কনে-দেখা আঁধার

এই নিয়ে ৫ বার মেয়ে দেখা হলো। ফারুক চাকরি পাওয়ার আগে সবসময়ই ভাবতো, চাকরি পেলে বিয়ে করাটা সহজ। সে এখন বুঝেছে, বিয়ে করার জন্যে সবার আগে দরকার বিয়েটা যাকে করবে, তাকে। টাকাপয়সা না থাকলেও বিয়ে করা যায়, কিন্তু নিজের কিংবা অন্যের বিয়ে-করতে-রাজি প্রেমিকা না থাকলে বিয়ে করা যায় না। ফারুক বিয়ে নিয়ে মহাবিরক্ত। সে ঠিক করে রেখেছে, আজকে যে মেয়েটাকে দেখতে যাচ্ছে, মেয়ে পছন্দ হয়ে গেলে, মেয়ের বাবার পা জড়িয়ে ধরে বসে থাকবে। সাধারণত ও অনেক চেষ্টা করেও চোখে পানি আনতে পারে না। তবে আজকে যে করেই হোক, আনবে, আর বলবে, আঙ্কেল, এখন থেকে আপনি যা বলবেন, আমি তা-ই করবো। তবু, আমার পুত্র দায়গ্রস্ত পিতামাতাকে আপনি দয়া করে বাঁচান। এই পৃথিবীতে সবারই বিয়ে করার অধিকার থাকা উচিত। বউ ছাড়া জীবনের কী অর্থ?

ফারুক মেয়ে দেখতে গেলো। সে যার পা ধরে হৃদয়বিদারক ভঙ্গিতে কান্নাকাটি করার প্ল্যান করেছিল, উনি ওইসময়ে ছিলেন না, একটা জরুরি কাজে বাইরে গেছেন। শিগগিরই ফিরবেন। ফারুকের সাথে গেছে ওর ১ বন্ধু, ওর চাচা আর ওই চাচার ছেলে। মেয়েদের বসার ঘরটি গোছানো, পরিপাটি; দেখতে অনেকটা নাটকের বাসাগুলোর মতন। ফারুকের বড়ো আশা, আজকে এক রাজকন্যার সাথে তার দেখা হবে। ও শুনেছে, মেয়ের বাবা মেডিসিনের বিজনেস করেন। ভদ্রলোকের কতো টাকা, কে জানে? একমাত্র মেয়ে, ছেলেও নেই; সব তো জামাইকেই দেবে। ধানমন্ডিতে ঝকঝকে দোতলা ডুপ্লেক্স বাসা। ফারুকের চোখ চকচক করে নাচতে লাগলো।

সে নিজেও রাজপুত্র সেজে এসেছে। জিলেট ফিউশন রেজর দিয়ে দুইবার জেলশেভ করেছে; প্রথমবার সোজা টানে, দ্বিতীয়বার উল্টো টানে। জোরে ঘষেঘষে শেভ করার সময়ে গাল একটু কেটে পর্যন্ত গেছে! সেলুনে গিয়ে চুলের সাইডের বাড়তি অংশগুলো কাটিয়েছে। হারবাল ফেসিয়াল নিয়েছে। ম্যানিকিউর করিয়েছে। বাসায় ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দুইটা তাকানোর ভঙ্গি প্র্যাকটিস করেছে; জেন্টেল লুক আর কুল লুক; সেকেন্ডটা মেয়েটার জন্যে। নাকের যে লোমগুলো বেরিয়ে থাকে, সেগুলো; এমনকি, কোনও দরকার নাই, তবুও বাথরুমে গিয়ে, শুধু জন্মদিনের অরিজিনাল ড্রেস না পরলে কোনওভাবেই যায় না, এরকম চুলটুলও কেটে ফেলেছে। আজকে সে পুরোপুরি অবাঞ্ছিত চুলহীন এক সুপুরুষ। গোসল করার সময় তোয়ালে দিয়ে ঘষে-ঘষে গায়ের সব ময়লা তুলে ফেলেছে। ৩বার শ্যাম্পু করেছে, কন্ডিশনার দিয়ে চুল ধুয়েছে। এভারইয়ুথ স্ক্রাব আর ওলে ফেসওয়াশ দিয়ে দুইবার করে ঘষেডলে মুখ ধুয়েছে। দেখা যায় এমন জায়গাগুলো, গলা, ঘাড়, কান, শার্টের আস্তিনের কাফলিংয়ের নিচে যতোটুকু অংশ ঢাকা পড়ে না ততোটুকু সাবানমাখা তোয়ালে দিয়ে গায়ের সব শক্তি দিয়ে ঘষেছে। এই আশায়, যদি শ্যামলা থেকে একটু উজ্জ্বল শ্যামলা দেখায়। চুলে ভাল করে জেলটেল দিয়ে চুল বসিয়ে বামদিকে একপাশ থেকে সিঁথি করে চুল আঁচড়েছে; একবার না, কয়েকবার। মাথায় এমনিই চুল কম, চিরুনির অত্যাচারে আরও কিছু চুল উঠে থাকবে। মুখে ডলেডলে গার্নিয়ার লাইট ক্রিম মেখেছে। বডিস্প্রে, বডিলোশন কিছুই বাদ যায়নি। অফহোয়াইট ফর্মাল প্যান্টের সাথে পাথরের কাজকরা রুপোলী রঙের কাফলিংদেয়া ডার্ক ব্ল্যাক শার্ট পড়েছে। প্যান্টটা কিনেছে ক্যাটস আই থেকে; শার্টটা ওর সেকেন্ড গার্লফ্রেন্ড মেনজ ক্লাব থেকে কিনে দিয়েছিল। শার্টের ভেতরের গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার কিনেছে ওয়েসটেকস থেকে। জুতা কিনেছে গ্যালারি অ্যাপেক্স থেকে; মোজাও নতুন। আর্টিস্টি কালেকশন থেকে ১৮০০ টাকা দিয়ে ফর্মাল বেল্ট কিনেছে। হাতে রোমানসনের রিষ্টওয়াচ; ওর লাস্ট গার্লফ্রেন্ডের কিনে দেয়া। (ওর ফেসবুক স্ট্যাটাস ‘পাতব কাল, কনের জাল! ফিলিং কুউল!’ দেখে ওর লাস্ট গার্লফ্রেন্ড ইনবক্সে মেসেজ পাঠিয়েছে, কালকে তো আমার ঘড়িটাই পরে যাবে, না? লজ্জা করে না তোমার? বেহায়া বলদ কোথাকার!) তার ধারণা, তাকে আজকে অক্ষয় কুমারের মতো লাগছে। সে ঠিক করে রেখেছে, মেয়ের বাসায় যাওয়ার পর থেকে নিঃশ্বাস ভেতরের দিকে ধরে রেখে যতোটুকু সম্ভব ওর ভুঁড়িটা লুকিয়ে রাখবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব বুদ্ধি কাজের সময় মাথায় থাকে না। তখন নিজেকেই ধরে থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছা করে। গতবারের মেয়েটা রিফিউজ করার সময় বলেছিল, ছেলে যেমন লম্বা তেমন মোটা তেমন কালো। দেখলেই প্রেগন্যান্ট ঐরাবতের চেহারা চোখে ভাসে। মেয়েটার ট্রুথফুলনেসে ফারুক মুগ্ধ হতে পারেনি। আজকে আর এই ভুল হবে না। প্রয়োজনে দম বন্ধ করে মরে যাবে, তবুও দম ভেতরের দিকে চেপে রাখবে। ও রেন্ট-এ-কার থেকে কনে-দেখা উপলক্ষে একটা এসি কার ভাড়া নিয়েছে। লম্বা মাইনের চাকরি করার অনেক সুবিধা। স্যামসাংয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ওর মুখটা হাসিহাসি হয়ে উঠলো।

মেয়ের বাবা রাস্তায় জ্যামে আটকে গেছেন। কিছুক্ষণ সময় লাগবে। মেয়ের খালাতো ভাই এসে বললেন, খালুর আসতে একটু দেরি হবে। তানিয়াকে এখন নিয়ে আসবো? নাকি, আপনারা আরও কিছুক্ষণ বসবেন? ফারুকের চাচা বললেন, কোনও সমস্যা নাই। আপনারা ওকে নিয়ে আসুন। আমরা গল্প করতে থাকি। ভাইসাহেব এর মধ্যে নিশ্চয়ই চলে আসবেন। মেয়ের খালাতো ভাই জ্বি আচ্ছা, বলে ভেতরে চলে গেলেন।

ফারুক কিছু বলছে না। সে এখন ক্যান্ডিডেট। সোহেল বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছে, যাতে আগ বাড়িয়ে কিছু না বলে। সোহেল বিশিষ্ট কনে-দেখা বিশেষজ্ঞ। এই পর্যন্ত ১৮ টা মেয়ে দেখেছে; ওর আম্মার পেইন খেয়ে। বেশিরভাগ মেয়েই ওকে পছন্দ করেনি। এটা নিয়ে ওর কোনও দুঃখই নেই। ওর টার্গেট, বিয়েশাদি না করে যতোদিন থাকা যায়। ফারুক দাঁত-দেখা-যায়-না টাইপের হাসির লুক দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কাজ হচ্ছে না। এর মধ্যেই ওমর ২ বার বলেছে, দোস্তো, তোকে দেখতে শিম্পাঞ্জির মতো লাগতেসে। বি ইজি দোস্তো, বি ইজি। ফারুকের ছোটো বাথরুম পেয়েছে। সে বুঝতে পারছে না, মেয়ে দেখতে এসে বাথরুম পেয়েছে, এটা বলা যায় কি না। কিন্তু তার অবস্থা বেশি একটা ভাল না। মনে হচ্ছে, যেকোনও সময় প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে। প্যান্ট-ভিজিয়ে-ফেলা ছেলের সাথে এরা মেয়ে বিয়ে দিতে নাও চাইতে পারে। অনেকক্ষণ ধরে বিশেষ একটা জায়গায় চুলকাচ্ছে। অস্বস্তি লাগছে। বাসায় যেতে পারলে শান্তি লাগতো। বাসা দুনিয়ার সবচেয়ে শান্তির জায়গা, যেখানে খুশি সেখানে ইচ্ছামতো চুলকানো যায়। তার মনে হতে লাগলো, বিয়ের মারে বাপ! হঠাৎ খেয়াল করলো, হায় আল্লাহ্! বেল্টের উপর এটা কী! সর্বনাশ! দম বন্ধ করে রাখতে ভুলে গেছে। ভুঁড়ি শার্টের বোতাম ফেটে বের হয়ে যেতে চাচ্ছে! তাকে দেখাচ্ছে ২ বাচ্চার বাপের মতো। দুনিয়ায় যার কেউই নাই, তারও শালার একটা খানদানি ভুঁড়ি আছে! ফারুক ভেতরের দিকে দম বন্ধ করে রাখলো। ও ঠিক করলো, ও আর কোনওদিনই দম ছাড়বে না। প্রয়োজনে মরে যাবে, তবুও না। বিয়ে না করার চাইতে মরে যাওয়াও ভাল। এই শালাদের বাসায় এসি নাই? এসি চলছে। সবার জন্যে এসি কাজ করছে; ফারুক বাদে। ফারুক মনে-মনে একটা থিওরি আবিষ্কার করে ফেললো। গরমে ছোটো বাথরুমের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এরপর এটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। দেখলো, কথা পুরোপুরি সত্য। সে নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ! সে ঠিক করে ফেললো, এই মেয়ের সাথে বিয়ে হলে, আজকের সব ঘটনা ওকে মজা করে করে বলবে। তবে ওর জীবনের সবকিছু কখনওই ওকে বলবে না। ও ছোটো মানুষ, মাত্র থার্ড ইয়ারে পড়ে। ও এতোটা কিছুতেই নিতে পারবে না। আরও বড়ো-বড়ো মেয়েরাও এতোটা নিতে পারে না। ওর লাস্ট ব্রেকআপ হওয়ার পেছনে ওর অনেস্টি অনেকাংশে দায়ী। একবার ডেটিং-এর সময় ওর মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল, লাইফের বেস্ট লিপকিসটা…বাকিটা ইতিহাস। এইসময় ওমর ওর গালে জোরে একটা থাপ্পড় মারলো। … দোস্তো, এই দ্যাখ কত্তোবড়ো মশা! টিস্যু দিয়ে গাল মুছে ফ্যাল। হেহে… ফারুকের চরম মেজাজ খারাপ হলো। ইচ্ছে করলো, টেবিলের উপর রাখা বুর্জ আল আরব-এর কোণা অংশটা ওর পেটে ঢুকিয়ে দেয়। শালা, আমার সুখ সহ্য করতে পারছে না। বন্ধু নামের কলঙ্ক। আমার এতো সাধের ফেসিয়াল শেষ। টিস্যু নেবেনেবে করছে ঠিক এইসময় ওরা ভেতর থেকে তানিয়াকে নিয়ে এলো। ফারুক নিজেই সবার আগে দাঁড়িয়ে পড়লো। যে করেই হোক, বাথরুম আটকে রাখতে হবে। মন মানে, কিন্তু ব্লাডার তো মানে না। বড়োই যন্ত্রণা। এইসময় ওর বড় বাথরুমও পেলো। তার মনে হলো, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখের কাজ, বাথরুম করা। আমাদেরকে এই দুনিয়ায় পাঠানোই হয়েছে বাথরুম করার জন্য। বিয়েটিয়ে সব ভুয়া জিনিস। চারিদিক ভাসিয়ে দেয়ার তীব্র ইচ্ছা চেপে অসহায় ভঙ্গিতে মেয়েকে দেখতে লাগল।

যতোটুকু সম্ভব আঞ্চলিকতা পরিহার করে সে বলার চেষ্টা করলো, আসসালামু আলাইকুম। বলেই খেয়াল করলো, তার পেট আবার বেরিয়ে গেছে। শালার পেট! সোহেল বলে দিয়েছে, ওর এখন একমাত্র কাজ, মাথা নিচু করে, চুপচাপ বসে থাকা। এইসময় শুধু মুরুব্বিরা কথা বলবে। ওকে যা জিজ্ঞেস করবে, শুধু সেটারই উত্তর দিবে, আর কিছু না। ও এক ফাঁকে দেখে নিলো, প্যান্টের চেইন লাগানো আছে কিনা, শার্টের ইন কুঁচকে আছে কিনা। পেছনের কলারটা ঘাড় পেছনের দিকে দিয়ে একটু সরিয়ে মাথা একটু নামিয়ে পেছনের চুলগুলো কলারের ভেতর ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে কলারটা আবার নামিয়ে দিলো। ৩ নম্বর পাত্রী দেখতে গিয়ে নার্ভাসনেস থেকে ও পাত্রীর মায়ের সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে এক অভিজ্ঞতা! আজকে সে পেট ভেতরের দিকে ঢুকিয়ে সবাইকেই খুব ভদ্রভাবে স্লামালিকুম বলেছে। মেয়ের মা, কাজিন, মেয়ের মামা সবার মুখই হাসিখুশি। মেয়ে লাজুক ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে বসে আছে। ফারুক যখন তাকাচ্ছে না, তখন সে ফারুককে দেখে নিচ্ছে। ফারুকের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। শ্যামলা রঙের মিষ্টি চেহারার মেয়ে। হাল্কা সাজগোজ করেছে। ফারুকের হঠাৎ মনে হলো, সে নিজেই মেয়ের চাইতে বেশি সাজুগুজু করে এসেছে। সে তার ভুঁড়ি লুকানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। মাথা নিচু করে সে বেল্টের উপরে তাকালো। না, বুক থেকে শার্টের ভাঁজ পেটের দিকে উঁচু হয়ে ওঠেনি। শান্তি, শান্তি!

বাথরুমের বেগ বাড়ছে। বাড়ুক! এই মেয়ের জন্যে সারাজীবনও বাথরুম না করে থাকা যায়। কয়েক ঘণ্টা তো কোনও বিষয়ই না! সে হঠাৎ খেয়াল করলো, মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলো। সে ভাবতে লাগলো, প্রবলেম কী? প্যান্টের চেইন খুলে গেছে? গালে কি এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে? শালা ওমরের বাচ্চা! ও দরদর ঘামছে দেখে হাসলো না কি? ও কি বেশি কুঁজো হয়ে বসেছে? মেয়েটা কি তাহলে কোনওভাবে ওর ভুঁড়ি দেখে ফেলেছে? আল্লাহ্‌র কসম, আজকের পর থেকে সে দুপুরে শুধু শসা খাবে। নাকি, ও মনেমনে কী ভাবছে সেটা মেয়েটা কোনওভাবে বুঝে গেছে? তার আবার বাথরুমের বেগ বাড়ছে; এবার বড়টা। বাসা থেকে দুইবার বাথরুম করে এসেছে। এতো বাথরুম কোত্থেকে আসে আল্লাহ্ই জানেন! নিজেকে ডায়রিয়া রোগী মনে হচ্ছে। আজকে রোজা রাখা উচিত ছিল।

মুরুব্বিরা নানান কথা বলছেন। বাড়িঘর কোথায়, কার বাড়ির কোনদিকে যেতে হয়, বাসায় কে কে আছেন জাতীয় কথাবার্তা। তাকে দুএকটা প্রশ্ন করা হলো। বেশিরভাগই ইয়েস নো টাইপের কোয়েশ্চেন। জ্বি, জ্বি না বলে সারিয়ে দেয়া যায়। মেয়েকে ওর চাচা কিছু প্রশ্ন করলেন। বেশিরভাগই আজাইরা প্রশ্ন। কোথায় পড়ে? স্কুল কোথায়? কলেজ কোথায়? কত সালে ম্যাট্রিক? কত সালে ইন্টারমেডিয়েট? অথচ এগুলো সবই বায়োডাটায় লেখা আছে। চাচার একটা প্রশ্ন শুনে ফারুকের মেজাজ খারাপ হলো। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, মা, তুমি রবীন্দ্রসংগীত পারো? প্রশ্ন শুনে ফারুকের মনে হলো, চাচাকে ধাক্কা দিয়ে সোফা থেকে ফেলে দেয়। নর্থসাউথের মেয়ে রবীন্দ্রসংগীত পারবে কোন দুঃখে? ওর চাচার ধারণা, দুনিয়ার সব মেয়েই রবীন্দ্রসংগীত পারে। আরও একটা মেয়েকে উনি এই প্রশ্ন করেছিলেন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ফারুকের কাছে প্রমিজ করেছিলেন, আজকে এই প্রশ্নটা করবেন না। এখানে এসে ভুলে গেছেন। চাচার সমস্যাটা কী? বিয়ে করবে ফারুক। ওর সাথে ঘর করবে ফারুক। ও রবীন্দ্রসংগীত পারুক আর সাম্বা ড্যান্সই পারুক, চাচার কী দরকার! তানিয়া একটু লজ্জা পেয়ে বললো, না আঙ্কেল, আমি পারি না। ফারুক দ্রুত বলে উঠলো, রবীন্দ্রসংগীতটংগীত না পারাই ভাল। রবীন্দ্রসংগীত আমার একটুও ভাল লাগে না। এবার চাচার মনে পড়ে গেলো। চাচা মেয়েকে আর কোনও প্রশ্নই করলেন না। এর মধ্যে নাস্তা খাওয়া চলছিল। ফারুক আসার সময় ৮ কেজি মিষ্টি এনেছে। এরা ওর আনা কোনও মিষ্টিই ওদেরকে দেয়নি। ওদের কথা বলার ধরনে ব্যবহারে ফারুক বুঝলো, ওরা বেশ বনেদি। কিন্তু কথা হল, ওরা ওকে কোনও প্রশ্ন করছে না কেনো? কী ব্যাপার? ও তো অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। তবে কি…? মেয়ের বাবা একটু আগে ফোন দিয়েছেন। উনি কাছেই চলে এসেছেন। তাহলে কি মেয়ের বাবা-ই আজকের হেড এক্জামিনার? ফারুকের টেনশন শুরু হলো। এই মেয়েকে বিয়ে করতে না পারলে জীবন বৃথা!

হঠাৎ পাখির তীব্র শিস্‌। কলিংবেল। পা জড়িয়ে ধরার সময় হয়েছে নাকি? আহা! দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হচ্ছে। দরোজা খোলা হল। হ্যাঁ, মেয়ের বাবা-ই। উনি হাসিহাসি মুখে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। উনাকে দেখেই ফারুক স্প্রিংয়ের মতো তড়াক করে সোফা থেকে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ওর মনে হচ্ছিল, তক্ষুনি দৌড়ে পালায়। মনে-মনে প্রার্থনা করলো, হে ধরণী! দ্বিধা হও, আমি গাছে উঠি! ও দোয়াদরুদ যা যা জানতো, সবগুলো পড়তে শুরু করলো। মেয়ের বাবা কঠিন দৃষ্টিতে ফারুকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাসিহাসি মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। ফারুকের চাচা আসসালামুআলাইকুম ভাইসাহেব বলে মেয়ের বাবার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন। ফারুকের মাথা কাজ করছে না। পুরো শরীর ঝিমঝিম করছে। হাতপা অবশ হয়ে আসছে। মাথার ভেতরে বোঁবোঁ শব্দ হচ্ছে। দুই কান গরমে লাল হয়ে গেছে। চোখকান দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরুচ্ছে! মুখের সবকটা গ্রন্থি মিলে মুখটাকে বিকৃত করে দিচ্ছে যেন! মনে হচ্ছে, কে যেন ওর বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে! ওর বুক ব্যথা শুরু হলো। ভুঁড়ি স্বরূপে ফিরে এলো। ওর একবার মনে হলো, কান্নাকাটি শুরু করবে নাকি? সে হঠাৎ খেয়াল করলো, পরনের অফহোয়াইট প্যান্টটা ভেজাভেজা লাগছে, পেটে চরম মোচড় দিচ্ছে। তাহলে কি…

: ভাইসাহেব, বুঝলেন? আমার ভাতিজা। খুব ভাল ছেলে। ম্যাট্রিক ইন্টার দুইটাতেই স্ট্যান্ড। বুয়েটে ইলেকট্রিক্যালে পড়ার সময় ৩ বার বৃত্তি পেয়েছে। জিআরই দিচ্ছে। ইউএসএ চলে যাবে। ওখান থেকেই মাস্টার্স আর পিএইচডি করবে। বৌমাও সাথে যাবে। কোনও সমস্যা নাই। হেহে… বুঝলেন ভাইসাহেব, খুব ক্যালিবারওয়ালা ছেলে। আমাদের ফ্যামিলির অ্যাসেট। ভাইয়া রেলওয়েতে ছিলেন। ডিজি হিসেবে রিটায়ার করেছেন। খুব সৎ মানুষ। ভাবীও পরহেজগার মহিলা। আমার বড়ো ভাতিজির বিয়ে হয়ে গেছে। জামাই ডাক্তার। গত মাসে ওদের একটা ফুটফুটে ছেলে হল। ছোটো ভাতিজাটা ফারুকের ছোটো। ডিএমসি’তে পড়ে। ফ্যামিলিতে কোনও ঝামেলাই নাই। ও আমাদের হীরার টুকরা ছেলে। অতি উন্নত চরিত্রের; নিয়মিত নামাজকালাম পড়ে। মুরুব্বিদের সাথে চোখ নামিয়ে কথা বলে, মেয়েদের দিকে তাকায় না পর্যন্ত! আজকালকার যুগে এমন ছেলে আর হয় না। ও আমার দেখা সেরা ছেলে। আমাদের বৌমা খুব ভাল থাকবে। আমার আব্বা পীর ছিলেন। আমাদের হোল ফ্যামিলিকে দেখলে আপনার অনেক ভাল লাগবে। কিছু বলছেন না কেনো ভাইসাহেব? আপনি ফারুকের সাথে কথা বলতে পারেন। হেহে…

: আমি বুঝতে পেরেছি, আপনাদের ছেলে খুব ভাল চরিত্রবান ছেলে। আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আপনাদের সাথে পরে আবার কথা হবে। আপনারা এখন আসতে পারেন।

ফারুকের চাচা আরও কিছু কুশল বিনিময়ের পর ফারুকরা বেরিয়ে এলো। ফারুকের চাচা মহাখুশি। ফারুক, আমি ঠিক করে ফেলসি, এই মেয়েকেই তোর জন্যে আনবো। আজকেই তোর আব্বার সাথে কথা বলবো। তোর অমত নাই তো? ফারুক কিছুই বললো না। তার মাথা কাজ করছে না, কথা বলার শক্তি নাই। কোনও রকমে শুধু বললো, চাচা, আপনারা গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যান, আমি পরে আসবো। বলেই রাস্তার পাশের পাবলিক টয়লেটের দিকে দৌড় দিল।

ফারুক ঘণ্টা হিসাবে একটা রিকশা ভাড়া করলো। তার মনে হতে লাগলো, এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ। তার বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নাই। তানিয়ার বাবা একজন অত্যন্ত ভাল মানুষ, উনাকে পা ছুঁয়ে সালাম করা দরকার। উনার পা ছুঁতে পারলেও জীবন সার্থক। এতকিছুর পরও উনি রিঅ্যাক্ট করেননি। চাইলে আজকে উনি ফারুকের সুইসাইড করার সব পাকা বন্দোবস্ত করে দিতে পারতেন। কিন্তু, করেননি। ওই বাসা থেকে ভেজা প্যান্ট নিয়ে বের হয়ে আসা ছাড়া আর কোনও যোগ্যতাই ফারুকের নেই।

রিকশা চলছে শ্লথ গতিতে। সন্ধ্যার ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা হাওয়া। ফারুকের মধ্যে প্রচণ্ড অপরাধবোধ কাজ করছে। ইচ্ছে করছে, গলা ফাটিয়ে কান্না করে। কিন্তু সমস্যা হল, রাস্তাঘাটে গলা ফাটিয়ে কান্নাকাটি করার বয়স এটা না। সে ভাবছে, তার চাইতে বেশি অপরাধ পৃথিবীতে কেউ কোনওদিন করেনি, করবেও না। চারপাশটা দেখে তার মনে হতে লাগলো, এই পৃথিবীতে শুধুই ২ ধরনের মানুষ আছে। কেউ কনডম কিনে। কেউ কনডম বেচে। দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষের কারওর কারওর বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে। সে খেয়াল করলো, তার মাথায় শুধুই ঘুরপাক খাচ্ছে, বিশ্বস্ত দোকান বলে কিছু নেই। সবসময়ই এক দোকান থেকেই কনডম কেনাটা কখনওই ঠিক নয়, কখনওই ঠিক নয়।

ফুটনোট। আমরা ছোটোবেলায় অংক করার সময় লিখতাম না, মনে করি, পিতার বয়স x?

আসুন এখনও লিখি, মনে করি, এই গল্পটি কাল্পনিক।

Content Protection by DMCA.com