জীবনযাপন করতে গিয়ে মানুষ প্রায়শই দুটি ভিন্ন ধরনের পথ বেছে নেয়। একদিকে আছে অটল পরিশ্রমের নীতি, অন্যদিকে আছে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত জীবনপ্রবাহ।
সমাজ শেখায়—“কঠোর পরিশ্রমের মতো মহৎ কিছু নেই।” এর ফলস্বরূপ, মানুষ ব্যস্ত মৌমাছির মতো প্রতিদিন সকালে একসাথে কর্মস্থলে ছুটে যায়, আবার সন্ধ্যায় ফিরে আসে। এ যেন এক অবিরাম র্যাটরেইস। কেউ সাধারণ ইঁদুর, কেউ নেতা ইঁদুর—কেউ গাড়িতে, কেউ বাসে, কেউবা হেঁটে-দৌড়ে।
যারা এই প্রতিযোগিতায় শীর্ষে ওঠে, তারা সহজতর সুবিধা পায় ঠিকই, কিন্তু সাথে করে বয়ে নিয়ে চলে ভয়, ঘৃণা আর অসীম উদ্বেগ। তাদের প্রতিদিনের শান্তি স্থায়ী হয় মাত্র একমুহূর্ত—উচ্চভিলাষ পূর্ণ হলো, বিভিন্ন জায়গার খরচ মিটল, কারও চাকরি গেল—এরপরই শুরু হয় নতুন উৎকণ্ঠা। নিজেদের সম্পত্তির অনুপাতে তারা নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ ভাবে। আর তাদের শান্ত করতে গেলে অপমানই জোটে। এই পথের ফলাফল—টেনশন, হৃদ্রোগ, অকালমৃত্যু, আর ওষুধ কোম্পানির প্রমোশন।
অন্যদিকে আছে “mellow yellow fellows”—যারা জীবনের সাথে লড়াই করে না, বরং প্রবাহের সাথে চলে। এদের ধারা সাধারণত অবজ্ঞার চোখে দেখে কঠোর পরিশ্রমীরা। অবশ্য, সত্যিটা হলো—যেমন কিছু মানুষ ভান করে অলস থেকে যায়, তেমনি কঠোর পরিশ্রমীদের মধ্যেও পাওয়া যায় দারুণ উদার ও আন্তরিক মানুষ।
তবে ধ্যানমগ্ন শান্তপ্রকৃতির মানুষেরা বিশ্বাস করে—যদি মন প্রশান্ত হয়, যদি পৃথিবীকে সম্ভাবনাময় আর সহায়ক জায়গা হিসেবে দেখা যায়, তবে এক অদৃশ্য করুণাময় শক্তি বা স্নেহশীলা প্রকৃতি সঠিক সময়ে সহায় হয়ে দাঁড়ায়। তাদের সচেতনতার ডিফল্ট স্তর হলো—এই মুহূর্তে থাকা বা বাঁচা। তারা সেই সাধারণ মানবিক অসন্তোষ থেকে মুক্তি পেয়েছে, যাকে বুদ্ধ বলেছিলেন: দুঃখ। এখানেই বেঁচে থাকার আসল জাদু।
তারা যা-ই করে, তাতে আনন্দ পায়। সেই আনন্দই কাজকে সহজ ও নিরবচ্ছিন্ন করে। তারা তাড়াহুড়ো করে না, দ্রুত শেষ করার জন্য ব্যস্ত হয় না—কারণ তাদের কাছে প্রতিটি মুহূর্তই আনন্দদায়ক। এই ভেতরের শান্তি তাদেরকে আরও সৃজনশীল, উৎপাদনশীল ও সুস্থ করে তোলে—কখনো কখনো এই শান্ত, স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহে চলা মানুষেরাও শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তগ্রহণের জায়গায় পৌঁছে যায়, এমনকি সর্বোচ্চ চেয়ার বা পদও দখল করে।
বাস্তবে এ দুই ধরনের মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া বা বন্ধুত্ব খুব কমই হয়। সচরাচর কেবল হতাশা আর অবসাদের চাপেই কেউ এক দিক থেকে অন্য দিকে সরে যায়। শেষপর্যন্ত, ব্যাপারটা মানুষের পছন্দের ওপর নির্ভর করে, যদিও এই পছন্দও অনেকখানি গড়ে ওঠে সমাজের চাপ আর অভ্যাসের প্রভাবে।