দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি-অধিকৃত ফ্রান্সে জার্মান দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, সেটি ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্স নামে পরিচিত। সে আন্দোলনের সাথে জড়িত একজন সন্ন্যাসী একটা বোর্ডিং স্কুল চালাতেন। ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা লুইস মালে সে স্কুলে পড়তেন। তখন তার বয়স ১১। মিডটার্ম চলাকালে স্কুলে তিনটি ইহুদি ছেলে ভর্তি হয় যারা কুখ্যাত জার্মান গেস্টাপো বাহিনির হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রিন্সিপ্যাল ব্যাপারটা জানতেন। তিনিই তাদের নাৎসি বাহিনির হাত থেকে লুকিয়ে থাকতে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তির সুযোগ দেন। স্কুলেরই কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে সেই ইহুদি ছেলেদের তথ্য গেস্টাপো বাহিনির কাছে দিয়ে দেয়। ১৯৪৪ সালের কোনো এক সকালে স্কুলে গেস্টাপো বাহিনির সদস্যরা আসে এবং সেই ইহুদি ছেলে তিনটিকে এবং প্রিন্সিপ্যালকে ধরে নিয়ে যায়। সেই তিনজনের মধ্যে একজনের সাথে মালের বন্ধুত্ব হয়েছিল। সেই কুৎসিত সকালটি মালেকে বদলে দেয়। সেই ছোট্ট মালে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, সে বড়ো হয়ে সিনেমা বানাবে, এই অন্যায়ের কথা সিনেমার মধ্য দিয়ে সবাইকে জানাবে। তবে মালে তাঁর প্রথম সিনেমা সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানাননি; বরং প্রায় ১০ বছর অপেক্ষার পর ১৯৮৭ সালে সিনেমাটি বানালেন, নাম দিলেন ‘গুডবাই, চিলড্রেন’। ততদিনে তিনি দুই ডজন ফিল্ম আর ডকুমেন্টারি বানিয়ে হাত মকশো করে ফেলেছেন।
সেদিনের ঘটনার পরের ঘটনা ছিল এই, সেই ইহুদি ছেলেগুলিকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়। সিনেমার গল্প বানাতে মালেকে খুব বেশি কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়নি। কারণ, সিনেমায় মালে যে স্কুল দেখিয়েছেন, তেমনই একটা স্কুলে তিনি নিজে পড়েছেন, সেখানকার পরিবেশ ও নিয়মকানুন যেমন ছিল, তেমনটাই তিনি তাঁর স্ক্রিপ্টে বর্ণনা করেছেন। বিশ্বাসঘাতকতাটা কে করেছে, তা মালে জানতে না পারলেও সিনেমায় টুকটাক রান্নার বাজারটাজার করে দেয়, কিশোরবয়সি ছাত্রদের বাইরে থেকে লুকিয়ে খাবার আর সিগারেট এনে দেয়, এমন একটা ছেলেকে দিয়ে কাজটা করিয়েছেন, যে ছেলেকে চুরির অভিযোগে চাকরিচ্যুত করে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়। প্রিন্সিপ্যাল গ্রেফতার হওয়ার পর স্কুলটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, সিনেমায়ও তা-ই দেখানো হয়। মালে সিনেমা বানানোর আগে তাঁর নিজের স্কুলের কাছাকাছি দেখতে একটা ক্যাথলিক প্রাইভেট স্কুল খুঁজে বের করেন শুটিং করার জন্য। স্কুলটা প্যারিস থেকে একটু দূরের এক শহরতলিতে। স্কুলের চারপাশের অপূর্ব নিসর্গ মুগ্ধ করার মতো। মালে সিনেমায় যা দেখিয়েছেন, তার প্রায় সবই তাঁর নিজের জীবনের ঘটনা। যদি বোর্ডিং স্কুলে ছাত্ররা কীভাবে থাকে, তাদের মনস্তত্ত্ব, দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি কারো জানতে ইচ্ছে করে, তবে এ সিনেমা দেখে অনেককিছুই জানতে পারবেন।
স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ করে সেটি তিনি সেই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র তাঁর বড়ভাইকে দেখিয়ে নেন, এবং আরও কিছু শিক্ষককেও দেখান যাঁরা তখনও বেঁচে ছিলেন। যখন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ফাদার জ্যঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন স্কুলের ছাত্ররা সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল, এবং তাদের উদ্দেশ্যে ফাদারের শেষ কথা ছিল: গুডবাই, চিলড্রেন। সিনেমায়ও ঠিক তা-ই দেখানো হয়েছে। মালের জীবনে ঘটনাটি ঘটেছিল শীতকালের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে। ১৯৪৪ সালের ছবি ফুটিয়ে তুলতে মালে সিনেমার শুটিং করেন শীতকালেই। স্কুলের ছাত্রদের একটু কষ্ট করতে হয়েছে, কিন্তু সিনেমাটি মাস্টারপিসের খাতায় নাম লিখিয়ে নিয়েছে। মালে শিশুদের নিয়ে অনেক সিনেমায়ই কাজ করেছেন। ফলে তিনি শিশুদের মনস্তত্ত্ব খুব ভাল করে বুঝতে পারেন।
সিনেমায় প্রধান চরিত্রে, অর্থাৎ মালের চরিত্রে এবং ইহুদি ছেলেটির চরিত্রে যে দুইটি শিশু অভিনয় করেছে, তারা এর আগে কখনো সিনেমায় অভিনয় করেনি, তবে তাদের দিয়ে মালে যে অভিনয়টা করিয়েছেন, তা রীতিমতো অসাধারণ! তাদের কাজে মালে এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন যে, তাঁর ধারণা, ওদের না পেলে সিনেমার কাজটাই বন্ধ রাখতে হতো! ইহুদি ছেলের চরিত্রে অভিনয় করে রাফায়েল ফেজতো, মালের ভূমিকায় গাস্পারড মানেসে। মজার ব্যাপার, গাস্পারড মানেসে আদতেই ছিল খুব লাজুক, অন্তর্মুখী, ভীতু প্রকৃতির একটা ছেলে এবং মালে ছোটবেলায় ওরকমই ছিলেন; যদিও সিনেমায় তার চরিত্র এক চটপটে বহির্মুখী কিশোরের। সিনেমায় মালের নাম জুলিয়েন। একদিন ১২ বছরের জুলিয়েন তার ১৩ বছরের বড়ভাইকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, ইহুদিরা কী অন্যায় করেছে? বড়ভাই উত্তর দেয়, ওরা খ্রিস্টকে মেরে ফেলেছে। জুলিয়েন তখন বলে, আমি তো ভেবেছিলাম খ্রিস্টকে রোমানরা মেরেছে। এটা শুনে বড়ভাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ওরা শুকরের মাংস খায় না এবং ওরা আমাদের চাইতে স্মার্ট।……যারা আমাদের চাইতে স্মার্ট, আমরা তাদের মতো নই বলেই তাদের সহ্য করতে পারি না, অতএব ঘৃণা করি। জগতে এটাই হয়ে আসছে, হচ্ছে, হবে।
মালে এ সিনেমায় তাঁর শৈশবস্মৃতির খুব ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি খুব নিপুণভাবে স্কুলের বাচ্চাদের ছবি এঁকেছেন। সেখানে ওদের নিষ্পাপ ও কলুষিত, দুই রূপই উঠে এসেছে। বোর্ডিং স্কুল লাইফের দুষ্টুমি, বন্ধুত্ব, ঝগড়া, উদ্ভট সব খেলাধুলা, নিম্নমানের খাবার, লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া, অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়া, ছাত্রদের বিছানা ভিজিয়ে ফেলা, বয়ঃসন্ধিকালের নানান নোংরা ভাবনা, বড়দের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ইরোটিকা ম্যাগাজিন দেখা, সবই সিনেমায় এসেছে খুব স্বাভাবিক নিয়মেই। এক নিষ্পাপ পরিবেশে যখন নির্দয়তার বীভৎস রূপ এসে উপস্থিত হয়, অথচ সেটা রুখে দিতে কিছুই করার থাকে না, তখন কতটা অসহায় আর নিরাশ লাগে, সিনেমাটি তার গল্পই বলে। মালের ভাষায়, তাঁর আত্মজীবনীমূলক ছবি ‘গুডবাই, চিলড্রেন’-এর শতকরা ৭৫ ভাগ ফিকশন, বাকিটা সত্যকথন। মালে ফিকশনের আশ্রয়ে যা নির্মাণ করেছেন, তা মূলত অতীতের এক বিষাদমাখা স্মৃতির রোমন্থন। এই নস্টালজিক সিনেমায় কোনো অতি-নাটকীয়তা নেই, একটাও অপ্রাসঙ্গিক দৃশ্য নেই, সংলাপের বাগাড়ম্বর নেই। মালের লেন্সে যতটা এসেছে, তার পুরোটাই সৎ এবং প্রয়োজনীয়।
সিনেমায় জুলিয়েন প্রচুর বই পড়ে, স্বভাবে কিছুটা উদ্ধত। আর দশটা কিশোরের যা যা বৈশিষ্ট্য, সেগুলি তার মধ্যেও আছে। সিনেমায় সে কোথাও দার্শনিক ভঙ্গিতে কথা বলে না কিংবা এমন কোনো আচরণ করে না, যেটা তার বয়সের কারো পক্ষে বেমানান। অপরদিকে ইহুদি ছেলেটি কারো সাথে তেমন একটা মিশে না, চুপচাপ স্বভাবের, কিছুটা আত্ম-সংবৃত, সবাই তাকে কেমন একটা এড়িয়ে চলে। সে নিজের মনে বই পড়ে, ক্লাসের রুটিন আর বোর্ডিং স্কুলের অনুশাসন মেনে সময় কাটায়। হয়তোবা সে অন্যদের কাছ থেকে নিজের ইহুদি পরিচয় লুকিয়ে রাখতেই নিজেকে ওরকম আড়াল করে রাখে। সে-ই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। জুলিয়েনের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল, দুইজন মিলে একবার একটু দূরের জঙ্গলে অ্যাডভেঞ্চার করতে যায়, সেখান থেকে ওদের পুলিশ ধরে নিয়ে আসে। তখন ওদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। একই নিষিদ্ধ কাজের প্রতি আগ্রহ দুইজন মানুষকে পরস্পরের কাছে নিয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পের ফটিককে যেন আমরা সেই স্কুলে পেয়ে যাই। “তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।” সিনেমায় কিশোরদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বেইমানি, আত্মসম্মান ও অপরাধের বোধ, সহযোগিতা ও বিরোধিতা, জীবন বনাম শিল্পকলা—সবকিছুই এসেছে গল্পের প্রয়োজনে, স্বাভাবিক গতিতে, কোথাও কোনো দৃশ্য আরোপিত মনে হয় না।