তিনচাকায় জীবন বাঁধা যে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা চাচার, ঘামের বিনিময়ে একপ্লেট ভাত কিনে খেতেন যিনি, তিনি গত কয়দিন ধরে ক্ষুধায় কুঁকড়ে আছেন, তার হিসেব আমি রাখিনি।
প্রতিদিন ক্ষুধার চাবুকের ঘা সয়ে সয়ে, জুতো সেলাই করতেন যে চাচা, তাঁর চুলোর ঘাড়ে ডেকচি আর চড়ে না, চোখের জলে জল মিশিয়ে ক্ষুধা গিলছেন কতদিন, সে সংখ্যাটা আমি কখনও জানতে চাইনি।
ওই তিনরাস্তার মোড়ে, এককোনায় বসে, চোখমুখ শাড়িতে ঢেকে যে বৃদ্ধা চাচি ভিক্ষা করতেন, তাঁর প্রসারিত হাতদুটোতে আজ কতদিন ধরে দুটো পয়সা পড়েনি, তা জানতে চাওয়ার সময় আমার হয়নি।
জীবনের সমস্ত দৈন্যের কাঁটাতারে নিজেকে ছিঁড়তে ছিঁড়তে যে টোকাই ছেলেটি ক্ষুধার সীমান্তেই ঠায় আটকে আছে, তার পেটের চামড়া কত ইঞ্চি ভেতরে ঢুকে গেছে, সে খোঁজ নেবার দরকার আমার পড়েনি।
পান-সিগারেট বিক্রির সামান্য টাকায়, যে বৃদ্ধ চাচা সন্ধের পর দুমুঠো চাল নিয়ে ঘরে ফিরতেন, তাঁর পরিবারের ভাগ্যে কতকাল ধরে দুটো শুকনো-ভাতের সাথে নুন-লঙ্কা জোটে না, তার ব্যাপ্তি আমি জানতে পারিনি।
অভাবের লাথি খেয়ে খেয়ে, রাস্তায় ভাসমান যে নীলপরীটা দুশো তিনশো টাকায় শরীর বেচে নিজের পরিবার টানত, সে পরীর শরীরের হাড় কয়টা ক্ষয়ে গেছে এই লকডাউনে, তার খোঁজ নিতে আমি কখনও চাইনি।
জীবনের ভার কাঁধে তুলে, মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে যে ফেরিওয়ালা জীবন ফেরি করে বাঁচতেন, তাঁর ভাঙা-গালটা ভেদ করে, আরও কটা দাঁত বেরিয়ে এসেছে, সে দৃশ্য দেখতে আমি কখনও যাইনি।
সমান্তরাল রেললাইনের ধারে জীবনের অসমান্তরাল গতিপথে পথ হারিয়েছেন যে গৃহহীন কুলি, তাঁর শরীরের শীর্ণ চামড়ার ভাঁজে আরও কতটা ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ব্যথা জমল এই ঘরে-থাকো’র সময়টাতে, তা অনুভব করার প্রয়োজন আমার হয়নি।
ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ বছর দশেকের যে শিশুটি আত্মহত্যা করল, তার কঙ্কালসার নিথর শরীরের ক্ষুধার মাপে ঠিক কয় পৃথিবীসমান কষ্ট মাপা যায়, সে ভারটা আমি কখনও বয়ে দেখিনি।
এইসব রাশি রাশি ক্ষুধার্তমুখের ভাত লুটে, ভদ্রতার রুমালে মুখ ঢেকে যে বড়োবাবুরা হাই তুলতে তুলতে, রুমের এসিটা ছেড়ে নিজের ভরাপেটটিকে নরম বিছানায় এলিয়ে দেন, তাঁদের পাপিষ্ঠ কাঁধে কত সহস্র মৃত্যুর দায় চাপা পড়ে আছে, সে হিসেব আমরা কেউই রাখিনি।
আমাদের দেয়ালে টাঙানো ঘড়িতে কেবলই কাঁটা আছে, সময়টা আর নেই। আমাদের এই গ্রহে জনমিতির গালভরা পরিসংখ্যান আছে, মানুষই শুধু নেই।
আমাদের হাতে মানুষের খোঁজ নেবার সময় নেই। আমাদের কারও দুঃখীদের দুঃখ ছোঁবার সাহস নেই। আমাদের ব্যস্ততার ভারে ক্রমশই পিষ্ট হচ্ছে যারা, তাদের দগদগে ক্ষতে একটুকরো শুকনো রুটির প্রলেপ মেখে দেবার সময় আমাদের ঘড়িতে ধরে না।
আহারে জীবন! আহারে ক্ষুধা! আহারে সময়!