যে যেমন আর যে পেশার মানুষ, সে সেভাবেই ভক্তিসাধনা করে। ভদ্রলোক, মিস্ত্রিমজুর, চাকরবাকর, রাজরাজড়া, বিধবা, কুমারী কন্যা আর পত্নী — এদের সকলের উচিত পৃথক পৃথকভাবে ভক্তিসাধনা করা। কেবল তা-ই নয়, স্বাস্থ্য, কাজকর্ম আর সাংসারিক কর্তব্যগুলিকে বজায় রেখেই প্রত্যেকে নিজের নিজের সাধনা করবে।
একজন ধার্মিক মানুষের কি উচিত জৈন সন্ন্যাসীদের মতো নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করা? অথবা সন্ন্যাসীদের চেয়ে বেশি সঞ্চয় করার প্রবণতা একজন বিবাহিত মানুষের কি অনুচিত? অথবা মিস্ত্রিদের উচিত সন্ন্যাসীদের মতো সবসময় ধর্মালয়ের মধ্যে বসে থাকা? অথবা ধার্মিক মানুষ যেমন তাঁর প্রতিবেশীদের সেবায় সবসময় কাজ করেন, সেইরকম সেবার কাজ থেকে সবসময় বিরত থাকা কি সন্ন্যাসীদের উচিত?
এই রকমের ভক্তিসাধনা কি হাস্যকর, খাপছাড়া, আর অসহ্য নয়? তবুও এই ভুলই মানুষেরা সাধারণভাবে করে থাকে। আসল ভক্তি আর নকল ভক্তির মধ্যে তফাৎটা কোথায়, তা মানুষে বুঝতে পারে না, বা বুঝতে চায় না বলেই তারা অসন্তোষ প্রকাশ করে, আর ভক্তিকে দোষ দেয়; অথচ এই সব গোলমালের জন্যে ভক্তি দায়ী নয়।
আসল কথা হচ্ছে, সত্যিকারের ভক্তিসাধনা কোনো কিছুই নষ্ট করে না; বরং সবকিছুকে নিখুঁত করে তোলে; এবং এই ভক্তি যখন মানুষের সঙ্গত পেশার সঙ্গে খাপ খায় না, তখন তাকে নিঃসন্দেহে মিথ্যা বলা যেতে পারে। মৌমাছি ফুল থেকে মধু সঞ্চয় করে; এ সময় ফুলের গায়ে আঁচড়টিও লাগে না; আর যেমনটি সে দেখেছিল, ঠিক তেমনি সেটিকে সে আস্ত আর তাজা রেখে দেয়। আর আসল ভক্তি তার চেয়েও ভালো কাজ করে; কারণ কোনো পেশা বা কাজ নষ্ট করা দূরে থাক, তাকে বরং তা আরও বেশি শোভন আর সুন্দর করে তোলে।
দামি পাথরের গায়ে মধু মাখালে তা আরও চকচক করে— যার যেরকম রঙ, সেই মতো। সেইভাবে, যারা ভক্তিমার্গের পথিক, তারা নিজেদের পেশায় আরও বেশি খোশমেজাজ নিয়ে কাজ করে। তার ফলে, পারিবারিক দায়দায়িত্ব শান্তিতে পালন করা যায়; স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা আরও অকৃত্রিম হয়; রাজা তাঁর কর্তব্যপালনে হন আরও সচেতন; আর প্রতিটি মানুষ তার নিজের সব কাজে আনন্দ পায়; এ সব কাজ করতে ভালো লাগে তার।
সেনাবাহিনীতে, কলকারখানায়, রাজদরবারে এবং সংসারে যারা কাজকর্ম করে থাকে, তাদের ভক্তিমার্গ পরিত্যাগ করা উচিত---একথা অনেকেই বলে থাকে; কিন্তু আসলে তা ভুল, এমনকি ধর্মমতেরও বিরোধী। এটা ঠিক, ভক্তিসাধনা একেবারে ধ্যানমার্গের অন্তর্গত। মঠবাসী আর সন্ন্যাসীরা তা অনুশীলন করেন। এইসব পেশার মানুষের পক্ষে এরকম সাধনা সম্ভব নয়। এই তিন রকম ভক্তিসাধনা ছাড়া আরও অনেক রকমের ভক্তিসাধনা রয়েছে; যারা নানান সাংসারিক পেশায় নিযুক্ত থাকে, উৎকর্ষ লাভের পথে সেগুলি তাদের সাহায্য করে।
এমনকি এ-ও দেখা গিয়েছে যে, সিদ্ধিলাভের জন্য যা বিশেষ উপযোগী, সেই নির্জনতায় অনেকেই পূর্ণতা লাভ করতে পারেননি; অথচ সিদ্ধিলাভের ক্ষেত্রে যেটাকে প্রতিকূল বলে মনে হয়, সেই হট্টগোলের মধ্যে তাঁরা তা লাভ করেছেন। যে লোক কোলাহলে খুব চমৎকার মানুষ ছিলেন, নির্জনতায় গিয়ে সেই লোকই নিজেকে কলঙ্কিত করেছিলেন, এমন নজির ভূরি ভূরি আছে। যেখানেই থাকি না কেন, সাত্ত্বিক জীবনযাপন করার চেষ্টা আমরা করতে পারি, আর তা করাও আমাদের উচিত।