প্রত্যাশাহীন সম্পর্ক

একটা সত্যি কথা কী, জানেন? পৃথিবীতে এক্সপেকটেশন ছাড়া কোনও সম্পর্কই হয় না। যার প্রতি ভালোবাসা, অধিকার, টান থাকবে, তার প্রতি প্রত্যাশা থাকবেই। ফিরতি ভালোবাসা, ফিরতি সম্মান, ফিরতি স্নেহ-সহ সব ধরনের এক্সপেকটেশন আপনাআপনি চলেই আসে। এর বাইরে মানুষ খুব একটা যেতে পারে না।

রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানদার আপনার কেউ হয় না বলেই তার প্রতি আপনার কোনও এক্সপেকটেশন থাকে না। আপনার বউ বা প্রেমিকা আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ বলেই তার কাছ থেকে প্রত্যাশাটা স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকবে। আপনাকে সে বুঝুক, ভালোবাসুক, স্নেহ করুক, শান্তি-স্বস্তি দিক, সংসারটা গুছিয়ে রাখুক, সে আপনার একজন ভরসা হোক... এ সবই তার কাছ থেকে আপনি চান, সে-ও অমন চায়।

আমরা কেবল তাদের কাছ থেকেই কখনও কিছু চাই না, প্রত্যাশাও করি না, যারা আমাদের কেউই হয় না। দিনশেষে, 'নিঃস্বার্থ সম্পর্ক' বলে দুনিয়ায় কিছু থাকে না, যেখানে সম্পর্ককে নিঃস্বার্থ বলা হয়, সেখানেও ন্যূনতম স্বার্থ থেকেই যায়। স্বার্থ থাকে না কেবল দুই জায়গায়। এক, ভিক্ষুক-দাতা সম্পর্কে; দুই, কলগার্ল-ক্লায়েন্টের মাঝে। এই দুই সম্পর্কে কোনও এক্সপেকটেশন থাকে না কোনও পক্ষেরই। কাজ শেষ, খোদা হাফেজ।

আমি কখনোই আপনার ক্ষেত্রে নিঃস্বার্থ নই, আপনিও নন। আমিও চাই, আপনি আমাকে ভালোবাসুন, অসংখ্য পরিচিতজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী, ঘরভর্তি মানুষ কিংবা সবচে' কাছের মানুষগুলোর ভেতরে বসেও আপনি মাঝেমধ্যে হুট করেই আমাকে মিস করুন, দুনিয়ার সবার জন্য জায়গা ছেড়ে দেবার পরও ছোট্ট একটা জায়গা আমার জন্যও থাকুক, যেখানটায় কেউ কখনও পা-টুকু পর্যন্ত দিতে পারে না, যে জায়গাটা এক আমি বাদে আর কারুরই নয়, এমন একটা শক্ত জায়গা আমার জন্যও থাকুক। আমি এসব চাই। আমি কোনও প্রত্যাশাশূন্য মানুষ ন‌ই।

আপনিও চান, আপনাকে নিয়ে যেন ভাবি, আপনাকে যেন বুঝি, আপনাকে নিয়েই যেন গল্প-কবিতা লিখি, সেইসব লেখার শব্দগুলোতে আপনি ছাড়া অন্যকেউ না থাকুক। এই চাওয়াগুলো কীরকমভাবে যেন চলে আসে... আমরা না চাইলেও। যেটাকে আপনি এক্সপেকটেশন বলেন, সেটা কখন‌ও কখনও অধিকারও বটে।
যেখানে সম্পর্ক থাকে না, সেখানে কোনও এক্সপেকটেশনও থাকে না। প্রত্যাশাশূন্যতা কি স্বেচ্ছাচারিতার লাইসেন্স দিয়ে দেয় না?!

আমার পাশের রুমমেটটার কাছে আপনার কোনও চাওয়া নেই, কারণ সে আপনার কেউ হয় না। কিন্তু আপনাকে নিয়ে আমার কিংবা আমাকে নিয়ে আপনার প্রত্যাশা বরাবর ছিলই, কারণ আপনি আমার কিংবা আমি আপনার অনেককিছুই হই, যা অন্যদের বেলায় নয়। আমরা না চাইলেও এসবের সাথেই আমাদের বাঁচতে হয়।
ঠিক একই অধিকারবোধ থেকে ভুলে ভেবে ফেলেছিলাম, আপনার ঘরটা আমার একার ঘর, আমার একার সংসার। যার ঘরটা আমার একার নয়, তার সাথেও কি থেকে যাওয়া যায় শেষ পর্যন্ত? আমি না পেলাম ঘর, না পেলাম নিজের মানুষ... তবে আদৌ কি কিছু পেলাম আমি?!

পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জায়গায় ঘর তুলেছেন যেখানটায়, স্বস্তি আর আশ্রয়ের প্রত্যাশায় তো আপনি সেখানেই ফেরেন দিনশেষে। কারণ সেই ঘর, ঘরের দেয়াল, দরজা, জানালা, এমনকী মাটিটাও তো আপনার। প্রতিবেশীর ঘরে গিয়ে তো আর ওঠেন না, তাই না? যাদের উঠতে হয় ওরকম, ওদের মনে যে কত কষ্ট... ভেবে দেখেছেন কখনও?

মানুষ যখন বুঝে যায়, যে ঘরকে সে ঘর ভাবে, সেটা আদতে তার ঘর নয়, ঠিক তখনই মানুষ পর হয়ে যায়। ঠিক তখনই সে দূরে সরতে সরতে ধীরে মিলিয়ে যায়... যেমনটা করে বহু বহু আগে আপনি আমাকে আর আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি 'নো এক্সপেকটেশন'-এর সমীকরণের চাপে পড়ে।

যাদের সাথে কখনোই পরিচিত‌ও হবে না ভাবত একসময়, সময়ের আবর্তনে তাদের সাথেই বাঁচতে হয় মানুষকে। এখানে সত্যিই কি কোনও প্রত্যাশা নেই? একদমই প্রত্যাশা না রেখে কাউকে রাখতে পারে মানুষ? রাখেও যদি, সে নিজে একটুও কি থাকে মানুষটার কাছে?