এক। মেয়েটি চুল জমাত; কোনও কারণে নয়, স্রেফ শখের বশে। একটা ব্যাগ আধা কেজি হয়ে উঠেছিল মাত্র দু-বছরে। মেয়েটির চুল হাঁটু অবধি নেমে যেত। বিয়ের পর তা কমতে কমতে কাঁধের একটু নিচে এসে ঠেকেছিল। কতটা ছিল আর কতটা গেল দেখতেই মেয়েটি চুল জমাত। এ একধরনের শখ, এ একধরনের স্বপ্ন। একদিন চার হাজার টাকা কিলোদরে মেয়েটির সমস্ত চুল বেচে পরচুলা ফ্যাক্টরি থেকে হাজার দুয়েক টাকা পেয়ে বরটি ভাবল, যাক্! বউ আমার একেবারে অকর্মা নয় তাহলে! মাত্র দু-বছরেই মেয়েটির শখ শ্বশুরবাড়িতে মূল্যবান হয়ে উঠেছিল। কেউ ভেড়া পালে, কেউবা বউ পালে। দুই। আমরা যা দেখি এবং ওরা যা দেখে, এই দুইয়ের মাঝে একটা পর্দা আছে। পর্দার এপারে ওপারে দুই রকমের। এবং, দুই রকমই সত্য। একেকটা জীবনের একেকটা সত্য। গোঁয়ার ও মূর্খ বাদে সবাই এটা মানে। পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন যে সত্যটা টিকে থাকবে, তা হলো, জীবনযাপনের সত্য একাধিক। আমরা সত্য যতটা বুঝি, ততোধিক অনুমান করি। আমরা যা হওয়াতে চাই, তা হয় কিংবা হবে যতটা, ততোধিক হয় কিংবা হবে, যা হয় কিংবা হবার কথা। তাই আমরা মূলত সত্যে নয়, অনুমানে বাঁচি। আমরা আকাশের কাঁধে হেলান দিয়ে বাঁচি, না কি আকাশ আমাদের কাঁধে হেলান দিয়ে বাঁচে, এর উত্তর না খুঁজেও পুরো একটা জীবন একটা আকাশ নিয়েই দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়। তিন। এতগুলি বছর পরও বিভিন্ন নম্বর থেকে তোমাকে ফোন করি... কথা বলতে নয়। যখন আমার কণ্ঠস্বর শোনামাত্রই তুমি কলটা কেটে দাও, আমার খুব ভালো লাগে। আজও তুমি আমার কণ্ঠস্বর মনে রেখেছ! ...এটা যত বারই দেখি, আমি ভীষণ তৃপ্তি পাই। তোমার একটা হ্যালো শোনার জন্য আমি ছটফট করতে থাকি...আজও! চার। তোমাকে এ জীবনে রাখতে চেয়েছিলাম আমার নিজের জন্য নয়, তোমার জন্য। আমি সবসময়ই জানতাম, তোমাকে অতটা যত্নে আর কেউ রাখতে পারবে না। তোমাকে পাইনি, দুঃখ নেই। তোমাকে ভালো রাখতে পারলাম না, আফসোস এটুকই। পাঁচ। শুধু আমাদের জন্যই নিজেকে মেলে ধরে পথ, আমাদের পকেটে পড়ে থাকা শব্দগুলিকে আমরা গুনতে থাকি, এবং হঠাৎ করেই ভাবি, এইসব শব্দ কখনও ফুরিয়ে গেলে আমরা তখন কীসে ভর করে বাঁচব? আমাদের ভয় করে। তবু আমরা থামি না, হাঁটতে থাকি। আমরা জানি, অনেকদূর যেতে হবে। মাঝে মাঝে আমাদের মনে হয়, হাওয়ায় হাওয়ায় সমুদ্রের ঘ্রাণ কীরকম যেন আটকে থাকে! ছয়। প্রেম--- কী এক ছোঁয়াচে অসুখ! এক বার যে পড়ে, সে কেবলই পড়তে থাকে... আরও গভীরে ডুবতে থাকে। প্রেমের কাঁধে ভর দিয়ে ফেললে পঙ্গুত্ব কেবলই বাড়তে থাকে। প্রেম চলে গেলে অশ্রু তবু রয়ে যায়। তার সঙ্গে কিছু দাগ, কিছু স্মৃতি। পৃথিবীকে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে ফেললেও তার চাইতে ভঙ্গুর মানুষ পাবে না কোথাও, প্রেমে যে পড়ে। সাত। তোমার কত সুবিধে! জন্মেছ এমন অবয়বে, দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। চাইলেই তুমি স্বপ্ন দেখতে পারো ওই পাহাড়ের উলটো পিঠে যাবার, যায়নি যেখানে কেউ কোনোদিনই। ঘরে কি বাইরে, সবখানেই তোমার আদর-কদর; ইচ্ছে হলেই প্রত্যাখ্যান করতে পারো যাকে খুশি। তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না, তোমার কাছে যাবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে ফিরে আসা যায় কেবলই। আমাকে সারাক্ষণই তোমার কথা ভাবাবার জন্যই জন্ম তোমার। তোমাকে ভেবে ভেবে নিজের দাফন প্রত্যক্ষ করতে করতে কাঁদবার জন্যই জন্ম আমার। আমার ঘরে ফিরতে না পেরে নীরবে আজ সয়ে যাই আয়ু। আট। তোমাকে পেলে তোমাকে নষ্ট করে ফেলতাম। তাই ভালো হয়েছে, তোমাকে পাই না। তোমাকে আমি প্রিয় গানগুলোতে ছুঁই। ভালোবাসা কী, জানো? তোমাকে শিখিয়ে দিই আজকে? শুনে রাখো, ভালোবাসা হচ্ছে আমাদের আচরণের জেনেরাস ইন্টারপ্রিটেশন। তোমার মতো একজন অপদার্থ মানুষেরও বিয়ে হয়েছে, সন্তান-সন্ততি আছে, তবে আমার কেন হবে না? স্বপ্ন দেখি, একদিন সত্যিই তোমাকে আর জ্বালাব না। নয়। আর কিছু নয়, আমি শুধু আমার অনুভূতিগুলোর একটা যোগ্য ঠিকানা চেয়েছিলেম। পেয়ে গেছি! ভালোবাসা... আসলে দূরে থাকলেই অনুভব করা যায়। কাছে থাকলে মানুষ ধরে ফেলতে চায়, শারীরিক হয়ে যায় সব। নৈকট্যের নাম প্রেম, দূরত্বের নাম ভালোবাসা। দশ। টাকা ওড়াবি, প্রেমও পাবি, ভালোবাসায় খুব ডুববি; হ্যাঁ হ্যাঁ, ওসব জানাই আছে! প্রেম-পিরিতি অনেকই পাবি, সেখানে আমায় পাবি কই রে? খুঁজতে খুঁজতে পাগল হবি, যাকে পাবি, তার মধ্যেও পাগল হয়ে আমায় নিবি, মিলিয়ে তুই নিস রে! পথে পথে ঘর মেলে, ঘর যে তবু একটাই! নাহয় আমি একটু বদ, ওটাই আমার গুণ রে! তাড়িয়ে দিলে পস্তাবি খুব, তেষ্টা পেলে কই দিবি ডুব? এগারো। দুঃখ শেয়ার করতে ইচ্ছে করে না। কীরকম যেন ছেলেমানুষি ছেলেমানুষি লাগে! সুখ শেয়ার করতে ইচ্ছে করে না। কীরকম যেন বড়োমানুষি বড়োমানুষি লাগে! সুখ কিংবা দুঃখ দেখিয়ে বেড়ানোর সত্যিই কোনও মানে নেই। আমার কোনও কিছুতেই যাদের কিছুই যায় না এসে, ওদের একসেকেন্ডও আমার না হোক। ঠিক তা-ই শেয়ার করি, যা আমাকে দেখায় না, বরং খুব যত্নে লুকোয়। আয়ু কিছুটা লুকোচুরির দাবি রাখে। নিজের ভেতরটা দেখিয়ে ফেললে মানুষ বুঝে নেয়, ছুরিটা ঠিক কোথায় চালাতে হবে। বারো। আমায় অমন করে পিছু আর ডেকো না। ভালোবাসি যে...যদি ভুল করে আবার ফিরি! আকুলতা... জীবনের অনেক বড়ো কিছু যদিও, তবু আরও অনেক গল্প বলার থাকে। পা থাকলেই কি আর ফিরে যাওয়া যায়? মন যে গেঁথে আছে এই চোরাবালিতে! তুমি ডাকো যত, ততই ভাবি, ডাকলেই কি আর ফিরে যাওয়া যায়? প্রতারণার কাছে আর কত বার যাব? তেরো। সে যখন যেতে থাকে, তখন কেবল যেতেই থাকে... কী যে কষ্ট...কী যে কষ্ট! তবুও সে যেতেই থাকে... কান্না পায়, বুক ভেঙে কান্না আসে! তবু কে শোনে এই অভাগার কথা! প্রাণটা যেন সরতে থাকে, এই বুকের মধ্য থেকে ক্রমেই সরতে থাকে... মগজ ও স্বর থামতে থাকে... কেবলই থামতে থাকে... কী যে করি! কী যে করি! ভেতরে মাঘ, বাইরে শ্রাবণ... অবিশ্রান্ত ঝরতে থাকে। কোথায় পালাই? কোথায় পালাই? জীবন ছেড়ে পালায় কীভাবে? গাছ নদী ফুল সবই ঝাপসা দেখি, বনের সবুজ, মনের অবুঝ... যা-ই দেখি, সব ঝাপসা দেখি। এ কী হলো! বেঁচে থাকাও কী দায় হলো! নিজের কাছেই হই অচেনা, বুকের রক্ত অঝোর ধারায় বইতে থাকে, কান্না-গেলা চোখ শুকিয়ে চুপি চুপি মরতে থাকে...কী যেন শুধুই খুঁজতে থাকে! চৌদ্দ। ভুল করেও আর কখনও ফিরব না ও-পথে। তোমার চোখে চোখ রাখার সমস্ত লোভের আজ ছুটি। আমি বরং শূন্য ছাদে বসে বসে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামাব। তোমার চেয়ে আকাশ ভালো, প্রেমের চেয়ে কান্না ভালো, ক্লান্তির চেয়ে বিষাদ ভালো। এইসব ভালোর ভিড়ে আজ মুছে যাক তোমাকে পাবার সমস্ত লোভ। যে জীবন ফুরিয়ে যায় যাপনের আগেই, হোক না তা যতই সুখের মধুর... সে জীবনের খোঁজ পেয়েও কী হয়, বলো? অনাস্বাদিত চুমুর স্বপ্নে স্বপ্নে সমুদ্রের গায়ে গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়াও শান্তির তোমার মুখে ডোবার চেয়ে। পনেরো। তুমি চলে যেতে পারো যেখানে খুশি। অনেক লেনদেনের পর আজ জেনেছি, যার নিজেরই হাত শূন্য, সে কখনও কাউকে কিছুই পারে না দিতে। তোমার তেষ্টা মেটাবার জল আসে যে কুয়ো থেকে, সেখানে জলের স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। জলটুকুও না পেলে বাঁচবে আর কী করে? বিশ্বাস করো, আমার মৃত্যুর পর সমস্ত দাহও এখন সমাপ্ত। কিছু ছাই সামনে রেখে কেন পড়ে থাকছ আজও? চলে যাও যেখানে খুশি। সময় এখনও আছে; সকল প্রদীপ নিভে গেলেও তবু দেরি হয়ে যায় না। থেকে যাবার নাম যখন মৃত্যু, তখন চলে গেলে পাপ হয় না। ষোলো। কাজ নেই যার, তার ঘরেও বসন্ত এলে বেচারা ভীষণ বিপদে পড়ে! কীভাবে যে বসতে দেবে, ভালোমন্দ খেতে দেবে... দু-বেলা যার জোটে না খাওয়া, তার ঘরেও কেন বসন্ত আসে? মনে পাপ নেই কি আছে, তার চাইতে ঢের জরুরি ঘরে কি আদৌ আছে কিছু বসন্তের পাতে দেবার মতো! মনে মনে সে শপথ করে, আসছে বছর আবারও যদি বসন্ত আসে, পিঁড়ি পেতে দেবে, থালা ভরে দইচিড়া দেবে যেভাবেই হোক। বসন্ত এলে ফিরিয়ে দেবার কী মানে আছে... প্রতিবছরই? তার চাইতে বসন্তের জন্য সে নাহয় তৈরিই হবে! সতেরো। কবিতা লিখতে নয়, হেলানো গাছ থেকে কয়েকটি ছেলে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তা দেখতে নদীর তীরে গেলাম। দুঃখ তাড়াতে নয়, তোমার চোখে ডুবে বিষাদ সরাতে কতটা মধুর লাগে, তা দেখতে তোমার কাছে এলাম। আঠারো। আঁধারে একা একা হাঁটছিলাম, সে-ই তো বরং ভালো ছিল! আলো ভেবে ছুটে গিয়েছি যখনই, তখন কাছে গিয়ে দেখি, সেই আলো আঁধারের চেয়েও কালো। আঁধার থেকে পালানোর চেয়ে বরং ভালো ছিল আঁধারে হাঁটতে শিখে নেওয়া। আলো চেনার স্বপ্নে স্বপ্নে আঁধার ভোলার দুঃস্বপ্নকে শেষমেশ নিয়তি পেলাম। উনিশ। আমরা চাই, আমাদের ভিড় করে থাকুক সমস্ত নাগরিক। আমরা ভুলে যাই, যাকে সবাই ভিড় করে থাকে, সেই ভিড়ে সবার আগে সে-ই হারায়। স্বপ্ন আমাদের হাঁটতে শেখায়। স্বপ্ন সত্য হলে সত্য আমাদের থামতে শেখায়। আমাদের যখন সবাই দ্যাখে, আমাদের তখন আর দেখাই যায় না। বিশ। সে আমায় দিয়েছে বলে, আর কখনোই যেন নক না করি! তবু আমার মন বলে, সে আমায় ভালোবাসে। আজ সম্পর্ক টিকে নেই, তবু আজও বিশ্বাস বেঁচে আছে।