দিদি প্রচুর পড়াশোনা করেন। নানা বিষয়ের উপর পড়তে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। উনি লেখালেখি করলে অনেক অসামান্য কিছু উপহার পেতাম আমরা। কিন্তু উনি লেখেন না। অনেক অনুরোধ করেছি, তবু দিদি লিখবেন না। কেন? লিখতে ভালো লাগে না নাকি! এই পৃথিবীতে যাঁদের লেখালেখি থেকে আমরা অনেক কিছু পেতে পারতাম, তাঁদের অনেকেই লেখেননি। প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের কথা আমরা জানি। ওঁর পকেট থেকে বাংলাদেশে আহমদ ছফা, সরদার ফজলুল করিম, আনিসুজ্জামান, হুমায়ূন আহমেদের মতো অনেক প্রণম্য বরেণ্য বুদ্ধিজীবী বেরিয়ে এসেছেন। আবদুর রাজ্জাকের স্মৃতিকথা নিয়ে রচিত আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটি পড়ে দেখুন। দেখবেন, জ্ঞানতাপস বলতে যা বোঝায়, প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক ছিলেন তার চাইতে অনেক বেশি কিছু। অথচ বাঙালির আফসোস থেকে যাবে যে উনি জীবনে একটিও বই লিখেননি। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর একটি লেখায় আমাদের বলছেন, আবদুর রাজ্জাক তাঁর প্রতিভার পুরোটাই খরচ করেছেন দাবা-খেলার পেছনে। তো গায়ত্রীদিদিও প্রফেসর রাজ্জাকের মতোই একজন জ্ঞানী মানুষ, যিনি জীবনে এখনও পর্যন্ত কিছুই লেখেননি। উনি কিছু লিখলে হয়তো আমি নিজেই এক হাজার কপি কিনে লোকের দরোজায় দরোজায় গিয়ে বইটি দিয়ে আসতাম, পড়তে অনুরোধ করতাম। এখন যাঁরা লেখেন, তাঁদের অনেকেই যে পাঠকের মনে কতটা বিরক্তির উদ্রেক করেন ও মূল্যবান সময় নষ্ট করেন, তা অবশ্য তাঁরা কোনও দিনই বুঝতে চাইবেন না। অবশ্য, ওঁদের বইয়ের পাঠকও আছেন। বাঙালি তো, কী কী যে খেয়ে হজম করে ফেলে, তা নিজেরাই জানে না!
দিদি আমাকে একজনের কথা বলেছিলেন। এলিজাবেথ গিলবার্ট, পেশায় লেখিকা, বয়স ৩৪। তাঁর স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর তিনি পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমেই তিনি চার মাস কাটান ইতালিতে। সেখানে তিনি খাওয়াদাওয়ার মধ্যে জীবনের কিছু সৌন্দর্য খুঁজে পান (Eat)। এরপর তিন মাস কাটান ইন্ডিয়ায়। সেখানে তিনি তাঁর জীবনের বেশ কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান আধ্যাত্মিকতা ও প্রার্থনার চর্চায় (Pray)। তাঁর এই ভ্রমণ শেষ হয় ইন্দোনেশিয়ার বালিতে, যেখানে তিনি আহার ও প্রার্থনার মধ্যে কিছু ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টায় মগ্ন হয়েছিলেন। সেসময় একজন ব্রাজিলিয়ান ব্যবসায়ীর সাথে তাঁর প্রেম হয় এবং আগের সমস্ত নৈরাশ্য ও কষ্ট ঝেড়ে ফেলে তাঁর জীবনের আর-একটি সুন্দর অধ্যায়ের সূচনা হয় ভালোবাসার মধ্য দিয়ে (Love)। এভাবেই রচিত হলো এই দুনিয়ার সবচাইতে বেশি বিক্রি হওয়ার বইয়ের তালিকায় শীর্ষস্থানীয় বইগুলির একটি ‘ইট, প্রে, লাভ’-এর। এই বইয়ের কথা আমাকে প্রথম বলেন গায়ত্রীদিদি।
তিনি সেসময় যা বলেছিলেন, সেগুলিকে নিজের কিছু কথা যোগ করে বলি।…তো সুশ, ওঁর লাইফ হিস্ট্রিটা খুব ইন্টারেস্টিং! ওঁর ডিভোর্স হয়ে যায়। ডিভোর্স হয়ে যাবার পর, উনি প্রথমে অনেক কষ্টে ছিলেন, ভীষণ মন খারাপ ছিল। এরপর উনি পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়ে গেলেন। পৃথিবী ঘুরে উনি দেখলেন, বেঁচে-থাকার কয়েকটা যে আনন্দ, সেগুলির মধ্যে প্রধান একটি হচ্ছে, বেঁচে থাকলে খাওয়া যায় অনেক মজার মজার। হ্যাঁ, অনেক মজার মজার খাবারের স্বাদ নেওয়া যায়। এটা একটা আনন্দ, খাবার খাওয়ার মধ্যে অপার্থিব আনন্দ আছে। এটি অকৃত্রিম, আদি, আন্তরিক। এরপর আর-একটি আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, প্রার্থনা করা। প্রার্থনা মানে কিন্তু ঈশ্বর বা গডের কাছে প্রার্থনা করা, তা কিন্তু না। তুমি যখন লিখো, তুমি যখন গান করো, তুমি যখন ছবি আঁকো, তুমি যখন পড়াশোনা করো, তুমি যখন তোমার প্যাশনের পেছনে সময় দাও, এইগুলি সবই কিন্তু এক-একটা প্রার্থনা বা ইবাদত। সেখানে কোনও ফাঁকি চলে না। প্রার্থনা মানে হচ্ছে, তোমার ভেতরের হৃদয়ের সাথে যোগাযোগ-স্থাপন করা, একটা নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ তৈরি করা তোমার হৃদয়ের সাথে। সে যোগাযোগের মধ্য দিয়েই তোমার হৃদয় তোমার সাথে কথা বলবে, বন্ধুর মতো করে পাশে বসে গল্প করবে। মনে রেখো, যিনি শাস্তি দেন, সে ঈশ্বরের চাইতে যিনি বন্ধুর মতো পাশে বসে গল্প করেন, সে ঈশ্বর অনেক বেশি কাজের। ঈশ্বরের প্রতি ভয় নয়, ভালোবাসা থাক। ভালোবাসার শাসনের চাইতে বড়ো শাসন আর নেই। কাউকে ভয় দেখিয়ে কিছু করতে বারণ করলে সে লুকিয়ে হলেও কাজটা করতে চাইবে। যদি তাকে ভালোবাসা দিয়ে কাজটা করতে বারণ করো, তবে তার হৃদয় ও বিবেক তাকে কাজটা করতে দেবেই না। হৃদয় ও বিবেক তার সাথে সাথে থেকে যায়, এই দুটোকে ফাঁকি দেওয়া যায় না; কিন্তু তোমার চোখের আড়ালে গিয়ে তোমাকে ফাঁকি দেওয়া খুবই সহজ।
প্রার্থনার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এখন তুমি তোমার অন্তর ও আত্মার সাথে যদি সে যোগাযোগটা যে-কোনও কাজ করে তৈরি করতে পারো, সেটাই তোমার জন্য প্রেয়ার বা প্রার্থনা। এটা হতে পারে গান করা, এটা হতে পারে সিনেমা দেখা, এটা হতে পারে নাচ করা, এটা হতে পারে লেখালেখি করা, এটা হতে পারে সেলাই করা, এটা হতে পারে বই পড়া…যা-কিছুই করো তুমি---ছবি আঁকো, রান্না করো, প্রকৃতি দেখো, বিটোফেন - বাখ - মোজার্ট - চপলিন যা মন চায় শোনো, মননশীলতার চর্চা করো…যা-ই করো তুমি, যে-কোনও কিছু তোমার জন্য প্রেয়ার হতে পারে, আর সাথে তোমার নিজের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী নিজের আত্মার শান্তি-স্বস্তির জন্য প্রার্থনা তো আছেই। এই প্রেয়ারটা করার সময় কেউ যদি ফাঁকি দেয়, কারও মন যদি অন্যদিকে থাকে, তবে ওই একটা কথা বলে না… ‘দো দিল বান্দা, কলেমাচোর, না পায় বেহেস্ত, না পায় গোর। অর্থাৎ যে কলেমা পড়ার সময় চুরি করে, যার মন বা দিল দুই দিকে সে কখনও কাফনও পায় না, মাটিও পায় না---কোনও কিছুই সে পায় না। এই কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। ইবাদত করার সময় একদম ধ্যানস্থ হয়ে ইবাদত করতে হবে। কাউকে দেখানোর জন্য নয়, নিজের হৃদয়কে জাগানোর জন্য। এটার একটা আনন্দ আছে। অনির্বচনীয় আনন্দ আছে। (‘দো দিল বান্দা, কলেমাচোর, না পায় বেহেস্ত, না পায় গোর’ নামে আমার একটি লেখা আছে, আমার ওয়েবসাইটে পাবেন। আগ্রহীরা পড়ে নিতে পারেন।)
আরও সহজ করে বলি। ধরুন, আপনি অনেক পড়াশোনা করলেন। পড়াশোনাটা আপনি যে কায়দায় করলেন, সেটি যে কারণেই হোক, সফল হয়নি। আপনি অনেক মন দিয়ে রান্না করলেন। হঠাৎ করে, রান্নার শেষ পর্যায়ে গিয়ে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য রান্নাটা নষ্ট হয়ে গেল। আমি যদি খুবই সাদামাটাভাবে বলি, অনেক চমৎকারভাবে রান্না করার পর হঠাৎ করে তেলাপোকা উড়ে এসে পড়ল রান্নাকরা খাবারে, এটাতে কিন্তু আপনার কোনও হাত ছিল না। আপনি তো আপনার কাজে কোনও ফাঁকি দেননি। আপনি আপনার ইবাদতের মধ্যে সৎ ছিলেন। আপনি দেখবেন, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা আপনাকে তেমন একটা কষ্ট দেবে না। কিন্তু ধরুন, তেলাপোকা উড়ে এসে পড়েনি, আপনি আপনার রান্নার প্রতি আন্তরিক ছিলেন না, ফলে রান্নাটা খেতে বাজে হয়েছে, এটা আপনি মেনেই নিতে পারবেন না, এটা আপনাকে অনেক কষ্ট দেবে। নিজের কথাই বলি। আমি প্রায় সময়ই বলি, আমার যদি চাকরিটা না-ও হতো, আমি একটুও কষ্ট পেতাম না। কেন পেতাম না? কেননা, আমি আমার পড়াশোনায় কোনও ফাঁকি দিইনি। আমার চেষ্টায় একচুল পরিমাণও গলদ ছিল না। একজন মানুষের পক্ষে সর্বোচ্চ যতটুকু পরিশ্রম করা সম্ভব, তার সবটুকুই আমি করেছি। যত কৌশল নিয়ে ভাবা সম্ভব ছিল আমার পক্ষে, তার সবটাই ভেবেছি। নিজেকে বা নিজের পড়াশোনাকে একমুহূর্তের জন্যও অবহেলা করেছি, এমন কোনও স্মৃতি আমার নেই। আমার সাধ্যের মধ্যে আমার পক্ষে এর চাইতে বেশি পড়াশোনা করা অসম্ভব ছিল।
এককথায়, আমার ইবাদতে কোনও ফাঁকি ছিল না। আমার নিয়ত ঠিক ছিল, আমার চলার রাস্তাটা পুরোপুরি সৎ ও আন্তরিক ছিল। এরপরও যদি আমার চাকরি না হতো, তবে আমি ধরে নিতাম, ইবাদতটা সফল হয়নি, কেননা আসলে ওটা আমার নিয়তিতে ছিল না। অনেক সময় নিয়ত ঠিক থাকলেও আপনার নিয়তিতে যদি না থাকে, তবে সেখানে আপনি কখনওই পৌঁছতে পারবেন না। আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন, আপনার নিয়তিতে যদি না থাকে, তবে আপনি সেখানে পৌঁছতে পারবেন না। আর যার নিয়তিতে আছে কোনও কিছু, তা সে চেষ্টা না করলেও ঠিকই পেয়ে যায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, কেউ কেউ এমন অনেক কিছুই পেয়ে গেছেন, যেটার জন্য তিনি চেষ্টাই করেননি, তাঁর চেষ্টা ছিল অন্য কিছু নিয়ে। আমার নিজের কথাই যদি ধরি, তবে বলতে পারি, সিভিল সার্ভিসে আসব, এটা আমি সারাজীবনে কখনও ভাবিনি। কিন্তু এটাই আমার নিয়তি ছিল, তাই মনের মধ্যে কখনও এই স্বপ্নকে আশ্রয় বা প্রশ্রয় না দিলেও আমি জীবনে এটাই পেয়েছি। আমি অন্য কিছু হওয়ার চেষ্টা করলেও তার কোনওটিই হতে পারিনি, কেননা সেগুলির একটিও আমার নিয়তিতে লেখা ছিল না।
নিয়ত ঠিক রাখাটা খুব জরুরি। ইবাদতে বা প্রার্থনায় কোনও ফাঁকি দেওয়া যাবে না। যেই কাজটাই করি না কেন, ঠিকমতো করতে হবে। যত কষ্টই হোক, করতে হবে। এবং, কষ্ট ভোগ করা ছাড়া কোনও ইবাদত হয় না। যে ইবাদতে আপনার কষ্ট হয়নি, আপনি ধরে নিতে পারেন, আপনার ইবাদতটাই হয়নি। আমি এটা খুব ফলো করি, খুব প্র্যাকটিস করি। যদি কোনও কিছু করার সময় আমার মনে হয়, আমার কষ্ট হচ্ছে না, তখন আমি বুঝে নিই, এখানে কোনও একটা ফাঁকি হচ্ছে, প্রার্থনায় কোনও একটা ভুল হচ্ছে। আমার কাজটা হচ্ছেই না। প্রার্থনায় কষ্ট হবে, সে কষ্টটা মেনে নিতে হবে, মেনে নিতে না চাইলে প্রার্থনার কোনও ফল আশা করাটাই বোকামি। তো এটাই হচ্ছে প্রার্থনা বা ইবাদত। তৃতীয়টি হচ্ছে লাভ বা ভালোবাসা। এটি পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কেমন গুরুত্বপূর্ণ? ভেঙে বলি। ধরুন, আপনি কাউকে ভালোবাসেন, সে মানুষটির ভালো চান। এর বিনিময়ে আপনি যদি কোনও পার্থিব লাভ বা প্রাপ্তি না-ও পান, তা-ও মানুষকে ভালোবাসার কারণে আপনার মধ্যে যে শক্তি, যে আনন্দ তৈরি হবে, যে একটা সুখের ফোয়ারা তৈরি হবে, তা আপনাকে অনেক সুন্দর করে বাঁচতে সাহায্য করে। এটা আপনাকে অনেক সুখী থাকতে সাহায্য করে, এটা আপনাকে হাসতে সাহায্য করে। ভালোবাসা এই পৃথিবীর সুন্দরতম অনুভূতি। এটা কিন্তু বোঝার জিনিস, যেমন আমরা যদি বলি, গরিব মানুষকে কেন ভালোবাসব? কেন পশুদের ভালোবাসব? ইত্যাদি ইত্যাদি…তবে সেটি কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
ধরুন, আপনি কাউকে অনেক ভালোবেসে কোনও কিছু দিলেন, ভালোবেসে কারও জন্য কিছু একটা করলেন---সে আপনার বন্ধু, কাছের কেউ, অচেনা কেউ, যে-ই হোক, এখন যদি সে কাজটির মূল্যায়ন না-ও করে, তা-ও কাজটা করে আপনি যে একটা শান্তি পেলেন, এটা কি সে পেয়েছে, আপনি যার জন্য এটা করলেন? পায়নি কিন্তু! শান্তিটা পেয়েছেন আপনি নিজে। আপনি একাই ওই শান্তির ভাগীদার। এখন ফিরে আসি এলিজাবেথ গিলবার্টের গল্পে। এই লেখিকা ভদ্রমহিলা যখন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখলেন, ওঁর প্রথম অনুভূতি ছিল, পৃথিবীর সব মানুষই মূলত একই রকমের, পৃথিবীর সব মানুষের চাওয়া-পাওয়া প্রায় এক। ওদের ভাষা ভিন্ন, ওদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন, ওদের জীবনের আচার-বিশ্বাস-আচরণগুলি ভিন্ন, ওদের খাদ্যাভ্যাস ভিন্ন, ওদের পোশাক ভিন্ন, ওদের চেহারাও ভিন্ন। কিন্তু ওদের চিন্তাভাবনা, চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখের অনুভূতি সর্বজনীন। একেবারেই একই রকমের। তখন উনি আর-একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করলেন, যে মানুষকেই যখন আমরা ভালোবাসি, তখন আফ্রিকার কাউকে ভালোবাসলে আমাদের মধ্যে যে অনুভূতি হবে, আমি যদি ইউরোপিয়ান কাউকে ভালোবাসি, ভিন্ন কোনও অনুভূতি হবে না। এই ভালোবাসার, প্রেমে-পড়ার অনুভূতিটা সব জায়গায়ই মোটামুটি একই রকমের।
এই যে আমরা খাই, এই খাওয়ার যে তৃপ্তি, তার অনুভূতিটাও একই রকমের। ভেতরে যে শান্তি, যে অভিজ্ঞতা পেলাম, একটা খাবারের অভিজ্ঞতা পেলাম, একটা খাবারের স্বাদ পেলাম---এর যে আনন্দ, যে অনুভূতি, সেটা মোটামুটি একই রকমের, যে-কোনও দেশের খাবারই খাই না কেন! আর প্রার্থনার অনুভূতি তো অবশ্যই অতিঅবশ্যই একই রকমের। পৃথিবীতে যতগুলি উপাসনালয় আছে, প্রত্যেকটা উপাসনালয়ে গিয়ে যারা উপাসনা করে, প্রত্যেকেরই মনের খবর একই, মনের ইচ্ছে (বা নিয়ত) একই, মনের প্রাপ্তিও একই। এমনকি যারা উপসনালয়ে যায় না, তারাও যে বাসায় থেকে প্রার্থনা করে, এই বাসায় বসে করা উপাসনা---নামাজ, প্রার্থনা, আহ্নিক, পূজা যে নামেই ডাকুন না কেন, প্রত্যেক প্রেয়ারের আউটপুট কিন্তু একই। এই যেমন ধরুন, আপনি যেমনি আন্তরিকভাবে রান্না করে ভালো কিছু একটা রান্না করলেন, তেমনি আপনার বন্ধুটা গবেষণায় মগ্ন থেকে, অর্থাৎ একটা বিষয় নিয়ে ইবাদত করে ভালো কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেললেন, দুইজনের আউটপুট কিন্তু একই প্রকৃতির। আর ভালোবাসা,---আপনি যখন কাউকে ভালোবাসেন, তখন আপনার ভেতরের যে অনুভূতিটা, যে আনন্দটা, তা সবার ক্ষেত্রেই কম-বেশি একই রকমের। আহার, প্রার্থনা, ভালোবাসা---এই তিনটা ব্যাপার হচ্ছে সর্বজনীন অনুভূতিপ্রদায়ী। বইটিতে এসব নিয়েই বলা আছে, তাই বইটির নাম ‘ইট, প্রে, লাভ’। গায়ত্রী তালরেজা প্রায়ই বলতেন, তুমি তোমার জীবনটা যদি এই তিনটা জিনিস দিয়ে কাটিয়ে দিতে পারো, তখন দেখবে, জীবনটা অনেক সহজভাবে কাটবে, সুন্দরভাবে কাটবে। এই তিন অনুভূতির ঘরে যারা ফাঁকি দেয়, তারা একটা নিরর্থক জীবন কাটায়।
দিদির কাছ থেকে আমি যা শিখেছি, তার শতকরা দশভাগও লিখে বোঝাতে পারব না। তবে আমার ‘অস্পষ্ট জার্নাল’ সিরিজটার অনেক লেখাই ওঁর কাছ থেকে শেখা জীবনশিক্ষাগুলি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। আগ্রহীরা ওই সিরিজটা পড়তে পারেন। দিদির কাছে আমার অসীম ঋণ। সত্যিই অসীম ঋণ, যা কোনও কিছুর বিনিময়ে শোধ করা যাবে না। উনি আমাকে আর-একটা জিনিস শিখিয়েছেন, সেটা হলো, ‘তুমি যদি কখনও বিশ্বভ্রমণ করো, তবে তুমি অবাক হয়ে যাবে এটা দেখে যে, পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষই সংখ্যায় বেশি।’ আমি বললাম, ‘কী বলো তুমি, দিদি! আজব কথা বলছ! পৃথিবীতে খারাপ লোকের সংখ্যা বেশি না?’ উনি বললেন, ‘না। পৃথিবীতে খারাপ লোক বেশি হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত বহু আগেই। পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত তেমন মানুষের সংখ্যা বেশি, যারা কোনও মানুষের ক্ষতি চায় না, যারা কোনও মানুষের অমঙ্গল চায় না। তবে তোমার কোনও কাজ, তোমার কোনও কথা, তোমার কোনও আচরণ যদি কারও জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, তখন সে যেটা করবে, সেটা তোমার ভালো না-ও লাগতে পারে। তখন তুমি তাকে খারাপ মনে করবে। কিন্তু তোমার কাজ যে তাকে বিরক্ত করছে, সেটা তোমার আগে মাথায় রাখা উচিত। এটা আমরা আগে মাথায় রাখতে পারি না সাধারণত। আমরা মনে করি, সে কেন আমার সাথে এমন করছে? আমার কিন্তু একই সঙ্গে মাথায় রাখা উচিত, আমি যেটা করছি তার সাথে, সেটা আমি কী করছি! এটা কিন্তু অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। মাথায় না রাখলে সে যা করবে আমার সাথে, তা আমার প্রাপ্য।’
আমাকে উনি এসব বলতেন। ওঁর লেসনগুলি শেয়ার করতে গেলে সারাদিন চলে যাবে, সারারাত চলে যাবে, তা-ও ফুরোবে না। ওঁর যে একজনের সাথে রিলেশন ছিল, ওঁর নাম ছিল রাজেশ কাপুর। উনি ডাকতেন আরকে নামে। তো আমি একদিন বললাম, ‘এই যে আরকে, তাঁকে তুমি বিট্রে করেছ, তিনি তারপরও তোমার সম্পর্কে এত ভালো বলে কেন?’ তিনি এটা শুনে লিখলেন, ‘লল!’ তারপর লিখলেন, ‘হা হা হা…’ উনি আমাকে বললেন কী দেখুন---‘সুশ, তার সাথে যে আমার প্রেমটা ছিল, সেই প্রেম ছিল মূলত বন্ধুত্ব। আমাদের সমাজের প্রেমগুলি যতটা বন্ধুত্ব, তার চেয়েও অনেক বেশি প্রেম। এ কারণেই প্রেমগুলি টিকে না এবং প্রেমগুলি যখন ভাঙে, তখন ওরা একে অপরকে ব্লেইম করতে থাকে, আর নিজেরা কষ্ট পায়। তুমি দেখো, তুমি যখন কাউকে ব্লেইম করো, তখন তার যতটা ক্ষতি, তোমার ক্ষতি তার থেকে অনেক অনেক বেশি।’ আমি বললাম, ‘কীরকম?’
উনি বলে গেলেন, ‘তোমার মনে হয়, তুমি ওকে ব্লেইম করে করে শান্তি পাচ্ছ, তাই না? তুমি কখনও কাউকে ব্লেইম না করে একবার ক্ষমা করে দিয়ে দেখো তো কেমন লাগে! তুমি যার সম্পর্কে খারাপ বলতে পছন্দ করো, তার সম্পর্কে ১ ঘণ্টা ভালো বলে দেখো তো কেমন লাগে! খুব কঠিন কাজটা। যদি কাজটা একবার করতে পারো, তবে তুমি ওই শক্তিটা অর্জন করবে। ওই শক্তিটা যদি অর্জন করো, তাহলে তোমার সঙ্গে কেউ এমন কিছু করতে পারবে না, যে কাজের জন্য তুমি পরবর্তীতে তাকে ব্লেইম করতে পারবে। তুমি একবার প্র্যাকটিস করে দেখোই না! মজার কিন্তু! তো রাজেশ আমার সম্পর্কে কেন ভালো বলবে না, বলো? আমি তাকে বিয়ে করতে পারিনি, আমার ফ্যামিলি বিয়েটা হতে দেয়নি বলে। আমাদের কপালে লেখা ছিল না আজীবন একসাথে থাকাটা। এখন আমি যাকে পেয়েছি লাইফ-পার্টনার হিসেবে, তার মাথায় চুল নেই, সে দেখতে রাজেশের মতো সুন্দরও না, কিন্তু তার মনে অনেক কিছু আছে। সে অনেক বড়ো মনের একজন মানুষ। সে আমাকে ভালোবাসে, আমাকে ভালো রাখার সব চেষ্টা সে করে। আমার হাসি তার কাছে অনেক দামি। সে একজন সৎ ও পরোপকারী মানুষ। মানবিকতার সমস্ত গুণই ওর মধ্যে আছে। সে রাজেশের সম্পর্কে সবকিছুই জানে। রাজেশও তার সম্পর্কে সবকিছু জানে এবং তারা ভালো বন্ধু। রাজেশ আমাদের ফ্যামিলি-ফ্রেন্ড। রাজেশের স্ত্রী আমার খুব ভালো বন্ধু। রাজেশের স্ত্রীও আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানে। আমি ইন্ডিয়া থাকতে আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল, আমাদের দেখা হতো, সবই জানে সে।’
কিন্তু আমরা, মানে আমি ও রাজেশ সব সময় মনে করি, এই যে আমরা পার্কে একসাথে বসে থাকতাম, এই যে আমরা ঘুরতে যেতাম, এই যে আমরা একসাথে খাওয়াদাওয়া করতাম, এই যে আমরা একসাথে সময় কাটাতাম, এই যে আমরা একসাথে নিজেদের মধ্যে হারিয়ে যেতাম, এই যে আমরা কষ্ট আর কান্নাগুলি শেয়ার করতাম, এই যে আমরা আনন্দগুলি খুলে বলতাম পরস্পরকে, ওখানে যে একটা আনন্দ ছিল, এই আনন্দটাই হচ্ছে আমাদের প্রাপ্তি। আমাদের পুরনো যত সুখ, সেগুলি আমরা পেয়েছি আমাদের দেখা হয়েছিল বলেই, নয়তো জীবনে ওই মুহূর্তগুলি তো আসত না, সেই ছোটো ছোটো সুখগুলিও পাওয়া হতো না। ধরো, যদি আমাদের ব্রেকআপের কিছু সময় আগে বা পরে আমাদের দুজনের যে কেউই মারা যেতাম, তবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার সময় কিছু সুখের স্মৃতি সাথে নিয়ে যেতাম। যদি আমাদের দেখা না হতো, তবে আমরা এইসব দারুণ স্মৃতিরত্ন কোথায় পেতাম? একসাথে থাকতে পারলাম না বলেই কি একসাথে যখন ছিলাম, তখনকার শান্তি, সুখ আর স্বস্তিগুলিকে উপেক্ষা করে, অস্বীকার করে, বিস্মৃত হয়ে বাঁচতে হবে হবে? এমন বিস্মৃতিপরায়ণতা জীবনে কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। এটা অকৃতজ্ঞতা---নিজের প্রতি, তোমার স্রষ্টার প্রতি।’
তুমি যতদিন একটা মানুষের সাথে থাকবে, ততদিন ওই মানুষটার সাথে তোমার সুখের যে স্মৃতিগুলি, ওটাই হচ্ছে তোমার প্রাপ্তি। তুমি যদি এটাকে খারাপ বলতে থাকো, তাহলে এটা হচ্ছে একধরনের নিজের হৃদয়ের সাথে বেইমানি করা। হৃদয় সাক্ষ্য দেবে, তুমি মিথ্যা বলছ, কারণ তার সঙ্গে তো তোমার কিছু সুখের স্মৃতি ছিল, তাই না? রাজেশ এবং আমি আমাদের অতীতের সুখগুলির কথা স্মরণ করি বেশি। কষ্টগুলির চাইতে বরং সুখগুলিই বেশি স্মরণ করি।’ আমি দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তো যখন তুমি সুখগুলির কথা স্মরণ করো, তখন তো তোমার খারাপ লাগে, লাগে না? মনে হয় না, তোমার কলজের একটা অংশ কোথায় যে ফেলে এলে! বুকের ভেতর থেকে মোচড় দিয়ে কান্না পায় না?’ দিদি উত্তর দিলেন, ‘ওই যে খারাপ তো লাগেই, তখন আবার একই সঙ্গে ভাবতে হয়, এই পৃথিবীতে কিছু বিষয় থাকে, যেগুলির উপর আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সেগুলি নিয়ে সারাদিন ভাবলেও-বা কী হবে, কিছু কষ্ট পাওয়া বাদে? যে জিনিসগুলির উপর তোমার নিয়ন্ত্রণ নেই, সে জিনিসগুলি নিয়ে কক্ষনো বেশি ভাববে না। একটা মজার জিনিস শোনো। মানুষ সব থেকে বেশি কষ্ট পায় কেন, জানো?’ আমি বললাম, ‘কেন?’
দিদি বললেন, ‘সে যা যা করতে পারছে, তার জন্য সে কষ্ট পায় না, সে যা যা করতে পারেনি, সেগুলি নিয়ে ভাবে, এইজন্য সে বেশি কষ্ট পায়। সে যা যা করতে পারছে, তা নিয়ে ভাবলে সে এত বেশি কষ্ট পেত না। মানুষ বাস্তবের চেয়ে অবাস্তবে ডুবে থাকে বেশি, তাই কষ্ট পায়। যার উচ্চতা ছয় ফুট নয়, সে কষ্ট পায় এই ভেবে, কেন আরও একটু লম্বা হলাম না? অথচ সে চেষ্টা করেও তার উচ্চতা আরও পাঁচ ইঞ্চি বাড়াতে পারবে না। এই ব্যাপারটার জন্য কষ্টে কষ্টে নিজের মাথার সমস্ত চুল ছিঁড়ে ফেললেও কী লাভ, বলো? মানুষ তার কৃতকর্মের জন্য যত না কষ্ট পায়, তার চাইতে বেশি কষ্ট পায় তার অকৃতকর্মের জন্য। সে যে সমস্ত ভুল করছে, সেগুলির জন্য কষ্ট পায় না, সে বেশি কষ্ট পায় যে সমস্ত ভুল সে করতে পারেনি, সেগুলির জন্য।’ ‘দিদি, আমাকে একটু ব্যাখ্যা করে বলো।’ ‘দেখো, আমার সাথে যে রাজেশের মিলনটা যে হয়নি, এখানে তারও কোনও হাত ছিল না, আমারও কোনও হাত ছিল না। আমাদের ইচ্ছা ও আন্তরিকতা ছিল পুরোমাত্রায়, কিন্তু উই ওয়্যার নট মেইড ফর ইচ আদার। আমরা একে অপরের জন্য পৃথিবীতে আসিনি, এবং এটা আগে থেকে ঠিক করা ছিল। নিয়তিকে আমরা কখনও বদলাতে পারি না। এটা আগে থেকে সত্যিই নির্ধারিত ছিল যে আমরা পরস্পরের জন্য নই। তাহলে বলতে পারো, আমরা যে এতটা সময় কাটালাম, এতো সুখের সময় কাটালাম, এতো এতো স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিলাম, ওসবের মানে কী? আসলে কী জানো, এটাও আমাদের নিয়তি। এটাও আমাদের কপালে লেখা ছিল।’
আমাদের দুজনের দেখা হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে। প্রেম হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে। তুমি একটু ভেবে দেখো, ওই সময় যদি রাজেশ আমার লাইফে না আসত, তো ওই সময় কিন্তু আমার লাইফে মহেশ ছিল না, ছিল? তাহলে আমার লাইফে এমন কেউ আসতে পারত, যে আমার অনেক বড়ো ক্ষতি করে ফেলতে পারত! কী, আসতে পারত না? কিংবা রাজেশ যদি আমার ক্ষতিও করত, তাও ভালো ছিল।’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীরকম ভালো?’ উনি বললেন, ‘সেক্ষেত্রে ওর সাথে আমার ব্রেকআপ হওয়ার মানে হলো, আমার বাকি জীবনটার জন্য আমি সেইফ হয়ে গেলাম। আমার যা গেছে, তা অল্পের মধ্য দিয়েই গেছে। কিছুদিনের জন্য আমাকে খারাপ কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সারাজীবন আমার সে খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে না। একজন খারাপ বা ভুল লোকের সাথে সারাজীবন থাকার চাইতে অল্প কিছু সময়ের জন্য থাকা অনেক ভালো। আমাদের সাথে যা-ই হয়, তার মধ্যে অনেক মঙ্গল লুকিয়ে আছে, এটা মাথায় রাখতে হবে সব সময়ই। আর রাজেশ আমার জীবনে যে এসেছিল, সেটা আমার জন্য খারাপ কিছু ছিল না। ওই সময়টাতে আমি অনেক একাকী অনুভব করতাম। ওই সময়টাতে আমার নিজের অনেক ধরনের সমস্যা চলছিল। আমার কষ্টের কথাগুলি শেয়ার করার মত তেমন কেউ ছিল না। রাজেশের কাছে শেয়ার করতাম এবং রাজেশ আমাকে একধরনের গুড-ফিলিং দিত। সে আমাকে সব সময় বলত, তুমি ভালো কিছু করবে, ভালো থাকবে। আমি আছি তোমার পাশে।
তুমি চিন্তা করে দেখো, ওর সাথে আমার যে রিলেশন ছিল, সেই রিলেশন থেকে আমি ভালো কিছুই পেয়েছি, খারাপ কিছু পাইনি। ওই সময়ে আমার যে একটা মেন্টাল সাপোর্ট দরকার ছিল, তা পেয়েছি। অনেক বিষণ্ণতার মধ্যে ছিলাম, সেটা কেটে গেছে, আমি আমার কাজগুলি গুছিয়ে করতে পেরেছি। তার বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। আমরা একে অপরের জন্য ব্লেসিং ছিলাম। তবে কেন ওকে ব্লেইম করব আমি? কেন সেটা থেকে কষ্ট পাব, বলো তো? মানুষের জীবনে অনেকগুলি পর্যায় থাকে। একটা পর্যায়ের সাথে আর-একটা পর্যায় কখনও মিলানো যাবে না। প্রত্যেকটা পর্যায়ের নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে। তুমি যখন শিশু ছিলে, তখনকার একটা বিউটি ছিল, তুমি যখন কিশোর হয়েছ, তখনকার একটা বিউটি তুমি পেয়েছ; তারুণ্যের একটা বিউটি, যৌবনের একটা বিউটি, মধ্যবয়সের একটা বিউটি, বার্ধক্যের একটা বিউটি---এরকম প্রত্যেকটা বিউটিই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটা বিউটিকে ফিল করতে হয়। তুমি যদি একটা বিউটি ফিল করার সময় আর-একটা বিউটি নিয়ে আফসোস করো, তাহলে তুমি যে ফিলিং-এ সেই মুহূর্তে আছ, সে ফিলিংটা তুমি পাবে না। মাঝখান থেকে পুরো ক্ষতিটাই তোমার, ওতে কারও কিছু এসে যাবে না। এই পৃথিবীর আনন্দযজ্ঞ থেকে তুমি যদি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখো, তবে ওতে কারও কিচ্ছু এসে যায় না, পুরো অপ্রাপ্তিটুকুই তোমার একার।’
এখন আমি যদি রাজেশের কথা ভেবে ভেবে অনুশোচনা করি, আমি কেন তাকে পেলাম না, আমি কেন তাকে ছেড়ে আছি, সে কেন আমার নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি, তাহলে হবে কী, আমি এখন নিজেই অশান্তিতে থাকব। আমার বর্তমানে যে স্বামী আছে, তাকে অশান্তিতে রাখব বিনা কারণেই, আমার সন্তানকে অশান্তিতে রাখব, আমার কাজে ভুল হবে, আমি কোনও কাজে আনন্দ পাব না এবং মাঝখান থেকে যেটা হবে, এই যে আমি বেঁচে আছি, এটাকে আমি অনুভব করতে পারব না, এটাকে আমি উপভোগ করতে পারব না এবং এটা হচ্ছে একধরনের ডেডলি সিন। সিন কেন? সিন হচ্ছে এইজন্য, তুমি যে বেঁচে আছ, তোমাকে এই বাঁচিয়ে রাখাটা ঈশ্বরের জন্য বাধ্যতামূলক কিছু না। তোমাকে মেরে ফেললেও কিছুই হবে না। পৃথিবীতে তোমার চাইতে অনেক অনেক ভালো ভালো মানুষ মারা গিয়েছেন, তোমার চেয়েও অনেক অল্প বয়সে, তাই না? আচ্ছা, ধরো, তুমি তো ভাবো তুমি লিখো, ভালো লিখো। তোমার চেয়ে অনেক অনেক বেশিই ভালো লিখে, এমন অনেক মানুষ তোমার অর্ধেক বয়সে মারা গিয়েছে, যায়নি? তুমি এমন অপরিহার্য কে যে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে ঈশ্বরের? বরং ওদের বাঁচিয়ে রাখলে এই পৃথিবী আরও বেশি কিছু পেত ওদের কাজের মাধ্যমে।’
আমি বলতে পারি, আমি অনেক কিছু অ্যাচিভ করেছি, আমার অনেক বড়ো বড়ো ডিগ্রি আছে, আমার এই আছে সেই আছে, সত্যি বলতে কী, এগুলি আসলে কিছুই না। আমার চাইতে অনেক শিক্ষিত মানুষ, অনেক যোগ্য ও মেধাবী মানুষ, অনেক সফল মানুষ, অনেক ভালো মানুষ অনেক অল্প বয়সে মারা গিয়েছে। তারা পৃথিবীতে থাকলে, পৃথিবী অনেক কিছু পেত, তারা পৃথিবীকে অনেক কিছু দিতে পারত, সেটা তো হয়নি। ঠিক না? তবে আমি কেন বেঁচে আছি, যদি ওরা চলে যায়? মনে রেখো, তোমাকে যে বাঁচিয়ে রাখছেন ঈশ্বর, এটার প্রতি গ্রেটফুল থাকা উচিত। এটার জন্য গ্র্যাটিটিউড তোমার থাকা উচিত। তুমি যদি সব সময়ই ব্লেইম করো, তুমি যদি সবসময় রিগ্রেট করো, তাহলে ঈশ্বর মনে মনে বলবেন, একে যে বাঁচিয়ে রাখছি, আমার এতে কী বাড়তি লাভ হলো! মনে রেখো, তুমি এই পৃথিবীর জন্য অপরিহার্য কেউ না। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ এ নয় যে তুমি বেঁচে থাকার মতোই একজন মানুষ। এটা স্রেফ প্রকৃতির একটা খেয়াল বা অনুগ্রহ, তোমার জন্য একটা বোনাস বা উপহার। তোমার আয়ু তোমার জন্য একটা গিফট বাদে আর কিছুই না।’
এখন আমি বুঝি, এখানে ঈশ্বর বলতে দিদি ঈশ্বর বোঝাননি। ঈশ্বর কোনও ব্যক্তি নন, ঈশ্বর কোন সত্তাও নন। ঈশ্বর হচ্ছেন আমাদের ভেতরের ঈশ্বর। এই যে আমি রিগ্রেট করছি---তা যে কারণেই হোক না কেন, এরকম রিগ্রেট করে করে আমাদের ভেতর একটা নেগেটিভ মেসেজ বা ভাইব বা সিগনাল যাচ্ছে, সেটা আমরা জীবনীশক্তিকে আস্তে আস্তে কমিয়ে দেয়, সেটা আমাদের বেঁচে-থাকার ইচ্ছাকে কমিয়ে দেয়, সেটা আমাদের কাজ করার ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়, সেটা আমাদের চিন্তাভাবনা করার যে শক্তি, সেটাকে কমিয়ে দেয়। আমি মানুষটা নিজে ভালো না থাকলে আমি কী করে ভালো উপায়ে ভাবব! আমি মানসিকভাবে ভালো না থাকলে আমি কী করে ভালো চিন্তা করব! তাই না? নিজের হাতেই নিজের মনের শক্তি কমিয়ে দেওয়ার ফলে আমি ক্রমেই সাধারণ একজন মানুষ হয়ে যাই, আমি জীবনে বলার মতো কিছুই অ্যাচিভ করতে পারি না। তখন আমরা বলি কী, ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন! আসলে শাস্তিটা আমরা নিজেরাই আমাদের দিচ্ছি। এইজন্য আমরা বর্তমান সময়ে যেভাবে বেঁচে আছি, এটার প্রতি আমাদের থ্যাংকফুল থাকা উচিত, গ্রেটফুল থাকা উচিত। এটাকে উপভোগ করা উচিত। উপভোগ করলে, আমাদের ভেতরে একটা ভালো মেসেজ বা ভাইব বা সিগনাল যাবে, আমাদের ভেতরে একটা আনন্দের অনুভূতি তৈরি হবে। এই আনন্দের অনুভূতি, এই ভালো মেসেজ আমাদের ভালো করে বাঁচতে সাহায্য করবে। আমাদের কালকের দিনটা আরও সুন্দর হয়ে আমাদের জীবনে আসবে, আরও ইফেক্টিভলি আমাদের বাঁচতে সাহায্য করবে।
আচ্ছা, ঈশ্বর, ভগবান, গড এসব কী আসলে? আমরা যে মানুষকে সাহায্য করি, বলি কী, আল্লাহ্ আমার ভালো করবেন, ঈশ্বর আমার মঙ্গল করবেন,…আসলে ব্যাপারটা কী? কারও ভালো করলে নিজের মধ্যে একটা ভালো অনুভূতি তৈরি হয়। এই ভালো অনুভূতির ফলে নিজের মধ্যে আপনাআপনিই একটা ভালো শক্তি (পজিটিভ এনার্জি) তৈরি হয়। আমরা তখন আমার কাজগুলি একটু কনফিডেন্টলি করতে পারি। আমার যে বন্ধুটা এই সাহায্যটা করে না, তার মধ্যে এই কনফিডেন্স গ্রো করবে না, তার মধ্যে মনের সেই শক্তিটা তৈরি হয় না। যার ফলে, যদি আমরা সমপর্যায়ের যোগ্যতা ও ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকি, তবে তার চেয়ে আমার কাজের মানটা ভালো হয়। এ সবই হচ্ছে মনের একটা খেলা, মনের শক্তিকে জাগিয়ে তোলার উপায়। যার মনের শক্তি যত বেশি, সে তত বেশি এগিয়ে। আমরা বলি কী, ঈশ্বর আমাকে পুণ্য দিয়েছেন, ঈশ্বর আমাকে আশীর্বাদ করেছেন। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, ঈশ্বর নন, আমি নিজেই আমাকে আশীর্বাদ করেছি। আমি কৌশলে আমার ভেতরটাকে জাগাতে পেরেছি। ধর্মের মূল কাজই হচ্ছে ভেতরটাকে জাগানো। যে ব্যক্তি নিজের ভেতরটাকে জাগাতে পারে না, ধর্মাচরণ তার উপর কোনও প্রভাবই ফেলতে পারে না। যে মানুষ তার চৈতন্যকে, তার ভেতরটাকে যত বেশি জাগাতে পারবে, সে মানুষ তত ভালো থাকে, তত বেশি সফল হয়।
জীবনে সফলতার চাইতে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে সার্থকতা। যার হৃদয় যত বেশি জাগ্রত, সে মানুষটা তত বেশি সার্থক। আমি অনেক সার্থক মানুষকে দেখেছি, যারা ব্যাক্তিগত জীবনে হয়তো তেমন সফল নয়। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, একজন মানুষ রাস্তায় কুলির কাজ করে। তো তার জীবনে আর্থিক সাফল্য বলি, আর জাগতিক সাফল্যই বলি, এসবের কিছুই নেই। সে পড়াশোনা জানে না, দুনিয়ার কোনও কিছুই তেমন জানে না। সে চট্টগ্রাম পোর্টের ভেতর কুলির কাজ করে, মানে মালামাল ওঠানামার কাজ করেই তার পেট চলে। ওই লোকটা একদিন দুপুরবেলা খাবার নিয়ে এসেছে। তো ভাত নিয়ে সে মাত্রই খেতে বসল, তখন সে দেখে কী পাশে একটা ছেলে কান্না করছে। সে ছেলেটাকে বলে, কী রে, তুই কাঁদিস কেন? সে ছেলে বলছে, আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমার খেতে ইচ্ছে করছে। আমি একটু দূর থেকে ঘটনাটি দেখি, বোধহয় এরকমই কিছু একটা বলছিল সে। তখন সেই কুলি বলে, তুই এদিকে আয়। ছেলেটা কাছে এলে তখন সে খাবারটা তার সাথে ভাগ করে খেল। তার চোখে মুখে যে খুশির ঝিলিক খেলা করছিল তখন, তা যে-কোন সংবেদনশীল মানুষকেই স্পর্শ করবে। অথচ সে নিজেই ছিল অনেক ক্ষুধার্ত, গায়ে গতরে ওরকম মাল বহন করার শ্রম দেয় যারা, ওদের অনেক বেশিই পরিশ্রম হয়, ক্ষুধাও পায়। এমন খুশি, এমন সুখ, এমন তৃপ্তি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ, যোগ্যতা, বুদ্ধি দিয়েও কেনা যায় না, এটা হৃদয়ের ঐশ্বর্য দিয়ে অর্জন করে নিতে হয়, সবাই তা করতে পারে না। তাই চেষ্টা করে মানুষ সফল ঠিকই হতে পারে, কিন্তু সার্থক হতে পারে না।
এই লোকটা কিন্তু জীবনে সফল না হলেও সার্থক। সে বেঁচে-থাকার আনন্দটা খুঁজে পেয়েছে। এই লোকটার মনে যে আনন্দ তৈরি হয়েছে, ওই আনন্দকে ধারণ করে সে আরও চারবেলা আধপেটা খেলেও ওর কিছু হবে না। পৃথিবীর প্রত্যেকটা তৃপ্তি আমাদের মধ্যে একধরনের শক্তি তৈরি করে, আমাদের মধ্যে একধরনের ক্ষমতা তৈরি করে। এই ক্ষমতা আমাদের অন্য একটা মানুষ থেকে আলাদা করে দেয়। এই ক্ষমতাটা অর্জন করার জন্য যা যা করতে হয়, যেমন আপনি আপনার কাজটাকে ভালো করে করেন, পরিশ্রম ও আন্তরিকতা দিয়ে করেন, আপনি আপনার চিন্তায় ও কাজে মানবিক হোন, সেটাকেই আমি প্রার্থনা বা ইবাদত বলছি। আপনি যদি আপনার ইবাদতটা ভালোমতো করেন, তা যে উপায়েই করেন না কেন, আপনার যেভাবে থাকতে ভালো লাগে সেভাবে থেকেই---মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায়, প্যাগোডায় যেখানে যেতে ইচ্ছে করে, সেখানে গিয়ে, কিংবা ঘরে থেকেই নিজের হৃদয়কে তৈরি করার মধ্য দিয়ে নিজের আত্মাকে জাগ্রত করার কাজটা ঠিকভাবে করে যেতে হবে।
এই যে আমরা অনেক সময় দেখি, এই যেমন, আমাদের ঘরে বয়স্ক বাবা-মা প্রার্থনা করে, ধর্মালয়ে যায়, এটাকে আমরা অনেকে যুক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করি, খারাপভাবে দেখি। এটার পেছনে কারণ খুঁজতে যাই, বোঝার ও বোঝানোর চেষ্টা করি,---এসবের কী মানে আছে! অনেকে কীর্তন শুনতে যায়, অনেকে ওয়াজ-মাহফিলে যায়, এটাকে অনেকে খারাপভাবে দেখে। আমি এই বিষয়টাকে খারাপভাবে দেখি না। কারণ ওই মানুষটা তো ওভাবেই ভালো থাকে, আমি যদি তাকে অন্য কোনও উপায়ে ভালো রাখতে না পারি, তবে নিজেকে ভালো রাখার যে বুদ্ধিটা সে অনুসরণ করছে তার নিজের মতো করে, সেখান থেকে তাকে সরিয়ে কেন আনব? ভালো থাকার মানেটা কী আসলে? ভালো থাকার মানে হচ্ছে, আমাদের ভেতরটাকে জাগ্রত করা। যার ভেতরটা যত জাগ্রত, তার রোগশোকও কম হবে এবং সে তত সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবে, সে তত বেশি মানুষের উপকার করে বাঁচতে পারবে, সে তার নিজের ফ্যামিলিতেও তত ভালো আউটপুট দিতে পারবে। এগুলি করার যে উপায়, তা হচ্ছে শান্তি ও স্বস্তি পাওয়া। এই শান্তি বা স্বস্তিটা যেখান থেকে আসে, যা করলে তৃপ্তি পাওয়া যায়, সেটা করতে বাধা দেওয়া একধরনের পাপ।
যা করে একজন মানুষ নিজে ভালো থাকে অন্যের কোনও ক্ষতি না করেই, বরং দিনের শেষে সে মানুষটি সমাজের কিছু উপকার করে, তা করতে তাকে বাধা দেওয়া যাবে না। যে যেভাবে ভালো থাকে, তাকে সেভাবে ভালো থাকতে দেওয়া উচিত। কারও উপর কোনও কিছু চাপিয়ে দিয়ে কারও ভালো করা যায় না। তাকে তার মতো করে ভালো থাকতে দেওয়া উচিত। তবে হ্যাঁ, তাকে তার মতো করে ভালো থাকতে দিয়ে যদি কারও কোনও ক্ষতি হয়, তবে তাকে সেটা বোঝানো মধ্য দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু কারও কোনও ক্ষতি হচ্ছে না, এমন আনন্দদায়ী কোনও কাজ যে করে, তাকে সে কাজটা করতে বাধা দেওয়ার কোনও মানে নেই। এই যে আমরা অনেক সময় বলি না, আমাদের ঘরের মা-বোনরা বসে বসে জি-বাংলা - স্টার প্লাস দেখে, ওদের কোনও কাজ নেই, ওদের মনমানসিকতা সাবস্ট্যান্ডার্ড…এই জাতীয় কথাবার্তা, আমি ব্যক্তিগতভাবে এই রকম করে বলাটা পছন্দ করি না। আমি ভাবি, আমি নিজে তো তাকে সময় দিচ্ছি না, তবে এভাবে বলি কী করে? আমি তো ঘরের মহিলাদের সময় দিচ্ছি না। তাদের একটা বিনোদন তো দরকার, তাই না? তাদের কি বেঁচে থাকতে হবে না? তারা ওই অনুষ্ঠানগুলি দেখে। ওসব দেখে তারা ভালো থাকে। তাদের ভেতরের যে মনটা, তাদের ভেতরের যে হৃদয়টা, ওসব অনুষ্ঠান তাদের হৃদয়-মনকে ভালো রাখে। এবং তাদের তারা ভালো থাকলে তারা পরিবারটাকে ভালো রাখবে। এইজন্য আমি জি-বাংলা, স্টার জলসা ইত্যাদি দেখাটাকে খারাপভাবে দেখি না কখনও। আমি যাকে কোনও উপায়ে ভালো থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারছি না, সে যদি নিজের মতো করে কোনও রাস্তায় ভালো থাকে কারও কোনও ক্ষতি না করে, তবে সেখানে আমার বলার বা মাতব্বরি করার কী আছে?
আমি তখন একটা সময় বলতাম, এই যে ছেলে-মেয়েরা প্রেম করে, তারা কি বিয়ে করতে পারবে? যদি তারা একে অপরকে বিয়ে করতে না পারে, তবে কেন তারা প্রেম করে? আমি তখন এভাবে ভাবতাম যে, যাকে বিয়ে করব না বা করতে পারব না, তার সাথে প্রেম করার কী দরকার? কারও সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে তাকে আমি বিয়ে করতে পারবই! তখন আমাকে গায়ত্রীদিদি একদিন বললেন, ‘জীবনটা তো কোনও যুক্তিতে চলে না। জীবনটা চলে বিশ্বাসে। তুমি যে মুহূর্তে ভাবছ, ‘তাকে ভালোবেসে আমি অনেক ভালো আছি, এটাই আমার বিশ্বাস।’ সে মুহূর্তে তুমি সেটাই করো। সেটা করলেই তুমি ওই মুহূর্তে ভালো থাকবে। আরে সুশ, তুমি যে ওকে বিয়ে করা পর্যন্ত বেঁচে থাকবে, এটা তোমাকে কে বলল? তোমার আয়ু ততটুকু না-ও তো থাকতে পারে। ঠিক না? সেটা যদি ঠিক হয়, তবে তুমি যতদিন বেঁচে আছ, ততদিনই নিজেকে কষ্টে রাখলে ভবিষ্যতে ভালো থাকবে, সে আশায়, তোমার জীবনে সেই ভবিষ্যতটা না-ও তো আসতে পারে। তো তুমি যতদিন বেঁচে আছ, ততদিন কষ্টের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবে, আর হঠাৎ মৃত্যু এসে পড়লে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তোমার মনে হবে, এই পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে ছিলাম, কোনও ভালো স্মৃতিই তো মনে নেই!’ আমি তখন নিজেও ভাবলাম, এই পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৯৬ ভাগ প্রেমেই তো ব্রেকআপ হয়ে যায়। তো ওরা তা-ও কেন ভালোবাসে? ওদের দেখে কেন বাকিরা প্রেমে পড়া ছেড়ে দিচ্ছে না? নিশ্চয়ই এখানে এমন কিছু রহস্য আছে, যা ‘দুইয়ে দুইয়ে চার’-এর নিয়মে চলে না!
দিদি আরও বললেন, ‘…তার চেয়ে, তোমার নিজের ভেতরের আত্মাকে কিছু ভালো স্মৃতি উপহার দাও। তাকে ভালো স্মৃতি উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত রেখো না। যদি রাখো, তবে সেটা একধরনের পাপ। তাকে উপভোগ করতে দাও জীবনকে, আনন্দ পেতে দাও। এই যে তুমি এত পরিশ্রম করছ, চাকরির জন্য এত এত খাটছ, এমনকি মাঝেমধ্যে পড়াশোনা না হলে নিজেকে ক্ষমাই করছ না পর্যন্ত, কী লাভ বলো তো? তুমি কি নিশ্চিত যে তুমি যা পাওয়ার জন্য খেটে মরছ, তা তুমি পাবেই? তুমি চাকরির পরীক্ষা যেদিন দিতে যাবে, সেদিনই তো মারা যেতে পারো; কী, পারো না? তুমি যে চাকরির পরীক্ষায় প্রথম হবে, সে পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার আগের রাতেও তো তুমি মারা যেতে পারো, তাই না? হয়তো ভাবছ, এভাবে করে ভাবলে তো মানুষ কোনও কাজই করতে পারত না। হ্যাঁ, সেটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক, নিজের উপর এতটা অত্যাচার করা যাবে না। নিজের উপর এমন অত্যাচার করলে একধরনের পাপ হয়। কারণ ওই মুহূর্তে তোমার ভেতরের মানুষটাকে ভালো রাখাটা তোমার দায়িত্ব। ঈশ্বর তোমাকে সে দায়িত্বটা দিয়েছেন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যমে। না হলে তো তোমাকে বাঁচিয়ে না রাখলেও হতো।’
দিদির কথা শুনে তখন আমি ভাবলাম, কথা তো আসলে সত্যি! আমি আমার চেষ্টা করে যাব, তবে ফলের আশায় এতটা ব্যগ্র হয়ে থেকে থেকে নিজেকে যন্ত্রণায় রেখে দেওয়ার কোনও মানে নেই। আমার নিয়ত ও প্রচেষ্টা ঠিক থাকলে যদি সে জিনিসটা আমার নিয়তিতে থাকে, তবে আমি তা পাবই পাব! আমার মন থাকুক কর্মে, ফলে নয়। এখনও গায়ত্রীদিদির কথা মনে এলে আমি অনেক ইমোশনাল হয়ে পড়ি। এই মানুষটা যে আমার জন্য আসলে কী, তা আমি লিখে বা কথা বলে বোঝাতে পারব না। মানুষটাকে আমি কখনও সুন্দরতম ভাষা দিয়েও প্রকাশ করতে পারব না। আমার জন্য উনি সত্যিই অনেক কিছু। আমার প্রায়ই মনে হয়, আহা, যদি আমার কিছু আয়ু আমি ওঁকে দিয়ে দিতে পারতাম! সত্যি সত্যি দিয়ে দিতে পারতাম যদি, অনেক ভালো লাগত! যে মানুষটা আমার বেঁচে-থাকাকে অর্থবহ করে দিয়েছেন, তাঁর জন্য কিছু বছর কম বেঁচে-থাকাটাকে আমি পরমসৌভাগ্য মনে করব।
এই চার পর্বের লেখায় আমি হয়তো অনেক বাজে বকেছি, অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তাও লিখে ফেলেছি হয়তো! তবে আমি যা যা লিখেছি, তার সবই আমার ঐকান্তিক বিশ্বাস, আমার সৎউপলব্ধি, আমার আন্তরিক অনুভব। আপনারা যাঁরা আমার এই লেখাটি পড়লেন, তাঁদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনারাও আপনাদের নিজের জীবন থেকে শেখা নানান কিছু আমার সাথে শেয়ার করবেন। এতে আপনি, আমি এবং অন্য অনেকেই সমৃদ্ধ হব। প্রিয় পাঠক, আমি যা যা লিখলাম, সেগুলি আপনি আপনার মতো করে ভাবুন। আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা, দর্শন, শিক্ষা, বিশ্বাস ইত্যাদির সমন্বয়ে ভাবুন আমার কথাগুলিকে। আপনার যদি কোনও মতামত থাকে, পরামর্শ থাকে, ব্যক্তিগত জীবনদর্শন থাকে, তবে আমাকে তা জানাবেন অনুগ্রহ করে। আমি আপনার কাছ থেকে শিখতে চাই। জেনে রাখুন, এই পৃথিবীতে যদি একটা মানুষও আপনার মতামতকে মূল্যায়ন করে, সেই মানুষটা আমি হতে চাই। এটা সব সময়ই মাথায় রাখবেন।
তবে বিনয়ের সাথে বলছি, অহেতুক ব্যক্তিগত আক্রমণ বা নিন্দা করবেন না, ওটা মানুষের কাজ নয়, জানোয়ারের কাজ। আমি আপনার খাইও না, পরিও না। আপনার কণামাত্রও ক্ষতি আমি কখনও করিনি, আপনাকে আমার লেখায় ট্যাগও আমি করিনি। চাইলে আমাকে আনফলো করে দিতে পারেন, এতে আপনারও মঙ্গল, আমারও মঙ্গল। আপনি আমার লেখা পড়লেও আমার কিছু এসে যায় না, না-পড়লেও আমার কিছু এসে যায় না। আমি বিশ্বাস করি, আপনি আপনার হৃদয়ের তাগিদেই আমার ওয়ালে আসেন, এখানে যা লাভ বা স্বার্থ বা প্রাপ্তি, তার পুরোটাই আপনার নিজের। আমি কখনওই আপনার জন্য লিখি না, আমি কেবল আমার নিজের আনন্দের জন্যই লিখি। তাই অনুগ্রহ করে নির্বোধের মতো আমাকে এবং আমার অন্য পাঠকদের বিরক্ত করবেন না। আমার লেখা পড়ার পর আপনি আমাকে আপনার গঠনমূলক কথাগুলি বলবেন, আপনার সুন্দর ভাবনাগুলি জানাবেন। আমি নিজের ও আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আপনি এবং আপনার মতামত, দুই-ই আমার জন্য জরুরি। অপেক্ষায় রইলাম আপনার কাছ থেকে শোনার। নিজে ভালো থাকুন, অন্যকে ভালো রাখুন। আপনার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছি।