদের বিন্যাসে গতানুগতিক কিছু না থাক, তোমার মুঠোয় মুঠো ভরে আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে দাঁড়াতে চাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে!
অন্তত পরিযায়ী পাখি না হোক নীলপ্রেম!




হে আমার দারুচিনি দ্বীপ-কন্যা, প্রথম নারী আর কৈশোর ছেড়েছি তোমার জন্য!
এসো আমার গৃহে, কপাটে রেখেছি মেদিনী জোছনা...চৌকাঠ পার হয়ে এসো।