কথা

অভিশাপ থেকে মুক্তি নেই যার,
আপ্যায়ন থেকে মুক্তি নেই যার,
সে আসে যায়—
যেন এক আরোগ্যাতীত ক্ষতের ব্যথা…
তার নাম কথা।




একেক মুখে একেক রূপে
প্রেমের, আবার ঘৃণারও—
নিরাকৃতি, তবু অনুসৃত।




কথার আঘাত ঠিকানা দেয় ভুলিয়ে,
ঘুরি তখন অন্ধ জন্তুর মতো
ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে।




কামনার রঙে, প্রতারণার মুখোশে
কথাই এগিয়ে, মানুষ পিছিয়ে।




নরমাংস কথার দাস—পচে মাংস, কথা নয়।




পৃথিবী আঁধার ছেঁকে আনে অক্ষরের রং,
ম্লান হয় দিনের আলো কথার কালিতে।
কথার কি আর থাকে প্রেমের সময়?




গতির বুক ফুঁড়ে, খুঁজে পাবার চেষ্টার মধ্যে,
পাণ্ডুলিপি তৈরি হবার ল্যাবরেটরিতে,
পুরোনো ধূলির স্তূপে
উক্তির টাটকা আবেগ খুঁজো না।
কথার ঠোঁটে-ধরা মিথ্যে ভাগ্যলিপির খামটি ভুল করেও খুলো না।




তবু দেখবে,
প্রয়াস ও প্রকাশ, এই দুইয়ের দ্বৈতভয়ের ধারায়
ভেসে চলেছে পুরোনো নকশা আর নূতন বাসনা।
আরও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পোড়ো তখন।
শরীরের দুই দিকে ঝুলিয়ে দিয়ো দুই হাত
বাজারের শূন্য থলের বদলে,
থলের ছেঁড়া জায়গাগুলি আর সেলাই কোরো না যেন—থলেটাই ছিঁড়ে যাবে তাহলে।




নীরবতা শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা।
বক্তৃতায় ঢুকে পড়লে খেয়াল কোরো,
যা বলার থাকে, তা আসে না মুখে সময়মতো।
ভাবনার জটের মধ্যে কেবলই গিঁট পড়তে থাকে,
খোলসের বাইরে জমে খোলসের স্তূপ,
আর আকাশ ঘন করে বসে নৈঃশব্দ্যের দাগ।




নির্ভয়ে চলে কেউ কেউ—
কথার বাতি নিভে গেলেও ওরা কাতর হয় না,
ফুল ঝরে পড়তে দেখলেও ঠিক জানে,
সে-ফুল যায়নি হারিয়ে।




দিনের ধাঁধানো আলো ওদের চোখ নিতে পারে,
তাই কথার স্রোতে ওরা যায় না হারিয়ে।
ওদের চোখের পাতায় পাতায় কথা পড়ে, কথা সরে।




কাছে টানে লোকে কাকে?
কাকে দেয় আশ্রয় ও প্রশ্রয়?
আর তাড়িয়ে দেয় কাকে খুব করে বকে?
নালিশ করে না কখন মানুষ?
একা চলে কে?
আবার জন্মে না কে?




এসবের উত্তর কথার কাছে নেই।
উত্তর তাই জমাই থেকে যায়
অতীতের গুহায়; এমন মনের মধ্যে, যার কিনা চালচুলো কিছু নেই।
মন তখন অনুমান ছুড়ে ছুড়ে সত্যকে বিঁধতে চায়।




এক লাইন লিখতে গেলে দেখতে হয় বুঝি
অনেক শহর? অনেক জনপদ? অনেক মানুষ? অনেক অনেক কিছুই?
আমি তো বরং দেখি, একটি লাইনের জন্য
মরতে হয় অনেক বার,
জন্মাতে হয় অনেক জন্মে,
খুঁড়তে হয় অনেক নরক,
উঠতে হয় অনেক স্বর্গে।




বিন্দু থেকেই কথার জন্ম—যেখানে কোথাও শব্দ নেই।




আমরা করি না কেন যা-ই,
সবাই মূলত কথার চাষী, কুমোর, মিস্ত্রি, কারিগর—
কথা গেঁথে মালা গড়ি,
কথার সেচে ফসল ফলাই,
কথার নূপুর পরে নাচি,
কথার রঙে ছবি আঁকি,
কথার পট দেয়ালে টাঙাই,
চিন্তার ভার কথায় তাড়াই।




খুনি খুন করে নেয়
মানুষ যত, কথা ততোধিক।
তবু এখান-ওখান থেকে—
গলি থেকে, বাড়ি থেকে, বাজার থেকে,
শহর থেকে, গ্রাম থেকে, জঙ্গল থেকে
একে একে কথারা এসে ভিড় করে।




কথায় কথায় মিল হলে
জন্ম নেবে কবিতা,
নতুবা ঝুলবে নীরবতা
কবিতার শব হয়ে
সিলিং থেকে, জাতমৃত দেহে।




কবিতার শব, শিশুদের বা পূর্ণযৌবনার শব,
সব কিছু মাড়িয়ে, হাজার পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে
কথারা বাঁচে মরে।




যে-কথা ফেরারী, ভাবে সে…
সূর্যের মতো জ্যোতি কার?
কে নিরালোক নির্ঋতির চেয়েও?
জানে না যে, জানায় সে-ও 
ফাঁকা বুলির ধান ভেনে।




গভীরতম সমার্থ কি বিপরীতার্থ হয়ে যায় সমাহিত
চলে যখন শব্দ ও শব্দহীনতা সমান তালে।
চিন্তার ধার আজও ধারে বলো কে?
অসংগতির মাঝেই তবে কেন যত সংগতির খোঁজ মেলে?
নশ্বরের মাঝেই অনশ্বরের বীজ—
হয় রোপিত অমৃতকথার ভাঁজে।




কথা আসে
মাংস ফুঁড়ে, মাটি ফুঁড়ে;
দেহের খেতে বুনি বীজ,
মাটিকে কোপাই ইচ্ছেমতো,
ঢালি জল, মাখি কাদা,
গাঁথি রোদ্দুরে আর জড়ের চৈতন্যে;
একদিন মাটিও কথা বলে।




হাজার আঁটি ফসল কাটি,
কথার শিষেই মধু ঝরে,
গোলা ভরি কথার ভারে।




আদিতেও কি চিন্তা ছিল? কী তা তবে?
আকাশ বুঝি? সব কি তবে ওখান থেকেই?
কথার ধারা পড়ল ঝরে আকাশ থেকেই?
প্রজ্ঞা ছিল বন্দি কোথায়? দূরের গুহায়?
আমার মুখে, তোমার মুখে ছড়াল কবে?
স্বর্গ থেকে নামল মর্ত্যে কথারা যখন,
পাতালেও তার ঢুকল কিছু মাছের পেটে।




বিপরীতকেও মেনে নিতে জানে কথা,
মানুষ জানে না তা। দিনের চোখে
চোখের মণির গহন আঁধারে মেশে 
রাতের চোখে দিনের সহজ প্রতিমা।




চির অভিশপ্ত প্রার্থিত ঘৃণিত মূর্ত-অমূর্ত আপ্যায়িত
কথা…
সে এক ডানা-মেলা বৃহৎ পাখি,
ডানা ছড়িয়ে দু-দিকে
ভেসে যায়, গেয়ে যায়
মুখে মুখে, বুকে বুকে, চোখে চোখে।




মাটিতে, হাওয়ায়, জলে, মাংসে পাঠাই যখন কথার ডাক, মনে হয়, বলি,
কাছে এসো, গাছ হয়ে থাকো;
রেখো নিচে কথাহীনতার শেকড়,
উপরে থাকে যেন ধ্বনির ডালপালা,
দ্বৈতের দেহে ফোটাও অদ্বৈতের আলো।




কথা, আবার এসো—
দিব্যদেহে, দিব্যমনে।