কফিতে চুমুক দিতে দিতে



ফেইসবুকে যারা লিখেছে—লিখে চলেছে—এমন সব কথা, যা আমাদের ভাবতে শেখায়, নিজেকে বদলে ফেলতে শেখায়, যা এমনকি শাস্ত্র, উপদেশ, আধ্যাত্মিক রচনা বা অনুপ্রেরণাদায়ী ভক্তি-রচনার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, সেগুলি নিছকই ফেইসবুক পোস্ট হলেও, মনে হয়, যেন ঈশ্বর তাঁরই এক মাধ্যম দিয়ে মানুষের সাথে কথা বলছেন—তাদের সাথে, যারা সাময়িকভাবে এই দ্বৈততার জগতে সিদ্ধান্তহীনতার জালে আটকে ও ঝুলে আছি।

যা মানুষকে জাগরণের পথে নিয়ে যায়, তার গুরুত্ব ঐশ্বরিক। পার্থিব জীবনের অসংখ্য বিরোধ, দ্বন্দ্ব, তর্ক সত্ত্বেও, কখনো কিছু শব্দ, কিছু পঙ্‌ক্তি, কিছু বাণী গভীরভাবে আমাদের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। জীবনের পথ এদিক-ওদিক ঘুরে যেতে পারে, আবার নতুন পথেও তা ঘটতে পারে—কেবলই একটিমাত্র বাণীর ছোঁয়ায়। তাই বলা হয়—"যখন শিষ্য প্রস্তুত, তখন গুরু এসে যায়।" হ্যাঁ, সেই মানসিক প্রস্তুতিটাই দরকার।

প্রথম জাগরণেই কানে আসে ঈশ্বরের সেই বাণী—“নিজের বোধের উপর ভরসা কোরো না। সর্বকাজে আমাকে স্বীকার করো, আমি তোমার পথ পরিচালনা করব।” তখনই মনে হলো—স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণে ঢোকো, ভয়-সন্দেহের সিংহগুলোকে খাঁচায় আটকে দাও, আর সময়ের প্রবাহের সাথে ভেসে চলো—ঈশ্বরের ইচ্ছার যন্ত্র হয়ে।

কফির দ্বিতীয় কাপে যখন চুমুক দিচ্ছেন, তখনই বুদ্ধিবৃত্তি চুপিচুপি ফিরে এল। শুরু করল আর্থিক দুশ্চিন্তা, নিজেকে তৈরি করার ব্যর্থতা আর পুরোনো বন্ধুদের অবহেলার হিসেব কষা। আহা, এই ইগো আবার একই অক্ষরের ছন্দে মেতে উঠল—যেন সে অলিটারেশন ভীষণ ভালোবাসে! আপনি হঠাৎ বলে উঠলেন, থামো, থামো! আবার তাই শান্ত হয়ে বসে পড়লেন, ধ্যানের নীরবতায়। আবারও পরীক্ষা করলেন সেই স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ বাটনটা, আধা কাপ কফি পেটের মধ্যে ঢেলে নিলেন, আর অলস ভঙ্গিতে ফেইসবুক খুললেন।

হ্যাঁ, জানি—‘আমি’ বলে কিছু নেই, কর্তা বলে কিছু নেই, ‘তুমি’ নেই—শুধুই ঈশ্বর, আর সবই ঈশ্বরের ভেতরে। অথবা, যদি বুদ্ধের পথে ঝোঁকো, তবে সেই ‘শূন্যতা’—যা আসলে শূন্য নয়। কিন্তু তারপরও আমরা এখানে, ফেইসবুকে রাজা-উজির মারছি—মায়ার খেলায় বন্দি হচ্ছি, কিংবা নিছক মজার ছলেই ভেসে যাচ্ছি।

আবারও মন ফিরল সেই সূক্ষ্ম স্তরে—যেখানে আমরা সদ্য-জাগরণের থিয়েটারে দাঁড়িয়ে আছি—নিজের বোধের উপর ভরসা না করার শিক্ষা। অবচেতনের ঘরে-ঢোকা মানুষ কিংবা সম্পূর্ণ জাগ্রত সাধক—দু-জনেরই মনে একই দাপুটে বিশ্বাস—“আমাদের নিজস্ব যুক্তিবোধই সব।” আর যুক্তি না থাকলে আমরা পথ হারাব। কিন্তু যদি সত্যিই যুক্তিবোধের উপর ভরসা না করি? কী হবে? শূন্যতা? বোকামনে ধ্যানাবিষ্ট অবস্থা? বিরক্তিকর অন্ধকার? না, না, একেবারেই না।

কারণ এসবের মাঝখানে একটি “নিউট্রাল গিয়ার” আছে—যা থেমে থাকার আর ছুটে চলার মাঝামাঝি, নেগেটিভ–পজিটিভের মাঝখানে, ভালো–মন্দের মাঝখানে। ইগো তখন ফিসফিস করে বলে—“বোরিং!”—কিন্তু ওটাই ইগোর মিথ্যা ফাঁদ।

আসলে সেই নিউট্রাল গিয়ারই প্রবাহ, প্রেরণা, মিউজ, জিনিয়াস—যেখানে জীবন নতুন আলোয় ঝলমল করে ওঠে, ধীরে আসে, অথচ ভুলে-যাওয়া ঘরটিকে আলোকিত করে তোলে। যে-কোণটি এতদিন সামাজিক চাপে চাপা পড়ে ছিল—যেখানে আমরা শিখেছিলাম “মানুষ কী বলবে” নামের দেবতাকে পূজা করতে।

সেই আলোয় আমরা বুঝতে পারি শেক্সপিয়ার যেমন বলেছিলেন—“দুনিয়া এক মঞ্চ, আমরা কেবল অভিনয়শিল্পী।” ঈশ্বর পরিচালক চেয়ারে বসে আমাদের সংলাপ লিখে দেন। আর কোনো এক মুহূর্তে আমরা বুঝে যাই—আমরা আসলে শুধু অভিনেতাই নই, পরিচালকও বটে। আমাদের ভূমিকাটা তার চেয়েও বড়ো, যা ইগো আমাদের বিশ্বাস করিয়েছে।

এবং তখনই, যখন আমরা নিজের বোধের উপর ভরসা করা থামাই—ভেতর থেকে এক মৃদু ফিসফিস আমাদের জানিয়ে দেয়—স্বর্গরাজ্য সবসময় ভেতরেই ছিল। শান্তি, নিখুঁত মনের প্রশান্তি, নিজের সত্য পরিচয়ের আনন্দময় বোধ—সবই অন্তরে অপেক্ষা করছিল। দারুণ, তাই না?

তারপর? কফি শেষ? আরেক কাপ তাহলে আরেক দিন!