সুপ্রাচীন কলরেকর্ড থেকে, আমি মৃত্যু বলছি… পড়ছি বিগত হাওয়ার জন্মদানে প্রাপ্ত লিপি থেকে, পুড়ে-যাওয়া মেঘের দ্বিতীয় খণ্ড… তারপর সূর্যের অঘোষিত ধ্বংসনামা। আজ বেঁচে থাকবে কেবলই আস্থার পললভূমি! আমি মৃত্যু, আমি ঘুমিয়ে আছি জন্মের পর থেকে, আত্মার উষ্ণ শয্যা আজও ছাড়িনি… উঁহু, থুতু দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাসার কোনও অবকাশ নেই, আমি পঙ্গু নই! দু-পায়ে ভর দিয়ে ভিত্তিহীন চলা…এ নীতি কেবলই যাযাবর রাতের, মাঠের পর মাঠ বাতাসের বেগে ছুটতে চাওয়া স্থূল কুয়াশার...কেননা সে জানে, তার পা ভারী হয়ে আছে কীসব ভৌতিক লালসায়! আমি দেবোপম, যে ঘুমিয়েছে প্রত্যেকটা জীবনের সবকটা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জুড়ে! আমি সে-ই, বেদনার্ত প্রসবে যে রূপান্তরিত হয়েছে ধুতুরা ফুলের বিষ-মাখানো স্বাদে! যে এখনও রয়েছে গোপন সব পাখির কাছে, সুগন্ধি ঘাস আর রাষ্ট্রদ্রোহী দেশপ্রেমিকের ভজনে, যে পথ চলে জোনাকিদের আলো সেচে সেচে। অতঃপর, আমি চোখ বুজেও ছিলাম জেগে, জলের গভীরে থাকা মাছেদের মতো, হঠাৎ শিকারে যদি মন লাগে! আকাশ ফুঁড়ে বজ্রের ন্যায় ক্রমাগত তাণ্ডবনাচন নেচেছি পৃথিবীর যাবতীয় অভিশাপের ঘাড়ে… আহা, সে কী স্বপ্ন ছিল ইন্দ্রজিতের! আমি চিরসত্য মাটির কাছে, পুণ্যে-শিষ্ট কিংবা পাপে-ক্লিষ্ট আত্মার কাছে, মগজ এবং মননের কাছে। আমি অমার্জনীয় পাপ পাঠ্যবইয়ের সূচিপত্রে, গণিতের প্রতিটি সূত্রে কিংবা মানুষের অভিধানে। অতঃপর চামড়ায় সেলানো জামা গায়ে সুতো হয়ে জন্ম নিয়েছি উপসংহারে; হাহাকার করা সবুজের অধিপতি হতে, নখের ভেতর রক্তের উষ্ণতা নিয়ে আমি বেরিয়েছি স্বজাতির পিঠের সন্ধানে… রক্তভেজা তেলতেলে নগ্ন পিঠই চাই আমার, বুঝলে!? একপাত্র জল দাও আমায়, বিনিময়ে এনে দেবো সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঝুলে-পড়া একতাল মাংস! ধর্মের আভরণে অধর্মের চামড়া ওঠা শরীর আমি দেখিয়ে দেবো যদি দিতে পারো একমুঠো সরষে বীজ! ছুঁয়ে দেখো আমার জমিনের মাটি; দেখবে, মাংসের দীনতায় ফুসফুস গিয়ে ঠেকেছে একেবারে শিরদাঁড়ায়। আরে আমার ধূম্রখোর বাবুসাব, এত ভয় পাচ্ছ কেন? ফুসফুস বের হওয়া অমন হাড়গিলে বেঢপ শরীর দেখে!? দ্যাখো, আমার নাকে রক্তের গন্ধ নেই গো! চোখের জল চেখে দ্যাখো; দেখবে, কেমন নিরুত্তাপ বইছে সেই জলের ধারা। শিরাবিহীন নখে পাবে না নষ্ট মাংসের এতটুকুও চিহ্ন! চাষাভুষারা যে আজন্ম শাকাহারি গো…অথচ কথা ছিল, একদিন যৌথ খামারি হব! আর বৃক্ষরা কাঁদছে বিষণ্ন সুন্দর চোখে, সমুদ্র মরে গেছে অপ্রেমের বৈধতা মানতে পারেনি বলে! ওদিকে জারজ সুখে বৈধ শিশুর আগমনে পালিয়ে বেড়াচ্ছে লেবুস্য দানাবর শৌর্যবান পুরুষ! উচ্ছ্বল গাঙের নিঃশ্বাসে আজ বুড়িয়ে যাবার গন্ধ পাওয়া যায়, ভীষণ টকে গেছে গো! শোন হে নবাগত কিশলয়, সেসব শোকার্ত নিঃশ্বাস বন্ধক রেখে আমি মৃত্যু বলছি… আজ থেকে পানশালায় যাবে না আর কেউ, সুরার রঙে ভেজা ঠোঁটে তৃষ্ণা মেটাবে না শরীরজয়ী অপ্রেমিক! রমণীয় জোছনায় দাঁত বসিয়ে, চায়ের আড্ডায় যুক্তি কপচাবে না কোনও সমাজপতি! জুতোর তলায় কাঁচা স্বপ্নগুলো পিষ্ট হবে না আর, শত বিক্ষিপ্ত স্পর্শেও নড়বে না ফুলবিক্রেতা কুমারী মেয়েটির স্থির দৃষ্টি। ফুলেরা ভুলে যাবে প্রজাপতি, কেননা সে বহুগামী! শুদ্ধ হতে বাষ্পে স্নান করবে না সে কিংবা কোকিল কেউই! পলাতক শৌর্য নিয়ে পুরুষ হাঁটবে না আর কোনও পূর্ণ চাঁদে; হাঁটে যদি, তবে নির্বিষ করো তাকে। বংশজ জারজ সুখ আজ থেকে মিছিলে নামবে প্রত্যেকটা উন্মাদ রাতের বিরুদ্ধে… বাধ সাধবে কে? তুমি…তুমি? না কি তুমিই?! অতঃপর সবুজের সঙ্গে সংসার পাতবে এঁটো খাওয়া কাকের দল, প্রেমের কটিদেশে তবেই জন্ম নেবে মরে-যাওয়া সমুদ্র! তা-ই দেখে কয়লা হবার পূর্বশর্তে বৃক্ষরা আরও একবার হাসবে। ঠোঁটের কার্নিশে ঝুলতে থাকা চুমু হেঁটে যাবে দণ্ডিত কবির বাড়ি এবং একের পর এক অঙ্কুরোদ্গম হবে কবিতার, এই অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপে সোনালু ফুলের আগুনে পুড়বে বাবলা কাঁটায় গাঁথা বিহঙ্গ যুবক! অপ্রেমের ক্ষমতাই যেন ভুল সংলাপ… আমি দিব্য বলছি, যে রক্তের সাথে কয়লা মিশিয়ে বানাবে ধ্রুব কালি, লিখে যাবে, নিভৃতচারী মানুষগুলো শব্দের আকালে কতটা বিচূর্ণ, সে কাহিনি! কীভাবে প্রিয়তমার অদৃষ্টে সংগোপনে চিঠি গুজে দিয়ে ফিরে যায় অপ্রেম, রেখে যায় ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে লাবণ্যময়ী নারী এবং অগ্নিকন্যাদের…! কবি তাঁর স্পর্শে নিভিয়ে দেয় আগুন, লোনাজলে পড়ে থাকে বৈরাগী ঢেউ এবং শঙ্খ, ঝিনুক ভুলে যায়, মুক্তির জন্য বিসর্জন দিতে হয় সম্ভ্রম, সে-কথাটুকও! অথবা, মানুষ ভুলে যায় বালুচরে নদীটির অপমৃত্যুর মুখরোচক শোকপালা এবং অভুক্ত শিশুর হাড় মাড়িয়ে খালি পায়ে প্রভুর স্তুতিগান! কুমারী বোঝে না, সন্ন্যাসী বাউল কতটা বিশুদ্ধ; ধ্যানের ঘোরে সুখের দহনে সংসারী হয়ে ওঠে তাঁর আঙুল, টান পড়ে একতারায় এবং করুণ আবেদনে কীভাবে নেচে ওঠে রক্ত… এর কিছুই খোঁজে না হায় বসন্তবালিকা! এর দায় সন্ন্যাসী বাউলের নয়, নয় একতারার কিংবা কুমারী মেয়েটির, এ-দায় নেবে কেবলই আঙুলের বিবর্ণ শরীর…আহ্ মাথার উপর উড়ছে ভীষণ বির্বণ শরীর! মৃত্যু ভয় পায় না বিবর্ণতা, সময় কিংবা লাবণ্য সেখানে অসুন্দর, কুমারী জোছনায় জোড়া চাঁদ এবং পূর্ণ অমাবস্যায় কালো ভ্রমর…ওরাও; তাই বলছি, ফিরে যাও নিজ বৃত্তে, আমার চেতনায় করাঘাত কোরো না! ঘুমোতে দাও আমায়, বাঁচতে দাও বিপন্ন বৃক্ষদের, বিধবা ছায়া এবং দণ্ডিত কবিকে!