এক। ফুলের বাগানে যাস কেন মিছে, তোর অন্তরেই ফুলবন! সে-বনে যা, আর সাজি ভরে নে, পাবি ঠিকই তাঁর দর্শন! দুই। প্রিয় কবি মহাশয়, মদ্যপানের কুফল যে কী, দু-চরণ লিখতেন যদি, সকলে তা মানত নিশ্চয়ই! প্রিয় প্রকাশক, এ আর এমন কী! বসুন, লিখছি এখুনিই; তার আগে গিলি দু-ঢোক! তিন। যুদ্ধ আর বিদ্রোহ মিলে মেরেছে অগণিত মানুষ; মানুষের হায় মানই আছে, নেই তার কোনো হুঁশ! মরেছে রোগে, মরেছে শোকে; দুর্ঘটনা কি দুর্ভাবনা—মেরেছে মানুষ তা-ও; কেউ মরে বয়স হলে, কেউবা মরে সময় হলে— জন্মের পরেই মরে শিশু, কখনো মরে মা-ও। তবু হায়, সবচেয়ে বেশি মেরেছে যে-জন— সে কেবলই কটাক্ষভরা রমণী-নয়ন! চার। উচ্চগ্রামে বাঁধো বীণা, আরও উঁচুতে ধরো তান; গাইবে যদি, পাগল হয়ে ধরো তোমার মনের গান। চাঁদের আলো, সাঁঝের বাতাস, সুনীল সাগর, মুক্ত আকাশ— এসব নিয়ে ধুলোর খেলা তোমার পুরোবে না আর আশ। হৃদয়বাণীর গভীর ধ্বনি উঠুক ছেড়ে এই পৃথিবী; বিশ্বপতির আসন টলুক, জাগুক তোমার আত্মাছবি। চড়িয়ে আরও তার ওপরে, তোলো বীণায় চৈতন্যবাণ; জগৎ তখন নীরব হবে, নেমে আসবেন ভগবান। পাঁচ। জীবন-আকাশে ঝড় দিলে যদি, তা নেভাতে দাও শক্তি; দুঃখের সাগরে টেনে নিলে যদি, তা পেরোতে দাও ভক্তি। নিলেই যদি বিপদের ঘরে, ভেঙে দাও সব ভয়; রিক্তই যদি করলে আমায়, কোরো না নিরাশ্রয়। দিলে যদি এ হৃদয়খানি— তোমারই যে অপার দান, মৃত্যু এলেও জীবন ঝরুক, যেন হয় না কখনও ম্লান। ছয়। আজ যে আমার মন মেতেছে দখিন হাওয়াতে; আধফোটা ওই কুসুমকলির ক্ষণিক চাওয়াতে! এ প্রাণ আমার চাইছে কী যে, বুঝি না তো আমিও নিজে! হৃদয়টা আজ হারিয়ে গেছে কী গান গাওয়াতে? কোন মধুসুর ডাক দিল আজ দখিন হাওয়াতে? সাত। ওগো প্রিয়, যাবে যদি, যাও চলে, দুঃখ নেই। তবু যাবার বেলায়, মিনতি এটুক রাখো--- যা দেখে কাছে নিলে, যা ভুলে ঠেলে দিলে... তার গান গাও এক বার! আট। লোহার শেকলে বাঁধা টিয়াকে দেখে, বিষাদে বলে ময়না সোনার খাঁচায় থেকে, "তোমাকে দেখলে, ভাই, মনে বড়ো দুঃখ পাই। ইচ্ছে করে, ফেলি ভেঙে নিগড় তোমার।" ময়নার কথা শুনে টিয়াটি হেসে, বলল তাকে ধীরে মৃদুসম্ভাষে, "তার আগে, যদি পারো আপন পিঞ্জর ছাড়ো। মুক্ত নিজে হয়ে খুলো নিগড় আমার।" নয়। তুমি ভাবো, জেতার জন্য কত-না ছলে আমায় ঠকাও! আমি জানি, জেতার জন্য কত-না ছলে তোমায় জেতাই! জেতো না তুমি, জিতি না আমিও...শুধু আমাদের মন জেতে। দশ। বলল সবুজ পাতা হয়ে গরবে বিভোর, ওরে ও নীরস কাণ্ড, কী-বা কাজ তোর? কাণ্ড বলে হেসে, তোর বাহাদুরি এখুনি ফুরোবে ওরে--- আমি যদি মরি। এগারো। শুধুই তার বিমোহন রূপ আমার চিন্তার কারণ নয়; তার চোখে অপদার্থ আমি--- এই চিন্তায় অশান্ত হৃদয়! বারো। গোলাপ হারাতেও পারে সৌরভ তার, কিরণক্ষয়ে কমতেও পারে চাঁদের গৌরব, প্রেমিক কখনো ভোলে প্রেম দুর্নিবার--- প্রেম যদি হয় সত্য, এ হওয়া চিরঅসম্ভব। তেরো। আড়ম্বরে করে পূজা, বৃথাই কাটালে জীবন, ক্ষণস্থায়ী বস্তুর ধ্যানে ছিল মগ্ন তোমার মন। বাহ্যিক অবয়ব যা, প্রতিমুহূর্তে হচ্ছে ক্ষয়, আবর্তিত যা-কিছু, দিনে দিনেই বদল হয়। এখানে-সেখানে ঘুরে কোথা পাবে নাকো আরাম, পৃথিবীর পুরোটা ঘুরলেও মিলে কি আর বিশ্রাম? জগতে রূপ আছে অগণিত, কিন্তু আত্মা এক, বাইরে যেটুক দেখি, জন্মে ওতে চেতনা হরেক। একে-ওকে পূজলে, দেখো, আছে অনর্থের ভয়, 'এক'-এর দুর্ভেদ্য দুর্গেই জ্ঞানীর চিরন্তন আশ্রয়। চৌদ্দ। যে হৃদয়ে নেই প্রেম-ব্যথা, সে হৃদয় হৃদয়ই তো নয়! প্রেমহীন মানুষের যে দেহ, কাদার পিণ্ডই কেবল হয়। প্রেমের বন্দি হও, যদি মুক্ত হতে চাও; প্রেমের সকল বোঝা বুক পেতে নাও। প্রেমের মদিরায় আবেগ আসুক প্রাণে, আর সবই স্বার্থদুষ্ট, অবসাদই আনে। প্রেম হতে ফিরিয়ো না সুন্দর মুখখান--- প্রেমই সত্য, পাবে প্রেমেই ঈশ্বরের সন্ধান। পনেরো। নদী ছিল যখন দূরে, নিজের মনে খেলত লাফাত, সে নিজের সীমায় ঘুরে। মাথায় আসেনি কোনোদিন, মিলবে এসে বিশালের বুকে, সাগরে সে হবে লীন। দিনটি সত্যি এল যখন, ঘুচে গেল তার সব দম্ভ পেয়ে বিশালের দর্শন। ষোলো। আমার মন যে আমায় মানে না। আমার প্রাণের মনের এই দ্বন্দ্ব, কেউ তো এটা জানে না। আমার মনের সাথে যখন আমি খেলি, বিচার করে যখন পথ চলি, প্রাণের দাবি যায় সে কেবল দলি; প্রাণের খবর মন তো আমার রাখে না। প্রাণ বলে, তোমায় ভালোবাসি, তবু তোমার মালা হলো বাসি, মন বলে, সে যে গলার ফাঁসি; প্রেমের পরশ তাই তো তুমি পেলে না। আমি জানি, তুমি চেনো আমায়, সেই চেনা রাখবে আমায় সুধায়, তোমার পাশে তোমার প্রেমের গাথায়; আমার প্রাণের কথা থাক না অজানা। সতেরো। লোভ বলে, "ক্রোধ, তুমি নও মোটে ভালো, হিংসার আগুন কেমন সারাবিশ্বে জ্বালো!" "তুমিও যে সেই দোষে দোষী সমতুল," হেসে বলে ক্রোধ, "নেই তাতে ভুল।" আঠারো। তাকিয়ে যারা যায় দূরের পানে, তাদের দেবো কীসের অজুহাত,— সাঁঝের পাখি বলবে যখন গানে কাজ সেরে নে, ওই যে এল রাত? উনিশ। এ জগতে থেকে কীই-বা হবে হায়, এ জীবনে যদি তোমাকেই না পাই? বেঁচে আছি তোমায় পাবার আশায়, এ জগত ছেড়ে তবে কী করে যাই?