গীতামাহাত্ম্য নিয়ে

গীতামাহাত্ম্যে আছে:

সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ।
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ।।

উপনিষদসমূহ গাভী, অর্জুন গোবৎস, কৃষ্ণ হচ্ছেন গোপ, আর দুধ হলো গীতা। এখন কথা হচ্ছে, এই দুধ অর্জুনের পর আর কে পাবে? সুধীর্ভোক্তা হচ্ছেন সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ—তাঁরাই পাবেন।

গীতায় সাত-শো শ্লোক আছে। আমরা তা দিয়ে কী করছি? গীতারূপী অমৃতদুগ্ধ আমরা মাথায় রাখছি, ভগবানের বিগ্রহের আশেপাশে রেখে পুজো করছি, প্রচণ্ড সম্মান দেখাচ্ছি, তোতাপাখির মতন সমানে মুখস্থ করছি, কিন্তু পান করছি না। সেজন্যই আমরা দুর্বল। এই গীতাযোগ তথা গীতার দর্শনকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে উন্নত করার কুশলতা মূলত অনুভবের জন্য—ঠাকুরঘরে বা ঠাকুরের আসনে লাল কাপড় আর তুলসীপাতা দিয়ে স্পর্শহীনভাবে যত্নে ঢেকে রাখার কিংবা মাথায় তুলে নাচানাচি করার জন্য নয়। গীতার বাণী অনুভব করতে না পারলে গীতামৃতদুগ্ধ থেকে শক্তি পাওয়া যায় না।

আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। যেখানেই যাই না কেন, কাছাকাছি কোথাও বুকস্টল বা বুকশপ চোখে পড়লে আমি অবশ্যই সেখানে এক বার হলেও ঢুঁ মারি। ব‌ই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার কাছে প্রার্থনার মতন একটা ব্যাপার।

একবার এক মন্দিরে গিয়েছি। ভগবানের প্রসাদ পাবার পর ওঁদের বুকস্টলে ঢুকলাম। ওখানকার প্রায় সব ব‌ই-ই আমার কাছে আছে (ব‌ইকেনার তীব্র নেশার কারণেই কেনা হয়েছিল), তবু মনের টানে স্টলে ঢুকে ব‌ই ঘাঁটছি, এমন সময় স্টলের দায়িত্বে থাকা মন্দিরের ভক্ত মহোদয় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ওঁদের প্রকাশিত ‘শ্রীমদ্‌ভাগবত’ গ্রন্থটি আমার কাছে আছে কি না। আমি সবিনয়ে জানালাম, ওঁদেরটি নেই, তবে আমার সংগ্রহে পাঁচ সেট অন্য প্রামাণ্য অনুবাদ আছে। উনি বেশ অনুনয় করে বললেন, কেবল ওঁদেরটিই প্রামাণ্য; আমি যেন তাই ওঁদেরটিও নিই। ওঁদের ভাগবত ঘরে রাখলেও নাকি পুণ্য হবে।

আমার হাসি পেয়ে গেল। বুঝলাম, ইনি ভাগবত ভালো বোঝেন না। নিশ্চিত হবার জন্য ভাগবতের দর্শন নিয়ে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করলাম এবং মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। মনে হলো, তাঁর অনুরোধটি রেখে এখান থেকে দ্রুত পালাই। (না পালালে যে তাঁকে আরও সময় খরচ করে সহ্য করতে হবে!) আমি জানতাম না, আমার জন্য অভিনব এক অস্বস্তি অপেক্ষা করছে। আমি ভাগবতের সেটটি কেনার পর তিনি এবং সেখানে থাকা আরও কিছু ভক্ত মহানন্দে সেই মহাগ্রন্থের সেটটি তাঁদের মাথায় ছুঁইয়ে আমাকে রীতিমতো প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন। তাঁদের মধ্যে সিনিয়র ভক্তপ্রবর অবশেষে সেই বিশালাকায় সুদৃশ্য সেটটি আমার মাথার উপর তুলে দিয়ে বিনয়ের সাথে ভক্তিতে গদগদ হয়ে বললেন, “কৃপা করে শ্রীমদ্‌ভাগবতের সেটটি কিছু সময়ের জন্য আপনার মাথায় স্থাপন করুন।”

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দেখলাম, অনেকেই তাঁদের মোবাইল-ক্যামেরার সদ্ব্যবহার করছেন। নিজের উপর খুব রাগ হলো। বার বারই মনে হতে লাগল, আমি এখানে কেন এলাম? পৃথিবীতে কি আর যাবার জায়গা ছিল না!

এখন আপনিই বলুন, এমন মানুষ তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে কী শিখিয়ে যাবেন? গীতা, ভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত—ভারতীয় দর্শনের এইসব আকরগ্রন্থ নিয়ে নাচানাচি করাই ধর্মাচরণ—এমন কিছু? ওতে তো শারীরিক ব্যায়াম হবে, তার সাথে ধর্মপালনও কি হয়ে যাবে? সত্যিই কি এতটা অগভীর সনাতন ধর্মদর্শন? উল্লেখ্য, এঁরা বেদ-উপনিষদ-বেদান্তের ধারেকাছেও কখনও ঘেঁষেন না বা ঘেঁষতে পারেন না।

সমস্ত জীবন ধরে গীতার যোগাভ্যাস করতে হয়। এতে অলৌকিকত্ব কিছু নেই। গীতাকে ভালোভাবে বুঝে অন্তরে ধারণ না করে কোটি কোটি বার প্রণাম করা বা মাথায় তুলে নাচানাচি করার মধ্যে নিবিড় আবেগ থাকতে পারে, তবে ওতে বিন্দুমাত্রও কোনো কল্যাণ নেই। কীভাবে লোকের সঙ্গে চলতে হবে, নিজের কর্তব্যকর্ম তথা ধর্ম কীভাবে পালন করতে হবে—এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় কথাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় আমাদের শিখিয়েছেন। গীতার মর্মানুসারে চললে নিজের কাজের মাধ্যমে নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতি হবে, আবার অপরেরও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হবে।

স্বামী বিবেকানন্দ প্রাত্যহিক জীবনে প্রায়শই একটি মটো ব্যবহার করতেন—আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ—‘আত্মনো মোক্ষার্থং’ অর্থ ‘নিজের (আত্মার) মোক্ষলাভের জন্য’, চ অর্থ এবং, ‘জগদ্ধিতায় বা জগৎ হিতায়’ অর্থ ‘জগতের সকলের মঙ্গলের জন্য’। নীতিবাক্যটি মানবজীবনের দুটি মূল লক্ষ্য নির্দেশ করে—একটি হলো: নিজের আত্মার পরিত্রাণ অন্বেষণ করা এবং অন্যটি হলো: বিশ্বের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা। এটি অর্জন করতে মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টা—কেবল নিজের পরিত্রাণের জন্যই নয়, বৃহত্তর মানবতার সেবাপ্রদানের জন্যও প্রয়োজনীয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায়‌ ঠিক এই উপদেশটিই দিয়েছেন। তাৎপর্য না বুঝে গীতা মুখস্থ করে, শ্রদ্ধার সাথে আসনে সাজিয়ে রেখে, ফুল আর দূর্বা দিয়ে পূজা নিবেদন করে, আবেগে মাথায় তুলে নেচে আমরা কি পৃথিবীর সামনে নিজেদের সম্মান বাড়াতে পারব? ভগবান নিজেও কি তা করতে বলেছেন পুরো গীতার কোথাও?

যথার্থ গুরুর সন্ধান পেলে তো ভালো, আর না পেলেও নিজেকে জাগাতে অন্য কার‌ও দ্বারস্থ হতে হবে না। আত্মচৈতন্য তো মানুষের নিজের ভেতরেই আছে। সেই আত্মা অজ্ঞানের (আত্মা বা ব্রহ্ম বা চৈতন্য সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব‌ই অজ্ঞান) আবরণে ঢাকা। সেই আবরণ সরিয়ে নিলে আত্মা নিজেই প্রকাশিত হন। আর এই স্বয়ংপ্রকাশ আত্মার প্রকাশ করাই মানুষের ধর্ম। দেবত্বের এমন জাগরণ‌ই সব ধর্মসাধনার মূল।

অর্জুনের পর যে-দুধ আমাদের পাবার কথা ছিল, সেই দুধ মাথায় উঠিয়ে নাচলে তো তা গড়িয়ে মাটিতে পড়ে পানের অযোগ্য হয়ে যাবে! ‘জয় গীতা’, ‘জয় গীতা’ বলে চেঁচাতে তো সবাই-ই পারে, গীতার অমৃত পান করতে পারে কয়জন? গীতা সকল উপনিষদের সার, যেখানে খুবই অল্প পরিসরে ধর্ম ও দর্শনের দুরূহ সব তত্ত্ব সন্নিবেশিত হয়েছে। এই গ্রন্থ বেশ দুর্বোধ্য বিধায় গীতার (সঠিক) ভাষ্য বা ব্যাখ্যা না পড়ে গীতা পড়া আর লোকদেখানো গীতানৃত্যের রাস্তা তৈরি করা—এক‌ই কথা।

ভগবানের চরণ ধরার মানে যে ভগবানের আচরণ ধরা, এই সহজ বোধটি আমাদের আর কবে হবে? কতটা গভীরে তলিয়ে গেলে পরে টের পাওয়া যায়? লোকের সাধারণ বৈশিষ্ট্য‌ই হচ্ছে অন্যকে অসম্মান করা—সম্মান কি কেউ কারও চেহারা দেখে করে? নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে লাফালাফি না করে বরং শ্রেষ্ঠ হবার চেষ্টা করাই শ্রেয়—পথটা কঠিন বলেই খুব কাজের।

আমাদের চৈতন্য হোক।